Welcome

Website counter
website hit counter
website hit counters

Sunday, November 18, 2012

বাইরের জগতে কি ধরনের রবীন্দ্র পরিচিতি আমাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখবে

বাইরের জগতে কি ধরনের রবীন্দ্র পরিচিতি আমাদের স্বার্থ 

অক্ষুন্ন রাখবে

পলাশ বিশ্বাস

তিনি দেববিগ্রহের পরিবর্তে মানুষ অর্থাৎ কর্মী ঈশ্বরকে পূজার কথা বলতেন। 

 সামাজিক ভেদাভেদ, অস্পৃশ্যতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধেও তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ।

বাংলার বিশ্বজনীন ভাবমুর্তি প্রগতিশীল, জাতের তোয়াক্কা না করা সমাজের, কিন্তু বাস্তবে সর্বত্রই আধিপাত্যবাদের জয়জয়কার৤ সমাজ. রাজনীতি, সংস্কৃতি, পেশা, বাণিজ্য, সবক্ষেত্রেই সংরক্ষনের বাইরে ও সংরক্ষনের ক্ষেত্রেও অস্পৃশ্যতা নির্মম বাস্তব৤ রবীন্দ্র চর্চায় আধিপাত্যবাদের জয়গান তাই প্রমাণ করে৤

রবীন্দ্র নাথের পুজা প্রসন্গে আমরা সারা দেশে সবচেয়ে বেশী আবেগপ্রবণ জাতি৤ আমরা আমাদের জীবন ও যৌবন রবীন্দ্রনাথ ছাড়া ভাবতেও পারি না৤ অথচ রবীন্দ্রচর্চা আধিপাত্যের ঘেরাটোপের বাইরে অসম্ভব৤ নিপীড়িত পিছিয়ে পড়া মানুষের পাশে যে রবীন্দ্রনাথ, তা আমরা বার বার ভুলে যাই৤ ভারতবর্ষের মানূষের কাছে তাই সার্বজনীন রবীন্দ্র পরিচিতি প্রেম ও আধ্যাত্বের কবি হিসাবে৤ চন্ডালিকা নৃত্য নাটিকার মন্চনে আমরা যত না উত্সাহী,এই রবীন্দ্র রচনার মুল স্বর অস্পৃশ্যতা ও আধিপাত্যবাদের বিরোধিতা নিরিখে রবীন্দ্র পরিচিতি স্থাপনায আমাদের অনীহা সে অপেক্ষা প্রবলতর৤ আসরা রথের রশি নিয়ে বিস্থারিত আলোচনা আজও করিনি৤ রাশিযয়ার চিঠির তাত্পর্য্য বূঝতে উত্তর ভারতের ন্যায় সামাজিক বদলের প্রতীক্ষাই আসাদের ভবিতব্য৤বাংলায় আসরা রবীন্দ্রনাথকে ভগবানের আসনে বসিয়েছি৤ রবীন্দ্র সন্গীত না জানা মেয়েকে আমরা বিবাহযোগ্যা মনে করতে পারি না৤ পরিবর্তন যুগে জনপথে আমরা প্রতিনিয়ত রবীন্দ্র সহচর৤ কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, আমরা ঠিক কতটা ববীন্দ্রনাথকে জানি এবং বাইরের জগতে কি ধরনের রবীন্দ্র পরিচিতি আমাদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখবে৤জমিদারের পূত্র, নোবেল পুরস্কারের আলোয় আলোকিত রবীন্দ্রনাথকেই জনসমক্ষে পেশ করায় আমাদের যারপর নাই উত্সাহ৤এই প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হবে, এমন আশা করাই বৃথা৤

আপনি নিশ্চই রবীন্দ্রনাথের চন্ডালিকা গীতিনাট্যটি পড়েছেন? দেখেছেন সেখানে প্রকৃতি কী অবমাননাকর জীবন যাপন করে চলছে- ওকে ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা ছি/ ও যে চন্ডালীকার ঝি। এই হচ্ছে হিন্দু ধর্ম। মানবতা বিরোধী।কবিগুরম্ন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি নৃত্যনাট্য। এ আখ্যানে তিনি ধর্মের মধ্যে বৈষম্য, জাতপাতের ভেদ ও অস্পৃশ্যতার মতো বিষয়গুলো যে ঠুনকো, তা খুব সহজেই চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছেন। কবি চ-ীদাসের 'সবার উপরে মানুষ সত্য' এই বাণীরই প্রতিধ্বনি উঠে এসেছে তার এই সৃষ্টিকর্মে। চ-ালিকায় তিনি অস্পৃশ্য শ্রেণীর নারীর প্রতীকী চরিত্রে প্রকৃতি নামের এক তরম্নণীকে তুলে ধরেছেন। যে অন্য জাতের কাছে অচ্ছুৎ। অস্পৃশ্য প্রকৃতি (চ-ালের কন্যা চ-ালিকা) ফুলওয়ালী, দইওয়ালা, চুড়ি বিক্রেতা দ্বারাও অবজ্ঞাত ও প্রত্যাখ্যাত। এভাবেই তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের মধ্য দিয়ে চলছিল প্রকৃতির জীবন। এমনি একদিন প্রকৃতি কুয়ো থেকে জল তোলার সময় তার সামনে এসে দাঁড়ালেন 'বৌদ্ধ ভিৰু আমার'। তখনই প্রকৃতির 'দগ্ধ কাননের' জীবনটা বাঁচবার একটা অর্থ খুঁজে পেল। বুদ্ধ-শিষ্য ও করম্নণামন্ত্রের অনুগামী আনন্দ প্রকৃতির হাতে জলপান করতে চাইলে সে তার অপারগতার কথা জানায়। উত্তরে আনন্দ বলে_ 'যে মানব আমি সে মানব তুমি, কন্যা যা তাপিত শ্রানত্মকে সি্নগ্ধ করে সেই তো পবিত্র জল'। এই বলে আনন্দ প্রকৃতির হাতে জলপান করে এবং তাকে আশীর্বাদ করে। আনন্দ প্রকৃতিকে সহসা দিয়েছিল মানুষের তৃষ্ণা মেটানোর সম্মান। প্রকৃতির কথায়_ 'তিনি বলে গেলেন আমায়, নিজেরে নিন্দা করো না, মানবের বংশ তোমার, মানবের রক্ত তোমার নাড়ি'তে। এর পর থেকেই অস্পৃশ্য প্রকৃতি উঠে দাঁড়াবার বা ঘুরে দাঁড়াবার শক্তি পেল আনন্দের কাছ থেকে।

ব্রাক্ষ্মণ্যধর্ম হল একটি অধর্ম বা অধার্মিকের ধর্ম(অস্পৃশ্যতা অধর্ম নয় কি?) বা আরো ব্যাপকভাবে... চতুর্বর্ণপ্রথা,জাতপাত,অস্পৃশ্যতা-এগুলো হিন্দুধর্মের বিষয় নয়,এগুলো ব্রাক্ষ্মণ্য ধর্মের জিনিস।ব্রাক্ষ্মণ্যধর্ম ... বর্ণভেদ,জাতপাত,অস্পৃশ্যতা,সতীদাহপ্রথা,গুরুপ্রসাদী প্রথা ইত্যাদি অমানবিক, অশালীন প্রথাগুলি ব্রাক্ষ্মণ্যধর্মেরই অবদান।

মনে রাখা উচিত, অস্পৃশ্যতা কিন্তু রবীন্দ্র পরিবারকেও রেহাই দেই নি৤ রামমোহন রায়ের মৃত্যুর পর দেবেন্দ্রনাথই হয়ে ওঠেন ব্রাহ্মসমাজের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব। তাঁর অনুগামীরা তাঁকে মহর্ষি অভিধায় ভূষিত করে। আমৃত্যু দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন আদি ব্রাহ্মসমাজের নেতা। অস্পৃশ্যতাপ্রথার কারণে কেবল মাত্র পূর্ববঙ্গের (বর্তমান বাংলাদেশ) যশোর-খুলনার পিরালী ব্রাহ্মণ কন্যারাই ঠাকুর পরিবারে বধূ হয়ে আসতেন।

আম্বেদকর সারাজীবন সামাজিক বৈষম্য এবং অস্পৃশ্যতা প্রথার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। এসময় তিনি বৌদ্ধ ধর্মে ধর্মান্তরিত হন। আম্বেদকরকে ১৯৯০ সালে মরণোত্তর 'ভারত-রত্ন' উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

পরাধীন ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় , অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেবার

আহ্বান জানিয়ে গান্ধীজীর পরামর্শে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস শ্রী শ্রী গুরুচাদ ঠাকুরের কাছে পত্র

লিখেছিলেন । পত্রের উত্তরে গুরুচাদ ঠাকুর লিখেছিলেন , " আমার এ জাতি অনুন্নত ও

অশিক্ষিত , এরা স্বাধীনতা কি জিনিস তা বুঝে না , তাছাড়া আপনারা আমাদের অস্পৃশ্য মনে

করেন । তাই আপনাদের সঙ্গে একত্রে আন্দোলন করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয় ।


ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক ভারতের দাবিদার হয়েও ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বৈষম্যকে আনুষ্ঠানিকভাবে সমর্থন করে বিশ্বজনীন মানবাধিকারকে পদদলিত করে যাচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে ভারতে জাতপাতভিত্তিক যে বৈষম্য নীতি রাষ্ট্রীয় অনুমোদন ও সামাজিক প্রশ্রয়ে চলে আসছে, জাতিসংঘের হিউম্যান রাইটস কাউন্সিল তাকে 'মানবাধিকাল লঙ্ঘন' হিসেবে চিহ্নিত করতে চলেছে। জেনেভাতে জাতিসংঘের যে হিউম্যান রাইটস কাউন্সিলের যে অধিবেশন চলছে, তাতে এ নিয়ে সিদ্ধান্ত ঘোষিত হতে পারে। কিন্তু ভারত জাতপাতমূলক এ বৈষম্যকে মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে চিহ্নিত করার উদ্যোগের বিরোধিতা করেছে।
এদিকে ভারত জাতপাত ভিত্তিক বৈষম্য ও অস্পৃশ্যদের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টিকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বলে মনে করে। এ জন্য তারা এই ইস্যুটির আন্তর্জাতিকীকরণের ঘোরতর বিরোধী। ভঅরত চায় না সামাজিক এই ক্ষতটিকে আন্তর্জাতিক পাদপ্রদীপের আলোয় আনা হোক। বিশেষ করে ভারত গণতান্ত্রিক বিশ্বে নিজেকে 'বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশ' হিসেবে পরিচয় দিয়ে থাকে। তাছাড়া ভারত বিশ্বশক্তি হিসেবেও গড়ে উঠতে তৎপর। কিন্তু ভারতে মানবাধিকারের মান খুবই নিম্নপর্যায়ে রয়েছে। গণতান্ত্রিক সমাজের মূল বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদের স্বীকৃতি এবং ধর্মীয়, সামাজিক বা শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছিন্ন করে সকল ধর্ম, বর্ণ ও পেশার মানুষকে একই মানবিক অধিকার ও মর্যাদায় উন্নীত করা।
ভারতের হরিয়ানা রাজ্যে সমাজপতিদের বিধান অমান্য করে বিবাহ করায় একটি দম্পতি তাদের আক্রোশের হাত থেকে বাঁচার জন্য গ্রাম থেকে পালিয়ে দিল্লীতে আত্মগোপন করে আছেন। আদালতের নির্দেশে পুলিশ ওই দম্পতিকে এক মাসের জন্য পাহারা দিচ্ছে। তবে রবিন্দর নামের পুরুষটি আশঙ্কা করছে, তারা গ্রামে ফিরলে কিংবা সমাজপতিদের লোকজন তাদের আওতায় পেলে তাদেরকে হত্যা করা হতে পারে। রবিন্দর সম্ভাব্য ঘাতকদের ভয়ে চাকরিস্থল থেকে পালিয়ে দিল্লীতে গোপন বাসায় অবস্থান করছেন। সমাজপতিদের দাবি, বরং রবিন্দর ও কনে শিল্পীর বিয়ে শাস্ত্রসম্মত নয়। দু'টি পরিবার আলাদা গ্রামের হলেও সমাজপতিরা বলছেন, তাদের উভয়ের মধ্যে বংশসূত্রের সম্পর্ক রয়েছে। রবিন্দর সমাজপতিদের তাড়া খেয়ে নবপরিণীতা স্ত্রীকে নিয়ে নিজ গ্রাম থেকে বিয়ের পর পালিয়ে এসে প্রাণ রক্ষা করেছেন। ক্ষোভে, দুঃখে, অসহায়ত্বে দিশেহারা হয়ে রবিন্দর আত্মহত্যা করতে চেয়েও পারেনি।
ভারতের মতো একটি বৃহৎ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় রবিন্দরদের মতো অসম বিয়ে যারা করেন, তাদের বেঁচে থাকা কঠিন। অন্যদিকে উঁচুবর্ণের ছেলের সাথে নিচুবর্ণের মেয়ের বা নিচুবর্ণের ছেলের সাথে উঁচুবর্ণের মেয়ের বিয়েও ভারতে মেনে নেয়া হয় না। এ জন্য উভয়পক্ষ বা কোনো এক পক্ষকে চড়ামূল্য দিতে হয়। হিন্দুদের ব্রাহ্মণ্যবাদী কৌলিণ্য ও জাতপাতের বিশুদ্ধতা রক্ষার এই মধ্যযুগীয় আচার আধুনিক যুগে চলতে পারে না। কিন্তু তারপরও একমাত্র ভারতেই জাতপাতের বৈষম্য ও অস্পৃশ্যতার প্রতি রাষ্ট্রীয়ভাবে পক্ষপাত ও প্রশ্রয় মানবতাকে লাঞ্ছিত করে চলেছে।
সমাজ, আইন, পুলিশ, প্রশাসন, রাষ্ট্র সবাই ভারতে বর্ণাশ্রম ভিত্তিক জাতপাত ও অস্পৃশ্যতার পক্ষে অবস্থান নেয়। এমনকি নিম্নবর্ণের মানুষ বা হরিজন অস্পৃশ্যরা উঁচুবর্ণের মানুষের মন্দিরে পূজা করার অধিকার পায় না। নিম্নবর্ণের কোনো হিন্দু উচ্চ বর্ণের পানি তোলার কুয়ো স্পর্শ করলে তার বেঁচে থাকার অধিকার থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই তুচ্ছ অপরাধে অচ্ছ্যুৎ হরিজনদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। যুগ যুগ ধরে এই নির্মম লোমহর্ষক অত্যাচার চলছে ভারতীয় সমাজে। সমাজব্যবস্থা ও ধর্মীয় শাস্ত্রকারদের অনুমোদনে ভারতে মানবাধিকারের যে লঙ্ঘনের মহোৎসব চলছে, রাষ্ট্রীয় আইনে তার কোনো প্রতিকার নেই।
ভারতের সংবিধান প্রণেতা অম্বেদকর পর্যন্ত ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণাশ্রয়ী জাতিভেদের শিকার হয়ে অতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি 'মহাত্মা' গান্ধী পর্যন্ত অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে লড়াই করে সফল হননি। তিনি শেষ পর্যন্ত অস্পৃশ্যদের 'হরিজন' আখ্যা দিয়ে আত্মতৃপ্তি পেয়েছেন। কিন্তু ভারতের কোটি কোটি হরিজন আজও সমাজ ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মানবিক মর্যাদা ও নিরাপত্তার অধিকার অর্জন করতে পারেননি।
হিন্দুদের অভ্যন্তরীণ জাতপাতের বৈষম্য ও নিষ্ঠুর নিপীড়নের পাশাপাশি ভারতে মুসলমানদেরও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে অবজ্ঞা, অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার বানিয়ে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখা হয়েছে। ভারতের উগ্র হিন্দুরা মুসলমানদের প্রকাশ্যে হুমকি দিয়ে বলছে, 'হয় কুরআন ছাড়ো, নয় ভারত ছাড়ো'। উগ্রপন্থী হিন্দুরা মুসলমানদের স্বতন্ত্র ধর্ম-সংস্কৃতি পরিহার করে শুদ্ধচারী হয়ে ভারতীয় জাতীয়তার নামে হিন্দুত্বকে গ্রহণ করারও জন্য চাপ দিয়ে আসছে।
এদিকে ভারতের নিম্নশ্রেণীর হিন্দু জনগোষ্ঠী ও সংখ্যালঘু মুসলমানরা যে রাষ্ট্রীয় বঞ্চনার শিকার, ভারত সরকারিভাবেই তা স্বীকার করে নিয়েছে। 'মন্ডল কমিশন' ও 'সাচার কমিশন' নামের দুই কমিশনের রিপোর্টে নিম্নবর্ণের হিন্দু ও সংখ্যালঘু মুসলমানদের অনগ্রসরতা ও বঞ্চনার চিত্র তুলে ধরে তার প্রতিকারের সুপারিশ করা হয়েছে। কিন্তু এর বাস্তবায়নের পথেও অগ্রসর হিন্দুদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় শক্তির বাধা প্রবল। ভারতে গণতন্ত্র ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের সুফল থেকে নিম্নবর্ণের হিন্দু, সংখ্যালঘু মুসলমান ও হরিজনরা পায় না।
বৃহৎ গণতন্ত্রের দেশ ভারত তার জাতপাতের বৈষম্য নিরসনে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের প্রতি আস্থা আনতে ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৬ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এক ভাষণে অস্পৃশ্যতাকে বর্ণবিদ্বেষের সাথে তুলনা করেছিলেন। জাতিসংঘের জাতপাত নিরসন সম্পর্কিত খসড়া প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জাতপাতের যাঁতাকলে পড়ে সারা পৃথিবীতে ২০ কোটিরও বেশি মানুষ বৈষম্যের শিকার। এ ধরনের বৈষম্যকে অদ্ভুতভাবে পবিত্রতা বলে মনে করা হয়। কিন্তু ভারত বর্ণশ্রেণী হিন্দুত্বের মূলভিত্তি অস্পৃশ্যতা ও জাতপাতের বৈষম্যকে লালন করার ব্যাপারে বদ্ধপরিকর।
জাতপাতের বৈষম্য ও সাম্প্রদায়িক উগ্রতা ও সহিংতার অন্ধ উন্মাদনা বহাল রেখেও ভারত কিভাবে বৃহৎ গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে গর্ব করতে পারে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কেই তার ব্যাখ্যা দিতে হবে। মানবাধিকারের নীতিমালা সব দেশের জন্যই সমভাবে প্রযোজ্য হতে হবে।


