অবশেষে আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের দিকে নজর রেখেই মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটালেন মুখ্যমন্ত্রী। গ্রাম বাংলার পিছিয়ে পড়া মানুষের মুখ দেখা যাচ্ছে শেষ প্রযন্ত। মতুয়া মন্জুল কৃষ্ণ ঠাকুর এ যাবত মন্ত্রী হওয়ার পর তফসিলীদের জন্য অথবা হদ্বাস্তুদের জন্য কি কি করেছেন আমরা কেউ জানিনা।অথচ তিনি এখন পূর্ণ মন্ত্রী।অভিনন্দন। প্রসন্গতঃ উল্লেখ্য,মতুয়া ধর্মো মুলতঃ আদর্শ গার্হস্থ্ ধর্মো । এটি ৩টি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত । যথা-জীবেদয়া, নামে রুচি, মানুষেতে নিষ্ঠা । এটাই মতুয়া মতবাদ । মতুয়া-মতবাদের প্রধানদিক হলো-হাতে কাম,মুখে নাম,মূলমন্ত্র হরিনাম । হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তিত মতুয়া-মতবাদপূর্নাঙ্গ জীবন-ব্যাবস্থা গ্রহনে মানুষকে সহায়তা করে। কিন্তু ঠাকুর হরিচাঁদ জন্মগ্রহনকরেছিলেন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে, এক অবহেলিত-উপেক্ষিতসাধারন মানুষের ঘরে । ফলে বিদগ্ধ পন্ডিতমন্ডলীর কাছে তিনি অজ্ঞাত। যথাযথ প্রচারেরঅভাবে জনগনের নিকট অপরিচিত রয়ে গেছেন । তাছাড়া এদেশের সমাজ-ব্যাবস্থায়জন্মগত জাতভাগের কারনে অবতার হয়েও পন্ডিতমন্ডলীর নজরে পড়েননি । মন্জুল কৃষ্ণ পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে সেই ধারা অনুযায়ী কাজ করবেন কি, আজ অবধি তেমন প্রত্যাশার কারণ দেখি না।
বিধানসভা নির্বাচনের পুর্বে কলকাতায যে মতুয়া সমাবেশের আয়োজন হয়েছিল, তফসিলিদের পালাবদলে তার গুরুত্ব অপরিসীম।ঐ সমাবেশে বামপন্থীরাও হাজির ছিলেন উদ্বাস্তু এবং মতুয়া নেতাদের সন্গে।উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব সংকট সেদিন মুখ্য আলোচ্য ছিল। নিখিল ভারত বাউলি উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির ডাকে ২৮ ডিসেম্বর কলকাতার ধর্মতলায় এক সুবিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের মূল চালিকা শক্তি হিসাবে মতুয়া ধর্মীয় সংগঠন ছিল। সভায় যোগদানের জন্য পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলা সহ ভারতবর্ষের অন্যান্য রাজ্য থেকেও মানুষজন আসে। ধর্মীয় উন্মাদনা ও বেঁচে থাকার লড়াইয়ের এক যৌথ মিশেল দেখা যায়। মূল দাবি ছিল ২০০৩ সালের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন পেশ ও পাশ হওয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ভারত সরকার এই আইনের দ্বারা উদ্বাস্তু ও তাদের উত্তরপুরুষদের বেআইনি নাগরিকে পরিণত করেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রধান রাজনৈতিক দলের কোনটিই এই আইনের প্রতিবাদ করেনি, এখনও করছে না, যদিও তাদের নেতা নেত্রীরা ভোটের জন্য উদ্বাস্তুদের সংগঠনগুলির কাছে বারবার তাদের ঘনিষ্ঠতা দেখানোর চেষ্টা করছেন। এই সভাতেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। ২০০৩ সালে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনের সময় বিলটির ভূমিকায় বলা হয়েছিল যে, কমনওয়েলথভুক্ত কিছু দেশে যেখানে ভারতীয় বংশোদ্ভুতরা বসবাস করে, অর্থাৎ স্বেচ্ছায় ভারত ছেড়ে যে সব মানুষ বিভিন্ন দেশে চলে গেছে এবং সে দেশের নাগরিক হয়ে গেছে, তারা চাইলে তাদের ভারতীয় নাগরিকত্বও দেওয়া হবে। আর দ্বিতীয় উদ্দেশ্য হল চাইলে কাউকে ভারতীয় নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করা বা নাগরিকত্ব কেড়ে নেবার উদ্দেশ্যে এই আইন সংশোধন। দ্বিতীয় উদ্দেশ্য সাধিত হচ্ছে কমবেশি দু'কোটি পূর্ববাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তু বাঙালি মানুষকে নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করে দেশহীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করার মধ্য দিয়ে। ওই সব উদ্বাস্তুর অধিকাংশ নিম্নবর্ণের হিন্দু। এই সমাবেশ থেকে দাবি ওঠে উদ্বাস্তু সমাজ, দলিত সমাজ ও অন্যান্য সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষের যৌথ প্রচেষ্টায় ২০০৩ সালে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের আরও একটি সংশোধনে সরকারকে বাধ্য করা, যাতে যে উদ্বাস্তু পরিবার পূর্বপাকিস্তান ও বাংলাদেশ থেকে ভিটেমাটি পরিত্যাগ করে পাকাপাকি ভাবে ভারতে চলে এসেছে ও বাস করছে তারা যেন ভারতীয় নাগরিকত্ব পেতে পারে। এই দাবি আদায়ের জন্য প্রয়োজনে তারা পার্লামেন্ট ঘেরাও করবে। মা মাটি মানুষের সরকারে মল্জুল ঠাকুর ছাড়া উপেন বিশ্বাসও উদ্বাস্তু সমস্যা ও মরিছঝাপি নিয়ে বিশেষ সরব ছিলেন। সেই গণহত্যা কিন্তু তফসিলী ভোটব্যান্ক দখলে বড় কাজে এসেছিল। নানা কমিশন নিয়ে মাতামাতি হলেও মরিচঝাপি গণহত্যার কথা আজ কেঊ মনে রাখেনি। ঠাকূরনগরে হরিচান্দ গুরুচান্দের মহাত্ব স্থাপনে আলাদা আয়োজনের প্রয়োজন কতটা, এ প্রসংগ না হয় থাক, কিন্তু মনরুল ঠাকুরকে বাংলায় অন্যত্র তফসিলিদের মধ্যে দেখা যাযনি।দেখা যায় নি ঊপেন বিশ্বাস, ঊজ্জ্বল বিশ্বাস ও অন্যান্য সংরক্ষিত নেতাদের।আবার তারা নূতন মুখের মিছিলে সামনের সারিতে।পঞ্চায়েত ভোটের পর এরা কি করবেন, এটাই বরং দেখতব্য। এই দৃশ্য কি মনে পড়ে,উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রদানে গড়িমসি সমস্যা জিইয়ে রেখেছে, জটিল করেছে। আসলে নাগরিকত্ব আইনে অস্পষ্টতা এবং পরবর্তী কালে ১৯৮৬ সালে ও বিশেষত ২০০৩ সালে অবিবেচনাপ্রসূত সংশোধনী উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব অর্জনের রাস্তা বন্ধ করে এ দেশে বসবাসকারী প্রায় দু'কোটি মানুষকে রাষ্ট্রবিহীন বিপন্ন জনগোষ্ঠীতে পরিণত করেছে। এই উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করলেও এখন তা হুমকির মুখে। ভারত সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের ফলে আজ তাদের হারাতে হচ্ছে নাগরিকত্বের অধিকার। যা কেবল অসাংবিধানিক আর চরম অমানবিকই নয়, আন্তর্জাতিক মানবিক অধিকার সনদেরও নির্মম লঙ্ঘন। পাকিস্তান সমকালে যে কোনো হিন্দু ভারতে এলেই নাগিরকত্ব পেত।
২০১২ সালে বিশ্বে সাত লক্ষ উদ্বাস্তু বেশী হয়েছে. এঁরা সেই সব মানুষ, যাঁরা অন্যদেশের এলাকায় পালিয়ে এসেছেন প্রাণের দায়ে. এই প্রসঙ্গে দেশের ভেতরেই সশস্ত্র যুদ্ধের কারণে ঘর বাড়ী ছেড়ে চলে যেতে হয়েছে এখনই চার কোটি ২০ লক্ষ মানুষকে. বিশ্বে আরও বেশী করেই মানুষ বাধ্য হচ্ছেন নিজেদের দেশ ছেড়ে নিরাপত্তার অভাবের জন্য চলে যেতে. গত বছরে একবিংশ শতকের রেকর্ড ভেঙে গিয়েছে – ১২ মাসের মধ্যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের কর্মীরা নথিবদ্ধ করতে পেরেছেন আরও আট লক্ষ নতুন উদ্বাস্তু মানুষকে. এই বছরে এই মাত্রা সেপ্টেম্বর মাসেই ছাড়িয়ে গিয়েছে. প্রসঙ্গতঃ সংখ্যা তত্ত্বে শুধু সেই মানুষদেরই আলাদা করা হয়েছে, যারা সরকারি ভাবে উদ্বাস্তু বলে নির্ণিত হয়েছেন, উল্লেখ করে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পরিচালন ইনস্টিটিউটের অভিবাসন প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ বিভাগের বিশেষজ্ঞ ভ্লাদিমির ভোলখ বলেছেন: "রাষ্ট্রসঙ্ঘের ১৯৫১ সালে নেওয়া কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী উদ্বাস্তু, এঁরা বিদেশী নাগরিক অথবা নাগরিকত্ব রহিত মানুষ, যাঁরা অনুসৃত হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন এই রকমের ভিত্তিমূলক বিপদে পড়ে অথবা সামরিক ক্রিয়াকলাপের ফলে বাধ্য হয়েছেন নিজেদের দেশ ছেড়ে চলে যেতে". বর্তমানে প্রতি দিনে দুই হাজারেরও বেশী লোক সীমান্ত পার হয়ে যাচ্ছেন, যাঁরা নিজেদের দেশে সামরিক সংঘর্ষের হাত থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজছেন. এই ধরনের বিপজ্জনক প্রবণতা বিশেষজ্ঞরা বিশ্বের বিভিন্ন বিন্দুতে একই সঙ্গে বিভিন্ন বিরোধের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গেই যোগ করেছেন. বর্তমানে রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু নিয়ে কাজ করার বিভাগকে একই সঙ্গে চারটি খুবই তীক্ষ্ণ সমস্যা সঙ্কুল বিরোধ সামলাতে হচ্ছে – সিরিয়াতে, সুদানে, গণতান্ত্রিক কঙ্গো প্রজাতন্ত্রে ও মালিতে. এই কথা বলা হয়েছে হাই কমিশনার আন্তোনিউ গুতের্রিশা প্রদত্ত রিপোর্টে. আর এটা এই প্রসঙ্গে যে, সেই সমস্ত পুরনো হয়ে যাওয়া সমস্যা, অংশতঃ আফগানিস্তানে, সোমালিতে, লাইবেরিয়াতে, ইয়েমেনে, এরিত্রে, কলম্বিয়াতে ও আরও কিছু অন্যান্য দেশে, সেই গুলিও মনোযোগের দাবী করে. বেশী সংখ্যায় উদ্বাস্তু হওয়ার ফলে অন্য দেশ গুলি আরও কম ইচ্ছুক নিজেদের সীমান্ত খুলে দিতে. প্রথমতঃ, বিশ্ব সমাজের সাহায্য বিরাট কিছু নয়, আর বিদেশী উদ্বাস্তুদের নিজেদের দেশে থাকতে দেওয়ার বিষয়ে দায়িত্ব বিশেষ করে সেই দেশের ঘাড়েই পড়ছে, যারা থাকতে দিচ্ছে. দ্বিতীয়তঃ, এমনকি যখন সামরিক বিরোধ কমে যাচ্ছে, তখনও উদ্বাস্তুরা ফিরে যাওয়ার বিষয়ে তাড়াহুড়ো করছে না, এই কথা উল্লেখ করে রাশিয়ার জনসংখ্যা গবেষণা ইনস্টিটিউটের ভাইস ডিরেক্টর মিখাইল দেনিসেঙ্কো বলেছেন: "সেই সমস্ত দেশ, যারা উদ্বাস্তুদের আসতে দিয়েছে, তারা এঁদের দেশে ফিরে যাওয়ার আগে নিরাপত্তার গ্যারান্টি দিতে বাধ্য. কিন্তু সমস্ত ক্ষেত্রেই এটা সম্ভবপর হচ্ছে না. যেমন, যুগোস্লাভিয়া থেকে যাওয়া উদ্বাস্তুরা যথেষ্ট দ্রুতই ফিরে এসেছেন, কিন্তু আমরা জানি যেমন বলা যাক আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া উদ্বাস্তুদের কথা, যারা অনেক দিন হল রাশিয়ার এলাকাতে ছিলেন. তাঁদের একাংশ এখানেই থেকে গিয়েছেন. কারণ যদিও আফগানিস্তানে গত বিশ বছরে অনেকবার সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু উদ্বাস্তুদের নিরাপত্তার বিষয়ে কেউই গ্যারান্টি দিতে পারছে না". এই প্রসঙ্গে রাষ্ট্রসঙ্ঘের বিশেষজ্ঞদের মতে, আসন্ন দশ বছরে বিশ্বে সর্ব মোট উদ্বাস্তুদের সংখ্যা শুধু বেড়েই যাবে. সশস্ত্র সঙ্কট ও তার পরেই ধ্বংস ও নিঃস্ব থাকার সময় বাধ্য করবে মানুষকে নিজেদের ঘর বাড়ী ছেড়ে ভাল কিছুর সন্ধানে যেতে. শুধু মানবিক সাহায্য দিয়েই এই সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হবে না. বিরোধের রাজনৈতিক ভাবে সমাধানের উপায় ও তা হতে না দেওয়া – এটাই আন্তর্জাতিক সমাজের কাজ. স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে পশ্চিমবঙ্গে আসা বাংলাদেশি উদ্বাস্তুরা তাদের উদ্বাস্তু হিসেবে ঘোষণা করার দাবি করেছে। একই সঙ্গে দাবি করেছে নাগরিকত্ব এবং পুনর্বাসন। ২৫ আগস্ট প্রতিবছরের মতো এবারও গোটা পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে পালিত হয়েছে উদ্বাস্তু দিবস। এই লক্ষ্যে কলকাতা, বারাসাত, হাওড়া, নদীয়াসহ রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে উদ্বাস্তু সমাবেশ, অবস্থান এবং বিক্ষোভ কর্মসূচি পালন করে। সেখান থেকে দাবি ওঠে নাগরিকত্বের এবং পুনর্বাসনের। এই উদ্বাস্তু দিবস পালনের ডাক দেয় ইউসিআরসি বা সম্মিলিত কেন্দ্রীয় বাস্তুহারা পরিষদ। এই সংগঠনের ডাকে এ দিন উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা সদর বারাসাতে জেলা প্রশাসকের দপ্তরের সামনে বিক্ষোভ দেখায় কয়েক শ উদ্বাস্তু। এখানে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে সভাপতিত্ব করেন সংগঠনের জেলা সভাপতি হরিদাস দাস। এ দিন উদ্বাস্তুদের দাবিসংবলিত একটি স্মারকলিপিও দেওয়া হয় জেলা প্রশাসকের কাছে। একইভাবে ইউসিআরসি কলকাতার উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের সামনেও বিক্ষোভ দেখায়। দীপক রায় ঠিকই লিখেছেনঃ
মতুয়া সম্প্রদায় মুলতঃ বাংলার হিন্দু শূদ্র বা নমঃশুদ্রদের সংগঠন। একসময় অবহেলিত ও লাঞ্ছিত, বঞ্চিত শূদ্র বা নমঃশুদ্র বা চণ্ডালদের সমাজে মর্যাদার আসনে বসাতে তৈরি হয়েছিল মতুয়া ধর্ম বা মতুয়া সম্প্রদায়। প্রায় ৪০০ বছর আগে অধুনা বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি, যা বর্তমানে গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী থানার অধীন, সেখান থেকে এই মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লড়াই শুরু করেছিলেন চন্দ্রমোহন ঠাকুর। সেই সময় হিন্দুসমাজের বর্ণপ্রথার কারনে সর্বশেষ ধাপে এদের অবস্থান ছিল। জাতপাতের ব্যবধান ঘুচিয়ে তাঁদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার এক আন্দোলনের সূচনা করেছিলেন তিনি। এর মধ্যে দিয়েই মতুয়া ধর্ম প্রবর্তন এবং শূদ্রদের মধ্যে তা গ্রহণের চল শুরু হয়েছিল। এর পেছনেও আছে গল্পের মতোই এক কাহিনি। আসুন জেনে নিই প্রায় ৪০০ বছর আগের এক কিংবদন্তি সেই কাহিনী। ভারতের তৎকালীন উত্তরপ্রদেশের মৈথিলী ব্রাহ্মণ চন্দ্রমোহন ঠাকুর বেড়াতে এসেছিলেন পূর্ববঙ্গে। তিনি ওড়াকান্দিতে এলে তাঁর সঙ্গে সেখানকার এক শূদ্র পরিবারের মেয়ে রাজলক্ষ্মী দেবীর ভালবাসার সম্পর্ক হয়েছিল। সেই সম্পর্ক থেকে তাঁরা বিয়েও করেন। যার ফলে সমাজপতিদের রোষানলে পড়েন চন্দ্রমোহন ঠাকুর। তবে তিনি তখন এই ঘটনায় একটুও না দমে গিয়ে পূর্ববঙ্গের শূদ্রদের সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের সূচনা ঘটান। এই চন্দ্রমোহনেরই উত্তরপুরুষ হরিচাঁদ ঠাকুর প্রবর্তন করেন মতুয়া ধর্ম। হরিচাদ ঠাকুরের জন্ম হয়েছিল ওড়াকান্দির সাফলিডাঙ্গা গ্রামে। তাঁর বাবা যশোবন্ত ঠাকুর ও মাতা অন্নপূর্ণা দেবী। বৈষ্ণবভক্ত হিসেবেও এলাকায় তিনি বেশ পরিচিত ছিলেন। তাঁর ভক্তরা অনেকেই মনে করেন হরিচাঁদ ঠাকুর আসলে বুদ্ধদেব ও শ্রী চৈতন্যদেবের যুগপৎ অবতার। হরিচাঁদ ঠাকুর অত্যন্ত সাদামাটা জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়ার সুযোগ পাননি। তবে বংশানুক্রমিকভাবে বৈষ্ণবীয় যে পরিমণ্ডলে বড়ো হয়েছেন তাতে তিনি ক্রমান্বয়ে স্বশিক্ষিত হয়ে ওঠার সুযোগ পেয়েছেন। বৈষ্ণবীয় পরিবেশে অবস্থান করার সুযোগে বিভিন্ন শাস্ত্রালোচনায় অংশগ্রহণ এবং প্রাসঙ্গিক শাস্ত্রপাঠের মাধ্যমে হিন্দু ও বৌদ্ধশাস্ত্র সম্পর্কে অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছিলেন। একইসাথে তিনি দেশীয় চিকিৎসা ও ভূমিব্যবস্থাসহ নানা ধরনের জ্ঞানে বিশেষ বুৎপত্তিও অর্জন করেছিলেন। প্রথম জীবনে তিনি মাঠে রাখালি করতেন। পরে কৃষিকাজ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মনোনিবেশ করেন। তবে অবতারপুরুষ হিসেবে আত্মপ্রকাশের সাথে সাথে তিনি সক্রিয় হন ভক্তদের মনরক্ষার কাজে। এ সময় সাফলিডাঙ্গা ছেড়ে ওড়াকান্দিতে বসবাস শুরু করেন। ধীরে ধীরে হরিচাঁদ ঠাকুরের ভক্তসংখ্যা বাড়তে থাকে। তাঁর ভক্তদের মতুয়া বলা হয়। মতুয়াদের জন্যেই ওড়াকান্দি ক্রমান্বয়ে চতুর্দিকে পরিচিত হয়ে ওঠে। বর্তমানে ওড়াকান্দি একটি তীর্থধামে পরিণত হয়েছে। ভারতীয় উপমহাদেশে তাঁর অসংখ্য ভক্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। ভক্তদের ধারণা, হরিচাঁদ ঠাকুর মনুষ্যরূপে পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করেছেন। তাঁর জন্মতিথিতে লক্ষ লক্ষ ভক্তের সমাগম হয় ওড়াকান্দিতে