সামাজিক অস্পৃশ্যতা ও ঘৃণা: হরিজন, ঋষি, সাঁওতাল, সুইপার, বুনো, মুন্ডা, শব্দকর, রবিদাস প্রভৃতি সম্প্রদায়ের কাছে আর্থিক দারিদ্র্যের চেয়ে মানবিক দারিদ্র্য অর্থাৎ অস্পৃশ্যতা এবং সামাজিক ঘৃণাই সবচেয়ে বড় দরিদ্র। এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য হোটেল-রেস্টুরেন্ট, সেলুন প্রভৃতিতে প্রবেশাধিকার নেই। তাদের ছেলেমেয়েরা স্কুলে গেলেও মূলধারার ছেলেমেয়েরা তাদের সঙ্গে মেশে না, অবজ্ঞা করে এবং অনেক ক্ষেত্রেই স্কুলের শিক্ষকেরাও তাদের প্রতি যথাযথ আচরণ করেন না। কর্মক্ষেত্রেও কর্তৃপক্ষ তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করে না। সামাজিক অস্পৃশ্যতা ও ঘৃণাকে দুর করতে হলে মূলধারার জনগণের বা সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে। যাদের কথায় জনগণ উজ্জীবিত ও প্রভাবিত হয় সেসব রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও সমাজকর্মীকে প্রমাণ করতে হবে যে তারা নিজেরাই অস্পৃশ্যতা এবং ঘৃণা থেকে মুক্ত। 

 অস্পৃশ্যতা এবং সামাজিক ঘৃণার সঙ্গে সরকারি ও রাষ্ট্রীয় অবহেলা যখন যোগ হয় তখন সে সমাজ বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তা এসব অবহেলিত জনগোষ্ঠীর দারিদ্র্য পরিস্িথতিকে আরও অমানবিক পর্যায়ে নিয়ে যায়। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা, সহায়তা এবং মূলধারার জনগণের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তনের মাধ্যমে তাদের সমাজ বিচ্ছিন্নতা থেকে মুক্ত করার জন্য সরকারকেও উদ্যোগী হতে হবে।

পেশাচ্যুতি: নানা কারণে এসব জনগোষ্ঠীর সদস্যরা তাদের নিজ নিজ পেশা থেকে অপসারিত হচ্ছে বা পেশায় প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। যেমন, পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনগুলোতে সুইপার পদের চাকরিগুলো হরিজন সম্প্রদায়ের জন্য সংরক্ষিত থাকলেও নানাভাবে মূলধারার মানুষ এসব পেশায় ঢুকে পড়ায় সুইপার বা হরিজন সম্প্রদায়ের মানুষ কাজ-চাকরি পাচ্ছে না। মূল পেশার অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়ে তারা সামাজিক অস্পৃশ্যতা এবং ঘৃণার কারণে অন্য পেশায়ও প্রবেশাধিকার পাচ্ছে না। ফলে তাদের দারিদ্র্য পরিস্িথতির আরও অবনতি হচ্ছে।
ভুমিদখল: গ্রামের ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের (যারা প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর ছত্রচ্ছায়ায় থাকে) দ্বারা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিবারগুলো জোরপূর্বক কিংবা জাল দলিলের মাধ্যমে বা অন্যান্য পন্থায় জমি থেকে উচ্ছেদের ঘটনা কোনো সরকারের আমলেই বন্ধ হয়নি। দখলকারীদের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কঠোর ব্যবস্থা না নেওয়া, জমিজমার কাগজপত্র ভালোভাবে সংরক্ষণ না করা প্রভৃতি কারণে ভুমি আত্মসাৎকারীদের তৎপরতা বিগত বছরগুলোতে ভয়াবহভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এসব জনগোষ্ঠীর হাজার হাজার পরিবার জমি হারিয়ে ইতিমধ্যেই ভুমিহীন হয়ে গেছে। অবিলম্বে এ প্রক্রিয়া বন্ধ করা প্রয়োজন এবং একই সঙ্গে জবরদখলকারীদের কাছ থেকে জমি উদ্ধার করে তা এসব পরিবারকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। ভুমিবিষয়ক আইনকানুন এবং তথ্যাদি না জানাও জমি হারানোর আরেকটি কারণ। ভুমি আইন বিষয়ে ব্যাপক প্রশিক্ষণ কর্মসুচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে জনসচেতনতা বাড়াতে সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে।
পারিবারিক ও সামাজিক নিরাপত্তাহীনতা: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার পরিবারগুলো সারা বছরই একধরনের নিরাপত্তাহীন অবস্থার মধ্যে বসবাস করে। নারীরাই এই নিরাপত্তাহীনতার প্রধান শিকার হন। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের দ্বারা সম্"মহানিসহ নানা ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করা, চুরি করাসহ নানা ধরনের মামলায় জড়িয়ে নিরাপত্তাহীন পরিস্িথতির সৃষ্টি করে স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি হাতিয়ে নিয়ে নিঃস্ব করার প্রক্রিয়া বন্ধে সরকারি সহায়তা প্রদান অত্যন্ত জরুরি। সরকারি হস্তক্ষেপ ছাড়া এই নিঃস্বকরণ প্রক্রিয়া চলতেই থাকবে।
তথ্যহীনতা: তথ্যহীনতা বা 'তথ্য দারিদ্র্য' এসব জনগোষ্ঠীর সামগ্রিক দারিদ্র্য পরিস্িথতির অবনতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সুচক হিসেবে কাজ করে। জমির মালিকানা রক্ষার জন্য কী কী কাগজপত্র সংরক্ষণ করা প্রয়োজন কিংবা কী কী পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন সে সম্পর্কে তথ্য এবং এসব বিষয়ে জনসচেতনতার অভাব দারিদ্র্যায়নের গতি বাড়িয়ে দেয়। সরকারি কোন অফিসে কী কী সার্ভিস ও সহায়তা পাওয়া যায় অনেক পরিবারই তা জানে না বা কীভাবে সে সার্ভিস পাওয়া যায় সে সম্পর্কে অবগত নয়। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষিসহ বিভিন্ন বিষয়ে তথ্য, জ্ঞান ও প্রযুক্তিও তাদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না। সরকারি উদ্যোগে এসব তথ্য পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে।
পরিবেশ বিপর্যয়: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী বা জাতিগোষ্ঠীগুলো বনভুমি, জলাভুমি প্রভৃতি প্রাকৃতিক সম্পদকে ব্যবহার উপযোগী করে বংশানুক্রমিকভাবে জীবন ধারণ করে আসছিল। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যক্তিগতভাবে দখল করার মাধ্যমে বন ও জলাভুমির প্রাকৃতিক পরিবেশকে নানাভাবে বিনষ্ট করা হয়েছে বা হচ্ছে। আর এতে প্রধানত ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এসব জনগোষ্ঠী। অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষের ফলে উপকুল এলাকার অনেক জেলায়ই খাওয়ার পানির যে সংকট দেখা দিয়েছে, তারও প্রধান শিকার এসব জনগোষ্ঠী।
আইনি ও বিচারিক সহায়তা না পাওয়া: দেশের নাগরিকেরা বিশেষ করে বিভিন্ন অবহেলিত গোষ্ঠীর পরিবারগুলো সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে কতটুকু আইনি ও বিচারিক সহায়তা পাচ্ছে তার ভিত্তিতে সুশাসনের পরিমাপ হওয়া প্রয়োজন। এই মাপকাঠিতে বিচার করলে বাংলাদেশের সুশাসন পরিস্িথতি সংশ্লিষ্ট জনগোষ্ঠীর সদস্যদের কাছে মোটেই সন্তোষজনক নয়। আইনি ও বিচারিক সহায়তা পাওয়ার বিষয়টি রাষ্ট্র ও সরকারকেই নিশ্চিত করতে হবে।

রাষ্ট্রীয় পরিষেবা না পাওয়া: ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর সদস্যরা রাষ্ট্রীয় পরিষেবা থেকে বঞ্চিত। 


সোনা কান্তি বড়ুয়া, টরন্টো থেকে   

বাংলাদেশ এনলাইটেনমেন্টে একদা দক্ষিন এশিয়ায় ব্রাহ্মণ ব্যতীত সবাই বৌদ্ধ ছিলেন। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর ব্রাহ্মণ রাজা  পুষ্যমিত্র (খৃষ্ঠ পূর্ব ১ম শতাব্দী) সহ চক্রান্তকারীরা বিভিন্ন জঙ্গীদের সাথে কূঠনীতি করে উপমহাদেশে বৌদ্ধধর্ম এবং মন্দির ধ্বংস করেন।কথাশিল্পী শওকত আলীর লেখা "প্রদোষে প্রাকৃতজন " এবং "দুষ্কালের দিবানিশি" গ্রন্থদ্বয়ে দক্ষিন এশিয়ার হিন্দু শাসকগণ কর্তৃক বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের রক্তাক্ত ইতিহাস লিপিবদ্ধ করেছেন। 

 সম্রাট আকবরের আমলে হিজরি সালকে  (চান্দ্র ক্যালেন্ডার) অনুসরন করে  জানা বঙ্গাব্দের  অজানা ইতিহাস আমরা  হিন্দু রাজনীতির (সৌর ক্যালেন্ডার) ঐতিহাসিক  ষড়যন্ত্রে ভুলে আছি। ১৪৩২ হিজরি ১৪১৮ বাংলা বা বঙ্গাব্দ হয় কি করে? যুজুর ভয়ে নৌকা পাহাড়ের উপর  দিয়ে চলে। আমরা আরব দেশে গিয়ে  আজ ১৪১৮ হিজরি সাল বলতে পারি না। এমন ভয়ঙ্কর মিথ্যা দিয়ে বঙ্গাব্দের ইতিহাস রচিত  হ'লো অথচ আমাদের জাতীয় বিবেকের জবাবদিহিতার শক্তি  মরে ধর্ম নামক বিভিন্নভয়  ভীতির কবলে।  ত্রয়োদশ শতাব্দীতে হিন্দুরাজনীতির খাঁচা ভাঙতে অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাংলার বৌদ্ধগণ ইসলাম ধর্ম কবুল করেছিলেন। যার ফলে পশ্চিম বাংলায় আজ ও বুদ্ধ পূর্ণিমায় সরকারি ছুটি নেই।

 বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা "চন্ডালিকা" শীর্ষক নৃত্যনাট্যে  বিশ্বমানবতার বানী অহিংসা পরম ধর্ম প্রচার করেছেন। হিন্দু মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃষ্ঠান সহ সকল মানব সন্তান মিলে আমাদের মানবজাতি। রাজনীতি ও ধর্ম মানবাধিকারকে ধ্বংস করা অমানবিক অপরাধ বলে কবি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের ভাষায়, "গোত্র দেবতা গর্তে পুরিয়া, / এশিয়া মিলাল শাক্যমুনি।" হিন্দু শাসকগণ বুদ্ধগয়ার মাধ্যমে রাজনীতির "ব্রহ্মজাল"  পেতে রেখেছে। এই চাণক্য রাজনীতির কূট কৌশলে ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজপাঠ। তাই জাতিভেদ প্রথার  ট্রাজেডিতে  "বৌদ্ধগণ" ভারতে হিন্দু রাজনীতির ক্রীতদাসে পরিনত হয়েছে। আজ বৌদ্ধধর্ম ভারতের গরীব আদিবাসীদের ও ডঃ  বি. আর. আম্ভেদকরের অনুসারীদের ধর্ম।

 বাংলাদেশে পালরাজত্বের পর  রাজা বল্লালসেনের মহামন্ত্রী হলায়ুধ মিশ্র আরবের শেখকে তোয়াজ করে "শেখ শুভোদয়া" রচনা করেছিলেন। তারপর বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশ আক্রমন করে তার ধর্মভিত্তিক রাজনীতির মাধ্যমে বাংলার বৌদ্ধগণ ইসলাম ধর্ম গ্রহন করেন। ভারতবর্ষে স্বাধীন বৌদ্ধ জাতির অস্তিত্ব ধ্বংস করে পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মের জয়গান, "সারা জাঁহা সে আচ্ছা হে হিন্দুস্থান তোমারা," এবং পশ্চিমবঙ্গে "বুদ্ধ পূর্নিমার" কোন সরকারি ছুটি নেই। কোলকাতার বাঙালি লেখক ও পন্ডিতগণ বুদ্ধপূর্নিমা সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গ সরকারকে কিছুই বলছেন না। ভারতে পলিটিক্যাল হিন্দু শাসকগণের অত্যাচারে বৌদ্ধগণ চন্ডালে বা নীচ জাতিতে পরিনত হয়েছে। হিন্দুশাসকদের কাছে বৌদ্ধগণ হিন্দু রাজনীতির গোলাম। শান্তিকামী হিন্দু জনতা বৌদ্ধদের পরম বন্ধু, কিন্তু পলিটিক্যাল অত্যাচারী হিন্দু শাসকগণই অভিশপ্ত বৌদ্ধদের শত্র"।   

        ব্রাহ্মণ্যবাদের মাফিয়াচক্রে "ধর্মের অপব্যবহারে" লোভী ব্রাহ্মণ সহ শাসকগণ জাতিভেদ প্রথায় সনাতন ধর্মের মস্তক বিক্রয় করে গণতান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মকে করেছিলেন। অধ্যাপক হরলাল রায় তাঁর লেখা 'চর্যাগীতি' গ্রন্থের দশম পৃষ্ঠায় লিখেছেন, 'ধর্মকোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় পালি সাহিত্যের উৎপত্তি। হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারত হতে বিতারিত হয়েছিল। আশ্চর্য্যরে বিষয়, বৌদ্ধ ধর্ম তাঁর জন্মভূমি হতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। মুসলমান আক্রমণের বহু পূর্বেই আমরা সারা ভারতে ব্রাহ্মণ্যধর্মের পূনরুত্থান দেখতে পাই। সংস্কৃত ভাষা ও চর্চা চলেছে তখন পুরোদমে। তাঁরাই বিধান দিলেনঃ অষ্টাদশ পূরণানি রামস্যচরিতানি চ। ভাষায়াং মানবঃ শ্রত্বা রৌরবং নরকং ব্রজেৎ। এভাবে যাঁরা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে আয়ত্ত করে নিজের কুক্ষিগত করেছিলেন। বিশেষতঃ  কুমারিল ভট্ট, শংকরাচার্য প্রমুখের নেতৃত্বে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবিগণ নিস্তেজ হয়ে পড়েন এবং রিক্ত সর্বশান্ত হয়ে তাঁরা ধীরে ধীরে ভারতবর্ষ হতে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।"


বলা অপ্রাসঙ্গিক হবে না, চর্যাপদগুলো নিয়ে যখন আমরা আলোচনায় বসি তখন সাধারণতঃ একটা প্রশ্ন জাগে যে, বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন এ চর্যাপদগুলো নেপালে ও ভূটানে পাওয়া গেল কেন?  চর্যাকারদের জীবনী গ্রন্থগুলোই বা তিব্বতি ভাষায় লেখা কেন? এ সমস্ত সমস্যামূলক প্রশ্নের উত্তরদানে একটু আলোচনা দরকার। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ্য যে, অনেক ভারতীয় লেখক ও পন্ডিত মনে করেন যে ভারতে বৌদ্ধ রাজাদের অহিংসা ও সন্ন্যাস নীতির কারণে ভারতীয় সামরিক শক্তির অবক্ষয়ের প্রেক্ষাপটে মধ্যপ্রাচ্যের তুর্কি সৈন্যদল ভারত ও বাংলা জয় করে নিল। যাঁরা ইতিহাস চর্চার সঙ্গে যুক্ত তাঁদের জিজ্ঞাস্যঃ পাঠান ও তুর্কি সৈন্যগণ কি শুধু বৌদ্ধ বিহার, বিশ্ববিদ্যালয় ও মন্দির ধ্বংস করল? তাহলে পুরীর বৌদ্ধবিহারকে কারা হিন্দুর জগন্নাথ মন্দিরে দীক্ষা দিল?


 "চন্ডালিকা" বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে রবি ঠাকুরের কুঠারাঘাত


চন্ডালিকা   


একদল ফুলওয়ালি চলেছে ফুল বিক্রি করতে

 

ফুলওয়ালির দল।

   নব বসন্তের দানের ডালি এনেছি তোদেরি দ্বারে,

                                      আয় আয় আয়,

                              পরিবি গলার হারে।

                       লতার বাঁধন হারায়ে মাধবী মরিছে কেঁদে--

                       বেণীর বাঁধনে রাখিবি বেঁধে,

                       অলকদোলায় দুলাবি তারে,

                                    আয় আয় আয়।

                             বনমাধুরী করিবি চুরি

                             আপন নবীন মাধুরীতে--

                       সোহিনী রাগিণী জাগাবে সে তোদের

                       দেহের বীণার তারে তারে,

                                    আয় আয় আয়॥

--

 

 

                       আমার মালার ফুলের দলে আছে লেখা

                                বসন্তের মন্ত্রলিপি।

                       এর মাধুর্যে আছে যৌবনের আমন্ত্রণ।

                       সাহানা রাগিণী এর

                              রাঙা রঙে রঞ্জিত,

                       মধুকরের ক্ষুধা অশ্রুত ছন্দে

                              গন্ধে তার গুঞ্জরে।

                   আন্‌ গো ডালা, গাঁথ্‌ গো মালা,

                   আন্‌ মাধবী মালতী অশোকমঞ্জরী,

                            আয় তোরা আয়।

                   আন্‌ করবী রঙ্গন কাঞ্চন রজনীগন্ধা

                              প্রফুল্ল মল্লিকা,

                            আয় তোরা আয়।

                   মালা পর্‌ গো মালা পর্‌ সুন্দরী,

                            ত্বরা কর্‌ গো ত্বরা কর্‌।

                   আজি পূর্ণিমা রাতে জাগিছে চন্দ্রমা,

                             বকুলকুঞ্জ

                   দক্ষিণবাতাসে দুলিছে কাঁপিছে

                             থরথর মৃদু মর্মরি।

                   নৃত্যপরা বনাঙ্গনা বনাঙ্গনে সঞ্চরে,

                   চঞ্চলিত চরণ ঘেরি মঞ্জীর তার গুঞ্জরে।

                   দিস নে মধুরাতি বৃথা বহিয়ে

                             উদাসিনী, হায় রে।

                   শুভলগন গেলে চলে ফিরে দেবে না ধরা,

                             সুধাপসরা

                   ধুলায় দেবে শূন্য করি,

                             শুকাবে বঞ্জুলমঞ্জরী।

                   চন্দ্রকরে অভিষিক্ত নিশীথে ঝিল্লিমুখর বনছায়ে

                   তন্দ্রাহারা পিক-বিরহকাকলি-কূজিত দক্ষিণবায়ে

                   মালঞ্চ মোর ভরল ফুলে ফুলে ফুলে গো,

                   কিংশুকশাখা চঞ্চল হল দুলে দুলে গো॥

 

 

দইওয়ালার প্রবেশ

 

দইওয়ালা।

          দই চাই গো, দই চাই, দই চাই গো?

                          শ্যামলী আমার গাই,

                          তুলনা তাহার নাই।

                   কঙ্কনানদীর ধারে

                   ভোরবেলা নিয়ে যাই তারে--

                   দূর্বাদলঘন মাঠে তারে

                            সারা বেলা চরাই, চরাই গো।

                   দেহখানি তার চিক্কণ কালো,

                   যত দেখি তত লাগে ভালো।

                          কাছে বসে যাই ব'কে,

                          উত্তর দেয় সে চোখে,

                   পিঠে মোর রাখে মাথা--

                   গায়ে তার হাত বুলাই, হাত বুলাই গো॥

 

মেয়ে।

        ওকে    ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,

                ও যে    চণ্ডালিনীর ঝি--

                       নষ্ট হবে যে দই

                       সে কথা জানো না কি।

 

[ দইওয়ালার প্রস্থান

 

চুড়িওয়ালার প্রবেশ

 

চুড়িওয়ালা।

  ওগো      তোমরা যত পাড়ার মেয়ে,

                          এসো এসো দেখো চেয়ে,

                             এনেছি কাঁকনজোড়া

                             সোনালি তারে মোড়া।

                         আমার কথা শোনো,

                               হাতে লহ প'রে,

                             যারে রাখিতে চাহ ধ'রে

                             কাঁকন দুটি বেড়ি হয়ে

                                   বাঁধিবে মন তাহার--

                                      আমি দিলাম কয়ে॥

 

প্রকৃতি চুড়ি নিতে হাত বাড়াতেই

 

মেয়েরা।

                   ওকে    ছুঁয়ো না, ছুঁয়ো না, ছি,

                             ও যে চণ্ডালিনীর ঝি।

 

[ চুড়িওয়ালা প্রভৃতির প্রস্থান

 

প্রকৃতি।

        যে আমারে পাঠাল এই

                           অপমানের অন্ধকারে

          পূজিব না, পূজিব না সেই দেবতারে পূজিব না।

                কেন দিব ফুল, কেন দিব ফুল,

                            কেন দিব ফুল আমি তারে--

                      যে আমারে চিরজীবন

                                রেখে দিল এই ধিক্‌কারে।

          জানি না হায় রে   কী দুরাশায় রে

             পূজাদীপ জ্বালি মন্দিরদ্বারে।

                  আলো তার নিল হরিয়া

                       দেবতা ছলনা করিয়া,

                            আঁধারে রাখিল আমারে॥

 

পথ বেয়ে বৌদ্ধ ভিক্ষুগণ

 

ভিক্ষুগণ।

            যো সন্নিসিন্নো

                        বরবোধিমূলে,

                  মারং সসেনং মহতিং বিজেত্বা

                  সম্বোধি মাগঞ্চি অনন্তঞ্‌ঞানে

                  লোকুত্তমা তং পণমামি বুদ্ধ।

 

[ প্রস্থান

 

প্রকৃতির মা মায়ার প্রবেশ

 

মা।

         কী যে ভাবিস তুই অন্যমনে

                             নিষ্কারণে--

                  বেলা বহে যায়, বেলা বহে যায় যে।

              রাজবাড়িতে ওই বাজে ঘণ্টা ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং,

                                    বেলা বহে যায়।

                         রৌদ্র হয়েছে অতি তিখনো

                         আঙিনা হয় নি যে নিকোনো,

                             তোলা হল না জল,

                             পাড়া হল না ফল,

                         কখন্‌ বা চুলো তুই ধরাবি।

                         কখন্‌ ছাগল তুই চরাবি।

                             ত্বরা কর্‌, ত্বরা কর্‌, ত্বরা কর্‌--

                             জল তুলে নিয়ে তুই চল্‌ ঘর।

                         রাজবাড়িতে ওই বাজে ঘণ্টা

                             ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং ঢং

                                   ওই যে বেলা বহে যায়।

 

প্রকৃতি।

               কাজ নেই, কাজ নেই মা,

                         কাজ নেই মোর ঘরকন্নায়।

                             যাক ভেসে যাক

                                      যাক ভেসে সব বন্যায়।

                              জন্ম কেন দিলি মোরে,

                              লাঞ্ছনা জীবন ভ'রে--

                         মা হয়ে আনিলি এই অভিশাপ!

                         কার কাছে বল্‌ করেছি কোন্‌ পাপ,

                    বিনা অপরাধে একি ঘোর অন্যায়॥

 

মা।

     থাক্‌ তবে থাক্‌ তুই পড়ে,

                         মিথ্যা কান্না কাঁদ্‌ তুই

                                 মিথ্যা দুঃখ গ'ড়ে॥

 

[ প্রস্থান

 

প্রকৃতির জল তোলা

 

বুদ্ধশিষ্য আনন্দের প্রবেশ

 

আনন্দ।

       জল দাও আমায় জল দাও,

                      রৌদ্র প্রখরতর, পথ সুদীর্ঘ,

                               আমায় জল দাও।

                        আমি তাপিত পিপাসিত,

                          আমায় জল দাও।

                              আমি শ্রান্ত,

                                   আমায় জল দাও।

 

প্রকৃতি।

      ক্ষমা করো প্রভু, ক্ষমা করো মোরে--

                         আমি চণ্ডালের কন্যা,

                    মোর কূপের বারি অশুচি।

                তোমারে দেব জল হেন পুণ্যের আমি

                                    নহি অধিকারিণী,

                        আমি চণ্ডালের কন্যা।

 

আনন্দ।

     যে মানব আমি সেই মানব তুমি কন্যা।

                   সেই বারি তীর্থবারি

                        যাহা তৃপ্ত করে তৃষিতেরে,

                   যাহা তাপিত শ্রান্তেরে স্নিগ্ধ ক'রে

                               সেই তো পবিত্র বারি।

                       জল দাও আমায় জল দাও।

 

জল দান

 

[ প্রস্থান

 

প্রকৃতি।

         শুধু একটি গণ্ডূষ জল,

           আহা নিলেন তাঁহার করপুটের কমলকলিকায়।

              আমার কূপ যে হল অকূল সমুদ্র--

          এই যে নাচে এই যে নাচে তরঙ্গ তাহার,

              আমার জীবন জুড়ে নাচে--

                            টলোমলো করে আমার প্রাণ,

                                    আমার জীবন জুড়ে নাচে।

                  ওগো কী আনন্দ, কী আনন্দ, কী পরম মুক্তি!

                                    একটি গণ্ডূষ জল--

                  আমার জন্মজন্মান্তরের কালি ধুয়ে দিল গো

                                    শুধু একটি গণ্ডূষ জল॥

 

মেয়ে পুরুষের প্রবেশ

 

ফসল কাটার আহ্বান

 

                       মাটি তোদের ডাক দিয়েছে আয় রে চলে,

                                    আয় আয় আয়।

                       ডালা যে তার ভরেছে আজ পাকা ফসলে--

                                    মরি    হায় হায় হায়।

                             হাওয়ার নেশায় উঠল মেতে,

                             দিগ্‌ বধূরা ফসলখেতে,

                       রোদের সোনা ছড়িয়ে পড়ে ধরার আঁচলে--

                                    মরি    হায় হায় হায়।

                       মাঠের বাঁশি শুনে শুনে আকাশ খুশি হল।

                       ঘরেতে আজ কে রবে গো, খোলো দুয়ার খোলো।

                             আলোর হাসি উঠল জেগে,

                             পাতায় পাতায় চমক লেগে

                       বনের খুশি ধরে না গো, ওই যে উথলে--

                                    মরি    হায় হায় হায়॥

 

প্রকৃতি।

             ওগো     ডেকো না মোরে ডেকো না।

                       আমার কাজভোলা মন, আছে দূরে কোন্‌--

                               করে স্বপনের সাধনা।

                          ধরা দেবে না অধরা ছায়া,

                          রচি গেছে মনে মোহিনী মায়া--

                               জানি না এ কী দেবতারি দয়া,

                               জানি না এ কী ছলনা।

                   আঁধার অঙ্গনে প্রদীপ জ্বালি নি,

                   দগ্ধ কাননের আমি যে মালিনী,

                   শূন্য হাতে আমি কাঙালিনী

                         করি নিশিদিন যাপনা।

                   যদি সে আসে তার চরণছায়ে

                   বেদনা আমার দিব বিছায়ে,

                   জানাব তাহারে অশ্রুসিক্ত

                   রিক্ত জীবনের কামনা॥

 

দ্বিতীয় দৃশ্য


অর্ঘ্য নিয়ে বৌদ্ধনারীদের মন্দিরে গমন

 

                    স্বর্ণবর্ণে সমুজ্জ্বল নব চম্পাদলে

                    বন্দিব শ্রীমুনীন্দ্রের পাদপদ্মতলে।

                    পুণ্যগন্ধে পূর্ণ বায়ু হল সুগন্ধিত,

                    পুষ্পমাল্যে করি তাঁর চরণ বন্দিত॥

 

[ প্রস্থান

 

প্রকৃতি।

         ফুল বলে, ধন্য আমি

                               ধন্য আমি মাটির 'পরে।

                   দেবতা ওগো, তোমার সেবা

                               আমার ঘরে।

                   জন্ম নিয়েছি ধূলিতে,

                   দয়া করে দাও ভুলিতে,

                               নাই ধূলি মোর অন্তরে।

                      নয়ন তোমার নত করো,

                      দলগুলি কাঁপে থরোথরো।

                               চরণপরশ দিয়ো দিয়ো,

                        ধূলির ধনকে করো স্বর্গীয়,

                                    ধরার প্রণাম আমি তোমার তরে॥

 

মা।

                 তুই অবাক ক'রে দিলি আমায় মেয়ে।

                              পুরাণে শুনি না কি তপ করেছেন উমা

                                    রোদের জ্বলনে,

                                           তোর কি হল তাই।

 

প্রকৃতি।

              হাঁ মা, আমি বসেছি তপের আসনে।

 

মা।

                    তোর সাধনা কাহার জন্যে।

 

প্রকৃতি।

              যে আমারে দিয়েছে ডাক,

                                বচনহারা আমাকে দিয়েছে বাক্‌।

                        যে আমারি জেনেছে নাম,

                               ওগো তারি নামখানি মোর হৃদয়ে থাক্‌।

                            আমি তারি বিচ্ছেদদহনে

                              তপ করি চিত্তের গহনে।

                        দুঃখের পাবকে হয়ে যায় শুদ্ধ

                              অন্তরে মলিন যাহা আছে রুদ্ধ,

                        অপমান-নাগিনীর খুলে যায় পাক॥

 

মা।

                 কিসের ডাক তোর কিসের ডাক।

                      কোন্ পাতালবাসী অপদেবতার ইশারা

                             তোকে ভুলিয়ে নিয়ে যাবে,

                                    আমি মন্ত্র প'ড়ে কাটাব তার মায়া।

 

প্রকৃতি।

            আমার মনের মধ্যে বাজিয়ে দিয়ে গেছে--

                                          জল দাও, জল দাও।

 

মা।

                 পোড়া কপাল আমার!

                                   কে বলেছে তোকে "জল দাও'!

                         সে কি তোর আপন জাতের কেউ।

 

প্রকৃতি।

            হাঁ গো মা, সেই কথাই তো ব'লে গেলেন তিনি,

                            তিনি আমার আপন জাতের লোক।

                       আমি চণ্ডালী, সে যে মিথ্যা, সে যে মিথ্যা,

                             সে যে দারুণ মিথ্যা।

                      শ্রাবণের কালো যে মেঘ

                             তারে যদি নাম দাও "চণ্ডাল',

                      তা ব'লে কি জাত ঘুচিবে তার,

                             অশুচি হবে কি তার জল।

                      তিনি ব'লে গেলেন আমায়--

                             নিজেরে নিন্দা কোরো না,

                      মানবের বংশ তোমার,

                             মানবের রক্ত তোমার নাড়ীতে।

              ছি ছি মা, মিথ্যা নিন্দা রটাস নে নিজের,

                             সে-যে পাপ।

                      রাজার বংশে দাসী জন্মায় অসংখ্য,

                             আমি সে দাসী নই।

                      দ্বিজের বংশে চণ্ডাল কত আছে,

                             আমি নই চণ্ডালী।

 

মা।

                 কী কথা বলিস তুই,

                                      আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে।

                             তোর মুখে কে দিল এমন বাণী।

                      স্বপ্নে কি কেউ ভর করেছে তোকে

                                      তোর গতজন্মের সাথি।

                             আমি যে তোর ভাষা বুঝি নে।

 

প্রকৃতি।

    এ নতুন জন্ম, নতুন জন্ম,

                            নতুন জন্ম আমার।

              সেদিন বাজল দুপুরের ঘণ্টা,

                             ঝাঁ ঝাঁ করে রোদ্‌দুর,

                   স্নান করাতেছিলেম কুয়োতলায়

                               মা-মরা বাছুরটিকে।

                         সামনে এসে দাঁড়ালেন

                                   বৌদ্ধ ভিক্ষু আমার--

                              বললেন, জল দাও।

                        শিউরে উঠল দেহ আমার,

                                    চমকে উঠল প্রাণ।

                            বল্‌ দেখি মা,

                        সারা নগরে কি কোথাও নেই জল!