এবং পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে। হরিচাঁদের ধর্মদর্শন ছিল সমন্বয়বাদী। পতিতজনের মুক্তির পন্থা দান করাকে হরিচাঁদ ঠাকুর তাঁর অবতার গ্রহণের অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করেন। অন্যদিকে বলা যায় নিম্নবর্গীয় জনগোষ্ঠীর আত্মমর্যাদা বৃদ্ধি এবং তাদের আর্থ-সামাজিক মুক্তির বিষয়টি তাঁকে বিশেষভাবে প্ররোচিত করেছিলো। প্রচলিত ধর্মশাসন পদ্ধতিকে প্রাতিষ্ঠানিকতা-সর্বস্ব এবং আন্তরিকতাহীন অভিহিত করে হরিচাঁদ ঠাকুর তা প্রত্যাখ্যান করে বলেন, 'সংসারের কর্মযজ্ঞের মধ্য থেকেই ধর্মকর্ম করা সম্ভব। যে কোনো ধরনের আনুষ্ঠানিক ধর্মচর্চা বাহুল্যমাত্র। হাতে নাম মুখে কাজই ধর্ম'। দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মনীষী মাত্র ৬৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন। হরিচাঁদ ঠাকুর নিজেই তাঁর আধ্যাত্মিক উত্তরাধিকারী মনোনীত করে গিয়েছিলেন জ্যেষ্ঠপুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুরকে। তিনিই মতুয়া ধর্মের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসেন। ভক্তরাও গুরুচাঁদ ঠাকুরকে হরিচাঁদের স্থলাভিষিক্ত করে তাঁর উপাধি দেন 'হরিগুরুচাঁদ'। তাঁর পরমপ্রিয় ভক্ত হয়েছিলেন খুলনার তিনকড়ি মিঞা। তার নাতি জালালউদ্দিন বর্তমানে মতুয়াদের দলপতি। বিদেশি দম্পতি ডা. এস এস মিড তাকে ডেকেছিলেন ধর্মপিতা। তখনকার দিনে শিক্ষাবিস্তারের সুযোগ ছিল কম। তবু তাঁর এ ব্যপারে তীক্ষ দৃষ্টি ছিল এবং নিজ পুত্র গুরুচাঁদকে শিক্ষার প্রসারে প্রয়াস নিতে নির্দেশ দিয়ে যান। গুরুচাঁদও শিক্ষাকে অগ্রাধিকার দেন। তাঁর কাছে যিনিই আসতেন তাকে বলতেন, 'সন্তান যেন অশিক্ষিত না থাকে। সন্তানদের শিক্ষিত করতে পারলেই আমাকে সন্তুষ্ট করা যাবে'। এ আন্দোলন তিনি শুধু নমঃশূদ্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখেননি। বরং তেলি, মালি, কুম্ভকার, কাপালি, মাহিষ্য সব সম্প্রদায়ের জন্যই কাজ করে গেছেন। কোথাও স্কুল স্থাপিত হলে তার দ্বার ছিল সবার জন্য খোলা। দলিত নমঃশূদ্র জাতি শিক্ষালাভ করবে এটা মোটেই সমুচিত ছিল না সে সময়ে। তবু গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন তার লক্ষ্যে অটল। যাবতীয় বাধাবিঘ্ন কাটিয়ে ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে ওড়াকান্দিতে তিনি প্রথম স্কুল স্থাপন করেছিলেন। যা এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন। এ স্কুলেই প্রথম তিনি ছাত্রবৃত্তি চালু করেছিলেন। পরে এটি মিডল ইংলিশ স্কুলে পরিণত হয় এবং সরকারি সাহায্যে ১৯০৮ সালে ওড়াকান্দির মিডল ইংলিশ স্কুলকে হাই ইংলিশ স্কুলে পরিণত করেন। ১৮৮১ সালে খুলনার দত্তডাঙ্গায় এক নমঃশূদ্র মহাসম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঈশ্বর গায়েনের বাড়িতে। সেখানে দলিত সমাজে শিক্ষা প্রসারের প্রয়োজনীয়তা ও উপায় সম্বন্ধে তিনি ভাষণ দিয়েছিলেন। এর পর থেকেই তিনি একের পর এক স্কুল স্থাপন করতে থাকেন। তার দেখাদেখি চারিদিকে স্কুল খোলার ধুম পড়ে যায়। এসব নতুন স্কুলে শিক্ষাদান করতেন হাই ইংলিশ থেকে পাস করা শিক্ষার্থীরা। এই ভাবে দুর্গম অনুন্নত সুন্দরবন অঞ্চলেও শিক্ষা বিস্তার সম্ভব হয়। দলিত জাতির শিক্ষাক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় যেমন আন্দোলন করেছিলেন গুরুচাঁদ ঠাকুর, তেমনি চাকরিক্ষেত্রেও তাদের দাবি প্রতিষ্ঠার জন্য আন্দোলন করেছিলেন। তার ফলে বিশ শতকের প্রথম দশকে ১৯০৯ সালে শিক্ষা, চাকরি ও পরবর্তীকালে আইনসভায় আসন সংরক্ষিতও হয়েছিল। এমনকি তারা তফশিলভুক্ত জাতি হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। গুরুচাঁদ নিজের পুত্রদের শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করেছিলেন। প্রথম পুত্র শশীভূষণ ঠাকুর লক্ষ্মীপাশা বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। কনিষ্ঠ পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১২ সালে প্রবেশিকা পাস করেন। তিনি প্রথম 'নমঃশূদ্র সুহৃদ' পত্রিকা প্রকাশ করেন। শিক্ষা আন্দোলনের সাথে সাথে কর্মক্ষেত্র লাভের আন্দোলনও শুরু করেছিলেন। তৎকালে গুরুচাদের নেতৃত্বে পাঁচ সহচারীকে নিয়ে তিনি ছোটলাটের কাছে দেখা করেন। সেখানে তাঁরা জানান, 'সামাজিক অবিচারের জন্য নমঃশূদ্রদের শিক্ষা প্রসারে ব্যহত হচ্ছে। তাই সরকারি পরিষেবায় নিয়োগের বিশেষ প্রয়োজন'। এর পরে শশীভূষণ ঠাকুর নিযুক্ত হন সাব-রেজিস্ট্রার পদে, ডা. তারিণী চরণ বালা সরকারি ডাক্তার এবং কুমুদ বিহারী মল্লিক ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পদে নিযুক্ত হন। এটাই ছিল প্রথম কোনো নিম্নবর্ণের সরকারি কাজে যোগদান। ১৯৩২ সালে গুরুচাঁদ ঠাকুর 'শ্রীশ্রীহরিগুরু মিশন' স্থাপন করেন। এই মিশনের মাধ্যমে তিনি গ্রামে গ্রামে রাস্তাঘাট, পাঠশালা, স্কুল ও ছাত্রাবাস স্থাপনের ব্যবস্থা করেন। এই মিশনের উদ্যোগে তিনি তালতলাতে 'শান্তি-সত্যভামা বালিকা বিদ্যালয়' নামে মেয়েদের একটি আলাদা স্কুল স্থাপন করেন। এছাড়া মিসেস মিডের সহযোগিতায় ১৯০৮ সালেই মেয়েদের জন্য একটি শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে তোলেন। প্রসূতি মা ও শিশুসেবার জন্য নির্মিত হয় মাতৃমঙ্গল কেন্দ্র, যা আজও ওড়াকান্দিতে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। দলিত মানুষের আধুনিক চিকিৎসাসেবার জন্য গুরুচাঁদ ঠাকুর নিজের খরচে তারিণী বালাকে এমবিবিএস পড়িয়েছিলেন। আপন পৌত্র মন্মথ ঠাকুরকেও এমবিবিএস পড়ান। স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য খ্রিস্টান মিশনারিদের মাধ্যমে গ্রামে-গঞ্জে পায়খানা তৈরি ও পানীয় জলের পুকুরকে আলাদা করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেছিলেন। আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগে এই মনীষী যে আধুনিক চিন্তা করেছিলেন, আজও তা অব্যাহত রয়েছে মানবসমাজে। ১৯১৯ সালেই নতুন ভারত শাসন আইন প্রবর্তিত হয় এবং তাতে অস্পৃশ্যদের রাজনৈতিক অধিকার মেনে নেওয়া হয়। এরই ফলে বাংলার বিধান পরিষদে সর্বপ্রথম প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পান গুরুচাদের অনুসারী ভীষ্মদেব দাস। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে ১৩৯ জন সদস্যের মধ্যে মাত্র দুজন ছিলেন অস্পৃশ্য সমাজের। এরা ছিলেন ভীষ্মদেব দাস ও নিরোদবিহারী মল্লিক। নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পরও বিধান পরিষদে মনোনীত হতে পেরেছিলেন শুধু গুরুচাঁদ ঠাকুরের কারণে। শুধু শিক্ষাবিস্তারেই এই মনীষী থেমে থাকেননি, সমাজ উন্নয়নেও অনেক দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তিনি এমন অনেক কাজ করেছিলেন যা এই যুগের নিরিখে অতি তুচ্ছ মনে হলেও সেই সময়ে ছিল বিস্ময়কর সমাজকল্যাণমূলক কাজ। 'নমঃশূদ্র কল্যাণ সমিতি' গুরুচাঁদ ঠাকুরের এমনই একটি মহৎ কাজ। কয়েকটি গ্রাম বা কয়েকটি 'মিলা'র সৎ কর্মীদের নিয়ে গঠন করা হতো এই সমিতি। এর উদ্যেশ্য ছিল বহুমুখী। শিক্ষাবিস্তার, রাস্তাঘাট নির্মাণ, মজাপুকুর খনন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা রক্ষা, সৎ উপায়ে জীবনধারণ করা, মানুষকে সাহায্য করা ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। অর্থনৈতিক বুনিয়াদকে শাক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে গুরুচাঁদ 'লক্ষ্মীর গোলা' গঠন করেছিলেন। মরসুমের সময়ে ধান সংগ্রহ করে এ গোলায় রাখা হতো। দাম বাড়লে বিক্রি করে বিভিন্ন সামাজিক উপকরণ কেনা হতো। কখনো কখনো দুর্ভিক্ষের সময় এই ধান গরিবদের মাঝে বিতরণ করা হতো। আবার কখনো কখনো গোলার ধান ধারে দেওয়া হতো। তবে ফেরত দেয়ার সময় এক মণ ধানে ১০ সের বেশি দিতে হতো। এটা আসলে গ্রামীণ ব্যাংকিং পদ্ধতি ছিল। গুরুচাঁদ ঠাকুর ছিলেন বিচক্ষণ। তার চিন্তাচেতনা ছিল সুদূরপ্রসারী। তাই তিনি স্বনির্ভরতা অর্জনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, অর্থ ছাড়া মুক্তি নেই। ১৮৫৮ সালে বাংলায় কৃষক বিদ্র্রোহ এবং ১৮৫৯-৬০ সালে নিম্নশ্রেণীর কৃষকদের মধ্যে নীল বিদ্রোহ হয়। এ সময় শক্তিশালী জমিদাররা কৃষকদের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছিল। এই বিদ্রোহের নেতৃত্ব দেন হরিচাঁদ ঠাকুর। ১৮৭২-১৮৭৬ সাল পর্যন্ত পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে জমিদার ও তাদের অনুচরদের সংঘবদ্ধ কৃষকেরা আক্রমণ করে। আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন গুরুচাঁদ ঠাকুর। ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসেও তাঁর নাম লেখা রয়েছে। তাঁর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় শুধু গোপালগঞ্জ নয়, ভারতবর্ষেও বহু পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বেলেছেন। কিন্তু ২০০ বছর পরে এসে আমরা দেখছি গুরুচাঁদ ঠাকুরের স্বপ্ন এখনো পূরণ হয়নি। এখনো নিম্নবর্ণের জেলা হিসেবে কাশিয়ানীতে উন্নতির ছোঁয়া পড়েনি। তারা এখনো নৌকায় চড়ে স্কুলে যায় শিক্ষালাভের জন্য। নেই পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট, যানবাহন, পানীয় জলের সুব্যবস্থা। এমনকি অধিকাংশ গ্রামে বিদ্যুৎ পৌঁছায়নি। খ্রিস্টান ধর্মযাজক ডা. সি এস মিড গুরুচাঁদ সম্পর্কে লিখেছিলেন, 'সারা ভারতবর্ষের প্রাচীনপন্থী হিন্দুদের মধ্যে তার মতো একজন দূরদৃষ্টি ও তীক্ষ্ম বুদ্ধিসম্পন্ন এবং অমিত তেজস্বী মানুষ আমি দেখিনি'। ১৯৩৮ সালে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির সভাপতি হিসেবে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু গুরুচাঁদ ঠাকুরকে একজন মহামানব হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধী গুরুচাঁদ ঠাকুরকে বলেছিলেন মহান গুরু। তাঁর বংশধর ও অনুসারীরা এখনো দুই বাংলায় ছড়িয়ে আছেন এই সম্প্রদায়ের নয়নের মনি হিসেবে। বর্তমান বাংলাদেশে মতুয়া সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা আনুমানিক ৫০ লাখেরও বেশি। আর পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটা অবশ্যই কোটি ছাড়িয়ে গিয়েছে। দেশবিভাগের পরে পশ্চিমবঙ্গে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের একটা বড় অংশই মতুয়াদের সাথে আছেন, এটা বাস্তব। দুই বাংলার মতুয়াদের অবিসংবাদিত ধর্মীয় নেত্রী হলেন বীণাপাণি দেবী ওরফে বড়মা। দেশ ভাগের অল্প আগে বাংলাদেশের ওড়াকান্দির বাড়ি ছেড়ে স্বামী ব্যারিস্টার প্রমথরঞ্জন ঠাকুরের হাত ধরে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনার ঠাকুরনগরে আসেন বড়মা বীণাপাণি দেবী। ব্যারিস্টার প্রমথরঞ্জন ঠাকুর অবিভক্ত বাংলায় ফরিদপুরের বিধায়ক ছিলেন। আবার পশ্চিমবঙ্গে বিধান রায়ের আমলে তিনি রাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন। কলকাতা থেকে ৬৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত ঠাকুরনগরের নামও তৈরি হয়েছিল তাঁর নামেই। ফলে একটা রাজনৈতিক আবহ এই পরিবারে আগে থেকেই ছিল। বড়মার মতো বাংলাদেশি মতুয়াদের নেত্রী ছিলেন মঞ্জুলিকা ঠাকুর ওরফে ছোটমা। ওড়াকান্দিতে ২০০৬ সালে ছোটমা মঞ্জুলিকা ঠাকুর মারা যান। তাঁর স্বামী ছিলেন ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত বিধায়ক সচিপতি ঠাকুর। তাঁর পুত্র প্রভাসচন্দ্র ঠাকুর বর্তমানে বাংলাদেশ মতুয়া মহাসঙ্ঘের মহাসচিব। এর পুত্র সুব্রত ঠাকুর এখন কাশিয়ানী উপজেলার চেয়ারম্যান। ফলে বাংলাদেশেও মতুয়া পরিবারে একটি রাজনৈতিক আবহ আছে। এখনো প্রতিবছর মতুয়াদের উৎসবে পশ্চিমবঙ্গের ঠাকুরনগরে ৩০-৩৫ লাখ ও বাংলাদেশের ওড়াকান্দিতে প্রায় ১৫-২০ লাখ লোকের সমাগম হয়। মতুয়াদের রয়েছে শানবাঁধানো কামনা সাগর, যেখানে স্নান করলে নাকি পাপমুক্তি হয়। দুই বাংলা থেকে তো বটেই, উত্তর প্রদেশ ও মধ্যপ্রদেশ থেকেও আসেন প্রচুর তীর্থযাত্রী। বিভিন্ন এলাকা থেকে দলে দলে লাঠির মাথায় বাঁধা ত্রিকোণ পতাকা, কাঁসর ও ডঙ্কা বাজনা বাজিয়ে মতুয়ারা নাচতে নাচতে 'হরি বলো' ধ্বনি দিতে দিতে সমবেত হয়। দিনে দিনে এই প্রবনতা বাড়ছে ছাড়া কমছে না। মতুয়াদের নিয়ে চলচ্চিত্র, পুস্তক প্রকাশিত হয়েছে। তাঁদের দাবী অনুযায়ী স্কুল, কলেজ, গবেষণা কেন্দ্রের সুচনা হয়েছে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের আমলেই। আর এখন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নতুন সরকারের সাথে মতুয়াদের সম্পর্ক আরও ভালো। নতুন সরকারে মন্ত্রিপদে আছেন মতুয়া পরিবারের বড়মা'র ছেলে মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর। ফলে মতুয়াদের মধ্যে রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু মতুয়া সাধারন মানুষের ভিতরে আছেন প্রচুর বামপন্থী সমর্থক। আছেন তাঁদের নেতৃত্বও। বিগত বিধানসভা নির্বাচনে মতুয়াদের সরাসরি রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের ফলে সঙ্ঘাত ঘটছে। আগে এই সঙ্ঘাত ছিল ভিতরে, এখন ক্রমশঃ তা প্রকাশ্যে এসে গেল তাঁদের ২৫ তম সাধারন সভাকে কেন্দ্র করে। মতুয়া মহাসঙ্ঘের অবিসংবাদী নেত্রী বড়মা বীণাপাণি দেবীর উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষের সামনে, তাঁর দুই ছেলে রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর ও সঙ্ঘাধিপতি কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর কার্যকরী সমিতি গঠনের জন্য আলাদা প্যানেল মাইকে ঘোষণা করলেন। তীব্র বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়লেন দুজনে। হতভম্ব বড়মা বীণাপাণি ঠাকুর দুইজনকে সামলাতে না পেরে অসহায় অবস্থায় সাধারন সভা বন্ধ করে দিলেন। এরপরে আরও নাটক জমে গেল। দেখা গেল দুই পক্ষের প্যানেলেই আছে বড়মার স্বাক্ষর। মন্ত্রীর প্যানেলে দেখা যায় মুখ্যমন্ত্রী, খাদ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে সাংসদ একঝাক রাজনৈতিক নেতার নাম। শুরু হয়ে যায় বিক্ষোভ। প্রচুর মানুষ উভয় পক্ষের হয়ে বিক্ষোভে অংশ নেন। এদিকে এই সভায় কেন্দ্রীয় উপদেষ্টামণ্ডলীর সভাপতি প্রাক্তন বিধায়ক বাম নেতা হরিপদ বিশ্বাসের অনুপস্থিতি নিয়েও গুঞ্জন শুরু হয়ে গিয়েছে। এই ঘটনার পরে কপিলকৃষ্ণ ঠাকুর তাঁর প্রতিপক্ষ ভাই রাজ্যের মন্ত্রী মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুরের বিরুদ্ধে খুনের হুমকি দেবার অভিযোগ জানিয়ে পুলিশে অভিযোগ দায়ের করেন। আর এই প্রকাশ্য কলহ ভক্তকুলের কাছে হয়ে যায় যন্ত্রণা ও পীড়ার কারন। কার্যকরী সমিতির নদীয়া জেলার এক সদস্যের অভিযোগ, 'এই সামাজিক ও ধর্মীয় সংগঠনে ইদানীং অতিরিক্ত রাজনৈতিক অনুপ্রবেশের কারনেই এমন লজ্জাজনক ঘটনা ঘটেছে, যা আমাদের নতুন প্রজন্মকে মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রতি আগ্রহ হারাতে সাহায্য করবে'। এদিকে দু'জনেই দাবী করেছেন, তাঁদের প্যানেলই নির্বাচিত হয়েছে। বাস্তবে কি হয়েছে, তা একমাত্র বড়মা বীণাপাণি দেবীই জানেন। আপাততঃ তিনি মুখে কুলুপ এঁটে আছেন। বিব্রত বড়মা কোন সাংবাদিকের সাথে দেখাও করেননি বা ফোনও ধরেননি। কিন্তু এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে আগামিদিনে আরও বড় অশান্তির মেঘ দেখছে সাধারন মতুয়া ধর্মের ভক্তকুল। http://ukbdnews.com/kolkata/46095-2011-11-12-19-00-56.html