                 কেন এলেন আমার কুয়োর ধারে,

                        আমাকে দিলেন সহসা

                                মানুষের তৃষ্ণা-মেটানো সম্মান।

                                   --

 

                       বলে,   দাও জল, দাও জল।

             দেব আমি কে দিয়েছে হেন সম্বল।

                      কালো মেঘ-পানে চেয়ে

                          এল ধেয়ে

                                চাতক বিহ্বল--

                         বলে,   দাও জল।

                    ভূমিতলে হারা

                          উৎসের ধারা

                                অন্ধকারে

                                      কারাগারে।

                                কার সুগভীর বাণী

                                      দিল হানি

                                   কালো শিলাতল--

                                        বলে    দাও জল॥

 

মা।

                   বাছা, মন্ত্র করেছে কে তোকে,

                             তোর     পথ-চাওয়া মন টান দিয়েছে কে।

 

প্রকৃতি।

             সে যে পথিক আমার,

                             হৃদয়পথের পথিক আমার।

                       হায় রে আর সে তো এল না এল না,

                                এ পথে এল না,

                          আর সে যে চাইল না জল।

             আমার হৃদয় তাই হল মরুভূমি,

                                  শুকিয়ে গেল তার রস--

                             সে যে চাইল না জল।

--

 

                         চক্ষে আমার তৃষ্ণা,

                              তৃষ্ণা আমার বক্ষ জুড়ে।

                         আমি বৃষ্টিবিহীন বৈশাখী দিন,

                              সন্তাপে প্রাণ যায় যে পুড়ে।

                         ঝড় উঠেছে তপ্ত হাওয়ায় হাওয়ায়,

                              মনকে সুদূর শূন্যে ধাওয়ায়--

                                   অবগুণ্ঠন যায় যে উড়ে।

                         যে ফুল কানন করত আলো,

                                   কালো হয়ে সে শুকালো।

                               ঝরনারে কে দিল বাধা--

                                    নিষ্ঠুর পাষাণে বাঁধা

                                          দুঃখের শিখরচূড়ে॥

 

মা।

                 বাছা, সহজ ক'রে বল আমাকে

                                    মন কাকে তোর চায়।

                               বেছে নিস মনের মতন বর--

                                    রয়েছে তো অনেক আপন জন।

                                         আকাশের চাঁদের পানে

                                              হাত বাড়াস নে।

 

প্রকৃতি।

                   আমি চাই তাঁরে

                      আমারে দিলেন যিনি সেবিকার সম্মান,

                             ঝড়ে-পড়া ধুতরো ফুল

                      ধুলো হতে তুলে নিলেন যিনি দক্ষিণ করে।

                            ওগো প্রভু, ওগো প্রভু

                              সেই ফুলে মালা গাঁথো,

                                পরো পরো আপন গলায়,

                            ব্যর্থ হতে তারে দিয়ো না দিয়ো না।

 

রাজবাড়ির অনুচরের প্রবেশ

 

অনুচর।

         সাত দেশেতে খুঁজে খুঁজে গো

                                শেষকালে এই ঠাঁই

                            ভাগ্যে দেখা পেলেম রক্ষা তাই।

 

মা।

               কেন গো কী চাই।

 

অনুচর।

         রানীমার পোষা পাখি কোথায় উড়ে গেছে--

                            সেই নিদারুণ শোকে

                              ঘুম নেই তাঁর চোখে,

                                  ও চারণের বউ।

                        ফিরিয়ে এনে দিতেই হবে তোকে,

                                ও চারণের বউ।

 

মা।

               উড়োপাখি আসবে ফিরে

                                এমন কী গুণ জানি।

 

অনুচর।

         মিথ্যে ওজর শুনব না, শুনব না,

                          শুনবে না তোর রানী।

                   জাদু ক'রে মন্ত্র প'ড়ে ফিরে আনতেই হবে

                                খালাস পাবি তবে,

                                     ও চারণের বউ।

 

[ প্রস্থান

 

প্রকৃতি।

             ওগো মা, ওই কথাই তো ভালো।

                              মন্ত্র জানিস তুই,

                                মন্ত্র প'ড়ে

                                      দে তাঁকে তুই এনে।

 

মা।

                   ওরে সর্বনাশী, কী কথা তুই বলিস--

                                    আগুন নিয়ে খেলা!

                             শুনে বুক কেঁপে ওঠে,

                                        ভয়ে মরি।

 

প্রকৃতি।

             আমি ভয় করি নে মা,

                                ভয় করি নে।

                            ভয় করি মা, পাছে

             সাহস যায় নেমে,

                        পাছে নিজের আমি মূল্যে ভুলি।

                   এত বড়ো স্পর্ধা আমার,

                               এ কী আশ্চর্য!

                        এই আশ্চর্য সে'ই ঘটিয়েছে--

                            তারো বেশি ঘটবে না কি,

                   আসবে না আমার পাশে,

                             বসবে না আধো-আঁচলে?

 

মা।

            তাঁকে আনতে যদি পারি

                       মূল্য দিতে পারবি কি তুই তার।

                          জীবনে কিছুই যে তোর

                                  থাকবে না বাকি।

 

প্রকৃতি।

        না, কিছুই থাকবে না, কিছুই থাকবে না,

                          কিছুই না, কিছুই না।

                    যদি আমার সব মিটে যায়

                             সব মিটে যায়,

                    তবেই আমি বেঁচে যাব যে

                             চিরদিনের তরে

                    যখন কিছুই থাকবে না।

                  দেবার আমার আছে কিছু

                            এই কথাটাই যে

                 ভুলিয়ে রেখেছিল সবাই মিলে--

            আজ জেনেছি, আমি নই-যে অভাগিনী;

                 দেবই আমি, দেবই আমি, দেব,

                        উজাড় করে দেব আমারে।

                 কোনো ভয় আর নেই আমার।

                      পড়্‌ তোর মন্তর, পড়্‌ তোর মন্তর,

                ভিক্ষুরে নিয়ে আয় অমানিতার পাশে,

                          সে'ই তারে দিবে সম্মান--

                      এত মান আর কেউ দিতে কি পারে।

 

মা।

               বাছা, তুই যে আমার বুকচেরা ধন।

                             তোর কথাতেই চলেছি

                                      পাপের পথে, পাপীয়সী।

                             হে পবিত্র মহাপুরুষ,

                                      আমার অপরাধের শক্তি যত

                             ক্ষমার শক্তি তোমার

                                      আরো অনেক গুণে বড়ো।

                             তোমারে করিব অসম্মান--

                 তবু প্রণাম, তবু প্রণাম, তবু প্রণাম।

 

প্রকৃতি।

         আমায়     দোষী করো।

                             ধুলায়-পড়া ম্লান কুসুম

                                      পায়ের তলায় ধরো।

                             অপরাধে ভরা ডালি

                   নিজ হাতে করো খালি,

              তার পরে সেই শূন্য ডালায়

                 তোমার করুণা ভরো--

                        আমায় দোষী করো।

            তুমি উচ্চ, আমি তুচ্ছ

                      ধরব তোমায় ফাঁদে

                         আমার অপরাধে।

                    আমার দোষকে তোমার পুণ্য

                         করবে তো কলঙ্কশূন্য--

                    ক্ষমায় গেঁথে সকল ত্রুটি

                             গলায় তোমার পরো॥

 

মা।

        কী অসীম সাহস তোর, মেয়ে।

 

প্রকৃতি।

         আমার সাহস!

                      তাঁর সাহসের নাই তুলনা।

                 কেউ যে কথা বলতে পারে নি

              তিনি ব'লে দিলেন কত সহজে--

                            জল দাও।

         ওই একটু বাণী--

                                   তার দীপ্তি কত;

                        আলো ক'রে দিল আমার সারা জন্ম।

                   বুকের উপর কালো পাথর চাপা ছিল যে,

                               সেটাকে ঠেলে দিল--

                                    উথলি উঠল রসের ধারা।

 

মা।

                     ওরা কে যায়

                            পীতবসন-পরা সন্ন্যাসী।

 

বৌদ্ধ ভিক্ষুর দল

 

ভিক্ষুগণ।

              নমো নমো বুদ্ধদিবাকরায়,

                         নমো নমো গোতমচন্দিমায়,

                              নমো নমো নন্তগুণণ্ণরায়,

                                   নমো নমো সাকিয়নন্দনায়।

 

প্রকৃতি।

            মা, ওই যে তিনি চলেছেন

                                    সবার আগে আগে!

                       ফিরে তাকালেন না, ফিরে তাকালেন না--

                                তাঁর নিজের হাতের এই নূতন সৃষ্টিরে

                                        আর দেখিলেন না চেয়ে!

                                এই মাটি, এই মাটি, এই মাটিই তোর

                                        আপন রে!

                          হতভাগিনী, কে তোরে আনিল আলোতে

                                         শুধু এক নিমেষের জন্যে!

                                থাকতে হবে তোকে মাটিতেই

                                      সবার পায়ের তলায়।

 

মা।

     ওরে বাছা, দেখতে পারি নে তোর দুঃখ--

                               আনবই আনবই, আনবই তারে

                                              মন্ত্র প'ড়ে।

 

প্রকৃতি।

                পড়্‌ তুই সব চেয়ে নিষ্ঠুর মন্ত্র,

পাকে পাকে দাগ দিয়ে

                             জড়ায়ে ধরুক ওর মনকে।

                        যেখানেই যাক,

                             কখনো এড়াতে আমাকে

                                   পারবে না, পারবে না।

 

আকর্ষণীমন্ত্রে যোগ দেবার জন্যে মা

 

তার শিষ্যাদলকে ডাক দিল

 

মা।

             আয় তোরা আয়,

                         আয় তোরা আয়।

 

তাদের প্রবেশ ও নৃত্য

 

                      যায় যদি যাক সাগরতীরে--

                         আবার আসুক, আসুক ফিরে।

                               রেখে দেব আসন পেতে

                                        হৃদয়েতে।

                               পথের ধুলো ভিজিয়ে দেব

                                        অশ্রুনীরে।

                               যায় যদি যাক শৈলশিরে--

                         আসুক ফিরে, আসুক ফিরে।

                                  লুকিয়ে রব গিরিগুহায়,

                                          ডাকব উহায়--

                                  আমার স্বপন ওর জাগরণ

                                          রইবে ঘিরে॥

 

মায়ের মায়ানৃত্য

 

মা।

                     ভাবনা করিস নে তুই--

                               এই দেখ্‌ মায়াদর্পণ আমার,

                                     হাতে নিয়ে নাচবি যখন

                     দেখতে পাবি তাঁর কী হল দশা।

                   এইবার এসো এসো রুদ্রভৈরবের সন্তান,

                              জাগাও তাণ্ডবনৃত্য।

 

[ প্রস্থান

 

তৃতীয় দৃশ্য


মায়ের মায়ানৃত্য

 

প্রকৃতি।

                  ওই দেখ্‌ পশ্চিমে মেঘ ঘনালো,

                                      মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে--

                                   উড়ে যাবে শুষ্ক সাধনা সন্ন্যাসীর

                                      শুকনো পাতার মতন।

                                   নিববে বাতি, পথ হবে অন্ধকার,

                                      ঝড়ে-বাসা-ভাঙা পাখি

                                   ঘুরে ঘুরে পড়বে এসে মোর দ্বারে।

                                      দুরু দুরু করে মোর বক্ষ,

                                   মনের মাঝে ঝিলিক দিতেছে বিজুলি।

                                   দূরে যেন ফেনিয়ে উঠেছে সমুদ্র--

                                      তল নেই, কূল নেই তার।

                                      মন্ত্র খাটবে মা, খাটবে।

 

মা।

                       এইবার আয়নার সামনে নাচ্‌ দেখি তুই,

                                      দেখ্‌ দেখি কী ছায়া পড়ল।

 

প্রকৃতির নৃত্য

 

প্রকৃতি।

                  লজ্জা ছি ছি লজ্জা!

                              আকাশে তুলে দুই বাহু

                                        অভিশাপ দিচ্ছেন কাকে।

                                   নিজেরে মারছেন বহ্নির বেত্র,

                                      শেল বিঁধছেন যেন আপনার মর্মে।

 

মা।

                       ওরে বাছা, এখনি অধীর হলি যদি,

                                   শেষে তোর কী হবে দশা।

 

প্রকৃতি।

               আমি দেখব না, আমি দেখব না,

                               আমি দেখব না তোর দর্পণ।

                            বুক ফেটে যায়, যায় গো,

                                      বুক ফেটে যায়।

                            কী ভয়ংকর দুঃখের ঘূর্ণিঝঞ্ঝা--

                         মহান বনস্পতি ধুলায় কি লুটাবে,

                                    ভাঙবে কি অভ্রভেদী তার গৌরব।

                         দেখব না, আমি দেখব না তোর দর্পণ।

                                         না না না।

 

মা।

                         থাক্‌ তবে থাক্‌ এই মায়া।

                                   প্রাণপণে ফিরিয়ে আনব মোর মন্ত্র--

                                        নাড়ী যদি ছিঁড়ে যায় যাক,

                                   ফুরায়ে যায় যদি যাক নিশ্বাস।

 

প্রকৃতি।

                   সেই ভালো মা, সেই ভালো।

                                        থাক্‌ তোর মন্ত্র, থাক্‌ তোর--

                                   আর কাজ নাই, কাজ নাই ,কাজ নাই।

                             না না না, পড়্‌ মন্ত্র তুই, পড়্‌ তোর মন্ত্র--

                                        পথ তো আর নেই বাকি!

                                   আসবে সে, আসবে সে, আসবে,

                               আমার জীবনমৃত্যু-সীমানায় আসবে।

                                  নিবিড় রাত্রে এসে পৌঁছবে পান্থ,

                                    বুকের জ্বালা দিয়ে আমি

                                        জ্বালিয়ে দিব দীপখানি--

                                              সে আসবে।

                                     --

 

                               দুঃখ দিয়ে মেটাব দুঃখ তোমার।

                                           স্নান করাব অতল জলে

                                                 বিপুল বেদনার।

                               মোর সংসার দিব যে জ্বালি,

                             শোধন হবে এ মোহের কালি--

                                  মরণব্যথা দিব তোমার

                                        চরণে উপহার॥

 

মা।

                    বাছা, মোর মন্ত্র আর তো বাকি নেই,

                                   প্রাণ মোর এল কণ্ঠে।

 

প্রকৃতি।

              মা গো, এতদিনে মনে হচ্ছে যেন

                                   টলেছে আসন তাঁহার।

                              ওই আসছে, আসছে, আসছে।

                        যা বহু দূরে, যা লক্ষ যোজন দূরে,

                                  যা চন্দ্রসূর্য পেরিয়ে,

                              ওই আসছে, আসছে, আসছে--

                                  কাঁপছে আমার বক্ষ ভূমিকম্পে।

 

মা।

                   বল্‌ দেখি বাছা, কী তুই দেখছিস আয়নায়।

 

প্রকৃতি।

             ঘন কালো মেঘ তাঁর পিছনে,

                                    চারি দিকে বিদ্যুৎ চমকে।

                            অঙ্গ ঘিরে ঘিরে তাঁর

                                        অগ্নির আবেষ্টন,

                                  যেন শিবের ক্রোধানলদীপ্তি।

                            তোর মন্ত্রবাণী ধরি কালীনাগিনীমূর্তি

                                  গর্জিছে বিষনিশ্বাসে,

                                      কলুষিত করে তাঁর পুণ্যশিখা।

 

আনন্দের ছায়া-অভিনয়

 

মা।

                   ওরে পাষাণী,

                        কী নিষ্ঠুর মন তোর,

                         কী কঠিন প্রাণ,

                        এখনো তো আছিস বেঁচে।

 

প্রকৃতি।

             ক্ষুধার্ত প্রেম তার নাই দয়া,

                                     তার নাই ভয়, নাই লজ্জা।

             নিষ্ঠুর পণ আমার,

                  আমি মানব না হার, মানব না হার--

                       বাঁধব তাঁরে মায়াবাঁধনে,

                             জড়াব আমারি হাসি-কাঁদনে।

                       ওই দেখ্‌, ওই নদী হয়েছেন পার--

                             একা চলেছেন ঘন বনের পথে।

                       যেন কিছু নাই তাঁর চোখের সম্মুখে--

                                  নাই সত্য, নাই মিথ্যা;

                                      নাই ভালো, নাই মন্দ।

 

মাকে নাড়া দিয়ে

 

                             দুর্বল হোস নে হোস নে,

                       এইবার পড়্‌ তোর শেষনাগমন্ত্র--

                             নাগপাশ-বন্ধনমন্ত্র।

 

মা।

       জাগে নি এখনো জাগে নি

                  রসাতলবাসিনী নাগিনী।

                       বাজ্‌ বাজ্‌ বাজ্‌ বাঁশি, বাজ্‌ রে

                              মহাভীমপাতালী রাগিণী,

                                    জেগে ওঠ্‌ মায়াকালী নাগিনী--

                               ওরে মোর মন্ত্রে কান দে--

                      টান দে, টান দে, টান দে, টান দে।

                             বিষগর্জনে ওকে ডাক দে--

                       পাক দে, পাক দে, পাক দে,পাক দে।

                                গহ্বর হতে তুই বার হ,

                                     সপ্তসমুদ্র পার হ।

                                          বেঁধে তারে আন্‌ রে--

                                      টান্‌ রে, টান্‌ রে, টান্‌ রে, টান্‌ রে।

                                   নাগিনী জাগল, জাগল, জাগল--

                                 পাক দিতে ওই লাগল, লাগল, লাগল--

                            মায়াটান ওই টানল, টানল, টানল।

                            বেঁধে আনল, বেঁধে আনল, বেঁধে আনল॥

                      এইবার নৃত্যে করো আহ্বান--

                               ধর্‌ তোরা গান।

                      আয় তোরা যোগ দিবি আয়

                               যোগিনীর দল।

                         আয় তোরা আয়,

                            আয় তোরা আয়,

                              আয় তোরা আয়।

 

সকলে।

          ঘুমের ঘন গহন হতে যেমন আসে স্বপ্ন,

                               তেমনি উঠে এসো এসো।

                   শমীশাখার বক্ষ হতে যেমন জ্বলে অগ্নি,

                               তেমনি তুমি, এসো এসো।

                   ঈশানকোণে কালো মেঘের নিষেধ বিদারি

                         যেমন আসে সহসা বিদ্যুৎ,

                   তেমনি তুমি চমক হানি এসো হৃদয়তলে,

                         এসো তুমি, এসো তুমি এসো এসো।

                   আঁধার যবে পাঠায় ডাক মৌন ইশারায়,

                         যেমন আসে কালপুরুষ সন্ধ্যাকাশে

                              তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো।

                         সুদূর হিমগিরির শিখরে

                   মন্ত্র যবে প্রেরণ করে তাপস বৈশাখ,

                   প্রখর তাপে কঠিন ঘন তুষার গলায়ে

                         বন্যাধারা যেমন নেমে আসে--

                              তেমনি তুমি এসো, তুমি এসো এসো॥

 

মা।

               আর দেরি করিস নে, দেখ্‌ দর্পণ--

                         আমার শক্তি হল যে ক্ষয়।

 

প্রকৃতি।

         না, দেখব না আমি দেখব না,

                                   আমি শুনব--

                   মনের মধ্যে আমি শুনব,

                   ধ্যানের মধ্যে আমি শুনব,

                                   তাঁর চরণধ্বনি।

                       ওই দেখ্‌ এল ঝড়, এল ঝড়,

                                  তাঁর আগমনীর ওই ঝড়--

                            পৃথিবী কাঁপছে থরো থরো থরো থরো,

                                গুরু গুরু করে মোর বক্ষ।

 

মা।

               তোর অভিশাপ নিয়ে আসে

                                     হতভাগিনী।

 

প্রকৃতি।

               অভিশাপ নয় নয়,

                       অভিশাপ নয় নয়--

                   আনছে আমার জন্মান্তর,

                       মরণের সিংহদ্বার ওই খুলছে।

                             ভাঙল দ্বার,

                                   ভাঙল প্রাচীর,

                                         ভাঙল এ জন্মের মিথ্যা।

                         ওগো আমার সর্বনাশ,

                                        ওগো আমার সর্বস্ব,

                                          তুমি এসেছ

                                        আমার অপমানের চূড়ায়।

                         মোর অন্ধকারের ঊর্ধ্বে রাখো

                               তব চরণ জ্যোতির্ময়।

 

মা।

                 ও নিষ্ঠুর মেয়ে,

                          আর যে সহে না, সহে না, সহে না।

 

প্রকৃতি।

            ওমা, ওমা, ওমা,

                            ফিরিয়ে নে তোর মন্ত্র

                               এখনি এখনি এখনি।

                            ও রাক্ষুসী, কী করলি তুই,

                                    কী করলি তুই--

                            মরলি নে কেন পাপীয়সী।

                        কোথা আমার সেই দীপ্ত সমুজ্জ্বল

                                   শুভ্র সুনির্মল

                                সুদূর স্বর্গের আলো।

                        আহা কী ম্লান, কী ক্লান্ত--

                              আত্মপরাভব কী গভীর।

                                      যাক যাক যাক,

                                    সব যাক, সব যাক--

                             অপমান করিস নে বীরের,

                                    জয় হোক তাঁর,

                                        জয় হোক।

 

আনন্দের প্রবেশ

 

                        প্রভু, এসেছ উদ্ধারিতে আমায়,

                              দিলে তার এত মূল্য,

                                     নিলে তার এত দুঃখ।

                        ক্ষমা করো, ক্ষমা করো--

                             মাটিতে টেনেছি তোমারে,

                                    এনেছি নীচে,

                             ধূলি হতে তুলি নাও আমায়

                                    তব পুণ্যলোকে।

                               ক্ষমা করো।

                            জয় হোক তোমার জয় হোক।

 

আনন্দ।

               কল্যাণ হোক তব, কল্যাণী।

 

সকলে বুদ্ধকে প্রণাম

 

সকলে।

                  বুদ্ধো সুসুদ্ধো করুণামহাণ্ণবো,

                            যোচ্চন্ত সুদ্ধব্বর ঞানলোচনো

                            লোকস্‌স পাপুপকিলেসঘাতকো

                            বন্দামি বুদ্ধং অহমাদরেণ তং॥


06 Aug 2012   07:03:59 PM   Monday BdST
  Print this E-mail this

নারীর ভেতর কল্যাণী রূপের সন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ


সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট
বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

ঢাকা: বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ৭১তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলা একাডেমী সোমবার বিকেলে একাডেমীর সেমিনার কক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। অনুষ্ঠানে স্বাগত ভাষণ দেন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। 'রবীন্দ্রনাথের নাটকে তিন নারী' শীর্ষক বক্তৃতা প্রদান করেন শিল্প-সমালোচক পররাষ্ট্র সচিব মিজারুল কায়েস। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমীর সভাপতি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

শামসুজ্জামান খান বলেন, ''বাংলা একাডেমী রবীন্দ্রচর্চার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছে। সার্ধশত রবীন্দ্র জন্মবর্ষ উপলক্ষে এ বছরের সেপ্টেম্বর নাগাদ রবীন্দ্র বিষয়ক তিরিশটি বই প্রকাশিত হতে চলেছে। একটি প্রামাণ্য রবীন্দ্রজীবনী প্রকাশের উদ্যোগও আমরা গ্রহণ করেছি, যার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্রনাথের জীবন ও সৃষ্টির বিচিত্র মাত্রা আবিষ্কার করা সম্ভব হবে।''

মিজারুল কায়েস বলেন, নারী-অধিকার তথা মানবাধিকারের মৌল প্রত্যয়সমূহ রবীন্দ্রসৃষ্টিতে ভিন্ন মাত্রায় প্রতিভাসিত। নারীকে তিনি স্বাধিকার প্রমত্ততার কেন্দ্রে প্রতিস্থাপন করেছেন পাশ্চাত্যে নারী অধিকার স্বীকৃতির বহু আগেই। শ্যামা, চিত্রাঙ্গদা ও চণ্ডালিকা শীর্ষক তিনটি নৃত্যনাট্যে তিনি নারীমুক্তির ক্ষেত্রে নতুন বিপ্লব সাধন করেছেন। নারীকে তিনি অধিষ্ঠিত করেছেন লিঙ্গনিরপেক্ষ নায়কের আসনে। ঘোষিত নারীবাদী না হয়েও নাটক ও অন্যান্য রচনায় নারীর যে মূল্য তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন, তার দৃষ্টান্ত সমকালেও বিরল। প্রেম ও কর্মশক্তির সমন্বয়ে নারীর ভেতর কল্যাণী রূপের সন্ধান করেছেন রবীন্দ্রনাথ। আর রবীন্দ্র নৃত্যনাট্যে আমরা প্রকৃতির সমান্তরালে নারী মুক্তির নব আবাহন খুঁজে পাই। প্রকৃতির প্রশস্ত বিস্তারের ভিতর তিনি নারীর মহিমা অনুধাবন করতে চাইলেও সমাজ-রাজনৈতিক প্রেক্ষিতবিবর্জিত নয় তার নারী ভাবনা। তিনি বলেন, অস্পৃশ্যতা ও জাত-পাতের ভেদকে রবীন্দ্র-নায়িকারা তুচ্ছজ্ঞান করে মহামানবিকতার বৈজয়ন্তী উড়িয়েছে। 

সভাপতির ভাষণে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, জীবনের নানা প্রান্তে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নারীভাবনা বিবর্তিত হয়েছে। তবে সব সময়ই নারীর ভেতরে তিনি অজেয় মানব সম্ভাবনার সৌন্দর্য অন্বেষণ করেছেন। প্রাগ্রসর নারী-ভাবনার জন্য সমকালে তাকে অবমাননার শিকার হতে হয়েছে। তবু তিনি একের পর এক সৃষ্টিতে নারী তথা বৃহৎ বিশ্বমানবেরই বিজয় গান গেয়ে গেছেন।

সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করেন শিল্পী সাদী মহম্মদ, মানসী সাধু প্রমুখ। যন্ত্রাণুষঙ্গে ছিলেন ইফতেখার আলম প্রধান, আলমাস আলী, গাজী আবদুল হাকিম এবং নাজমুল আলম খান।

বাংলাদেশ সময়: ১৮৪০ ঘন্টা, আগস্ট ০৬, ২০১২
এডিএ/ সম্পাদনা: অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

http://www.banglanews24.com/detailsnews.php?nssl=b2264a6c88de84170ffaf27613a622ab&nttl=20120806070359131126


সোনা কান্তি বড়ুয়া, টরন্টো থেকে   


 প্রথম বাংলা বইতে অমৃত ভান্ডার

তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের আধ্যাত্মিক রস ও প্রজ্ঞালোকের ঝর্ণাধারায় আলোকিত প্রথম বাংলা বইতে ধ্যান নির্দেশের মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া যায় মহাসুখসঙ্গম। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান দন্ডিত রাজাকারদের ক্ষমা করার পরের ঘটনা সমূহ আমরা সবাই জানি। ইতিহাসের আলোকে ঠিক তেমনি বিজয় সেন সুদূর কর্ণাটক থেকে এসে বাংলা দখল করে নিল এবং বহিরাগত সেন রাজারা যে চারশ বছরের পাল সাম্রাজ্যের সমদর্শী সংস্কৃতি ও প্রচলিত বৌদ্ধধর্মের বিলোপ ঘটিয়েছে। বাঙালীর মুখ থেকে বাংলা ভাষা কেড়ে নিয়ে উত্তর ভারতীয় সংস্কৃতি তন্ত্র চাপিয়ে দিল। বলতে গেলে সমাজ জীবনের ও ব্যক্তি জীবনের সর্বত্র তখন ব্রাহ্মণ আধিপত্য। নিপীড়িত মানবাত্মার জয়গানে মুখরিত এই চর্যাগুলো। বাঙালী সমাজের এই করুণ ছবি দেখতে পাই ৩৩ নং চর্যায়। "টালত মোর ঘর নাঁহি পড়বেসী। হাড়ীতে ভাত নাঁহি নিতি আবেশী। এর মানে, নিজ টিলার উপর আমার ঘর। প্রতিবেশী নেই। হাঁড়িতে ভাত নাই, অথচ নিত্য ক্ষুধিত।" সেন রাজত্ব মানে  কর্ণাটকের ব্রাহ্মণ্যদের অধীনে বাংলা, নিজ বাসভূমেই পরবাসী করে দিয়েছে বাঙালীকে। ইতিহাসের এই অন্ধকার যুগে তবু বাঙালী দুহাতে অনন্ত সমস্যার পাথর সরিয়ে জীবনের যাত্রা পথ ধরে হাঁটতে শুরু করেছিল অন্যতর আলোর লক্ষ্যে।

      ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক শেখড়ের সন্ধানে ইহা ও এই প্রসঙ্গে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য যে, আমরা 'বৌদ্ধ চর্যাপদের' সন্ধান পেলাম আজ থেকে শতবর্ষ আগে। ১৯০৭ খৃষ্টাব্দে নেপালের রাজদরবারের পুঁথিশালায় প্রাচীন পান্ডুলিপির সন্ধান (১৯০৭ - ২০০৭) করতে গিয়ে মহামহোপধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী মহোদয় উক্ত বৌদ্ধ চর্যাপদের মরমী সংগীতগুলো আবিস্কার করেন এবং ভাষা আন্দোলনের আলোকে চর্যাপদ সন্ধানের ( ১৯০৭- ২০০৭) শতবার্ষিকী । বৌদ্ধ পাল রাজত্বের পতনের যুগে এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের পূনরুত্থান কালে অস্থির ঘটনা চাঞ্চল্যের দ্বারা চঞ্চল সেন বর্মন রাষ্ট্রের প্রবল আধিপত্যের  প্রেক্ষাপটে চর্যাপদের জন্ম আধুনিক গণতান্ত্রিক অধিকারের মেনিফিষ্টো হিসেবে। এর মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালীর সর্বপ্রথম গনতন্ত্রের বীজ 'বাক স্বাধীনতার অধিকার'। বাংলা ভাষার প্রথম 'বিপ্লবী মিনার'।  বৌদ্ধ কবি ও সাধকগন বিপুল প্রজ্ঞা ও ক্ষুরধার বৌদ্ধদর্শন প্রয়োগ করে মনুষ্যত্বের উন্মেষ বিকাশে চর্যাপদের (৮ম - ১২শ শতাব্দী) এক একটি কবিতা রচনা করতেন। মানুষের দেশ মানুষের মনেরই সৃষ্টি।  

গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুরাজনীতি হিন্দুদের অবতার বানিয়ে বুদ্ধগয়া দখল করে বিশ্ববৌদ্ধদের কাছ থেকে টাকা আনা পাই কামাচ্ছে। জয় বুদ্ধ বলে বৌদ্ধরা প্রধানমন্ত্রী হতে পারবে না। হিন্দু ভারতে বৌদ্ধদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি?  ১৯৫৬ সালে ১৪ অক্টোবর জাতিভেদ প্রথার ট্রাজেডি সহ্য করতে না পেরে ভারতীয় সাবেক আইন মন্ত্রী ডঃ  বি. আর আম্বেদকর ৫০ হাজার জনতা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। ভারতীয় হিন্দু শাসকগণ বুদ্ধকে হিন্দুর অবতার বানিয়ে বৌদ্ধগণকে নীচ জাতি  করে রাখেন। হিন্দু সমাজে মানবাধিকার নেই। হিন্দু মন্দিরে বুদ্ধ পূজা করার প্রথা আছে কি? বুদ্ধকে হিন্দু মন্দিরে পূজা না করে হিন্দুরা গৌতমবুদ্ধকে 'শিব' বা 'অবতার' বলে তামাশা করার কারন কি? ভারতে বৌদ্ধসমাজকে ধ্বংস করার জন্যে এই ষড়যন্ত্র চলে আসছে," বিক্রমপুরের (মুন্সীগঞ্জ) অতীশ দীপংকরের ভিটাকে, হিন্দুরা নাস্তিক পন্ডিতের ভিটা বলে" হাজার বছর ধরে। 

        জাতিভেদ প্রথার সমর্থক ও বর্ণাশ্রমবাদী রামদেবের যোগানুষ্ঠানে "বুদ্ধং সরনং গচ্ছামি' উচ্ছারিত হয় কি ? বর্ণাশ্রমবাদী  রামদেব হাজার কোটি টাকার মালিক এবং তিনি জেনে ও জানেন না অর্থই অনর্থের মূল। রাজপুত্র সিদ্ধার্থ সিংহাসনের লোভ ত্যাগ করে 'বুদ্ধ ' হয়েছিলেন। রামদেব ভারতের ২৫ কোটি দলিত বা চন্ডাল জনতা এবং মুসলমানদের মানবাধিকার নিয়ে দিল্লীর দরবারে গিয়ে একটা টু শব্দ ও করেছেন কি?  হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাই  শুধু ভারতের সত্যিকারের নাগরিক হলে, সংখ্যালঘুদের জন্য তো আপনার প্রাণ কাঁদে না। কোন পরিকল্পনা ও নেই। প্রসঙ্গত:  বিশ্বমানবাধিকাররের আলোকে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কারন কি ছিল?  সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু পন্ডিতগণ "আল্লাহ উপনিষদ" রচনা করার পর ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ভেঙে যাবার কথা ছিল না। মানুষের লোভের জগতে "ধর্ম" কি নুতন উপাদান? কবি জসীম উদ্দীনের লেখা "আমার এই ঘর ভাঙিয়াছে যেবা / আমি বাঁধি তার ঘর। / আপন করিতে গুরিয়ে বেড়াই,/ যে মোরে করেছে পর। " বৈদিকপন্থী হিন্দু পন্ডিত, লেখক ও সন্ন্যাসীগণ  'অহিংসা পরম ধর্ম ' প্রচার না করে দলিত জনতার মানবাধিকার কেড়ে নিতে মিথ্যা পুরাণ সাহিত্য, ইতিহাস এবং আল্লাহ উপনিষদের মতো মনগড়া উপনিষদ রচনা করেন। 