'বাংলাদেশি' উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবিতে পশ্চিমবঙ্গের শীর্ষ চার দলের সমর্থন সুব্রত আচার্য্য, কলকাতা ভারতের পশ্চিমবঙ্গে অবস্থানরত 'বাংলাদেশি' উদ্বাস্তুদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়ে প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছেন রাজ্যের প্রধান চারটি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা। গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে কলকাতার ধর্মতলায় বাংলাদেশি উদ্বাস্তুদের সংগঠন 'মতুয়া মহাসংঘ' আয়োজিত এক মহাসমাবেশে অংশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন দল সিপিএমের পক্ষে আবাসনমন্ত্রী গৌতম দেব, প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি মানস ভূঁইয়া, তৃণমূলের প্রতিনিধি ও কেন্দ্রীয় জাহাজমন্ত্রী মুকুল রায় এবং রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথাগত রায় এই সমর্থনের কথা জানান। অনুষ্ঠানে জানানো হয়, 'বাংলাদেশি' উদ্বাস্তুদের এই সংগঠনের সদস্য সংখ্যা বর্তমানে প্রায় এক কোটি ২০ লাখ। ভারতের রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সম্প্রতি এ সংগঠনের বিশেষ সদস্য হয়েছেন। ভারতের সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল শঙ্কর রায় চৌধুরীও সংগঠনটির সঙ্গে যুক্ত। গতকাল মতুয়া মহাসংঘের জনসভায় অংশ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারের মন্ত্রী গৌতম দেব বলেন, সব দল মিলে কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে উদ্বাস্তুদের স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার সুপারিশ করা উচিত। প্রয়োজনে একটি সর্বদলীয় কমিটি করারও প্রস্তাব দেন তিনি। প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি ডা. মানুস ভূঁইয়া বলেন, ১৯৭১ সালের পরে বাংলাদেশ থেকে যারা নানা কারণে পশ্চিমবঙ্গে এসেছেন, তাঁদের নাগরিকত্ব পাওয়ার দাবি যুক্তিসঙ্গত। এই দাবি নিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং, অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এবং কংগ্রেস সভানেত্রী সোনিয়া গান্ধীর কাছে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। রাজ্য বিজেপির সভাপতি তথাগত রায় বলেন, বিজেপি বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দু-বৌদ্ধদের ভারতের স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার পক্ষে। এপার বাংলায় এসে আশ্রয় নেওয়া কোনো বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হবে না। তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী মুকুল রায় অনুষ্ঠানে মতুয়া মহাসংঘের প্রধান বীণা পানি ঠাকুরকে বলেন, উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবির বিষয়ে তাঁরা একমত। মহাসমাবেশ শেষে মতুয়াদের একটি প্রতিনিধিদল পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সঙ্গে দেখা করে। পরে সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক গণপতি বিশ্বাস সাংবাদিকদের জানান, তাঁদের দাবির বিষয়ে মুখ্যমন্ত্রী ইতিবাচক মনোভাব দেখিয়েছেন। কিন্তু বিষয়টি যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে, সেহেতু এ বিষয়ে সরাসরি তাঁর কিছু করার নেই। তবে পশ্চিমবঙ্গে কোনো উদ্বাস্তু যেন হেনস্তার শিকার না হন, সে বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। প্রসঙ্গত, ভারতের বিজেপি সরকারের সময় করা 'পুশব্যাক' আইন সংশোধন এবং উদ্বাস্তুদের স্থায়ী নাগরিকত্ব দেওয়ার দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করে আসছে মতুয়া মহাসভা। এবার ভোটের আগে এ বিষয়ে সব দলের সমর্থন আদায়ের জন্যই গতকালের মহাসমাবেশের আয়োজন করা হয়। জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর বাঙালি রিফিউজিস-এর সাংবাদিক সম্মেলন ছিল কলকাতা প্রেস ক্লাবে, ১ নভেম্বর। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কারণে পূর্ব পাকিস্তান ও পরবর্তীকালে বাংলাদেশ থেকে বাধ্য হয়ে চলে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবিতে এই সংগঠনটি আন্দোলনের কর্মসূচি নিয়েছে। তাদের দাবি, ২০০৩ এর নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন বাতিল করতে হবে। কেননা এই আইন পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুদের প্রতি এক চরম বিশ্বাসঘাতকতা। তাদের কথা, ১৯৪৭-এর দেশভাগ হিন্দু ও মুসলমান নেতৃবৃন্দের রাজনৈতিক উচ্চাশার ফল। সাধারণ মানুষের এক্ষেত্রে কোনো ভূমিকা ছিল না। অথচ সর্বত্র তারাই হয়েছে দেশভাগের বলি। ভারত থেকে লক্ষ লক্ষ মুসলমান তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, একই জিনিস হয়েছে পাকিস্তানেও। সেখান থেকে লক্ষ লক্ষ হিন্দু দেশভাগের ফলে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে আসতে বাধ্য হয়। সত্যি বলতে, এই উপমহাদেশ সেই প্রথম 'উদ্বাস্তু', 'মোহাজির' --- ইত্যাদি শব্দের সঙ্গে পরিচিত হয়। http://www.kalerkantho.com/index.php?view=details&type=gold&data=Car&pub_no=384&cat_id=1&menu_id=43&news_type_id=1&index=1&archiev=yes&arch_date=29-12-2010#.UKznYuS-pA0
উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব, সরব সি পি আই (এম)-ও নিজস্ব প্রতিনিধি নয়াদিল্লি, ২৭শে নভেম্বর— নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০০৩-এর বিরোধিতা এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তু মানুষদের নাগরিকত্বের দাবিতে আন্দোলনকে সমর্থন জানালো সি পি আই (এম)। রবিবার নয়াদিল্লিতে বাঙালী উদ্বাস্তু যৌথ সংগ্রাম কমিটির (জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর বাঙালী রিফিউজিস) ডাকে একটি জাতীয় কনভেনশনে উপস্থিত হয়ে সি পি আই (এম)-র পলিট ব্যুরো সদস্য বৃন্দা কারাত বলেন সি পি আই (এম) এই আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাচ্ছে। সোমবার থেকে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন, ২০০৩-এর বিরোধিতা করে এবং বাংলাদেশ থেকে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবিতে দিল্লির যন্তর মন্তরে অনির্দিষ্টকালীন অনশন অবস্থান শুরু করছে যৌথ সংগ্রাম কমিটি। বৃন্দা কারাত এদিন বলেন, সঠিক সময়ে এই আন্দোলন শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার এখন দেশজুড়ে অভিন্ন পরিচয়পত্র বা আধার কার্ড চালু করতে চলেছে। এরপর ভারতের নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসেবে একমাত্র এটিই বিবেচিত হবে বলে জানানো হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধন আইন মেনে এই কাজ হলে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তু মানুষ নাগরিকত্ব পাবেন না। হয়রানির কারণে বাংলাদেশ থেকে যাঁরা এদেশে এসেছেন তাঁদের অধিকাংশই গরিব এবং নিম্নবিত্ত মানুষ। তাহলে কেন শুধুমাত্র একটি বছরকে ভিত্তি ধরে তাঁদের বঞ্চিত করা হবে, প্রশ্ন তোলেন বৃন্দা কারাত। রায়পুর, উত্তরাখণ্ডের উধম সিং নগরে উদ্বাস্তু ত্রাণ শিবিরে কী অবর্ণনীয় পরিবেশে আছেন বাঙালীরা, নিজের দেখা সেই অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন তিনি। এবিষয়ে তিনি আগেও কেন্দ্রীয় সরকারকে অবহিত করেছেন বলে জানান কারাত। বি জে পি নেতৃত্বাধীন এন ডি এ সরকারের আমলে ১৮ই ডিসেম্বর ২০০৩সালে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল সংসদে পেশ করা হয়। সেই সময়ে বিরোধী দলনেতা মনমোহন সিং বলেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে হয়রানির কারণে যাঁরা এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন তাঁদের নাগরিকত্বের বিষয়টি উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে বিবেচনা করা উচিত। জবাবে তৎকালীন উপপ্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদবানি বলেছিলেন বিষয়টির সঙ্গে আমি একমত এবং বিবেচনায় রাখবো। কনভেনশনে এই বিষয়টি উল্লেখ করে বৃন্দা কারাত বলেন, তারপরেও কোনো সর্বসম্মতি তৈরি না করেই বিলটি আইন হিসেবে পাস হয়ে যায়। সোমবার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক আছে বৃন্দা কারাতের। সেই বৈঠকে তিনি যৌথ সংগ্রাম কমিটির দাবিগুলি সম্পর্কেও প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করবেন বলে এদিন জানান। ২০০৩সালে সংসদে আলোচনায় অংশ নিয়ে মনমোহন সিং কী বলেছিলেন সেকথাও তাঁকে মনে করিয়ে দেবেন বলে এদিন জানিয়েছেন বৃন্দা কারাত। যৌথ সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস তাঁর বক্তব্যে নাগরিকত্ব সংশোধন আইনের সমালোচনা করেন। উল্লেখ্য, নিখিল ভারত বাঙালী উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতি গত ২২-২৩শে নভেম্বর যন্তর মন্তরে অবস্থান করে এবং ২৪শে নভেম্বর একই দাবিতে মিছিল করে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক সুবোধ বিশ্বাস এবং জে কে মণ্ডলসহ অন্যান্যরা উপস্থিত ছিলেন। http://ganashakti.com/bengali/news_details.php?newsid=16606 দেশভাগের পর প্রথম কয়েকবছর ভারত থেকে মুসলমানদের দেশত্যাগের মাত্রা বেশি থাকলেও পরে তা কমতে থাকে। গত দশকে তা প্রায় শূন্যে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পাকিস্তান বা বাংলাদেশ থেকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের চলে আসার ক্ষেত্রে তা হয়নি। ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং তার আগে হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে বহু মানুষ এপারে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গে, চলে আসে। কারণ অবশ্যই রাজনৈতিক। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ওপার থেকে মানুষ আসার ঢল কমে যায়। কিন্তু মুজিবের হত্যার পর অস্থির বাংলাদেশ থেকে হিন্দুদের দেশত্যাগ আবার বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে বিচ্যুত পরবর্তী শাসকরা ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে 'ইসলাম'কে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার করতে থাকে। অবিরাম হিন্দু জনস্রোত চলে আসার পেছনে ধর্ম-রাজনীতির খেলা চলতে থাকে। ১৯৫০-এ স্বাক্ষরিত নেহরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী দুই দেশের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা, বাকস্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা সুরক্ষিত রাখতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয় দুই রাষ্ট্র। বাস্তবে তা খুব একটা কার্যকর হয়নি। 'ব্রাহ্মণ্যবাদী' সামাজিক কাঠামোয় এবং 'ছদ্ম ধর্মনিরপেক্ষ' ভারত রাষ্ট্রে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দু, আদিবাসী ও সংখ্যালঘুরা পিছিয়ে গেছে। ব্যবসা-শিক্ষা-চাকরি সর্বত্র। পাকিস্তান, বাংলাদেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। বাংলাদেশে সেই খানসেনাদের সময় থেকে বিএনপি-জামাত শাসনে কমবেশি হিন্দু নিপীড়ন চলেছেই। বাধ্য হয়ে পৈত্রিক ভিটেমাটি ত্যাগ করে কাতারে কাতারে মানুষ চলে এসেছে এপারে। অসহায় এই মানুষগুলোর ভবিষ্যত নাগরিকত্ব বিলের আঘাতে অনিশ্চিত ও আশঙ্কাজনক হয়ে উঠেছে। কেননা, আইনটির দুই(এক)(বি) ধারা অনুযায়ী 'অনুপ্রবেশকারী' বা 'বেআইনি অভিবাসী'র সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে : ক) কোনো বিদেশি, যিনি বৈধ পাসপোর্ট বা সমমানের কোনো অনুমতিপত্র ছাড়া এই দেশে ঢুকেছেন, তিনি অনুপ্রবেশকারী, অথবা
খ) বৈধ পাসপোর্ট বা সমমানের অনুমতিপত্র নিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছেন, কিন্তু ভিসা বা অনুমতির সময়সীমা শেষ হওয়া সত্ত্বেও এই দেশে থেকে গেছেন -- এঁরা অনুপ্রবেশকারী, ভারতের নাগরিকত্ব তাঁরা কোনোভাবেই পাবেন না। আইনের এই ধারাদুটি পড়লেই বোঝা যায়, তা কতটা অমানবিক এবং অযৌক্তিক। যে চরম অবস্থার শিকার হয়ে কোনো মানুষ বা জনগোষ্ঠী যখন পৈত্রিক ভিটেমাটি ত্যাগ করতে বাধ্য হন, তখন অনুমতিপত্র নিয়ে আসার প্রশ্ন আসে কি? কে দেবে তাদের অনুমতি? আবার সময়সীমা অতিক্রান্ত হওয়া সত্ত্বেও থেকে যাওয়ার মানে কি এই নয় যে তার জন্মভূমি আর তার নিজের নেই? তার কাছে তা এখন মৃত্যু উপত্যকা? বস্তুত এসব প্রশ্ন ও প্রসঙ্গ উঠে আসছিল ভারত সভা হলের কনভেনশনে উপস্থিত কিছু উদ্বাস্তু মানুষের কাছ থেকে। প্রেস ক্লাবের অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নেতৃবৃন্দ এবং আজকের সময়ে পরিচিত, স্বল্পপরিচিত কিছু রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক মুখ। আঠাশে নভেম্বর দিল্লিতে যন্তরমন্তরের সামনে আমরণ অনশন আন্দোলনের কর্মসূচি জানান তাঁরা। আহ্বায়ক সুকৃতি রঞ্জন বিশ্বাস জানালেন, বিভিন্ন সামাজিক সংগঠন, কর্মচারী সংগঠন এবং কিছু বিশেষ ব্যক্তি এই আন্দোলন সমর্থন করছে। Reshuffling her 18-month-old ministry inWest Bengal, Chief Minister Mamata Banerjee today inducted eight new faces, mostly from rural Bengal, with an eye on the coming panchayat elections in the state. Of the eight, six are sitting Trinamool Congress MLAs, while the other two are Krishnendu Narayan Chowdhuryand Humayun Kabir who switched over to Trinamool Congress from Congress only yesterday. The Mamata Banerjee government completed its 18 months in office yesterday. The reshuffle was aimed at filling up six ministries which became vacant after Congress ministers resigned following their party's pull-out from the Mamata Banerjee ministry on September 22 in a tit-for-tat response to the TMC's decision to walk out of theUPA government at the Centre. Thirteen ministers, including five existing, took oath at a simple ceremony at Raj Bhavan with Governor M K Narayanan administering them the oath of office and secrecy. Chief minister Mamata Banerjee, her council of minsters and Assembly speaker Biman Banerjee, were present, among a host of dignitaries at the ceremony. The ministers of state who were upgraded to cabinet rank were Madan Mitra, Arup Biswas, Subrata Saha, Manjulkrishna Thakur and Chandrima Bhattacharya. Also Krishnendu Chowdhury and Rajiv Banerjee (new faces) were given the cabinet rank.
মতুয়া আন্দোলন: নিজেকে অতিক্রম করতে পারলে সম্ভাবনা অনেক মতুয়া আন্দোলন: নিজেকে অতিক্রম করতে পারলে সম্ভাবনা অনেক সন্তোষ রাণা http://anandabazar-unicode.appspot.com/proxy?p=archive/1110201/1edit4.htm প্রাই আড়াই হাজার বছর ধরে চলে আসা ভারতীয় সমাজে সামাজিক পদমর্যাদার বহুবিধ ধাপ দেখতে পাই। ধাপগুলি পিরামিডের আকারে সাজানো। সর্বোচ্চ ধাপে ব্রাহ্মণ এবং সর্বনিম্ন ধাপে অস্পৃশ্য জাতিগুলো এবং জাতি-ব্যবস্থায় না-ঢোকা আদিবাসীরা। খ্রিস্টধর্মর্ে ও ইসলামে জাতিব্যবস্থার কোনও স্থান নেই, কিন্তু তারাও ভারতে জাতি-কাঠামো অনুযায়ী বিভক্ত হয়ে পড়ে। সামাজিক শ্রম-বিভাজনে কোন ব্যক্তি কী ভাবে অংশগ্রহণ করবেন এবং ফলে, সামাজিক উৎপন্নের কতটুকু অংশ ভোগ করবেন তা মূলত তিনি কোন ধাপে জন্ম নিয়েছেন সেটা দিয়ে নির্ধারিত হয়ে যায়। বিপুলসংখ্যক উৎপাদকদের অবস্থান পিরামিডের সর্বনিম্ন ধাপে। একটি রাজনৈতিক সূত্রীকরণের মাধ্যমে নিম্নবর্ণের মানুষদের সম্পত্তির অধিকার ও শিক্ষার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হয়। তেমনই একটি ধর্মীয় মতাদর্শগত সূত্রীকরণের মাধ্যমে দ্বিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই ব্যবস্থায় ব্যক্তির কোনও সচলতা থাকে না। সমবেত। সর্বভারতীয় মতুয়া মহাসঙ্ঘের সভা। কলকাতা, ডিসেম্বর ২০১০ এই পরিস্থিতিতে এটা খুবই স্বাভাবিক যে সমাজের উৎপাদক শ্রেণিগুলো সামাজিক উৎপন্নের বণ্টনে নিজেদের অংশ বৃদ্ধি করার জন্য সংগ্রাম করবে এবং এই সংগ্রাম সর্বদা সরাসরি শ্রেণি-সংঘাতের পথে না গিয়ে কখনও কখনও ধর্মীয় মতাদর্শগত সংগ্রামের রূপ নেবে। চার্বাক ও বুদ্ধ থেকে শুরু করে মধ্যযুগের কবির, নানক ও শ্রীচৈতন্য হয়ে আধুনিক কালের জ্যোতিবা ফুলে, অম্বেডকর, শ্রীনিবাস গুরু ও পেরিয়ার পর্যন্ত ভারতীয় সমাজের অভ্যন্তরীণ সংগ্রাম এই সাধারণ ধারা অনুসরণ করেছে। পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থা শুরু হওয়ার পর ধাপগুলির মধ্যে কিছু পরিমাণে অভ্যন্তরীণ শ্রেণি-বিভাজন ঘটেছে যা চলমান সংগ্রামকে নানা ভাবে প্রভাবিত করেছে। অবিভক্ত বাংলার পূর্ব অংশে এই ধারারই সংগ্রাম ছিল মতুয়া আন্দোলন। ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দির বিখ্যাত সমাজ সংস্কারক হরিচাঁদ ঠাকুর (১৮১২-১৮৭৮)-এর নেতৃত্বে এক বিরাট সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। হরিচাঁদ 'হাতে কাম, মুখে নাম' এই বাণীর মাধ্যমে বলেন যে, নমঃশূদ্ররা কারও চেয়ে হীন বা নিচু নয়। কাজ করা বড় ধর্ম, শ্রমে অংশ নাও এবং গার্হস্থ্য জীবনে থাকো। কারও কাছে দীক্ষা নিও না বা তীর্থস্থানে যেও না। ঈশ্বর সাধনার জন্য ব্রাহ্মণদের মধ্যস্থতার প্রয়োজন নেই। দলে দলে মানুষ হরিচাঁদের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং যাঁরা তাঁর 'মত' গ্রহণ করেন তাঁরাই মতুয়া নামে পরিচিত হন। হরিলাঁদ ঠাকুরের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র গুরুচাঁদ ঠাকুর (১৮৪৭-১৯৩৭) মতুয়া আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। মূলত তাঁরই উদ্যোগে ১৯১১ সালের লোকগণনায় 'চণ্ডাল' নামের বদলে 'নমঃশূদ্র' নাম ব্যবহৃত হয়। নমঃশূদ্র ছাড়াও আরও অনেক নিম্নবর্ণের মানুষ যেমন, কাপালি, পৌণ্ড্র, গোয়ালা, মালো, ও মুচি মতুয়া আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর পিতার নির্দেশের সঙ্গে গুরুচাঁদ যুক্ত করেন শিক্ষা বিস্তারের এবং জমিদার-বিরোধী আন্দোলনের কর্মসূচি। এ ছাড়াও তিনি অস্পৃশ্যতা দূরীকরণ, সাম্প্রদায়িক ঐক্য প্রতিষ্ঠা এবং গণস্বাস্থ্যের উপর খুব নজর দেন। কোনও গ্রামের মানুষ তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করার জন্য এলে তিনি তাদের কাছে এই শর্ত রাখতেন যে গ্রামে প্রথমে একটি স্কুল স্থাপন করতে হবে এবং মাঠে-ঘাটে মলত্যাগ না-করে বাড়িতে পায়খানা বানাতে হবে। অষ্ট্রেলীয় মিশনারি মিড সাহেবের সহায়তায় তিনি বহু স্কুল করতে সক্ষম হয়েছিলেন। যুগ যুগ ধরে যে মানুষেরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। তাঁর বাণী ছিল, "তাই বলি ভাই মুক্তি যদি চাই বিদ্বান হইতে হবে পেলে বিদ্যাধন দুঃখ নিবারণ চিরসুখী হবে ভবে।" তাঁর সময়ে কিছু স্কুল থাকলেও তাতে অস্পৃশ্য শিশুদের প্রবেশের অধিকার ছিল না। কলকাতার সংস্কৃত কলেজে তো ব্রাহ্মণ (পুরুষ) ছাড়া আর কারও ভর্তি হওয়ার অধিকার ছিল না। ১৮৮০ সালে ওড়াকান্দি গ্রামে স্কুল স্থাপিত হয়। এটি ছিল নিম্নবর্ণের মানুষদের জন্য নিম্নবর্ণ মানুষদের দ্বারা স্থাপিত প্রথম স্কুল। শিক্ষা বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে নিম্নবর্ণের মানুষদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতাও বৃদ্ধি পায়। তা ছাড়া মতুয়ারা ছিলেন প্রধানত ভূমিহীন কৃষক। জমিদার ও মহাজনদের শোষণে জর্জরিত। তাই তাঁদের মধ্যে জমি সংক্রান্ত দাবি উঠে আসতে থাকে। ১৯২১ সালে বাংলার বিধান পরিষদে নমঃশূদ্র নেতা ভীষ্মদেব দাস এবং নীরদবিহারী মল্লিক তেভাগার দাবি উত্থাপন করেন। এঁরা দু'জনেই ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। ১৯৩৩ সালে ঘাটালে সারা ভারত কৃষক সভার সম্মেলনে গুরুচাঁদ নিজে যোগ দেন। এবং জমিদারি উচ্ছেদ ও তেভাগার দাবি রাখেন। ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বিধানসভার ৩০টি সংরক্ষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস মাত্র ৬টি আসন জেতে। বাকিগুলি নির্দলীয় প্রার্থীরা কংগ্রেসের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জেতেন। ৩০ জনের মধ্যে ১২ জন ছিলেন নমঃশূদ্র, যাঁদের মধ্যে মাত্র ২ জন ছিলেন কংগ্রেসের, বাকি ১০ জন ছিলেন গুরুচাঁদের অনুগামী। বিধানসভায় রায়তদের অধিকার সংক্রান্ত বিল পাশ করানোয় এঁদের ভূমিকা ছিল। গুরুচাঁদের মৃত্যুর পর রাজনৈতিক আন্দোলন হিসাবে মতুয়া আন্দোলন দুর্বল হয়ে যায়। ১৯৪৬ সালে নির্বাচনে বেশির ভাগ সংরক্ষিত আসন কংগ্রেস জিতে নেয়। তা সত্ত্বেও নমঃশূদ্র নেতা যোগেন মণ্ডলের উদ্যোগে বি আর অম্বেডকর বাংলা থেকে সংবিধান সভায় নির্বাচিত হন। দেশভাগের পর এবং বিশেষত ১৯৭১ সালের যুদ্ধের পর বহু নিম্নবর্ণের মানুষ উদ্বাস্তু হিসাবে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় আশ্রয় নেন। তবে এখনও এঁদের বেশ বড় একটা অংশ বাংলাদেশে রয়েছেন। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন অনুযায়ী তাঁদের নিরাপত্তাহীনতা বাড়ে কমে। ২০০৩ সালে এন ডি এ পরিচালিত সরকার যে নাগরিকত্ব আইন তৈরি করেছে তাতে উদ্বাস্তুদের বিশেষত ১৯৭১ সাল বা তার পরে আসা উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব প্রশ্নচিহ্নের মধ্যে পড়েছে। ৩০-৪০ বছর ধরে এ দেশে বসবাস করছেন এমন মানুষকেও 'বাংলাদেশি' বলে তাড়ানোর চেষ্টা চলছে। আর এক বার উদ্বাস্তু হওয়ার আশঙ্কা তাদের মধ্যে একটা নিরাপত্তাহীনতার জন্ম দিয়েছে। সেই অবস্থায় তাঁরা সর্বজনীন ভোটাধিকারকে ব্যবহার করে একটা রক্ষাকবচ আদায় করতে চাইছেন। এ বারের বিধানসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা তীব্র। রাজনৈতিক দলগুলির কাছে প্রতিটি ভোটই মূল্যবান। উদ্বাস্তুদের বড় অংশ বামপন্থীদের সঙ্গেই ছিলেন। কিন্তু বামপন্থীরা তাঁদের যথাযথ মর্যাদা দেননি। হরিচাঁদ ও গুরুচাঁদ বাংলার নিম্নবর্ণের মধ্যে নবজাগরণ ঘটিয়েছিলেন, এই ভূমিকা এখনও স্বীকৃতি পায়নি। ২০০৯ সালে লোকসভা নির্বাচনে ধাক্কা খাওয়ার পর বামপন্থীরা বিলম্বিত হলেও কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। তৃণমূল এবং বি জে পি যারা ২০০৩-এর নাগরিকত্ব আইন পাস করিয়েছেন তারাও মতুয়াদের মঞ্চে হাজির। তাঁরা নাকি মতুয়াদের দাবি সমর্থন করেন। অথচ মতুয়াদের প্রধান দাবি ছিল নাগরিকত্ব আইন (২০০৩)-এর সংশোধন। রাজ্যের আবাসন দফতরের মন্ত্রী গৌতম দেব প্রস্তাব করলেন যে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে নির্বাচিত ৪২ জন সাংসদ এক সঙ্গে দিল্লি গিয়ে মতুয়াদের দাবি পেশ করবেন। অতি উত্তম প্রস্তাব। কিন্তু কাজটা তো সেই ২০০৩ সালেই করা যেত, যখন ৪২ জন সদস্যের মধ্যে ৩৬ জনই বামফ্রন্টের ছিলেন। ভারতে সমাজে আধুনিকতার শর্ত হচ্ছে গণতন্ত্রের প্রসার। যুগ যুগ ধরে চলে আসা জাতি-বর্ণ ও অন্যান্য পরিচিতি ভিত্তিক শ্রম বিভাজনের বিলোপ। শুধু আইনের বইতে নয়, বাস্তব জীবনে। এই দিক থেকে দক্ষিণ ভারতের রাজ্য্যগুলোর সাফল্য বেশি। পশ্চিমবঙ্গ এখনও অনেক পিছনে। কোনও কোনও ব্যাপারে বিহারেরও পিছনে। মতুয়া আন্দোলনের প্রভাবে পশ্চিমবঙ্গে অবদমিত পরিচিতিগুলো সম অধিকার ও মর্যাদার জন্য সংগ্রামকে রাজনৈতিক মঞ্চে তুলে আনতে পারবেন কি না, ইতিহাসই বলবে। কিন্তু সন্দেহ নেই, পশ্চিমাঞ্চলে লাল মাটির দেশ থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গ পর্যন্ত আত্মপ্রতিষ্ঠার আওয়াজ মানুষকে আলোড়িত করেছে। মতুয়া আন্দোলন যদি নাগরিকত্ব প্রশ্নে সীমাবদ্ধ না থেকে গোটা সমাজের গণতন্ত্রীকরণের লক্ষ্যে অন্যান্য অবদমিত জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে হাত মেলাতে পারে, তা হলে তা এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে পারবে।
ভারতে বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের হাহাকারবাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নির্মাতা ঋত্বিক কুমার ঘটকের সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে 'মেঘে ঢাকা তারা' (১৯৬০), 'কোমল গান্ধার' (১৯৬১) এবং 'সুবর্ণরেখা' (১৯৬২) অন্যতম। চলচ্চিত্রগুলোতে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রুঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে। ঋত্বিক নিজে উদ্বাস্তু ছিলেন। বাপ দাদার পিতৃভূমি ঢাকা ছেড়ে গিয়েছিলেন '৪৭ সালে। থাকতেন কলকাতায়। তাই তিনি হয়তো বলেছেন কলকাতার উদ্বাস্তুদের কথা। কিন্তু সারা ভারতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রায় ১ কোটিরও বেশি বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই। ১৯৪৭ এর দেশবিভাগ এবং পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হায়েনাদের আক্রমণে নিজ স্বদেশ বাংলাদেশ ছেড়ে ভারতে গিয়ে উদ্বাস্তু হতে হয়েছে অনেক মানুষকে। ভারত বা বাংলাদেশ কোনো দেশের সরকারই সারা ভারতে ছড়িয়ে থাকা বাংলার এই আত্মীয় পরিজনের বেদনা ও বিপর্যয়ের কথা শুনছে না। এই উদ্বাস্তুদের কেউ কেউ দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ভারতের নাগরিকত্ব অর্জন করলেও এখন তা হুমকির মুখে। ভারত সরকারের বিমাতৃসুলভ আচরণের ফলে আজ তাদের হারাতে হচ্ছে নাগরিকত্বের অধিকার। যা কেবল অসাংবিধানিক আর চরম অমানবিকই নয়, আন্তর্জাতিক মানবিক অধিকার সনদেরও নির্মম লঙ্ঘন। পাকিস্তান সমকালে যে কোনো হিন্দু ভারতে এলেই নাগিরকত্ব পেত। কিন্তু ১৯৭২-এর ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির ভুল ব্যাখ্যায় তা বাতিল হয়ে গেল। সে অভিশাপ আজও প্রায় ১ কোটিরও বেশি হিন্দু বাংলাদেশীকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে। নাগরিকত্ব না থাকায় তাদেরকে সারাক্ষণ এক ভয়ানক বিপদের মধ্যে থাকতে হচ্ছে। ভারত সরকার পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুদের যেভাবে দেখেছে তার শতাংশ সুযোগও পায়নি বাংলার উদ্বাস্তুরা। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত বাঙালি ও পঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনের ক্ষেত্রে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের সীমাহীন বৈষম্যমূলক আচরণ তাই লক্ষ্য করার মতো। বাঙালিদের বড় অংশ আজ ক্ষেতমজুর আর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা পাঞ্জাবি উদ্বাস্তুরা জমি-মনিব। বাঙালি উদ্বাস্তুদের বড় অংশ আছেন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, আসাম এবং বিহার জুড়ে। পাঞ্জাবি উদ্বাস্তুদের এখানে ৮ একর থেকে ২০ একর জমি দেয়া হয়েছে। বিপরিতে বাংলার উদ্বাস্তুরা পেয়েছে ৩ একর থেকে মাত্র ১ কাঠা জমি পর্যন্ত। পরে '৭১ সালে যারা গিয়েছেন তারা কিছুই পাননি। তাদের নামই হয়ে গেছে 'উইদাউট'। এ যেন এক নতুন ধরনের বর্ণবিভাজন। যারা পশ্চিমবঙ্গে, ত্রিপুরায়, আসামে রয়ে গেছেন তাদের জন্য তবু কলোনি পত্তন হয়েছে। এর বাইরে যারা আছেন তাদের অবস্থা আরো মর্মান্তিক। ভাষা, সংস্কৃতি এমনকি বাঙ্গালী আত্মপরিচয়, সব কিছুই আজ হারাতে হচ্ছে তাদের। অধিকাংশেরই দুশ্চিন্তা ভোটার লিস্ট আর রেশন কার্ড নিয়ে। নাগরিকত্বের তো বালাই নেই। সারা ভারতে আজ বাংলাদেশী উদ্বাস্তুদের এই একই অবস্থা। আন্দামান ভারতের প্রাকৃতিক স্বর্গ। এখানে আগে ছিল ৪৬ শতাংশ বাঙালি, যার ৯৫ শতাংশই নমঃশূদ্রসহ দলিত মানুষ। বর্তমান পরিসংখ্যানটা ৪১ শতাংশের কাছাকাছি। তবুও বাঙালিই এখনো এখানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী। কিন্তু নিজস্বতার প্রায় কিছুই নেই। সর্বত্রই হিন্দি সংস্কৃতির থাবা। কেন্দ্রশাসিত এই অঞ্চলটি এখন 'এ' জোনে অর্থাৎ হিন্দিভাষী রাজ্য হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গেছে। সিলেবাস পাল্টে ফেলে বিজেপি'র আমলে এখানে রাতারাতি বাংলা ভাষাকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করে হিন্দি ভাষা জোর করে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে। বিহার ১৯৫১-র গণনায় বাঙালির সংখ্যা ছিল ১৮ লাখ ১৬ হাজার ১৭২ জন। পরে প্রায় ১ লাখ ২৪ হাজার বাঙালি উদ্বাস্তুকে দেশবিভাগের পর বিহারের পূর্ব ও পশ্চিম চম্পারন জেলায় বসবাস করতে পাঠানো হয়। কিন্তু ১৯৬১-র লোকগণনায় মোট বাঙালির সংখ্যা দেখানো হয় ১৭ লাখ ৫৯ হাজার ৭১৯ জন। অথচ হওয়া উচিত ছিল অন্তত ত্রিশ লাখ। আসলে চক্রান্ত দুদিকে। একদিকে বাংলার নানা উপভাষাগুলো ক্রমশ ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে হিন্দিতে। যেমন সুরজপুরিয়া, পাহাড়ি, লালপাহাড়ি, সাদরি, পাঁচপরগনিয়া, খোরটা কুর্মালি প্রভৃতি উপভাষা এখন হিন্দির দখলে। অন্যদিকে পূর্ববাংলা থেকে আগত উদ্বাস্তুদের কাউকে কাউকে জমি দেয়া হলেও দলিল দেয়া হলো না। তাদের নাগরিকতাও তাই দোদুল্যমান। গত দশকে চম্পারনের ২২ জন উদ্বাস্তু শিক্ষক হিসেবে সরকারের চাকরি পেলেও নাগরিকতার নিদর্শন না দেখাতে পারার জন্য চাকরিতে যোগদান করতে পারেননি। চাকরি ও প্রশাসনে কোনো দাম নেই বাঙালির মাতৃভাষার। সব ধরনের মাতৃ সংস্কৃতিহীন একটা হীন জাতিতে রূপান্তরিত হয়েছে বিহারের উদ্বাস্তু বাঙালিরা। সেখানকার স্কুল থেকে বাস্তবত বাংলা উঠে গেছে। দু-একটি কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় আছে। এতেও ছাত্র প্রধানত পশ্চিমবঙ্গ থেকেই যায়। বিহার থেকে উঠে আসে না। ঝাড়খণ্ড অভিজাত, অনভিজাত, তফসিলি জাতি ও জনজাতির প্রচুর বঙ্গভাষী মানুষ আছেন এ রাজ্যে। দু'কোটি জনসংখ্যার প্রায় ৪২ শতাংশ মানুষ বঙ্গভাষী। রাজ্যের ২৩টি জেলার মধ্যে ১৬টির ৭০ শতাংশ বঙ্গভাষী। অর্থাৎ ঝাড়খণ্ডের জনগণের ভাষাগত বিচারে প্রথম স্থান বাংলা। কিন্তু সেখানে বাংলাকে দ্বিতীয় ভাষার মর্যাদা দেওয়া হলো ঘোষণায়। কাজে এখনও তাও রূপায়িত হয়নি। অন্যদিকে হিন্দিকে রাজ্যের প্রশাসনিক ভাষা করা হয়েছে। এনসিইআরটি'র সিলেবাসের নাম করে আন্দামানের কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এক রাতে মাতৃভাষার মাধ্যম পাল্টে হিন্দি করে দেয়া হয়েছে। এটা নিয়ে সম্প্রতি কলকাতার বাংলা আকাদেমি হলে একটি সভার আয়োজন করা হয়। 