      হাজার হাজার বছর যাবত বৈদিক হিন্দুধর্ম এবং রাজনীতি মানবাধিকার বিরোধী 'বর্ণাশ্রম বা জাতিভেদ প্রথার' মাধ্যমে দক্ষিন এশিয়ায় দুর্নীতি বা ভ্রষ্ঠাচারের বীজ বপন করতে মানবাধিকারবাদী সিন্ধুসভ্যতার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম ধ্বংস করেন। যথাসময়ে সম্রাট অশোকের হাতে  ব্রাহ্মণ্য মার্কা হিন্দু রাজনীতির অবসান ঘটে। কিন্তু বিধি বাম। সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর আবার ব্রাহ্মণ্যবাদ জেগে উঠে দিনের পর দিন বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করে চলেছে। রামায়ণের অযোধ্যা অধ্যায়ে ৩২ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে গালাগাল দেবার পর রাজনৈতিক হিন্দুধর্ম আজ আবার বুদ্ধকে  হিন্দুদের নবম অবতার বানিয়ে ভারতীয় বৌদ্ধগণের অস্তিত্ব সমূলে ধ্বংস করার পর সম্রাট অশোকের বৌদ্ধ ঐতিহ্যময় গৌতমবুদ্ধের ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র নির্দেশিত ঐতিহাসিক স্মারককে অশোক চক্র নাম দিয়ে বৌদ্ধধর্মকে হিন্দুরাজনীতি দখল করেছে। হিন্দু পন্ডিতগণ অশোকের শিলালিপি পড়তে না পারলে ও ভারত নামক দেশটা সম্রাট অশোকের নামে পরিচিতি খোঁজে। এখানে বৌদ্ধধর্মের অহিংসার কাছে হিন্দুরাজনীতির হিংসার পরাজয় । আজ ও ভগবান মহাবীর ও গুরু নানক হিন্দুদের অবতার হয় নি। তবে ষড়যন্ত্র হরদম চলেছে। পলিটিক্যাল হিন্দুধর্ম নানা অবতার বানিয়ে বিশ্বের সকল ধর্মকে গিলে ফেলবে কি? তবে বলিউডে সাধক কবিরকে রাম বা কৃষ্ণের অবতার বানিয়ে ধর্মের বাজার দখল করে ফেলেছে। হিন্দুগণ হিন্দু মন্দিরে বুদ্ধপূজা না করে ও হিন্দুরাজনীতির পান্ডাগণ গৌতমবুদ্ধের পূত পবিত্র ধ্যানভূমি "বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির" দখল করে দৈনিক হিন্দুদের বিবাহ অনুষ্ঠান সহ শিবলিঙ্গের পূজা সকাল বিকাল বাদ্য যন্ত্র বাজিয়ে হিন্দু মন্দিরে পরিনত করার জন্যে গৌতমবুদ্ধকে 'হিন্দুমার্কা  বিষ্ণুর নবম অবতার' বানিয়ে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করেছে। 

      নিজের লোভ দ্বেষ ও মোহকে জয় করার নাম ধর্ম। মনের রামকে বনে পাঠিয়ে মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানালে তো ধর্ম হয় না। "আত্মসুখকে জয় করার কথা" বাট্রেন্ড রাসেল তাঁর লেখা "কন্কোয়েষ্ঠ  অব হ্যাপীনেস" নামক বইতে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। রক্তপাত তো অধর্ম ও অন্ধকারের কথা।  ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠা ট্রাজেডী ইহা এক ভারতীয় আইনের শাসনে হিউম্যান রাইটস এবং ধর্মনিরপেক্ষতার কলঙ্ক।  ১৭ বছর পর ভারতীয় লোকসভার মনোনিত "লিবারহ্যান কমিশন" বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও এবং উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যানসিংহ সহ ৬৮জন হিন্দু নেতাকে অভিযুক্ত করেছেন। হিন্দু যেই মানব, মুসলমান ও সেই মানব। মানুষ মানুষকে হিংসা করা আইনত: দন্ডনীয় অপরাধ। হিন্দু মুসলমানের স্রষ্টা এক ও অভিন্ন। যিনি রাম তিনিই রহিম। ভারত সরকারের দায়িত্ব ছিল বাবরি মসজিদ রক্ষা করে  "প্রত্যেকরই জীবন ধারন, স্বাধীনতা ও ব্যক্তি নিরাপত্তার অধিকারকে" শ্রদ্ধা করা।  আদালতে অভিযুক্ত কিন্তু বাবরি মসজিদ ধ্বংসের হোতা  সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ি, সাবেক উপ প্রধানমন্ত্রী লালকৃষ্ণ আদভানি ও মুরলি মোহন যোশী। রাজনীতির মাফিয়া চক্রে ধর্মের মস্তক বিক্রয়। জয় সত্য ও মানবতার জয়। ধর্মের নামে মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির বানানো ছেলে খেলা নয়। 

      রাজনৈতিক ভাবে ভারতে আজকের বৌদ্ধগণ কি পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মের গোলাম? বেহায়া হিন্দু শাসকগণ বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দির দখল করতে দিনের পর দিন মহাবোধি মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গ সহ হিন্দুদের দেবদেবী স্থাপন করেছে। বৈদিক হিন্দু রাজা ইন্দ্র মহেঞ্জোদারো  ও হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম (গৌতমবুদ্ধের পূর্বে আর ও ২৭ জন বুদ্ধ ছিলেন) ধ্বংস করে বৈদিক সভ্যতা স্থাপন করেন। পলিটিক্যাল হিন্দুধর্মে বৌদ্ধসভ্যতা বিরোধি এক কালো আইন বা প্রথার নাম 'অবতার বাদ।'

        কোলকাতার দেশ পত্রিকার মতে, "মহাভারতের যুগে শ্রীকৃষ্ণ তাঁহার সুদর্শন চক্র অরিকুলের দিকে নিক্ষপ করিলে আর রক্ষা ছিল না। সাঁ করিয়া ঘূর্ণায়মান চক্র প্রতিপক্ষের মুন্ডপাত করিত। মুখের কথা মুখেই রহিত  স্কন্ধ হইতে মস্তকচ্যুত হইত। ( পৃষ্ঠা নং ২৮, দেশ, ২ মে, ২০০৫)। " হস্তিনাপুরের রাজসভায় রাজ রাণী দ্রেীপদীর বস্ত্র হরন হল কেন? ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দ্রৌপদীকে বস্ত্র দানে রক্ষা করলেন কিন্তু দুর্যোধনকে শাস্তি দিলেন না। সভ্যসমাজে বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে ভগবান রামের পূজা করে হিংসার অন্ধকারে প্রতিহিংসার বীজ বপন করা হল।  দুর্যোধন গ্যাং এর পাপের ফলে কুরুক্ষেত্রের  ধর্মযুদ্ধে ভগবান শ্রীকৃূষ্ণ তাঁর ভক্ত অর্জুনকে  ভগবদগীতা শিক্ষা দিয়ে ও রক্তপাত বন্ধ করা গেল না। অহিংসার মুক্তিযুদ্ধে ধর্মযুদ্ধ সম্পন্ন হয়েছে কি? হিংসাকে অহিংসা দিয়ে জয় করতে হবে। বৌদ্ধদের শত শত বুদ্ধ মন্দির ও বিহার আজ ও হিন্দু মৌলবাদীরা দখল করে আছে। ভারতের পাটনা শহরে দলিত বা নীচু জাতের মানুষ চেয়ারে বসলে উঁচু জাতের মানুষ বন্দুকের গুলি দিয়ে উক্ত নীচু জাতের মানুষকে হত্যা করেছে। (উইকলি ভয়েস, টরন্টো, ডিসেম্বর০৫, ২০০৯)। হিন্দুরাজনীতি ধর্মকে অপব্যবহার করে ধর্মের দেশে মানুষকে হত্যা করে চলেছে দিনের পর দিন। প্রাণী হত্যা মহাপাপ।

      হিন্দু মৌলবাদীদের বুদ্ধগয়া দখল

      একদা হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার পর সম্রাট অশোকের প্রার্থনা ছিল, "বুদ্ধং সরণং গচ্ছামি।" ভূপালে সাঁচীর তোরনদ্বারের দক্ষিন তোরণের পশ্চিমের স্তম্ভের মাঝের দুটো প্যানেলে সেই মহামতি সম্রাট অশোকের  তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিবৃক্ষে  বুদ্ধ বন্দনার অমর এ্যালবাম আজ ও অম্লান হয়ে আছে।   তুমি যে মানব, আমি ও সেই মানব। ২৫৫৪ বছর পূর্বে  ভারতের বিহার প্রদেশে গৌতমবুদ্ধের "বুদ্ধত্ব লাভের" পবিত্র জায়গাটির নাম "বুদ্ধগয়া।" হিন্দু রাজনীতির দাদারা মাফিয়া চক্রের মতো বৌদ্ধদের তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির শত শত বছর পর্যন্ত দখল করে আছে। সম্প্রতি ভারতের "দৈনিক পাটনা" পত্রিকার সংবাদ ছিল মানুষের সকল মৌলিক অধিকার পরিপন্থী, মানবতা বিরোধী এক কালো আইনের নাম "বুদ্ধগয়া মহাবোধি ম্যানেজম্যান্ট কমিটির সদস্যগণের নীতিমালা" (ভারত, দৈনিক পাটনা, ২৪ মে, ২০০৮)। সম্রাট অশোক কলিঙ্গযুদ্ধের ভয়াবহ পরিনাম দেখে শান্তির জন্যে ত্রাহি ত্রাহি করতে করতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহন করেন। হিন্দু সমাজে মানবাধিকার নেই। হিন্দু রাজনীতি বৌদ্ধদের হাত থেকে বৌদ্ধধর্ম, অশোকচক্র এবং বুদ্ধগয়া কেড়ে নিয়েছে।

ভারতে পলিটিক্যাল হিন্দুধর্ম নাম যশের জন্যে বৌদ্ধধর্মের গলা টিপে দিয়ে  বৌদ্ধদের অবলোকিতশ্বর বোধিসত্বকে হিন্দুদের শিব বানিয়ে বৌদ্ধ ঐতিহ্য সমূহ সহ বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দির তীর্থভূমি  দখল করে নিয়েছে। বৌদ্ধদের তারা দেবীকে হিন্দু মহিষাসুর মর্দিনী দূর্গা বানিয়েছে। বৌদ্ধধর্মের শ্মশানের  উপর হিন্দুস্থানে সম্রাট অশোকের অশোকচক্র খচিত বর্তমান ভারতের জাতীয় পতাকা বিরাজমান।  সত্য কথা বলার উপায় নেই। 'বৌদ্ধধর্ম তো হিন্দুধর্মের শাখা নয়' বলতে না বলতে মৌলবাদী হিন্দুরা তেড়ে আসে, অথচ বিহার শব্দের অর্থ বুদ্ধমন্দির বা বৌদ্ধ বিহার। সম্রাট অশোকের রাষ্ঠ্রধর্ম ছিল গৌতমবুদ্ধের বৌদ্ধধর্ম,  আজ সেই বৌদ্ধধর্ম,  ভারতীয় অসহায় গরীব জনতার ধর্ম।

      অবলোকিতেশ্বর  বোধিসত্বকে শিব বানায়ে বুদ্ধগয়ায় শিবলিঙ্গ প্রতিষ্টা করার পর হিন্দু জঙ্গি ও রাজনৈতিক পান্ডারা বুদ্ধগয়া দখল করার পর বাবরি মসজিদ ধ্বংস করার সাহস পেয়েছে। এইজন্যে অন্যায়কে প্রশ্রয়  দেয়া মানবিক অপরাধ। আলকায়দার চেয়ে ও ভয়ঙ্কর হিন্দু মৌলবাদী নেতাগণ। হিন্দু মৌলবাদী সেনাবাহিনী সন্ন্যাসীর রুপ ধরে শত শত বছর পর্যন্ত ত্রিশূল দিয়ে সর্বত্র ভারতীয় বৌদ্ধগণকে হত্যা করেছে। রাজসভায় ঘোরতোর গালি দেবার অপরাধে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজের হাতের যন্ত্র নর হত্যার চক্র দিয়ে শিশুপালকে হত্যা করেছেন। আইনকে নিজের হাতে তুলে নেওয়া নৈতিক অপরাধ।

      বাবরি মসজিদ যারা ভেঙ্গেছে তাদের পূর্ববংশেরা অনেক বৌদ্ধবিহার দখল করে নিয়েছে। আমরা বৌদ্ধধর্মের স্বাধীনতা সহ বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দিরের মুক্তি কামনা করি। বিশ্ববৌদ্ধ সহ সম্রাট অশোকের বুদ্ধগয়ার  মহাবোধি মন্দিরকে হিন্দু মৌলবাদীনেতাগণ দখল করে আছে কেন? বিগত ৬ই ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে বাবরী মসজিদ ভেঙে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের কি লাভ হয়েছে?  হিন্দু সমাজের কাছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপদেশ ছিল, "রামের জন্মভূমি অয়োধ্যার চেয়ে ও সত্য জানো, / হে কবি তব মনোভূমি।" রাম জন্মভূমির নামে ১৯৯২ সালের দাঙ্গায় ভারতে এক হাজার মানব সন্তান নিহত হয়েছে। "মুসলিম তার নয়নমনি, হিন্দু তাহার প্রাণ।" কবি নজরুল ইসলামের স্বপ্ন ছিল হিন্দু মুসলমান ভাই ভাই। বুদ্ধগয়া  দখলে নেবার পর হিন্দু জঙ্গীরা বাবরী মসজিদ ভেঙেছে। তারপর ভগবান যীশুকে অবতার বানিয়ে ভবিষ্যতে খৃষ্ঠান চার্চ আক্রমন করার আশংকা দিন দিন বাড়ছে। অথচ কালকাতার রামকৃষ্ণ মিশন বিশ্বহিন্দু পরিষদ এবং আর এস এসের বিরুদ্ধে কলকাতা হাইকোর্টে মোকদ্দমা করে দাবী করেন যে, "রামকৃষ্ণ মিশন" হিন্দু প্রতিষ্ঠান নয়।" কোন হিন্দু মন্দিরে বুদ্ধ পূজা হয় না। ভগবান গৌতমবুদ্ধ বেদ বিরোধী ধর্ম প্রচার করার পর ও  হিন্দু কবি জয়দেব ও জঙ্গীরা গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুর নবম অবতার বানিয়ে রাজনীতির ফায়দা লুটে নিয়ে টাকা আনা পাই কামাচ্ছে। সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু পন্ডিতগণ "আল্লাহ উপনিষদ" রচনা করে মোগলে আজমের রাজনীতির বাজার দখল করেছিলেন। অবশেষে অবিচার ও সময়ের অভিশাপে যদু জালাল উদ্দিন হয়েছে রাজনীতির মাফিয়া চক্রে ধর্মের মস্তক বিক্রয় করে।

      একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দী থেকে শুরু হলো সাধক চর্যাকারগনের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস। যার দূর্ণিবার জীবন্ত স্রোত হাজার বছরের সংকোচের জগদ্দল পাথর ভেঙ্গে এলো আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্র"য়ারীর উনিশশো বায়ান্ন সাল থেকে আজকের বাঙালী ঐতিহ্যমন্ডিত আর্ন্তজাতিক মাতৃভাষা দিবস। বাঙালী জাতি আবার নতুন সহস্রাব্দের আলোকে আবিস্কার করবে বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন বৌদ্ধ চর্যাপদের প্রতিটি শব্দ ও তার গভীর মর্মার্থকে। কারণ দেশ ও ভাষা বাঙালীর কাছে নিরেট বাস্তব, অতিশয় অপরিহার্য। বৌদ্ধ চর্যাপদ পাঠ এবং গবেষণার সময় মনে হবে বাংলা কেবল একটি দেশ নয়, সে একটি সভ্যতা, একটি সংস্কৃতি, একটি অপাপবিদ্ধ জীবনাদর্শ বা জীবন দর্শণের প্রতীক, যার মর্মবাণী হল বিশ্ব মানবতাবাদ। পরকে আপন করে দেখা। 


লেখক এস বড়–য়া খ্যাতিমান ঐতিহাসিক, কথাশিল্পী, বিবিধগ্রন্থ প্রনেতা এবং প্রবাসী কলামিষ্ঠ । 

http://www.news-bangla.com/index.php?option=com_content&task=view&id=7792&Itemid=47

বাংলা ভাষার জনক গৌতমবুদ্ধ | Print |

সোনা কান্তি বড়ুয়া

গভীর গবেষণার পর পন্ডিতগণ উপলব্ধি করেছেন যে, গৌতমবুদ্ধ বঙ্গলিপিকে ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা করেন। সমস্ড় ব্রাহ্মণ্য সংস্কৃতিতে লিপির কোন স্থান নেই। সরস্বতি বাগদেবী লিপির দেবী নন। তাই কলকাতা কেন্দ্রীয় (ইম্পেরিয়াল) লাইব্রেরীতে বাংলা ভাষার জনক গৌতম বুদ্ধের ছবি বিরাজমান। অধিকন্তু প্রাচীন কালের ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা ও সংস্কৃতি লেখাকে নরকের দ্বার স্বরূপ ফতোয়া জারি করে সাধারণ মানুষের মৌলিক জনশিক্ষার অধিকার হরণ করেছিলেন। এই অন্ধকার যুগে একমাত্র গৌতমবুদ্ধই লোভী ব্রাহ্মণদের ব্রাহ্মণ্যবাদী দলিত ঐতিহ্য ও সভ্যতা বিকৃতির হাত থেকে দক্ষিন এশিয়ার জনগণকে রক্ষা করেন (দেশ, কলকাতা, ১ ফেব্রয়ারি, ১৯৯২)।