'বাংলার বাইরে বাঙালি সহায়ক সমিতি সহমর্মী'র উদ্যোগে এই সভা সর্বসম্মতভাবে একটি দাবিপত্র গ্রহণ করে। দাবিপত্রটির শিরোনাম দেয়া হয়, 'বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাসহ মাতৃভাষায় পড়ার অধিকার'। এই দাবিপত্রে বলা হয়েছে, ১. ঝাড়খণ্ডে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে জাতীয় শিক্ষা গবেষণা ও প্রশিক্ষণ পরিষদের (এনসিইআইটি) সিলেবাস প্রচলন স্থগিত রেখে বাংলা মাধ্যমে পাঠ্যপুস্তক সরবরাহ করার জন্য ঝাড়খণ্ড সরকারকে অবিলম্বে নির্দেশ প্রদান করুন। ২. এনসিইআরটি'র বই কেবলমাত্র হিন্দি, ইংরেজি ও উর্দু মাধ্যম পাওয়া যায়। অবিলম্বে সমস্তরের বই ভারতের দ্বিতীয় প্রধান ভাষা বাংলায় অনুবাদ করা হোক। এছাড়া এনসিইআরটি'র যেসব বইতে বিষয়বস্তুর ধর্মীয়করণ ও তথ্য বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে তা বন্ধ করতে হবে। সংশোধিতভাবে প্রকাশিত বই বাংলাসহ অন্যান্য ভাষায় অনুবাদ করতে হবে। ৩. আন্দামানে গত পঞ্চাশ বছর ধরে বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে হিন্দি মাধ্যমের বই পাঠ্যতালিকাভুক্ত করা আছে। অবিলম্বে তা বন্ধ করে বাংলা মাধ্যমের বই অনুবাদ, প্রকাশ ও সরবরাহের জন্য এনসিইআরটি কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয়া হোক। ৪. প্রতিটি রাজ্যে বাংলাসহ সংখ্যালঘু ভাষাভাষীদের জন্য সেই রাজ্যের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়, প্রত্যেকটি স্বীকৃত মাতৃভাষায় ১০০ নম্বরের একটি করে বিষয় রাখবার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক হোক। যা জাতীয় সংহতিকে সুদৃঢ় করবে এবং জাতীয় ভাষাগুলোর প্রাসঙ্গিকতাকে জীবন্ত করে তুলবে। ৫. পশ্চিমবঙ্গের মতো ভারতের প্রতিটি রাজ্যে স্কুল কলেজ স্তরে সংখ্যালঘু ভাষা হিসেবে মাতৃভাষাসমূহকে অন্যতম প্রধান ভাষা হিসেবে পড়াবার সুযোগ প্রদান করা হোক। উত্তর প্রদেশ ও উত্তরাঞ্চল এখানকার নমঃশূদ্র, পৌণ্ড্র ক্ষত্রিয়, রাজবংশী, ধোপসহ বিভিন্ন তফসিলি জাতির মানুষকে প্রথম দিকে তফসিলি জাতি হিসেবে স্বীকার করা হলেও এখন তাদেরকে সে অনুযায়ি কোনো সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে না। বাংলা পড়ার ব্যবস্থা যা ছিল তা বাদ দিয়ে সেখানে সংস্কৃতি করা হয়েছে। এ অঞ্চলের দশটি জেলায় প্রায় ১৪ লাখ উদ্বাস্তু বাঙালির বসবাস। যাদের বড় অংশ এখন দিনমজুর। পুনর্বাসনের সময় এদের অল্প কিছু পরিবার প্রায় ৮ একর ও ৩ একর জমি পায়। পরেও অনেক উদ্বাস্তু দলিত মানুষ গেছেন। যাদের কোনো জমি নেই। কারো আছে এককাঠা-দেড়কাঠা বাস্তুজমি। এবং এই বাস্তুভিটা ও জমিহীনদের পাড়া হলো 'উইদাউট' পাড়া। ঘরের মধ্যে পূর্ববাংলার আঞ্চলিক বাংলা। বাইরে হিন্দি। নতুন প্রজন্ম বাংলা পড়তেও জানেনা। আসাম পূর্ববাংলা থেকে যেসব মানুষ দেশভাগের সময় ভারতে এসেছে তাদের প্রধান অংশ পশ্চিমবঙ্গে আর দ্বিতীয় প্রধান অংশ গিয়েছে আসাম ও ত্রিপুরায়। ১৯ মে'র ১১ জন শহীদের বলিদানে বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা বাংলার অধিকার সংরক্ষিত হলেও উক্ত চারটি জেলা হাইলাকান্দি, শিলচর, কাছাড় ও করিমগঞ্জ বাদে সর্বত্র, বাঙালিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগিরকের মতো সন্ত্রস্ত জীবন। বাঙালিরা বরাকে অধিকার রক্ষা করতে পারলেও ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় তাদের হাতে মৃত্যুর ফরমান। জোর করে বোরো আর খাসিয়া উগ্রপন্থী নামের আড়ালে গোটা প্রশাসন বাঙালি বিতাড়নের সমস্ত চক্রান্ত করছে। মাতৃভাষা যাদের অভিব্যক্তি। শ্রম যাদের মূলধন। তাদের তো কলকাতায় জমি কেনার টাকা নেই। এসব বাঙালিরা এখন দিন রাত কাটাচ্ছেন দুর্ভাবনা আর দুঃস্বপ্নের বলয়ে। মেঘালয়, মিজোরাম, মণিপুর এ অঞ্চলের সব কিছুর হর্তাকর্তা হল ফেডারেশন অব খাসিয়া জয়ন্তিয়া গারো পিউপিল অথবা খাসি স্টুডেন্ট ইউনিয়ন (কে.এস.ইউ)। এ অঞ্চলে ভারতের গণতান্ত্রিক শাসন নয়, চলে খাসিয়াদের দরবারি শাসন। তারাই এখানে বিকল্প প্রশাসন চালায়। ব্যবসায়ীর লাইসেন্সও তারা মানে না। আর গরিব দলিত উদ্বাস্তুদের তো কথাই নেই। লাখ খানেক অসহায় বাঙালির উপায় নেই বলে বসবাস করে এখানে। কাজ করে ন্যায্য দিনমজুরিও পায় না এখানকার হতদরিদ্র বাঙারি উদ্বাস্তুরা। এসব বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসবাদের মদতদাতা ছিল আগে খ্রিস্টান মিশনারিগুলি। এখন ভিন্ন ধারার রাজনীতি দ্বারা এরা নিয়ন্ত্রিত হয় বলে জানা গেছে। এদিককার বনাঞ্চলে ৮০ হাজার বর্গমাইল এলাকাজুড়ে একটি বাঙালি আবাসন প্রকল্প করার কথা ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে মাত্র ৩০ হাজার বর্গমাইল এলাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এজন্য। এর পেছনে কারণ ছিল, ভারতীয় হিন্দুবাদীরা সরকারকে প্রভাবিত করেছিল এই বলে যে, এত বড় এলাকা দেয়া হলে পরবর্তীতে বাঙালিরা এটাকে রাজ্য ঘোষণা করতে বলবে। এবং এই বাংলাদেশী উদ্বাস্তুরাই হয়ে উঠবে একটি রাজ্যের মালিক। এসব কুমন্ত্রণা দেয়ার ফলেই কেন্দ্রীয় সরকার জমির বরাদ্দ কমিয়ে দেয়। ছত্তিশগড় ছত্তিশগড়ে মনে করা হয় বাঙালিমাত্রেই বর্ণহিন্দু, অন্তত কাগজে-কলমে। বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত উচ্চবর্ণের হিন্দুরা গিয়ে সেখানে থাকছেন তাদেরও একই অবস্থা। তাই তাদের কারো কাস্ট সার্টিফিকেট নেই। পুলিশসহ অন্যদের সবার মাস্তানির শিকার এই নিরীহ বাঙালিরা। সংস্কৃতিও এই থাবার বাইরে নয়। বাংলা ভুলে যেতে বাধ্য পরবর্তী প্রজন্ম। মাতৃভাষা শিক্ষার, মাতৃসংস্কৃতি চর্চার কোনো পরিবেশ এখানে নেই। উড়িশ্যা উড়িশ্যার সাংস্কৃতিক বিকাশের সূচনা বাংলায়। কলকাতায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে উড়িশ্যার সঙ্গে নানা কারণে বাংলার দূরত্ব তৈরি হয়। এখন বাঙালিরা এখানে তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে উঠছেন। উদ্বাস্তুরা যেন যুদ্ধে পরাজিত বাহিনী। যে কোনো অত্যাচার, অপমান, লাঞ্ছনা তাঁদের প্রাপ্য। কলকাতায় বসে যে কোনো উড়িয়াভাষী তার সন্তানকে মাতৃভাষায় উচ্চশিক্ষা দিতে পারেন। কিন্তু উড়িশ্যার স্কুলগুলোতে বাংলা পড়ার কোনো সুযোগ নেই। অন্যদিকে চাকরি ইত্যাদি ক্ষেত্রে বাঙালি উদ্বাস্তুরা দ্বিতীয় কি তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিক। বাংলা ওখানে যেমন 'ছোট উড়িয়া' তেমনি বাঙালিরা আজ এখানে 'ছোটলোক'। নবরঙপুর, উমরকোট, বাইঘরা, ওরাসিংহা, কাঁচড়াপারা, সর্বত্র ওরা এমন কি বাঙালি উদ্বাস্তুদের দোকানপাট ঘরদোর, পুড়িয়ে দিচ্ছে। আক্রমণ হানছে। নারীদের লাঞ্ছিত করছে। পুলিশ এসে বাঙালিদেরই উচ্ছেদ করছে, ধরে নিয়ে যাচ্ছে। আর কেন্দ্রীয় সরকারের বাংলাভাষী মাত্রেই বাংলাদেশি হিসেবে চিহ্নিতকরণ এখানে অন্য এক পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। এতে ভারতীয় বাঙালিদের অবস্থাও হয়ে পড়েছে ত্রিশঙ্কু। মহারাষ্ট্র এখানেও বাংলাদেশী উদ্বাস্তু এবং বাঙালিদের অবস্থা ভালো কিছু নয়। ভাষা রক্ষা এবং মাতৃভাষায় পড়ার অধিকার নিয়ে এখনো বাঙালিরা সেখানে সংগ্রাম করছে। মহারাষ্ট্র সরকার হতে মাতৃভাষা বাংলায় প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থার আদেশ দেয়া না হলে মহারাষ্ট্র রাজ্যের গড়চিরোলি জেলার ১৫টি বাঙালি পুনর্বাসনপ্রাপ্ত গ্রামের জেলা পরিষদের প্রাথমিক স্কুলগুলো বন্ধ করে ভীষণ আন্দোলন শুরু করা হবে বলে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগে লিখিতভাবে জানান দিয়েছিল বাঙালিরা। ভাষা যেখানে হুমকির মুখে অন্য কোনো অধিকার নিয়ে সেখানে ভাববার অবকাশ নেই। দিল্লি ২০০১ সালে দিল্লি কোর্টে একটি মামলা করে বলা হয় দিল্লিতে ২৮ লাখ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী আছে। পরে ওই মামলায় স্বীকার করা হয় ১৩ লাখ বাংলাদেশি এসেছে। এবং বিশ্ব হিন্দু পরিষদ দায়িত্ব নিতে চায় এদের চিহ্নিত করে তাড়ানোর। ফলে আজন্ম লালিত বাঙালি-বিদ্বেষী নানা শক্তি সারা ভারতসহ রাজধানীর এই বাংলাভাষী দরিদ্র মানুষকে নানা অজুহাতে প্রতিদিন তাড়া করে ফিরছে, হয়রানি করছে। এদের নির্যাতনে আজ অনেক বাঙালি এখান থেকে উৎখাত হচ্ছেন। নিরুপায় হয়ে অনেকেই পা বাড়াচ্ছেন পশ্চিমবঙ্গের দিকে। পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি হায়েনাদের অথবা উগ্র মুসলিম মৌলবাদীদের অত্যাচারে, নিষ্পেষণে, রক্তাক্ত আগ্রাসনে দেশ ছেড়ে এসে আজ এই ১ কোটি মানুষ পুরোপুরি নিঃস্ব। সারা ভারতের কোথাও তাদের জায়গা নেই। উত্তরবঙ্গেও বিদেশি মদতে গড়ে উঠেছে দক্ষিণবঙ্গের বাঙালিবিদ্বেষী শক্তি। তারা পূর্ব বাংলার উদ্বাস্তুদের 'ভাটিয়া' নামে চিহ্নিত করে এদের হটানোর আন্দোরনে মাঠে নেমেছে। আত্ম সংস্ক্রতি রক্ষার ধোঁয়া তুলে এ আন্দোলন সামনে এলেও তাদের আচলের তলায়ও বিদেশি অস্ত্র এবং পেছনে রয়েছে দেশী উগ্রপন্থার ইন্দন। নাগিরকত্ব আইনের নয়া জুজু এ সব কিছুকে ছাপিয়ে এখন যে বিষয়টি আলোচনায় তা হচ্ছে, নাগরিকত্ব আইন। এই আইনটি অনেক দিনের হলেও ইদানিং যেন এটি নবজীবন লাভ করেছে। এই আইনের বলে কলকাতার প্রায় দেড়হাজার বাংলাদেশী উদ্বাস্তুকে কিছু কাল আগে অবিলম্বে ভারত ত্যাগ করার ফরমান ধরিয়ে দেয়া হয়েছে। একই ঘটনা ঘটছে মহারাষ্ট্রে, বিহারে, উত্তরপ্রদেশে। পুনর্বসতিপ্রাপ্ত ঘরের ছেলেমেয়েরা চাকরি ও পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে তারা এদেশের নাগরিকই নয় এই অভিযোগে। এমনকি, পশ্চিমবঙ্গে গত বিধানসভা নির্বাচনে, নির্বাচন কমিশনের প্রতিনিধি ৫০ লাখেরও বেশি লোকের নাম ভোটার লিস্ট থেকে বাদ দিয়েছে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারী এই অভিধায়। কলকাতার নদীয়া জেলাতেই পুলিশের তাড়ায় কত পরিবারকে রাত কাটাতে হয়েছে ঝোপে জঙ্গলে। তার ইয়ত্তা নেই। সংশোধিত (২০০৩) নাগরিকত্ব আইনে বলা হয়েছে ১. ভারতের সংবিধানের ৬ নং অনুচ্ছেদের (ক) ধারা মোতাবেক ১৯৪৮ সালের ১৮ জুলাইয়ের পরে পূর্ববঙ্গ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যারা ভারতে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন, অথচ এখনো নাগরিকত্ব নিবন্ধীকরণ করেননি, তারা সকলে বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে গণ্য হবেন। যদি না তারা ভারতে প্রবেশ ও বসবাসের বৈধ সরকারি অনুমতিপত্র দেখাতে পারেন। লক্ষণীয় বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী সংজ্ঞাটি এই বিলে নতুন সংযোজিত হয়েছে। এ সংজ্ঞাটির মাধ্যমে বৈধ অনুমতিপত্র ব্যতীত পুর্ববঙ্গ থেকে ভারতে আগত প্রায় ১ কোটিরও বেশি পূর্ববঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষদের বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত করা যাবে। ২. বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিরা ১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৫/১(ক) ও (গ) ধারা অনুসারে নাগরিক হওয়ার আবেদন করারও অযোগ্য বলে গণ্য হবেন। ৩. বে-আইনি অনুপ্রবেশকারী হিসেবে চিহ্নত ব্যক্তিদের সন্তান সন্তুতিরা যদি ভারত ভূমিতে জন্মগ্রহণ করেও, তথাপি তারা ভারতের নাগরিকত্ব লাভের অধিকারী হবে না। ৪. শুধু তাই নয়, উক্ত বে-আইনি অনুপ্রবেশকারীরা ভারতের জাতীয় পরিচয়পত্র থেকে বঞ্চিত হবেন এবং বে-আইনিভাবে ভারতে বসবাস করার জন্য ৫ বছর পর্যন্ত জেল এবং ৫০ হাজার টাকা জরিমানাসহ তাদের পূর্ববর্তী বাসভূমিতে ফেরত পাঠানো হবে। ভারত সরকার কেন বাংলাদেশি হিন্দুদের কথা ভিন্নভাবে বিচার করবে না? একটু আলাদা সুযোগ কি তাদের প্রাপ্য নয়? এ দাবি তোলা হয়েছে বিভিন্ন মহল থেকে। তা সত্ত্বেও কিন্তু সরকার নীতির পরিবর্তন বা শৈথিল্য কিছুই দেখাননি। উল্টো আদালত বারবার সরকারকে চাপ দিয়ে বলছে, আগামী কয়েক মাসের মধ্যে সমস্ত বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকারীদের এদেশ থেকে বিতাড়িত করতে হবে। চোখে মুখে হতাশা আর দুশ্চিন্তার ছাপ ১ কোটি উদ্বাস্তু বাংলাদেশীর। তাদের পাশে দাঁড়ানোর কেউ নেই! http://www.nagorikblog.com/node/1198
দেড় কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু নাগরিকত্বের পথ চেয়ে রয়েছে
সুকুমার মিত্র | ডিসেম্বর 24, 2011 14:03
বাঙালি উদ্বাস্তদের সমস্যা জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে৷ ়এবার আন্দোলনে সামিল হচেছ সিপিএমও৷ তবে সর্বভারতীয় সমস্ত রাজনৈতিক দলই বাঙালি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের সমস্যা নিয়ে সরব হয়েছে৷ দিল্লির যন্তর মন্তরে অনশন আন্দোলনে ঠাকুরনগরের মতুয়া মহাসংঘের ঠাকুরবাড়িতে যাঁরা আন্দোলন শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহল সিং তাঁদের ডেকে পাঠান ও বৈঠক করেন৷ দিল্লিতে জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর বাঙালি রিফিউজিস-এর ব্যানারে মূলতঃ সেই মতুয়াদেরই অনশন আন্দোলনের ফলে প্রধানমন্ত্রী তাঁর দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রী ভি নারায়ন স্বামীকে অনশন মঞ্চে পাঠান দূত হিসেবে৷ জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি ফর, বাঙালি রিফিউজিস এর পক্ষে সুকৃতিরঞ্জন বিশ্বাস দ্য সানডে ইন্ডিয়ানকে জানিয়েছেন, ভারতে প্রায় দেড় কোটি বাঙালি উদ্বাস্তু রয়েছে৷ যাদের কোনও পরিচয়পত্র নেই৷ এমনকী ভোটার তালিকায় তাদের কোনও নাম নেই৷ বিশাল জনগোষ্ঠী পরিচয়হীনভাবে দীর্ঘদিন বসবাস করবেন এটা চলতে পারে না৷ এঁদেরকে বৈধ নাগরিকত্ব দিয়ে দেশভাগের ফলে উদ্ভুত সমস্যার একটা স্হায়ী সমাধান প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন৷ তাঁর দাবি, ভারত সরকার আগের তুলনায় এই সমস্যা নিয়ে অনেক বেশী সংবেদনশীল মনোভাব নিয়ে বিষয়টি দেখছে৷ শীঘ্রই প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তাঁর সরাসরি এই সমস্যা সমাধানের প্রক্রিয়া চালু করার পদক্ষেপ দ্রুত চালু করার বিষয় নিয়ে আলোচনা হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে৷ সাংসদ রামদাস আতাউলে ছাড়াও এবার উদ্বাস্তু সমাজ ও গণতান্ত্রিক মানুষের এই আন্দোলনের সমর্থনে এগিয়ে এসেছেন সিপিএম সাংসদ বৃন্দা কারাত৷ তিনি 28 নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীকে অনশনের কথা জানিয়ে চিঠি লেখেন৷ অনশন মঞ্চে এসে কংগ্রেস সাংসদ বাবা কে সি সিং, প্রাত্তুন সাংসদ ও ফরওয়ার্ড ব্লকের সর্বভারতীয় সাধারন সম্পাদক দেবব্রত বিশ্বাস, সিপিআই নেতা ডি রাজা, কংগ্রেস নেতা ও সাংসদ কেশভ রাও, প্রাত্তুন সিপিএম সাংসদ অসীম বালা, সিপিআইএম-এল নেতা কার্তিক পাল, সমাজকর্মী ডা. বিনায়ক সেনরা সংহতি জানিয়েছেন আন্দোলনকারীদের সমর্থনে৷ অনশনের প্রথম দিন তো বটেই রাষ্ট্রমন্ত্রী ভি নারায়ন স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি মঞ্চেও আসেন৷ শুধু সিপিএম নয়, দিল্লিতে অনশন মঞ্চে মাওলানা সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী, সাংসদ মাওলানা মাহমুদ মাদানি এবং সাংসদ রামবিলাস পাশোয়ানকে অনশন মঞ্চে নিয়ে আসেন৷ 1948 বা 1971 এর কোন কাট৲ অফ ডেট মানতে রাজি নন আন্দোলনকারীরা৷ তাদের মতে কাট৲ অফ ডেট করতেই হয়, তা করা হোক 31ডিসেম্বর, 2011৷ রামবিলাস পাশোয়ান মনে করেন, এই নীতির ফলে যদি 2-5 শতাংশ মুসলিম ভারতীয় নাগরিকত্ব পান তাতে আপত্তি নেই৷ তাতে 98-99 শতাংশ হিন্দু উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব সমস্যার সমাধান হবে৷ এই প্রসঙ্গে স্বরাষ্ট্র দফতরের রাষ্ট্রমন্ত্রি জিতেন্দ্র সিং- এরসঙ্গে আন্দোলনকারীরা দীর্ঘ আলোচনাও করেন৷ মাওলানা মাহমুদ মাদানি সাহেব জানিয়েছেন যে, তিনি ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও সনিয়া গান্ধিকে চিঠি লিখেছেন৷ দিল্লি থেকে অনশনের পর আন্দোলনকারীরা ফিরে আসার পর উত্তর চব্বিশ পরগনার হূদয়পুরে আম্বেদকর মিশনে জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটির এক সভা হয়৷ ওই সভায় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে 250 জন প্রতিনিধি অংশ গ্রহণ করেন৷ http://www.thesundayindian.com/bn/story/%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%A1%E0%A6%BC-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%9F%E0%A6%BF-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%99%E0%A6%BE%E0%A6%B2%E0%A6%BF-%E0%A6%89%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%81-%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%97%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%95%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AA%E0%A6%A5-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A7%87-%E0%A6%B0%E0%A7%9F%E0%A7%87%E0%A6%9B%E0%A7%87/14/1078/ পঞ্চায়েতের আগে গ্রামে চোখ, মন্ত্রিত্বে নতুন মুখ http://www.anandabazar.com/21raj1.html
সরকারের দেড় বছর পূর্ণ করে তাঁর মন্ত্রিসভায় আরও ৮ নতুন মুখ আনছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। নতুন মন্ত্রীদের সম্ভাব্য তালিকায় গ্রামবাংলার প্রাধান্যই উল্লেখযোগ্য। একই সঙ্গে মন্ত্রিসভায় স্থান পাচ্ছেন সদ্য কংগ্রেসত্যাগী দুই বিধায়ক। তৃণমূল শিবিরের ব্যাখ্যায়, আসন্ন পঞ্চায়েত ভোটের দিকে নজর রেখেই মন্ত্রিসভায় রদবদল ঘটাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজভবনে আজ, বুধবার দুপুরে নতুন মন্ত্রীদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হওয়ার কথা। নতুন মন্ত্রী নেওয়ার পাশাপাশিই মন্ত্রিসভার পুরনো সদস্যদের মধ্যে পাঁচ জনের পদোন্নতি ঘটছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। এর মধ্যে মদন মিত্র, অরূপ বিশ্বাস, সুব্রত সাহা ও মঞ্জুলকৃষ্ণ ঠাকুর পূর্ণমন্ত্রী পর্যায়ে উন্নীত হতে পারেন। চন্দ্রিমা ভট্টাচার্যকে স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী করার কথা। সরকারি সূত্রে মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত যা খবর, নতুন মন্ত্রী হিসাবে আসছেন হাওড়ার রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্টুরাম পাখিরা ও গিয়াসুদ্দিন মোল্লা, বর্ধমানের স্বপন দেবনাথ, নদিয়ার পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা, হুগলির বেচারাম মান্না, মালদহের কৃষ্ণেন্দু চৌধুরী এবং মুর্শিদাবাদের হুমায়ুন কবীর। শেষ দু'জন এ দিনই তৃণমূলে যোগ দেওয়ার জন্য কংগ্রেসের বিধায়ক পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। নবাগতদের মধ্যে কৃষ্ণেন্দু ও রাজীবের পূর্ণমন্ত্রী হওয়ার কথা। মন্টুরাম হচ্ছেন স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিমন্ত্রী। বাম আমলে মন্ত্রিসভায় 'কাজের লোকে'র বদলে জেলার কোটা পূরণ বেশি গুরুত্ব পেত বলে বিস্তর সমালোচনা হত। তৃণমূলের শাসনে দেড় বছরের মাথায় নতুন মুখ অন্তর্ভুক্তি নিয়েও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। পুরনো মন্ত্রীদের মধ্যে যাঁদের মর্যাদা বাড়ানো হচ্ছে, তাঁদের কয়েক জনের পারফরম্যান্স নিয়ে জনমানসেই প্রশ্ন আছে। আবার নতুন মুখদের মধ্যে কয়েক জনের এলাকায় ভাবমূর্তি স্বচ্ছ নয়। স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী দলে তাঁর ঘনিষ্ঠ মহলে বলেছেন, মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণে তিনি গ্রামের প্রতিনিধিদেরই গুরুত্ব দিয়েছেন। নতুন ৮ জনের মধ্যে আবার সংখ্যালঘু দু'জনও রয়েছেন। এমনিতেই বিধানসভা ভোটের আগে ছোট মন্ত্রিসভা গড়ার ঘোষণা করে শেষ পর্যন্ত সর্বোচ্চ সংখ্যক মন্ত্রীই নিয়েছিলেন মমতা। এ বারের সম্প্রসারণেও পঞ্চায়েত ভোটের আগে তৃণমূলের রাজনৈতিক তাগিদই গুরুত্ব পাচ্ছে। ফলে, এই সম্প্রসারণ এবং রদবদলে সরকারি কাজে কাঙ্খিত গতি আসবে কি না, তা নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে প্রশাসনিক মহলে। এরই মধ্যে ফের এক প্রস্ত বিভ্রান্তি এবং নাটক হয়েছে উত্তর কলকাতার তৃণমূল বিধায়ক শশী পাঁজাকে ঘিরে। মুখ্যমন্ত্রী এ দিনও দলীয় মহলে প্রস্তাবিত যে নতুন মন্ত্রীদের নাম বলেছিলেন, তাতে শশীদেবী ছিলেন। তখন নতুন মন্ত্রীর তালিকা ছিল ৯ জনের। পরে রাতে সরকারি স্তরে যে তালিকা মোটামুটি চূড়ান্ত হয়েছে, তাতে শশীদেবীর নাম নেই বলেই সরকারি সূত্রের খবর। এর আগেও এক বার স্রেফ কলকাতায় উপস্থিত না-থাকায় তাঁর নাম উঠেও কাটা গিয়েছিল! শেষ মুহূর্তে শপথের সময় ঠিক হয়েছিল, যখন শশীদেবী কলকাতায় ছিলেন না! এক বাম বিধায়কের কটাক্ষ, "সরকার হওয়ার পরে প্রথম শপথের দিনই কাশীনাথ মিশ্রের নাম ঘোষণা করেও বাতিল হয়েছিল। এখনও সেই ট্র্যাডিশন চলছে! শপথ না-নেওয়া পর্যন্ত বলা সম্ভব নয়, কে মন্ত্রী হচ্ছেন!" রাজ্যের মোট ২৯৪ জন বিধায়কের মধ্যে নিয়মানুযায়ী ১৫%-কে মন্ত্রী করা যায়। সেই হিসাবে রাজ্যে সর্বাধিক ৪৪ জন মন্ত্রী হতে পারেন। কংগ্রেস সরে আসার পরে মন্ত্রিসভার সদস্যসংখ্যা এখন ৩৬। এর সঙ্গে নতুন ৮ জন যোগ হলে হলে সর্বোচ্চ সীমার ৪৪ জনই মন্ত্রী হবেন। নতুন মুখ নেওয়ার পাশাপাশিই সুন্দরবন উন্নয়ন প্রতিমন্ত্রী শ্যামল মণ্ডলের মতো কেউ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ যেতে পারেন কি না, তা নিয়ে জল্পনা রয়েছে প্রশাসনিক মহলে। যে হেতু দক্ষিণ ২৪ পরগণা থেকেই আরও দু'জন নতুন মন্ত্রী আসছেন, তাই শ্যামলের উপরে কোপ পড়তে পারে বলে তৃণমূলেরও একটি সূত্রের অভিমত। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এ দিন মহাকরণ থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সময় মদন ও অরূপের মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করেন। যার ব্যাখ্যায় পরিষদীয় মন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেছেন, "ধরে নিন যাঁদের মাথায় হাত রাখলেন মুখ্যমন্ত্রী, তাঁরা পূর্ণমন্ত্রী হচ্ছেন!" প্রসঙ্গত, এ দিনই বিধানসভায় গিয়ে স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে বিধায়ক-পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন রেজিনগরের হুমায়ুন ও ইংরেজবাজারের কৃষ্ণেন্দু। কংগ্রেস নেতৃত্বের উপরে ক্ষোভ অভিমানেই তাঁরা তৃণমূলে যোগ দিতে বাধ্য হলেন বলে আরও এক বার দাবি করেছেন তাঁরা। কিন্তু কংগ্রেস ভাঙিয়ে মন্ত্রী করার ঘটনায় অন্য রকম প্রতিক্রিয়াও তৈরি হচ্ছে। দুই পদত্যাগী বিধায়ককে নিয়ে সরাসরি মন্তব্য করতে না-চাইলেও কংগ্রেসের প্রাক্তন মন্ত্রী মানস ভুঁইয়ার প্রশ্ন, "কংগ্রেস-তৃণমূল জোট বেঁধে রক্ত-ঘাম ঝরিয়ে সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করার পরে যে মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে অনাস্থায় সমর্থন চাইতে আলিমুদ্দিনে যাওয়ার কথা বলেন, তাঁদের কাছে কী নীতি-দর্শন প্রত্যাশা করা যায়?"
|
ওঁরা মন্ত্রী হলেন | নাম: হুমায়ুন কবীর ডাকনাম: খবির বয়স: ৪৯ শিক্ষা: মাধ্যমিক পাশ পেশা: কখনও ইটভাটা, কখনও বা 'ট্রান্সপোর্টের কারবার'। বেশ চলছে। কী ভাবে রাজনীতিতে: দাদা গোলাম মৌলা ছিলেন পঞ্চায়েতে নির্দল প্রার্থী। পরে অতীশ সিংহের হাত ধরে ১৯৭৭-এ কংগ্রেসের মিছিলে। বেলডাঙার কংগ্রেস বিধায়ক নূরুল ইসলাম 'রাজনৈতিক গুরু'। কংগ্রেসের টিকিটে ৯৩-এ সোমপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে দাঁড়িয়ে হার। তারপর কখনও কংগ্রেস কখনও বা তৃণমূলের টিকিটে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ। সুবিধে হয়নি তেমন। শেষতক অধীর চৌধুরীর বদান্যতায় দেড় বছর আগে কংগ্রেসের টিকিটে রেজিনগরের বিধায়ক। সম্পত্তি: নিজের আর ছেলের নামে রেজিগরে দু'টি বাড়ি। পিতা-পুত্রের দু'টি বাজখাই গাড়ি— স্করপিও আর হুন্ডাই। রয়েছে খান কতক বাইকও। প্লাস পয়েন্ট: সবার সঙ্গে মেলামেশা করেন। মাইনাস পয়েন্ট: বড্ড বেশি ডাকাবুকো! জনশ্রুতি: ঘন ঘন দল-বদল করতে ওস্তাদ। প্রতিশ্রুতি: "এখনই কিছু বলছি না। আগে দেখি কী দফতর পাই।"
|
| নাম: পুণ্ডরীকাক্ষ সাহা। ডাক নাম: নন্দদা। বয়স: ৫৮। শিক্ষাগত যোগ্যতা: বি.কম। পেশা: রাজনীতি, রাজনীতি এবং রাজনীতি। কী ভাবে রাজনীতিতে: ঠাকুর্দা ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। ছাত্রজীবন থেকেই 'পলিটিক্সে'। সত্তরের দশকে কংগ্রেসে হাতেখড়ি। তৃণমূল গঠনের শুরু থেকেই মমতার আস্থাভাজন। দলের ইচ্ছায় সরকারি চাকরি থেকে অবসর। ২০০১ সালে নবদ্বীপ বিধানসভা কেন্দ্রের তৃণমূল প্রার্থী। সিপিএমের প্রভাবশালী নেতা বিশ্বনাথ মিত্রকে হারান। সেই শুরু। তারপরে এক টানা ০১, ০৬ এবং ১১, তিন বারের বিধায়ক। ২০০৫-২০০৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নবদ্বীপের পুরপ্রধানের দায়িত্বে। এখনও তিনি নবদ্বীপ পুরসভার ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর। সম্পত্তি: ব্যক্তিগত কোনও সম্পত্তি নেই। পৈতৃক বাড়িতে পরিবারের অন্যদের সঙ্গে বসবাস। বিধায়ক ভাতা হিসেবে যা পান তাতেই চলে। প্লাস পয়েন্ট: সৎ ও সংযমী মানুষ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয়। মাইনাস পয়েন্ট: অসম্ভব রাশভারি। জনশ্রুতি: গোঁফ দিয়ে যায় চেনা! প্রতিশ্রুতি: আগে তো মন্ত্রী হই! | |
নীরবতার সংলাপ Posted by bangalnama on December 31, 2009 চমকে যাওয়ার মতোই তথ্য সব। মরিচঝাঁপি। নৈঃশব্দের অন্তরালে গণহত্যার এক কালো ইতিহাস – লিখেছিলেন জগদীশ মন্ডল। তৎকালীন দক্ষিণবঙ্গের এক সাংসদ শক্তি সরকারের সঙ্গে বারবার গিয়েছিলেন কাদামাটি আর সমুদ্রের নোনা জলের গন্ধ-মেশা হোগলা বনের দ্বীপে। তার পর সব চুপচাপ। বহু বছর কেটে গেল। ২০০৪-এ প্রকাশিত অমিতাভ ঘোষের বই 'দ্য হাঙরি টাইড' মরিচঝাঁপি দ্বীপে অল্পকাল-স্থায়ী কিছু ছিন্নমূল মানুষের কথা বৃহত্তর জনসমাজের কাছে নিয়ে এলো। সম্প্রতি দ্বিতীয়বার বইটি পড়বার সময় অনুভব করলাম স্বপ্নভঙ্গের যন্ত্রণা মানুষের জান্তব জীবনযন্ত্রণারও অধিক। এমনি একটা সময়ে "মরিচঝাঁপি ছিন্নদেশ, ছিন্ন ইতিহাস" পড়তে পড়তে মনে হল এ-সবই তো জানা ঘটনা, তিন দশক আগে আমাদের প্রজন্মের মানুষ জনকে যা সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আবার নতুন মাত্রায় দেখা দিল মরিচঝাঁপি। বারবার ঘুরে আসে কতগুলো নাম। সঙ্গে আসে আত্মবিস্মৃতির গ্লানি। আমাদের বঙ্গভূমির বুদ্ধিজীবি মানুষ হয়তো এমন করেই বেঁচে আছেন। নিজের কাছে লুকিয়েও হয়তো বা। সুখে সমৃদ্ধিতে ভালই তো আছেন। কী দরকার রাজশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে। শিরদাঁড়া একটু সামনে নুইয়ে দিলেই যখন রাজভোগের কিঞ্চিৎ উচ্ছিষ্ট হাতে এসে যায়। মরিচঝাঁপির অলস শান্ত দ্বীপে গোলাগুলি চলেছিল আজ থেকে প্রায় তিরিশ বছর পনেরো মাস আগে, নদীপারের কুমিরমারি অঞ্চলে। মরিচঝাঁপি থেকে কিছু খাদ্য আর পানীয় জল সংগ্রহ করতে এসেছিলেন নতুন বসতির উদ্বাস্তুরা। প্রস্তুত ছিল জ্যোতিবাবুর স্বরাষ্ট্রসচিব রথীন সেনগুপ্ত সাহেবের পুলিশবাহিনী। অন্তরালে অখন্ড ২৪ পরগণার পুলিশ সুপার অমিয় সামন্ত। গুলি চলল। বাঁচার স্বপ্ন শেষ হল না। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন বেশ কিছু মানুষ। কেউ বললেন অনেক। অমিয় সামন্ত বলেন মাত্র দুজন। শরীরে গুলি নিয়েও বেঁচে থাকলেন দু'একজন। হয়তো এখনও তাঁদের সন্ধান পাওয়া যায়। দমদম এলাকায় মরিচঝাঁপি নামের আস্ত একটি কলোনিই গড়ে ওঠে পরবর্তী সময়ে। তবে সেই মরিচঝাঁপি পর্বের যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা আর মুখ খুলতে সাহস পান না। এসব তথ্য তুষার ভট্টাচার্যের বহুকষ্টে নির্মিত তথ্যচিত্রের অংশমাত্র। এই সেদিনও মরিচঝাঁপির প্রথম প্রজন্মের ছেলে-মেয়েরা বলত তারা কিছু জানে না। অবশ্যই ভয়ে, অনুমান করা যায়। তুষারবাবুর ছবি দেখে আর ওঁর সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় বিষাদগ্রস্ত হয়েছিলাম। সেই গভীর বিষণ্ণতা শুধুই ওঁর তথ্যচিত্রের বিষয়বস্তু-উদ্ভূত নয়। এ বিষণ্ণতা সর্বজনীন মানবতার 'এভরিম্যানস ডেথ ডিমিনিশেস মি' – প্রত্যেক মানুষের মৃত্যুই আমাকে ক্ষয় করে। ঠিক তখনই হাতে এল এই বই; খসড়া আকারে। এক মানবতাহীন বামপন্থী সরকারের কলঙ্কিত ইতিহাসের খোঁজ। গাঙচিল-এর প্রকাশনা; সম্পাদনা করেছেন মধুময় পাল। প্রকাশের আলোয় ওই কালের এক অসাধারণ দলিল। মরিচঝাঁপি ছিন্ন দেশ, ছিন্ন ইতিহাস।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত উদ্বাস্তুরা, পিঁপড়ের সারির মতো, শুধু বেঁচে থাকার আর্তি সম্বল করে পশ্চিমবঙ্গে ঢুকেছিল। এইসব ছিন্নমূল মানুষগুলির বাসস্থান কোথায় দেওয়া হবে? দন্ডক বনে না কালাপানির দেশ আন্দামানে? ভারি গোল বাঁধিয়েছিলেন বামফ্রন্টের নেতারা। নেতারা। পশ্চিমমঙ্গেই হবে এইসব বাঙালিদের পুনর্বাসন। গড়ে উঠেছিল অসংখ্য উদ্বাস্তু কলোনি। শুধু কলকাতা বা শহরতলির আশেপাশেই না। উত্তরবঙ্গের বহু জায়গায় স্থান হয়েছিল, অবশ্য ওঁদের নিজেদের চেষ্টাতেই। তবুও স্থান সংকুলান করা যায়নি। আন্দামান দ্বীপমালা কিছুতেই নয়। অতএব বাধ্য হয়েই বহু পরিবারকে সরকার পাঠিয়েছিল দন্ডকারণ্যে – পশ্চিম ওড়িশা, মধ্যপ্রদেশের একাংশ (এখন যা ছত্তিশগড়) এবং অন্ধ্রের পাহাড়ি মালভূমি মিলিয়ে এই অঞ্চল। কেন্দ্রীয় সরকার দন্ডকারণ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের হাতে দায় সঁপে দিয়েছিলেন এইসব তথাকথিত নিম্নবর্গীয় বাঙালি উদ্বাস্তুদের। উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের প্রথম থেকেই লক্ষ্য ছিল সস্তা মজুরি অথবা যৎসামান্য ডোল দিয়ে উদ্বাস্তু মানুষগুলোকে খাটিয়ে কিছু নদীবাঁধ তৈরি করিয়ে জমি কিছুটা সেচ সেবিত করায়। চোলাই মদ তৈরি ছাড়া ওই সব অঞ্চলের মানুষদের জন্য অন্য কোনো ছোটশিল্পের উদ্যোগ ছিল না। দন্ডকারণ্যের পাথুরে জমি, শুকনো বাঁজা মাটি, আর অসহ্য খরায় তপ্ত বনভূমি বাসের যোগ্য ছিল না। ১৯৬৪ সালের পর থেকেই বেশ কিছু পরিবার দন্ডক বন ত্যাগ করে। তাঁদের হিসাব পাওয়া যায়নি। সম্ভবত তাঁদেরই একটা অংশ কুমিরমারি পেরিয়ে মরিচঝাঁপির প্রথম কিস্তির আগন্তুক। শৈবাল গুপ্ত, যিনি বেশ কিছুকাল দন্ডকারণ্য উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান ছিলেন, তাঁর লেখাতে কিছু তথ্যের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লেখাগুলি প্রকাশিত হয়েছিল ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির তিনটি সংখ্যায়। পরবর্তীকালে মরিচঝাঁপি থেকে পশুর মত বিতাড়িত হয়ে যাঁরা দন্ডকে ফিরে গিয়েছিলেন বলা হয়েছিল, তাঁদের অনেকেরই হদিস পাওয়া যায়নি। হয়তো তাঁদের কিছু মানুষ পুরনো নাম গোত্র হারিয়ে জনারণ্যে মিশে আছেন। হয়তো তাঁদের মুখ বন্ধ। ১৬ই মে ১৯৭৯, যেদিন মরিচঝাঁপিতে দন্ডকবন থেকে আগত উদ্বাস্তু বিতাড়ন শেষ হল, সেদিন আসলে কী ঘটেছিল? প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা প্রায় কারুরই নেই। সেই সব স্বপ্ন-দেখা এবং স্বপ্ন-ভঙ্গের শেষে কিছু মানুষ যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁদের খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব কাজ। এই প্রসঙ্গে একটি গল্প মনে আসছে। গল্পটি পশ্চিমবাংলার এক নামী লেখকের। গল্পর কাঠামোটা উপস্থিত করা গেল। একদিন ঘর হারানো নিঃসম্বল একদল উদ্বাস্তু স্ত্রী-পুরুষ নিয়ে উত্তর কলকাতার এক বাগান বাড়ি দখল করে বসলেন নিম্নবর্গীয় নমঃশূদ্র নেতা। ঠিক যেন সতীশ মন্ডল- মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু নেতার আদলে কল্পিত। সঙ্গে ওঁর প্রায় কিশোর পুত্র। নানা মানুষের সঙ্গে ওঁর পরিচয়। তার মধ্যে এক উচ্চবর্গীয় মহিলাও। নিজের ছেলেকে ওই মহিলার জিম্মা করে ওঁদের চলে যেতে হয় সম্ভবত দন্ডক বনেই। তারপর অনেক বছর কেটে গিয়েছে। ওই ছেলে এখন যুবা। হয়তো ওর প্রতিভা ছিল অনেক। মনে করা যাক এক আশ্রমবাসিনী সুন্দরীর অসম প্রেমের অপ্রাপ্তি-অভিমানে তাড়িত হয়ে ও আশ্রয় নিয়েছে দক্ষিণ কলকাতার এক বস্তিতে। ততদিনে মস্তানিতে হাত পাকিয়েছে। এমনই একটা দিনে এক দলের সঙ্গে ওকে যেতে হয় মরিচঝাঁপি অপারেশনে। অপারেশনের দায়িত্ব বামফ্রন্টের বড় শরিকের। কেননা সেজ শরিক আরএসপির ঘাঁটি কুমিরমারি এবং সংলগ্ন এলাকা। ভোটের তাগিদে মরিচঝাঁপির দ্বিতীয়বার ছিন্নমূল মানুষগুলোর প্রতি একটা সহানুভূতি আরএসপির ছিলই। মরিচঝাঁপি দ্বীপ তখন ঘিরে ফেলেছে পুলিশের লঞ্চ এবং অসংখ্য নৌকো। অপারেশনের পুরো দায়িত্ব জ্যোতি বসুর উত্তর দক্ষিণের দুই ম্যান ফ্রাইডের। পেছনে পুলিশ কর্তা আর কলকাতায় বসে সরাষ্ট্র সচিব। অনাহারি, তৃষ্ণার্ত, তবু বাঁচবার স্বপ্নে মশগুল মানুষগুলো হোগলার ছাউনি-ঘেরা ঘরে। সারাদিনের পরিশ্রমে জোগাড় করা চাল কাঠের আগুনে ফুটছে। টগবগ শব্দ হচ্ছে। এই শব্দ উনুনের চার পাশে বসা বাচ্চাগুলোর কানে বিজয়ী অশ্বখুরের ধ্বনি তুলছে- এই বর্ণনাটুকু জ্যোতির্ময় দত্তের। ঠিক তখনই দলীয় মস্তানরা নিঃশব্দে ঘরে ঘরে আগুন লাগিয়ে দিল। মরিচঝাঁপির আকাশ রাঙা হয়ে উঠল। আগুনলাগা ঘরের চালগুলো শিশু, বৃদ্ধ মানুষগুলোকে গ্রাস করল। ওই যুবা প্রতিবাদী উদ্বাস্তু নেতাকে খুন করে ফিরে এল অন্য মস্তানদের সঙ্গে। তার মনেও পড়ল না, সর্বগ্রাসী আগুনের আলোয় নিজের পিতাকেই সে হত্যা করে গেল। এই গল্পটি এক সার্থক উপন্যাসের প্রক্ষিপ্ত অংশ। অনুমান করা যায়, ঔপন্যাসিকের সর্বসমক্ষে বলতে না পারা কথার এক শব্দহীন উচ্চারণ। তখন আনন্দবাজারে কর্মরত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় গিয়েছিলেন মরিচঝাঁপিতে। নদী সমুদ্র ঘেরা মরিচঝাঁপি দ্বীপে ন্যূনতম জীবনধারণের প্রয়োজনেই কুমিরমারি থেকে পানীয় জল, চাল ইত্যাদি আনতে হত। ছোট ছোট কাঠের ডিঙি বানিয়ে উদ্বাস্তুরা তাঁদের প্রয়োজনীয় সামগ্রী সংগ্রহ করতেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই অলক্ষ্যে থাকা রাজনৈতিক প্রভুদের নির্দেশে রাজ্য পুলিশ ডিঙি ডুবিয়ে ওঁদের শুধু ভাতে মারাই নয়, জীবনহানিও ঘটাত। বলাই বাহুল্য এই নৌকাডুবিগুলো দেশি বা আন্তর্দেশীয় আইন-বিরোধী কাজ। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সবই দেখেছিলেন। আনন্দবাজার পত্রিকায় ১৯৭৮ সালে তা ছাপা হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পঞ্চাশটা নৌকো ভর্তি কাঠ নিয়ে মরিচঝাঁপির মানুষজন দ্বীপে ফিরছিলেন। মাঝদরিয়ায় সেই নৌকোগুলো ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কাঠ তো গেল নদীগর্ভে। আর মানুষগুলো? কারা ওই নৌকো ডোবালো? মেলেনা উত্তর। পঞ্চাশটা নৌকো ডোবানোর স্বীকৃতি এবং পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে উদ্দেশ্য করে কিছু জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা সুনীলবাবু বলেছিলেন। কিন্তু যা আশ্চর্যের তা হল মরিচঝাঁপিতে সিপিএম যে নৃশংস অত্যাচার চালিয়েছে, একজন সংবেদনশীল সাহিত্যিক হয়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তার ধিক্কারে মুখর হননি। তাই হয়তো বিবেকের তাড়নায় 'পূর্ব-পশ্চিম' উপন্যাসে প্রক্ষিপ্ত হলেও অসাধারণ মমত্বে উপরে উল্লিখিত গল্পটি ঘটনার আদলে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। আনন্দবাজারে উনি প্রতিবেদন লিখলেন 'পশ্চিমবঙ্গীয় বাঙালির উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে তিতিবিরক্ত। মোটামুটি যাঁদের সহানুভূতি আছে, তাঁরাও মনে করেন, উদ্বাস্তুদের দায়িত্ব নেবে ভারত সরকার।' এই লেখাটিরও মূল্য যে কম ছিল না সেকথা না বললে নিশ্চয়ই অবিচার করা হবে। তবু জিজ্ঞাসা থেকে যায়, দন্ডক থেকে কেন নতুন স্বপ্নে বুক বেঁধে নীল আকাশের নীচে, নদী-জলের সোঁদাগন্ধ নিয়ে এবং ঝড়, জল, সাইক্লোনের বিপদ মাথায় করে মরিচঝাঁপির কাদামাটি আর হোগলা বন সাফ করে উদ্বাস্তুরা ঘর বাঁধতে চেয়েছিল, এ প্রশ্ন কি মানুষের দন্ডমুন্ডের কর্তাদের মনে একবারও উঁকি মারেনি? বরুণ সেনগুপ্ত আনন্দবাজার পত্রিকায় তাঁর রাজনৈতিক প্রতিবেদনে লিখলেন- 'আমার প্রশ্ন, আজ যাঁরা পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসীন, সেই দলগুলোই, অর্থাৎ সিপিএম, ফরওয়ার্ড ব্লক এবং আরএসপি-ই কি দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে বলে আসেননি যে পূর্ববঙ্গের শরণার্থীদের পশ্চিমবঙ্গের বাইরে পাঠাবার কোনও প্রয়োজন নেই? তাঁদের নেতারাই কি দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করেননি যে, পশ্চিমবঙ্গেই এদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার মতো পর্যাপ্ত জমি আছে? তাঁরাই কি সর্বতোভাবে উদ্বাস্তুদের বোঝাবার চেষ্টা করেনি যে, আন্দামান বা দন্ডকারণ্যে যাওয়া মানে তাঁদের সর্বনাশ হয়ে যাওয়া? আজ সতীশ মন্ডল (মরিচঝাঁপিতে আসা দ্বিতীয়বার ছিন্নমূল সর্বহারা মানুষগুলোর নেতা) যখন সেই কথাই বলছেন তখন তাঁকে চক্রান্তকারী বলা হচ্ছে কেন?' কারণ একটা ছিলই। হয়তো ওই বঞ্চিত, লাঞ্ছিত লোকগুলো ভবিষ্যতে সিপিএম-এর ভোটব্যাঙ্কে অন্যের থাবার কারণ হয়ে উঠত। আর দ্বিতীয় কারণ ভারতীয় অরণ্য আইন রক্ষার ছলনা। আজ যেমন নয়াচর নিয়ে প্রোমোটারি করার অদম্য প্রচেষ্টা চলছে, তেমনি মরিচঝাঁপি রেখে দিয়ে ভবিষ্যতের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। অথচ মরিচঝাঁপি কেমন ছিল সেই ১৯৭০ দশকের শেষ পাদে? প্রায় ১২০ বর্গমাইল ব্যাপ্ত মরিচঝাঁপি সুন্দরবনের সুন্দরী গড়ানের বনভূমি। আর এদিকে কুমিরমারি বাগনার বিস্তৃত অংশ। এখানে সেখানে নারকেল গাছ। জলকাদায় ভরা জমিতে হোগলা আর শীর্ণকায় ছোট গাছগাছড়া। মাঝের উঁচু জমির অংশে সবুজ ঘাস। উপরে নীল আকাশ। ভরা বর্ষায় মাটির সোঁদাগন্ধ। ঝড় আর বাতাস, বন্যা আর সমুদ্রের বানভাসি আশঙ্কায় ভরা সেই প্রায় নির্জন মরিচঝাঁপির দিনরাত। এসবের কথা আশ্চর্য মায়াময়তায় ফুটে উঠেছে অমিতাভ ঘোষের 'দ্য হাঙরি টাইড' উপন্যাসে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের শরিক দলগুলো নিজেদের প্রাক কথন আর রাজনৈতিক উত্থানের কথা ভুলে না গিয়ে, পুলিশকর্তা আর ক্যাডারদের না নামিয়ে যদি দ্বীপটি মনুষ্যহীন না করতেন, তবে ওই মরিচঝাঁপিই আজ সমৃদ্ধিতে ভরভরন্ত হয়ে উঠতো। আমরা কমবেশি পরের কাহিনী জানি মাত্র। যে বিপদসঙ্কুল বাতাবরণে একদা জঙ্গল কেটে বসতি গড়ে উঠেছিল, সেখানকার অধিবাসীরা আজ মোটামুটি ভালই আছেন প্রকৃতির সঙ্গে লড়াই করে। পশ্চিমবঙ্গের কোস্টলাইন সুরক্ষায়ও তাঁরা একটা মানব দেওয়াল তৈরি করে রেখেছে। মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তু আগন্তুকরা আসার অল্পদিনের মধ্যেই জায়গাটা সাফসুতরো করে বাসযোগ্য করে তুলেছিল। বেশ কিছু নলকূপ বসিয়েছিল। তবে নোনা জলের জন্য সেই অতি অগভীর যন্ত্রগুলো কার্যকর হয়ে ওঠেনি। দরকার ছিল সরকারি সাহায্যের। কিন্তু বামফ্রন্ট সরকার তো প্রথম থেকেই বাম। তাই রায়মঙ্গল এবং আরও দু'টি নদী পেরিয়ে ওঁদের পানীয় জল এবং খাদ্য আনতে হতো। দ্বীপে ছোট ছোট গাছ ছাড়াও কিছু মোটা বেড়ের বড় গাছ ছিল। ঝড়ের কবল থেকে ওইগুলিই দ্বীপটিকে সুরক্ষা দিতে পারত। কিন্তু জীবিকার প্রয়োজনে কিছু গাছ কেটে ওঁরা ডিঙ্গি নৌকো বানিয়েছিলেন। মাটির রাস্তা ঘাট প্রস্তুত করেছিলেন। ছাউনি দিয়ে স্কুলবাড়িও তৈরি হয়েছিল। গোলমালটা লাগল ঠিক এমন সময়েই। শুরু হয়ে গেল মিথ্যাপ্রচার। বড় বড় পুলিশ কর্তার আগমন ঘটল। ফিসফিস প্রচার শুরু হলো – বিদেশী কোনও বড় শক্তি এইসব খেতে-না-পাওয়া চর্মসার মানুষগুলোকে অর্থ, অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করছে। বড় বড় পিচের রাস্তা তৈরী করে সমুদ্র পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়ার প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। বাংলাদেশের সাহায্যে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদ সুন্দরবন-সংলগ্ন মরিচঝাঁপি থেকে তার সম্প্রসারণের কাজ শুরু করতে যাচ্ছে। অতএব বোঝাই গেল নিরন্ন হাঘরে উদ্বাস্তুদের মরিচঝাঁপির মেয়াদ শেষ। পশ্চিমবঙ্গ সরকার তার পুলিশ বাহিনী দিয়ে প্রায় ঘিরে ফেললো দ্বীপটিকে। নেতৃত্ব দিলেন অমিয় সামন্তদের মতো পুলিশের বড় কর্তারা। খাদ্য, পানীয় জল নিয়ে যাওয়া বন্ধ করলেন। তার আগেই জনতা দলের নেতারা, যেমন কাশীকান্ত মৈত্র এবং আরও কয়েকজন, গোপনে মরিচঝাঁপি ঘুরে যাচ্ছেন। কখনও তাদেরও ফাটকে পুরছে পুলিশ। আনন্দবাজার-এর সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত কাছ থেকে এই সব দেখছেন। বিএসএফ-এর কর্তাদের আনুকূল্যে বারবার মরিচঝাঁপি যাওয়ার সূত্রে জেল-এ যাওয়ার হাত থেকে বেঁচে এসে আনন্দবাজার পত্রিকায় দিনের পর দিন রিপোর্ট লিখেছেন। ওইগুলিই এখন আমাদের রেকর্ডেড ইতিহাস। মরিচঝাঁপির পূর্বাপর সম্পূর্ণ এক ইতিহাস লিখে সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত পরবর্তী মানুষের কাছে, যাঁরা একদিন গণহত্যার পুঙ্খানুপুঙ্খ ইতিহাস লিখবে তাঁদের কাছে, স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। মধুময় পাল মশাই, তাঁর এই মূল্যবান বই-এ সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের বিপুল তথ্যসম্পদে ভরা প্রবন্ধটি লিখিয়ে নিয়েছেন। শৈবাল কুমার গুপ্ত মরিচঝাঁপি পর্বের কারণ-সংক্রান্ত ব্যাপারে অসাধারণ পশ্চাৎপট প্রস্তুত করেছেন ওঁর নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে। পান্নালাল দাশগুপ্ত মরিচঝাঁপির উদ্বাস্তুদের নিয়ে কখনও যুগান্তর পত্রিকা এবং নিয়মিতভাবে কম্পাস পত্রিকায় লিখে গিয়েছেন। দন্ডক-এর আর দন্ডক থেকে পলায়নপর উদ্বাস্তুদের সমস্যার স্থায়ী সমাধানে উনি বারবার গিয়েছেন ওই সব এলাকায়। আর পশ্চিমবাংলার উদ্বাস্তুরা যেহেতু ওড়িশার প্রান্তিক মানুষ বা দন্ডকের ভারপ্রাপ্ত কিছু কর্তাদের কাছ থেকে অসহযোগিতার সম্মুখীন হয়েছে, পান্নালালবাবু ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী এবং কেন্দ্রীয় পুনর্বাসন দফতরের আমলাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। কিন্তু কিছু লাভ হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী তখন নানাভাবে অপপ্রচার এবং কৃত্রিম অসহায়তার দোহাই পারছেন। বিধানসভায় বিতর্কের উত্তরে জনতা দলের সদস্য ও নেতা কাশীকান্ত মৈত্রকে জনতা দলের জোট কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই-এর কাছে যেতে বলছেন। ১৯৭৮-এর নভেম্বর মাস নাগাদ অখন্ড চব্বিশ পরগণার পুলিশের 'সামন্ত'তন্ত্র ব্যারিকেড তৈরি করল। যাতে মরিচঝাঁপির মানুষজন বাগনা, কুমিরমারি ইত্যাদি অঞ্চল থেকে পানীয় জল আর খাদ্যসংগ্রহ করতে না পারেন। হাইকোর্ট মানবাধিকার রক্ষার্থে পুলিশের এই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে রায় দিল। তখন খাদ্যপানীয় সংগ্রহের দেরি ঘটিয়ে আস্তে আস্তে মানুষগুলোর শক্তিক্ষয় করিয়ে দেওয়া হয়। হোক না আদালত অবমাননা। তারপর এল সেই ভয়ংকর দিন। মে মাসের এক গভীর রাতে দু'শো পুলিশ আর সাধারণ নৌকোয় দু'হাজার ক্যাডার দিয়ে ঘিরে ফেলা হলো মরিচঝাঁপি। আগুন দেওয়া হলো বাড়িগুলোতে। উদ্বাস্তু বোঝাই কিছু নৌকো ডুবিয়ে দেওয়া হলো। আর কিছু শিশু, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, উদ্বাস্তু নেতাকে ধরে বেঁধে আনা হল হাসনাবাদ রেলওয়ে স্টেশনে। কিছু আগুনে পোড়া মানুষ নদীর কুমীর-কামটের পেটে গেলেন। শোনা যায় ব্যাপক গুলি চলেছিল অন্ধকারে। সমস্ত বুক পুড়ে যাওয়া ফণিবালা এবং আরও কিছু আধপোড়া ধ্বস্ত মানুষের সন্ধান পেয়েছিলেন সুখরঞ্জন সেনগুপ্ত ঝাড়গ্রামের কাছে দুধকুন্ডিতে। এই সবই তিনি প্রত্যক্ষদর্শী রিপোর্টার হিসেবে লিপিবদ্ধ করে মানুষের গোচরে নিয়ে এসেছেন। আর একটা কথা না বললে হৃদয়ের গভীর উচ্চারণের অনুরণন পাওয়া যাবেনা। মধুময় পাল তাঁর প্রকাশিতব্য সংকলনে শ্রী অমিয়কুমার সামন্ত- তৎকালীন অখন্ড চব্বিশ পরগণার পুলিশ সুপার-এর একটি লেখা সংগ্রহ করেছেন। মধুময় তাঁর ভূমিকায় – 'সত্যেরে লও সহজে'তে- আমাদের এবং এই প্রজন্মের মানুষদের হৃদয় খুঁড়ে দিয়ে মন্তব্য করেছেন- 'যাঁরা অবরোধের দেওয়াল খাড়া করেন, সত্য বলার এক্তিয়ার তাঁদের থাকেনা।' কেন না মরিচঝাঁপি কান্ডের ব্যাখ্যানে সামন্তমশাই বলেছিলেন 'বিভিন্ন লেখায় পুলিশি নির্যাতন সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তা 'মিথ্যাচার'। শুধু এই তথ্যভিত্তিক সংকলনেই নয়, 'দি স্টেটসম্যান ফেস্টিভ্যাল' সংখ্যায় মরিচঝাঁপি সংক্রান্ত লেখায় একই কথা বলেছেন সামন্ত। একটা সুখবর অবশ্য আছে। মরিচঝাঁপির মামলাটা সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্টে উঠেছে। দেখা যাক জীবিত পুলিশ অফিসাররা কী এফিডেভিট দেন। আর সেই স্বপ্নভঙ্গ-হওয়া বারবার-ছিন্নমূল দন্ডক-ফেরত মরিচঝাঁপির মানুষগুলো, যারা শেষ পর্যন্তও মরে বেঁচে ছিল, তাঁদের কী হলো? শঙ্খ ঘোষের লেখা দিয়ে শেষ করি- 'ট্রেনের থেকে ঝাঁপ দিয়েছো ধান শিয়রে। গলার কাছে পাথরবাঁধা বস্তামানুষ। মাটির থেকে উঠছিল তার মাতৃভূমি বুকের নীচে রইলো বিঁধে বৃহস্পতি।'
এইরকম একটা ইতিহাসলব্ধ সংকলনের দরকার ছিল। এটা সময়ের দাবী। সূত্রঃ মরিচঝাঁপি, ছিন্ন দেশ ছিন্ন ইতিহাস সম্পাদনাঃ মধুময় পাল, গাঙচিল ২০০৯ লিখেছেন – অমিয় চৌধুরী [তিরিশ বছর পর প্রকাশিত মরিচঝাঁপির ছাইচাপা পড়া ইতিহাস। ২৭শে ডিসেম্বর ২০০৯, সংবাদ প্রতিদিন পত্রিকায় ক্রোড়পত্রে প্রকাশিত শ্রী অমিয় চৌধুরীর প্রতিক্রিয়ার অংশবিশেষ লেখকের অনুমতিক্রমে বাঙালনামায় প্রকাশিত হল।] http://bangalnama.wordpress.com/2009/12/31/nirabatar-sanlaap/
প্রাগৈতিহাসিক দুঃখ: এপার বাংলা বনাম ওপার বাংলার বাঙালি! জাহাঙ্গীর হোসেন
বাঙালি! বসবাস করে পৃথিবীর দু'টো ক্ষুদ্র ভূখণ্ডে। একটিকে তারা দাবি করে নিজ স্বাধীন দেশ বলে, নাম 'বাংলাদেশ, অন্যটি বিশাল ভারতের একাংশের প্রদেশ, নাম 'পশ্চিম বাংলা'। অভাব, দুর্যোগ আর কষ্ট বাঙালি জীবনের চিরন্তন সত্য। হাজার বছরের পুরনো 'চর্যাপদে'ও বাঙালি জীবনের অভাব, বঞ্চনা আর কষ্টের কথা সুষ্পষ্টভাবে দৃশ্যমান। যে কারণে 'সুখের কাঙাল' বাঙালি নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করে হতে চায় অভিবাসী, অনেকটা পরিজায়ী পাখির মত। কিন্তু তারপরও কষ্ট আর দুঃখ যেন তার পিছু ছাড়তে চায়না স্বদেশ কিংবা বিদেশে। বিশাল ভারতের অংশ ছিল 'বাংলা' প্রদেশ। একসময় ভারতবর্ষের রাজধানীর মর্যাদা লাভ করেছিল বাঙালির অহঙ্কার 'কোলকাতা'। মুসলিম লীগের দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ করা হয় ১৯৪৭ সনে, যাতে ভারতবর্ষের হিন্দু-মুসলমান বিশাল জনগণের কোন ম্যান্ডেট নেয়া হয়নি কখনো। পাঞ্জাব ও বাংলাকেও করা হয় বিভক্ত ধর্ম অনুসারে। একাংশ পড়ে পাকিস্তানের ভাগে, নতুন নামকরণ হয় 'পূর্ব পাকিস্তান'। ধর্মীয় পরিচয়ে রাষ্ট্র বিভাজন হওয়াতে পাকিস্তানের উভয় অংশ থেকেই ব্যাপকহারে হিন্দুরা গমন করতে থাকে ভারতে 'নিরাপদ শান্তির প্রত্যয়ে' ১৯৪৭ থেকেই। এরমধ্যে নানা সময়ে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার কারণে পরিজায়ী প্রথা অব্যাহত থাকে 'বিভক্ত' ২-রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর মধ্যে। ভারত থেকে আগত মুসলমানরা পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেই পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে নিজেদের আইনী মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়, বিশেষ করে করাচীতে বসবাসকারী মুসলমানগণ। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতে উদ্বাস্তু হিসেবে প্রবেশকারীগণ 'উরংঢ়ষধপবফ চবৎংড়হং জবযধনরষরঃধঃরড়হ ধহফ ঈড়সঢ়বহংধঃরড়হ অপঃ, ১৯৫৪' আইন অনুসারে শুধু ভারতের নাগরিকত্বই পায়নি, তারা পাকিস্তানে ফেলে আসা সম্পত্তির ক্ষতিপুরণও পেয়েছে যথাসময়ে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত মধ্য প্রদেশ ও রাজস্থানে বসতি স্থাপনকারী কয়েক হাজার হিন্দু উদ্বাস্তুকে নাগরিকত্ব প্রদান করা ছাড়াও, ভারতের ২০০৩ সনের নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন পাস হওয়ার পরও, ২০০৪ সনে আইনের বিধান সংশোধন করে 'গুজরাট' ও 'রাজস্থানে' আগত প্রায় সকল হিন্দুদের ৫-বছর বসবাসের সহজ শর্তে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। বর্ণিত প্রদেশে সংশোধিত আইনটি হচ্ছেঃ (ঈরঃরুবহংযরঢ় জঁষব (অসবহফসবহঃ) অপঃ ২০০৪), '১৯৬৫ ও ১৯৭১ পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে আগত এবং গুজরাটের কুচ, পাটান, বনসকণ্ঠ ও আহমেদাবাদ জেলায় কমপক্ষে ৫-বছর বসবাসকারী সকল উদ্বাস্তু হিন্দুুকে 'জেলা কালেক্টর' ভারতীয় নাগরিক হিসেবে গণ্য করতে পারবেন'। এ ছাড়া 'রাজস্থানের বাদমের ও জয়সালমের জেলায় ১৯৬৫ ও ১৯৭১ এর পাক-ভারত যুদ্ধের পর পাকিস্তান থেকে আগত কমপক্ষে ৫-বছর বসবাসকারী ব্যক্তিগণকে জেলা কালেক্টর নাগরিকত্ব প্রদান করতে পারবেন'। বিধানটি ২৮/০২/২০০৪ তারিখ ভারতে সরকারী গেজেটে প্রকাশিত ও কার্যকর হয়। এ ক্ষেত্রে ভারত ভাগের বলিপ্রাপ্ত 'কপাল পোড়া' বাঙালি হিন্দুরা ১৯৪৭ এর পর ক্রমাগতভাবে ভারতে বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করলেও, অদ্যাবধি অনেকেই এখনো সেখানে 'ছিন্নমূল উদ্বাস্তু'। ধর্মীয় কারণে ভারতের রাজনৈতিক বিভক্তির সময় যদিও লোক বিনিময়ের প্রস্তাব ওঠে কিন্তু পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল তথা বাংলা অঞ্চলে কখনো লোক বিনিময় ঘটেনি, যা ঘটেছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। বিভক্তির পরই ভারতের জাতীয় নেতৃবৃন্দ বার বার প্রতিশ্র"তি দিয়েছিল, পাকিস্তান থেকে ভারতে গমনকারী হিন্দু উদ্বাস্তুদের ভারতে বসবাসের যৌক্তিকতা, নাগরিকত্ব প্রাপ্তি ইত্যাদি বিষয়ে। এ ক্ষেত্রে ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৪৭ ভারতের জাতির জনক মহাত্মা গান্ধী ঘোষণা করেন, 'হিন্দু ও শিখরা যে কোন সময় ভারতে যেতে পারে, এ ক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রধান কর্তব্য হবে আগতদের জীবিকার সংস্থান' (সূত্র ঃ ম.গা.র পৃ. ১০-১১)। ১৫ আগস্ট ১৯৪৭ ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর ভাষ্য ছিল, 'রাজনৈতিক কারণে সৃষ্ট উদ্বাস্তুদের সুখ দুঃখের সম অংশীদার আমরা থাকব' (সূত্র ঃ ওহফবঢ়বহফবহপব ্ অভঃবৎ পৃ. ৫)। ভারতের ১ম রাষ্ট্রপতি ড. রাজেন্দ্র প্রসাদ শপথ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, 'উদ্বাস্তুদের সকলকে পুনর্বাসন ও পুন:প্রতিষ্ঠা করার জন্য আমরা উদ্বিগ্ন' (সূত্র ঃ ডারাপ্রব পৃ. ২)। ১৫/০১/১৯৫৩ ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের প্রতিশ্র"তি ছিল, 'তাহারা (উদ্বাস্তুরা) আমাদের কাছে বিদেশী হইতে পারে না' (সূত্রঃ প্রচার বিভাগ, ভারত সরকার, পৃ. ১২১)। এভাবে নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটি (এআইসিসি), ভারতের পুনর্বাসন মন্ত্রী মহাবীর ত্যাগী প্রমুখ সকলেই পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী উদ্বাস্তুদের ব্যাপারে তাদের মানবিক ও যৌক্তিক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিভিন্ন সময়ে। উল্লেখ্য যে, ভারতের সংবিধানের ৭ম তফশিলভুক্ত ৩ নং সূচির ২৭ ধারায় উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সনে পাকিস্তানের উভয় অংশে হিন্দু-মুসলমান মারাত্মক দাঙ্গা শুরু হলে ব্যাপকহারে হিন্দুরা ভারতে গমন করে, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান অঞ্চল থেকে। এ সময় ভারত সরকার কোনরূপ প্রমাণপত্র (ডকুমেন্ট) ছাড়াই পাকিস্তান থেকে ভারতে প্রবেশকারী হিন্দু উদ্বাস্তুদের বসবাসের অধিকার, নাগরিকত্ব, রেশনকার্ড ও ভোটার করার প্রতিশ্র"তি দেয়। ১৯৭১ সনের ২৫ মার্চের আগ পর্যন্ত এ ব্যবস্থা মোটামুটি প্রতিপালনের ব্যবস্থা ভারতে ছিল। ১৯.০৩.১৯৭২ সনে সম্পাদিত ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতেও বাংলাদেশ অঞ্চল থেকে ভারতে গমনকারী হিন্দুদের ব্যাপারে কোন বিধি নিষেধের আরোপের কথা বলা হয়নি। যে কারণে ১৯৪৭-এ হিন্দু-মুসলমান রাষ্ট্র বিভক্তির পর পাকিস্তান অঞ্চল থেকে নানা সময়ে বাঙালি হিন্দুরা নানা প্রক্রিয়ায় ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করে। এরমধ্যে অনেকে ভারত তথা পশ্চিম বাংলায় 'প্রয়াত' হলেও, তাদের ভারতে জন্মগ্রহণকারী সন্তান সন্তুতিরা বাড়ি-ঘর বানিয়ে, ভোটার হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তি করে, যায়গা জমি ক্রয় করে রীতিমত 'ভারতীয়' হয়ে ভারতে বসবাস করছে। অনেকে চিন্তাও করেনি, তাদের ভবিষ্যত পরিণতি কিংবা নাগরিকত্ব বিষয়ক আসন্ন জটিলতর সমস্যার কথা। এই প্রাক্তন 'উদ্বাস্তুরা' এখন আক্রান্ত ভারতীয় '১৯৪৬ সনের বিদেশী আইন (ঋড়ৎবরমহবৎং' অপঃ, ১৯৪৬)' ও '২০০৩ সনের নাগরিকত্ব (সংশোধন) আইন (ঈরঃরুবহংযরঢ় অসবহফসবহঃ অপঃ, ২০০৩)' দ্বারা। এই আইনের বিভিন্ন ধারা বলে ৪০-৫০ বছর সময় ধরে ভারতে বসবাসকারীদের কাউকে কাউকে হয়রানি, মামলা, গ্রেফতার ইত্যাদি করা হয়েছে। ২০০৬ সন থেকে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন উদ্বাস্তু এলাকা থেকে ১৭৩৬ জন উদ্বাস্তুকে গ্রেফতার ও ১৫৫টি কেস দায়ের করা হয়েছে (সূত্র: পুস্তিকা-অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট. পৃ-২২)। রাজনৈতিক কারণে উদ্বাস্তু হিসেবে পরিগণিত এই ভাগ্যহীনদের অধিকার রক্ষায় ২০০৪ সনে কোলকাতায় গঠিত হয় 'অল ইন্ডিয়া রিফিউজি ফ্রন্ট'। যারা কাজ করে যাচ্ছে রাজনৈতিক বিভাজনের বলিপ্রাপ্ত উদ্বাস্তুদের অধিকার রক্ষার জন্যে। এ সংগঠন ভারত বিভক্তির সময় উদ্বাস্তু বিষয়ে ভারতের জাতির পিতা মহাত্মা গান্ধীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের বিবিধ প্রতিশ্র"তি, ঐ সময়ের ভারতীয় আইন, উদ্বাস্তুবিষয়ক জাতিসংঘ সনদ (সিদ্ধান্ত নং ৪২৮(৫), ১৯৫০ সনের নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি, ১৯৭২ সনের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি, উদ্বাস্তু বিষয়ে গুজরাট-রাজস্থান প্রভৃতি প্রদেশে গৃহীত কর্মকাণ্ড, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্যমূলক আইন ও আচরণের প্রতিবাদ, পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু আন্দোলন জোরদার, সম্মিলিত কেন্দ্রীয় উদ্বাস্তু পরিষদ গঠন, পশ্চিমবঙ্গের উদ্বাস্তুদের বসতি মরিচঝাঁপিতে পরিকল্পিত আক্রমণ (মরিচঝাঁপি ১৯৭৮-৭৯, আক্রান্ত মানবিকতা, তথ্যচিত্র নির্মাণ ও প্রদর্শন) এবং উদ্বাস্তুদের আন্দামানে পাঠানোর প্রতিবাদে বিক্ষোভ কর্মসূচি, ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ও মুখ্যমন্ত্রীর কাছে সমস্যাটির ব্যাপারে স্মারকলিপি পেশ ও প্রতিবাদ এবং জনমত গঠনে পত্র-পত্রিকায় উদ্বাস্তু বিষয়ক সমস্যাটি তুলে ধরার নানাবিধ প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে অক্লান্তভাবে। পৃথিবীর দারিদ্রক্লিষ্ট, কষ্ট আর বঞ্চিত বাঙালির অংশী একজন 'বাংলাদেশী বাঙালি' হিসেবে উদ্বাস্তু পশ্চিম বাংলার বাঙালিদের বর্তমান সমস্যাটিকে নিতান্তই মানবিক বলে মনে করি। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার বিষয়টিকে গুজরাট ও রাজস্থানের প্রেক্ষাপটে বিচার করতে পারেন মানবিক দৃষ্টিতে। আর পশ্চিম বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় সকল মানবিক সমস্যায়ই 'মমতাময়ী'। তিনি সিঙ্গুরের মত এ সমস্যাটির ব্যাপারে এগিয়ে এলে, অভিবাসীর লক্ষ্যে পাকিস্তান ত্যাগী, বর্তমানে ভারতে বসবাসকারী 'ভারত ভাগের বলিপ্রাপ্ত' উদ্বাস্তু বাঙালিরা হয়তোতাদের অনাগত সন্তানদের সুখ চিন্তায় নিশ্চিন্তে পরপারে যেতে পারবেন। অন্যথায় জীয়নকালের মতই মৃত্যুর পরও তাদের আত্মা 'উদ্বাস্তু' হিসেবে ঘুরে বেড়াবে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের যত্রতত্র! Email: jahangirhossaindhaka@gmail.com http://www.weeklymanchitra.com/archive_details.php?id=2644&nid=6 |
No comments:
Post a Comment