দক্ষিন এশিয়ার যাদুঘরসমূহ, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল, আফগানিস্ড়ানের বামিয়ান পর্বতমালা, পাকিস্ড়ানের ডাযামার ভাসা বাঁধ, রাজশাহীর পাহাড়পুর এবং নরসিংদীর উয়ারী বটেশ্বরে আবিস্কৃত হলো লক্ষ লক্ষ বুদ্ধমূর্তি। মিশরের মুসলমানগণ তাঁদের পূর্বপুরুষগণের পিরামিডকে নিয়ে গর্ববোধ করেন। গৌতমবুদ্ধের বোরোবুদুর বৌদ্ধ জগতের পূজনীয় ধর্মস্থান ইন্দোনেশিয়ার মুসলমানদের কাছে "জাতীয় ঐতিহ্যের সুতিকাগার।" বাংলা বিশ্বকোষে (১৩শ ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫) রাজপুত্র সিদ্ধার্থের (গৌতমবুদ্ধ) বঙ্গলিপি অধ্যয়ন করার ঐতিহাসিক প্রমান বিরাজমান এবং ২৬০০ বছর পূর্বে গৌতমবুদ্ধ বঙ্গলিপিকে ব্রাহ্মণদের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।  চর্যাপদে গৌতমবুদ্ধ বাংলা ভাষার জনক।
সম্রাট অশোকের রচিত শিলালিপির (নেপাল) মতে, গৌতমবুদ্ধের পূর্বে কাশ্যপবুদ্ধ এবং কনকমুনিবুদ্ধ সহ আর ও বুদ্ধ ছিলেন। তাই গৌতমবুদ্ধ  বৈদিকধর্মের উত্তরাধিকারী নন। গৌতমবুদ্ধের পূর্বে দেবভাষা বা সংস্কৃত ভাষার কোন গ্রন্থ ছিল না। বাংলাভাষা সংস্কৃত ভাষা থেকে জন্ম নেয়নি, অশোকের শিলালিপির ভাষা ব্রাহ্মলিপি (প্রায় ৪০ টা ভাষায় বর্ণমালার জনক),  অনুসরন করে দেবনাগরী লিপি বা বর্ণমালা প্রতিষ্ঠিত হয়। গৌতমবুদ্ধ বঙ্গলিপি অধ্যয়ণ করার পর ও তাঁর (গৌতমবুদ্ধের) বুদ্ধবর্ষ বাদ দিয়ে বঙ্গাব্দ রচিত হল কেন? রবীন্দ্রনাথের ঠাকুর বৈদিক জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মের জয়গান গেয়ে চন্ডালিকা শীর্ষক নৃত্যনাট্য রচনা করেছিলেন এবং তিনি তাঁর ভারতীয় সমাজের কাছে বৌদ্ধধর্মের পতনের কারন সম্বন্ধে জবাবদিহি করেছেন, (সৌজন্য, দেশ, কলকাতা, ২ মে, ২০০৫, পৃষ্ঠা নং ৪১;  ভাষন, ১৮ মে, ১৯৩৫ সাল, ধর্মরাজিকা বিহার, কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি),  " তাঁর (গৌতমবুদ্ধের) তপস্যা কি শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে ? ভারতের মাটিতে আজ তাঁর তপস্যা বিলুপ্ত হয়েছে। আমাদের অমূল্য ভান্ডারে দ্বার ভেঙ্গে গেছে। মানুষকে আমরা শ্রদ্ধা করিনে। আমাদের সেই প্রেম, মৈত্রী, করুণা, যা তাঁর দান, সব আমাদের গিয়েছে। তাঁর দানকে রুদ্ধ করেছি মন্দির দ্বার পর্যন্ড়। এ জাতের কখনও মঙ্গল হতে পারে? তাঁকে বলা হয় শূন্যবাদী। তিনি কি শূন্যবাদী? তিনি বললেন, "জীবে দয়া কর।" 
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বৌদ্ধ চিন্ড়াধারাপুষ্ঠ অশোক চক্র (বৌদ্ধধর্মের ধর্মচক্র) ভারতের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় এমবে–ম বা সরকারী স্মারক চিহ্ন রুপে বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, "তিনি (গৌতমবুদ্ধ) জন্মেছেন মানবের চিত্তে, প্রতিদিন তিনি জন্মাচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি বেঁচে আছেন।" তবু ও ভারতে বৌদ্ধধর্ম সংখ্যা গরিষ্ঠের ধর্ম নয় কেন?
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "গৌতমবুদ্ধ আমার মহান ণ্ডরু, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। "ইঁফফযধ, সু ষড়ৎফ, সু সধংঃবৎ, ঃযু নরৎঃযঢ়ষধপব, রং ঃঁষু যবৎব যিবৎব পৎঁবষ রং ঃযব ড়িৎষফ ড়ভ সবহ, ভড়ৎ ঃযু সবৎপু রং ঃড় ভরষষ ঃযব নষধপশ ড়ভ ঃযবরৎ ঁঃঃবৎ ভধরষঁৎব, ঃড় যবষঢ় ঃযবস যিড় যধাব ষড়ংঃ ঃযবরৎ ভধরঃয ধহফ নবঃৎধুবফ ঃযবরৎ ঃৎঁংঃ; ঃড় ভড়ৎমবঃ ঃযবসংবষাবং রহ ঃযবব ধহফ ঃযঁং ভড়ৎমবঃ ঃযবরৎ ফধু.      
চর্যাপদের আগে পালি ও বাংলাভাষায় বৌদ্ধ ত্রিপিটক সহ বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় সমূহ  বৌদ্ধধর্মের সাথে কোথায় হারিয়ে গেল? ইতিহাসের উত্তমপুরুষ গৌতমবুদ্ধের সময় থেকে হিসাব করলে ও বাংলা বর্ণমালার বয়স প্রায় ২৬০০ বঙ্গাব্দ। হিন্দু শাসকগণ মুসলমান শাসকদের সাথে একত্রিত হয়ে হিজরি সালকে বিকৃত করার কথা ছিল না। শকাব্দকে হিন্দু রাজনীতি বুকে বেঁধে রাখার পর বঙ্গাব্দ থেকে বুদ্ধবর্ষ কে সরাতে হিন্দু রাজনীতি গভীর ষড়যন্ত্র করে (১৪৩২ হিজরি সালকে ১৪১৮ বঙ্গাব্দ) এবং ইসলামিক হিজরি সালকে বিকৃত করে বাংলার ইতিহাসকে হিন্দুভাবাপন্ন করে গড়ে তোলে। 
১৯০৬ সালে নেপালের রাজকীয় গ্রন্থাগার থেকে চর্যাপদ আবিস্কার হওয়ার পর হিন্দুত্বের ঝুলি থেকে ষড়যন্ত্রের বেড়াল বের হয়ে প্রমানিত হলো "বাংলা ভাষা পালি ভাষার বিবর্তিত রুপ।" হিন্দুরাজনীতি কিন্তু গৌতমবুদ্ধকে তাঁদের নবম অবতার বানিয়ে মিথ্যা ইতিহাস রচনা করে  বৌদ্ধ ত্রিপিটককে (বুদ্ধবংশ) অস্বীকার করতে রামায়ণের অযোধ্যা কান্ডে (অধ্যায়ে) ৩২ বত্রিশ নম্বর শে–াকে বৈদিক পন্থী হিন্দু পন্ডিতগণ বুদ্ধ এবং বৌদ্ধদেরকে যে ভাবে গালাগাল করেছেন তা অমানবিক এবং অধর্ম । তাই বুদ্ধগয়ার ভারতীয় বৌদ্ধভিক্ষু আচার্য বুদ্ধঘোষ ৫ম শতাব্দীতে শ্রীলঙ্কায় গিয়ে রামায়ন এবং মহাভারতে সম্বন্ধে নেতিবাচক মন্ড়ব্য করেছিলেন। বাংলার বুক জুড়ে মাটির নীচে ও উপরে বুদ্ধমূর্তি বিরাজমান। বিশ্বকোষ (১৩শ ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫) থেকে একটি গৌরবোজ্বল ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি উলে–খ করা হল, "কিয়ৎকাল পরে সিদ্ধার্থ ণ্ডরুগৃহে প্রেরিত হইলেন। সেখানে তিনি বিশ্বামিত্র নামক উপাধ্যায়ের নিকট নানা দেশীয় লিপি শিক্ষা করেন। ণ্ডরুগৃহে গমনের পূর্বেই তিনি ব্রাহ্মী, ... বঙ্গলিপি ...সহ ৬৪ প্রকার লিপি অবগত ছিলেন। 
বৌদ্ধধর্মের আলোকে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়: 
হিন্দু বর্ণাশ্রম বিরোধী সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়  ব্রাহ্মণদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে 'সাম্যবাদ' নামক বই লিখেছিলেন এবং গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদন করে ঘোষণা করলেন,  
"তখন বিশুদ্ধাত্মা শাক্যসিংহ অনন্ড়কালস্থায়ী মহিমা বিস্ড়ার পূর্বক, ভারতাকাশে উদিত হইয়া, দিগন্ড় প্রসারিত রূপে বলিলেন, "আমি উদ্ধার করিব। আমি তোমাদেরকে উদ্ধারের বীজমন্ত্র দিতেছি, তোমরা সেই মন্ত্র সাধন কর। তোমরা সবাই সমান। ব্রাহ্মণ শুদ্র  সমান। মনুষ্যে মনুষ্যে সকলেই সমান। সকলেই পাপী, সকলের উদ্ধার সদাচরণে। বর্ণ বৈষম্য মিথ্যা। যাগযজ্ঞ মিথ্যা। বেদ মিথ্যা, সূত্র মিথ্যা, ঐহিক সুখ মিথ্যা, কে রাজা, কে প্রজা, সব মিথ্যা। ধর্মই সত্য। মিথ্যা ত্যাগ করিয়া সকলেই সত্যধর্ম পালন কর। (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২ থেকে ৩৮৩, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, কলকাতা)।"  ঋগ্বেদের সংহিতার দশটি মন্ডলে ১০২৮টি সূত্র আছে। ভগবান শিব, বিষ্ণু, ব্রহ্মা, ভগবতী কালী, দূর্গা (বা বোধিসত্ত্ব তারাদেবীর) এবং চন্ডীর কোন নাম নেই, এর বিপুল অংশ জুড়ে প্রধান দেবতা যুদ্ধ প্রিয় রাজা ইন্দ্রকে নিয়ে। 
হিন্দু মন্দিরে গৌতম বুদ্ধের পূজা হয় না, অথচ বুদ্ধের শিক্ষালব্ধ "অহিংসা মহামন্ত্রকে হিন্দু মন্ত্র বানিয়ে' হিন্দুরাজনীতি গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুর ভগবান বা নবম অবতার করেছেন। হিন্দুরা বৌদ্ধধর্ম গ্রহন না করে বা বৌদ্ধ ধর্মালম্বী না হয়ে হিন্দু রাজনীতি গৌতমবুদ্ধকে হিন্দু বানিয়ে জনতার প্রশ্ন : চর্যাপদের আগে বাংলা ভাষায় বিপুল বৌদ্ধ ত্রিপিটক কোথায় হারিয়ে গেল? 
সিন্ধুসভ্যতায় (মহেঞ্জোদারো এবং হরপ্পা) বৌদ্ধধর্ম, দক্ষিন এশিয়ার সম্রাট অশোকের শিলালিপি, চর্যাপদ, সিদ্ধাচার্য এবং বাংলাভাষা, বাঙালি জাতীয় ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বৈদিকপন্থী হিন্দুদের ঋগ্বেদে (১/৩৬/৮), বিরাজমান যদু (যাদব ও  ভগবান শ্রীকৃেষ্ণর প্রথম পূর্ব পুরুষ ) দূরদেশ থেকে ভারতে আসেন। যদুরা পর্শুর সন্ড়ান (১০/৮৬/২৩)। প্রাচীনতম বেদ হল ঋগ্বেদ, যার পদ্যে রচিত সংহিতার দশটি গোলে মালে আধুনিক সমাজের চোখে ধূলো দিচ্ছেন। হিহুদি জাতি বা রাজনীতি যীশুখৃষ্ঠকে হিহুদি করার সাহস না করলে ও হিন্দুরাজনীতি বৈদিক জাতিভেদ প্রথা অনুসরন করে ধর্মের নামে রাঠ্রের সিংহাসন লাভ করতে সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর বৌদ্ধধর্ম এবং  জাতিকে তিলে তিলে ধ্বংস করে চলেছে। " 
ব্রিটিশ পন্ডিত জেমস প্রিন্সেপ ভারতে এসে সম্রাট অশোকের শিলালিপি পড়তে পারলেন অথচ ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী পন্ডিতগণ সিন্ধুসভ্যতার বৌদ্ধধর্ম ও অতীত বুদ্ধগণের অস্ড়িত্ব স্বীকার না করে ১৮৩৭ সালে সম্রাট অশোকের শিলালিপি পড়তে না পেরে ইতিহাস চুরির চাতুর্য হাতে নাতে ধরা পড়ে গেল। 
হিন্দুরাজনীতি বৌদ্ধধর্মের ত্রিপিটক এবং বৌদ্ধ সাহিত্যের অস্ড়িত্ব সমূলে ধ্বংস করে গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুধর্মের নবম অবতার বা ভগবান করেন। তবে হিন্দু পন্ডিতগণ ১৮৩৭ সালে অশোকের শিলালিপি পড়তে না পারলে ও ডঃ আশা দাশ সহ অনেক হিন্দু লেখক ও লেখিকাগণ বৌদ্ধধর্মের অনুরাগী গবেষক হয়ে বৌদ্ধ জাতক এবং বৌদ্ধ সাহিত্য সম্বন্ধে গবেষণা করে রামায়ণী বা বৈদিক ভাবধারাকে আবিষ্কার করেন। 
গৌতমবুদ্ধের পাদপদ্মে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদন করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন 
"আমি যাঁকে আমার অন্ড়রের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করেছি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে তাঁকে আমার প্রনাম নিবেদন করতে এসেছি, এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্ঘ নিবেদন নয়, যাঁকে নির্জনে বারংবার অর্ঘ নিবেদন করেছি, সেই অর্ঘই আজ নিবেদন করতে উপস্থিত হয়েছি। 
একদিন বুদ্ধগয়াতে বুদ্ধমন্দির দর্শনে গিয়েছিলুম। সেইদিন এ কথা মনে জেগেছিল - যে সময়ে ভগবানবুদ্ধের চরণস্পর্শে সমস্ড় বসুন্ধরা জেগে ওঠেছিল, গয়াতে যেদিন তিনি স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাই নি, কেন সেদিন অনুভব করিনি তাঁকে একান্ড়ভাবে শরীর মন দিয়ে। "   ...  
ব্রাহ্মণ্য সভ্যতা সর্বদা বৌদ্ধসভ্যতাকে (অশোক চক্র বা বৌদ্ধদের ধর্মচক্র) আত্মস্থ করে সর্ব ভারতীয় বা হিন্দু সভ্যতার মিথ্যা ইতিহাস নিয়ে বিরাজমান। 
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,  
"যাঁরা প্রতাপবান, বীর্য্যবান তাঁদের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশী নয়। অনেক মানব, রাজা, ধনী মানী ও রাষ্ঠ্রনেতা এ পৃথিবীতে জন্মেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে কতজন এসেছেন? যিনি সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে এসেছিলেন আবার তাঁকে আহ্বান করছি আজকে এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভারতে, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিসম্বাদ, যেখানে ভেদ বিবাদে মানুষ জর্জরিত, সেই ভারতে তিনি আবার আসুন। সত্যের দ্বারা মানবের পূর্ণ প্রকাশ। যিনি আপনার মধ্যে সকল জীবকে দেখেন। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তিনি প্রকাশিত হবেন তাঁর মহিমার মধ্যে।" (চলবে.......)

http://www.thejogajog.com/bn/index.php?option=com_content&view=article&id=187:2011-08-18-09-17-21&catid=35:montreal&Itemid=70


সুপ্রীম কোর্টের রায়, হিন্দুত্বকরনের বিরুদ্ধে বুদ্ধগয়ায় বৌদ্ধদের জয়

লিখেছেনঃ  সোনা কান্তি বড়ুয়া , কানাডা টরন্টো থেকে বৃহস্পতিবার, 01 নম্ভেবর 2012 08:06

সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২ নিউ দিল্লী, ভারত। বুদ্ধগয়ায় ভারত সরকার মানবাধিকারকে পদ দলিত করে ভ্রষ্ঠাচারের মাধ্যমে ৬০ বছর পর্যন্ত হিন্দু রাজনীতির দ্বারা বৌদ্ধদের বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দির পরিচালনা করেন। ভারতীয় সুপ্রীম কোর্টের রায় বিগত ২৫০০ বছরের বৌদ্ধদের বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির ম্যানেজমেন্টের দায়িত্বভার ভারত সরকারের কাছ থেকে নিয়ে বৌদ্ধ সমাজের কাছে হস্তান্তর করেছেন। বৌদ্ধ সংগঠনের নেতা পূজনীয় ভন্তে আর্য নাগার্জুন (শুরাই সাসাই) এর আবেদনকে সাহার্য্য করতে বিচারক আলতামাস কবির এবং বিচারক জে ছেলামেশ্বরের একটি যুক্ত বেঞ্চে শ্রী জি. ই. ভাহানবতি, ভারতীয় এটর্নী জেনারেলের মাধ্যমে ভারত সরকার, বিহার সরকার এবং আর্কিওলোজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াকে উক্ত ভারতীয় সুপ্রীম কোর্ট নোটিশ জারি করেছেন। ইহাই মানুষ জাতির 'সত্য মেব জয়তে ।' জয় মানবাধিকারের জয় এবং বুদ্ধগয়ায় বৌদ্ধদের জয় মঙ্গল হোক।

হিন্দুত্ববাদীদের ইতিহাস চুরির চাতুর্যে ভারতে বৌদ্ধধর্ম দখল:

প্রসঙ্গত: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সব দেখে শোনে তিনি তাঁর ভারতীয় সমাজের কাছে বৌদ্ধধর্মের পতনের কারন সম্বন্ধে জবাবদিহি করেছেন (সৌজন্য, দেশ, কলকাতা, ২ মে, ২০০৫, পৃষ্ঠা নং ৪১; ভাষন, ১৮ মে, ১৯৩৫ সাল, ধর্মরাজিকা বিহার, কলকাতা মহাবোধি সোসাইটি), " তাঁর (গৌতমবুদ্ধের) তপস্যা কি শুধু ইতিহাসের পাতায় লেখা আছে ? ভারতের মাটিতে আজ তাঁর তপস্যা বিলুপ্ত হয়েছে। আমাদের অমূল্য ভান্ডারে দ্বার ভেঙ্গে গেছে। মানুষকে আমরা শ্রদ্ধা করিনে। আমাদের সেই প্রেম, মৈত্রী, করুণা, যা তাঁর দান, সব আমাদের গিয়েছে। তাঁর দানকে রুদ্ধ করেছি মন্দির দ্বার পর্যন্ত। এ জাতের কখনও মঙ্গল হতে পারে? তাঁকে বলা হয় শূন্যবাদী। তিনি কি শূন্যবাদী? তিনি বললেন, "জীবে দয়া কর।" বাংলা সহ ভারতের বুক জুড়ে মাটির নীচে ও উপরে বুদ্ধমূর্তি বিরাজমান। বিশ্বকোষ (১৩শ ভাগ, পৃষ্ঠা ৬৫) থেকে একটি গৌরবোজ্বল ঐতিহাসিক উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হল,"কিয়ৎকাল পরে সিদ্ধার্থ গুরুগৃহে প্রেরিত হইলেন। সেখানে তিনি বিশ্বামিত্র নামক উপাধ্যায়ের নিকট নানা দেশীয় লিপি শিক্ষা করেন। গুরুগৃহে গমনের পূর্বেই তিনি ব্রাহ্মী, ... বঙ্গলিপি ...সহ ৬৪ প্রকার লিপি অবগত ছিলেন। "

বৌদ্ধদের ধর্মস্থানে হিন্দু আগ্রাসন নিয়ে এতো কোর্ট কাছারির হাঙ্গামা কেন? আনন্দ বাজার পত্রিকার মতে (সম্পাদকীয়, ২২ আগষ্ট ১৯৯৩) হাজার হাজর বৌদ্ধ মন্দির (সহ পুরীর জগন্নাথ মন্দির, উড়িষ্যা এবং অন্ধ্র প্রদেশের তিরুপতি বালাজি) হিন্দুরা দখল করে নিয়েছে। হিন্দুরাজনীতি বৌদ্ধধর্মকে ধ্বংস করতে গিয়ে এতো গভীর ষড়যন্ত্র করে কেন? বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দির হিন্দুত্বকরনের বিরুদ্ধে হাজার হাজার জনতা সহ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের আমরন ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়েছে বছরের পর বছর।

বিরাজমান সিনিয়র উকিল রাজীব ধাবন তিনি তাঁর মক্কেল বৌদ্ধ নেতাকে উদ্দেশ্য করে বলেন যে, বিগত ৬০ বছর পর্যন্ত ভারতীয় সংবিধানের মানবাধিকার লঙ্ঘন করে ভারত সরকার বুদ্ধগয়া ম্যানেজম্যান্ট কমিটিতে অবৌদ্ধ (হিন্দু) সদস্যের মাধ্যমে বুদ্ধগয়া ম্যানেজম্যান্ট কমিটি পরিচালনা করে বৌদ্ধদের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে ভারতীয় সংবিধানকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। জনতার প্রশ্ন : বিগত ৬০ বছর পর্যন্ত ভারত সরকারের সাহার্যে অবৌদ্ধগণ কেন বুদ্ধগয়া ম্যানেজম্যান্ট কমিটি পরিচালনা করেছেন?

গৌতমবুদ্ধের (রাজপুত্র সিদ্ধার্থ) বুদ্ধত্বলাভের পূত পবিত্র ধ্যানভূমির নাম বুদ্ধগয়ায় "মহাবোধি মন্দির" আজ ( সেপ্টেম্বর ২২, ২০১২) সুপ্রীম কোর্টের রায়ের পূর্বে পর্যন্ত হিন্দুত্ববাদীরা শত শত বছর ধরে দথল করে ছিল। অথচ প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে বৌদ্ধ     চিন্তাধারাপুষ্ঠ অশোক চক্র ভারতের জাতীয় পতাকা এবং জাতীয় এমব্লেম বা সরকারী স্মারক চিহ্ন রুপে বিরাজমান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, "তিনি (গৌতমবুদ্ধ) জন্মেছেন মানবের চিত্তে, প্রতিদিন তিনি জন্মাচ্ছেন, প্রতিদিন তিনি বেঁচে আছেন।"   বৌদ্ধদের শ্রেষ্ঠতম তীর্থভূমি "বুদ্ধগয়া দখল করে"মন্দিরের দান বাক্সকে হিন্দুরাজনীতির অধীনে বন্দী করে রেখে ভারতীয় বৌদ্ধদের অস্তিত্বকে সমূলে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র ছিল। বৈদিক পন্থীরা মিথ্যা ইতিহাস বানিয়ে বৌদ্ধ সভ্যতাকে গ্রাস করার ষড়যন্ত্র উক্ত সুপ্রীম কোর্টের রায়ের মাধ্যমে বন্ধ হবে বলে আমরা আশা রাখি।

গৌতমবুদ্ধের পাদপদ্মে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদন করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন,

"আমি যাঁকে আমার অন্তরের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বলে উপলব্ধি করেছি আজ এই বৈশাখী পূর্ণিমায় তাঁর জন্মোৎসবে তাঁকে আমার প্রনাম নিবেদন করতে এসেছি, এ কোন বিশেষ অনুষ্ঠানে অর্ঘ নিবেদন নয়, যাঁকে নির্জনে বারংবার অর্ঘ নিবেদন করেছি, সেই অর্ঘই আজ নিবেদন করতে উপস্থিত হয়েছি। একদিন বুদ্ধগয়াতে বুদ্ধমন্দির দর্শনে গিয়েছিলুম। সেইদিন এ কথা মনে জেগেছিল - যে সময়ে ভগবানবুদ্ধের চরণস্পর্শে সমস্ত বসুন্ধরা জেগে ওঠেছিল, গয়াতে যেদিন তিনি স্বশরীরে উপস্থিত ছিলেন, সেদিন কেন আমি জন্মাই নি, কেন সেদিন অনুভব করিনি তাঁকে একান্তভাবে শরীর মন দিয়ে। "   ...

"যাঁরা প্রতাপবান, বীর্য্যবান তাঁদের সংখ্যা পৃথিবীতে বেশী নয়। অনেক মানব, রাজা, ধনী মানী ও রাষ্ঠ্রনেতা এ পৃথিবীতে জন্মেছে। কিন্তু সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে কতজন এসেছেন? যিনি সম্পূর্ণ মনুষ্যত্ব নিয়ে এসেছিলেন আবার তাঁকে আহ্বান করছি আজকে এই ছিন্ন বিচ্ছিন্ন ভারতে, যেখানে মানুষের সঙ্গে মানুষের বিসম্বাদ, যেখানে ভেদ বিবাদে মানুষ জর্জরিত, সেই ভারতে তিনি আবার আসুন। সত্যের দ্বারা মানবের পূর্ণ প্রকাশ। যিনি আপনার মধ্যে সকল জীবকে দেখেন। তিনি স্বয়ং প্রকাশ। তিনি প্রকাশিত হবেন তাঁর মহিমার মধ্যে।"

"এশিয়া খন্ডে মানবের সে কীর্তি দেখলে বিস্মিত হতে হয়। কেমন করে কোন ভাষায় বলব, তিনি এই পৃথিবীতে এসেছিলেন, কেমন করে মানুষকে তাঁর বাণী বলেছেন, সেই স্মৃতিটুকু রাখবার জন্য মানুষ অজন্তার গুহা হতে শুরু করে কত না অসাধ্য সাধন করেছে। কিন্তু এর চেয়ে দুঃসাধ্য কাজ হয়েছে সেদিন, যেদিন সম্রাট অশোক তাঁর শিলালিপিতে লিখলেন বুদ্ধের বাণী।"

ইতিহাসের মতে, হিন্দুত্ববাদীরা মুখে বলে তারা ধমীয় দল, আসলে তারা একটি ফ্যাসিষ্ঠ দল হয়ে আজ বৌদ্ধদের সবচেয়ে পবিত্র তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ায় " মহাবোধি মন্দির " হাজার হাজার বছর পর্যন্ত দখল করে ছিল। রাজা শশাঙ্ক ৭ম শতাব্দীতে বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দিল দখল করে বোধিবৃক্ষ ধ্বংস করার ইতিহাস চীনা পরিব্রাজক ইউয়েন সাং তাঁর ভ্রমন কাহিনীর ইতিহাসে লিপিবদ্ধ করে গেছেন। ইউরোপে নাৎসিদের হাতে ইহুদি নির্যাতনের মতো ভারতে (দক্ষিন এশিয়া) ব্রাহ্মণ শাসক পুষ্যমিত্র (খৃষ্ঠপূর্ব ১০০), রাজা শশাঙ্ক (৭ম শতাব্দী), ও শংকরাচার্য (৮ম শতাব্দী), সহ হিন্দুত্ববাদীদের হাতে বৌদ্ধ জনগণ ও দলিত নির্যাতন সহ বৌদ্ধ হত্যাযজ্ঞের ইতিহাস লেখা হলে পাঠকগণ দেখবেন, তা হলোকাষ্টের চেয়ে কম বীভৎস নয়।

হিন্দু বর্ণাশ্রম বিরোধী সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিম চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ব্রাহ্মণদের কুসংস্কারের বিরুদ্ধে 'সাম্যবাদ' নামক বই লিখেছিলেন এবং গৌতমবুদ্ধকে সশ্রদ্ধ বন্দনা নিবেদন করে ঘোষণা করলেন, "তখন বিশুদ্ধাত্মা শাক্যসিংহ অনন্তকালস্থায়ী মহিমা বিস্তার পূর্বক, ভারতাকাশে উদিত হইয়া, দিগন্ত প্রসারিত রূপে বলিলেন, "আমি উদ্ধার করিব। আমি তোমাদেরকে উদ্ধারের বীজমন্ত্র দিতেছি, তোমরা সেই মন্ত্র সাধন কর। তোমরা সবাই সমান। ব্রাহ্মণ শুদ্র সমান। মনুষ্যে মনুষ্যে সকলেই সমান। সকলেই পাপী, সকলের উদ্ধার সদাচরণে। বর্ণ বৈষম্য মিথ্যা। যাগযজ্ঞ মিথ্যা। বেদ মিথ্যা, সূত্র মিথ্যা, ঐহিক সুখ মিথ্যা, কে রাজা, কে প্রজা, সব মিথ্যা। ধর্মই সত্য। মিথ্যা ত্যাগ করিয়া সকলেই সত্যধর্ম পালন কর। (বঙ্কিম রচনাবলী, ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ৩৮২ থেকে ৩৮৩, সাহিত্য সংসদ প্রকাশিত, কলকাতা)।"

হিন্দু শাসক ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের ইতিহাস চুরির চাতুর্যে বিষ্ণুপুরাণে বুদ্ধকে বলা হয়েছে 'মহামোহ'"মনুসংতিা"এবং বিভিন্ন পুরান সাহিত্য রচনা করে বুদ্ধগয়া দখল করে আছে এবং গৌতমবুদ্ধকে হিন্দুর নবম অবতার বানিয়ে জাপান, থাইল্যান্ড, চীন সহ বৌদ্ধবিশ্ব থেকে মনের সুখে "টাকা আনা পাই" কামাচ্ছে। কৌটিল্য বিধান দিয়েছেন যে, ভোজনে যদি বৌদ্ধ শূদ্র প্রভুতির ব্যবস্থা হয়ে তবে জরিমানা দিতে হবে ১০০ পণ।

মানবাধিকারের আলোকে বঙ্গলিপির বয়স কত জানার অধিকার বাঙালি পাঠকদের অবশ্যই আছে। বাংলাভাষা থেরবাদী পালি ভাষার বিবর্তিত রূপ। বৌদ্ধধর্ম, বাংলা ভাষা ও জাতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়েছে রাজপৃত্র সিদ্ধার্থের (গৌতমবুদ্ধ) বঙ্গলিপি অধ্যয়ন এবং ১৯০৭ সালে নেপালের রাজকীয় লাইব্রেরী থেকে মহামহোপধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী কর্তৃক চর্যাপদ আবিস্কারের মাধ্যমে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়,

"মানবের দুঃখ দূর করার জন্য তিনি জন্ম নিয়েছেন। রাজাধিরাজ অথবা রাজপ্রতিভূরুপে তিনি হয়ত প্রভূত সন্মান পেতেন। কিন্তু সে সন্মান কালের সঙ্গে সঙ্গে বিলুপ্ত হ'ত। বর্তমানের আদর্শ মানুষকে খর্ব্ব করে। রাষ্ট্র নেতাকে ক্ষুদ্র বর্তমানের মধ্যে দেখা যায়। কিন্তু মহা পুরুষদেরকে দেখতে গেলে মহাযুগের মধ্য দিয়ে দেখতে হয়, গভীর অতীতের মধ্য দিয়ে যাঁর পাশে বর্তমান সংলগ্ন রয়েছে।

তিনি সমস্ত মানবের চিত্তের মধ্যে জন্ম নিয়েছেন, বর্তমানে তাঁর আসন রচনা হচ্ছে, ভাবী কালেও তাঁর আসন রচিত থাকবে। পাপী যে, জানে না সে, কোথায় তার দুঃখ দূর হবে। এই যে মানব, তারা তাঁর কাছে এসেছে কেন? তিনি সমস্ত মানবের মুক্তির জন্য এসেছিলেন। এই জন্যই মানব আজ ও তাঁর কাছে আসে।" সুপ্রীম কোর্টে সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী।   গৌতমবুদ্ধ বঙ্গলিপি অধ্যয়ণ করার পর ও গৌতমবুদ্ধের বুদ্ধবর্ষ বাদ দিয়ে হিন্দুরাজনীতি বঙ্গাব্দ রচিত করলেন কেন? হিন্দু ধর্মে মানবাধিকার না থাকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বৈদিক জাতিভেদ প্রথার বিরুদ্ধে বৌদ্ধধর্মের জয়গান গেয়ে চন্ডালিকা শীর্ষক নৃত্যনাট্য রচনা কথা হিন্দুরাজনীতির নিশ্চয় মনে আছে। হিংসায় পতন, অহিংসায় বিশ্বজয়।

রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, "গৌতমবুদ্ধ আমার মহান গুরু, আমার সর্বশ্রেষ্ঠ শিক্ষক। ÒBuddha, my lord, my master, thy birthplace, is tuly here where cruel is the world of men, for thy mercy is to fill the black of their utter failure, to help them who have lost their faith and betrayed their trust; to forget themselves in thee and thus forget their day.

"ওই নামে একদিন ধন্য হল দেশে দেশান্তরে

তব জন্মভূমি।

সেই নাম আরবার এ দেশের নগরে প্রান্তরে

দান কর তুমি।

বোধিদ্রুমতলে তব সেদিনের মহাজাগরণ

আবার সার্থক হোক, মুক্ত হোক মোহ আবরণ,

বিস্মৃতির রাত্রিশেষে এ ভারতে তোমারে স্মরণ

নব প্রভাতে উড়ুক কুসুমি।"

 

[এস. বড়য়া, প্রবাসী রাজনৈতিক ভাষ্যকার, বিবিধ গ্রন্থ প্রণেতা ও কলামিষ্ট।]

http://www.dhammainfo.com/heritage/more/item/310-%E0%A6%B8%E0%A7%81%E0%A6%AA%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%AE-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A7%9F,-%20%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A6%E0%A7%81%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%AC%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%AC%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A7%87-%E0%A6%AC%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%97%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A7%9F-%E0%A6%AC%E0%A7%8C%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%A7%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%9C%E0%A7%9F

ভারতীয় শাসকদের ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা

বাঙ্গাল আব্দুল কুদ্দুসঃ বিগত ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে হিন্দু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী অপশক্তি ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে রাম মন্দির প্রতিষ্ঠার ট্র্যাজেডি ভারতীয় আইনের শাসন, হিউম্যান রাইটস এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ইতিহাসে এক মহা কলংকের ইতিহাস নতুন করে রচনা করেছে। ভারতীয় লোকসভার মনোনীত 'লিবারহ্যান কমিশন' বাবরি মসজিদ ধ্বংসের জন্য ১৭ বছর পর ভারতের উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী কল্যাণ সিংহসহ ৬৮ জন হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতাদের অভিযুক্ত করেছেন। এ কথা সত্য যে, বাবরি মসজিদ যে সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদীরা ভেঙে দিয়ে সেখানে মন্দির গড়ে তুলছে, তাদের পূর্বপুরুষরা অসংখ্য বৌদ্ধবিহার দখল করে হিন্দু দেব-দেবীর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। এ কারণেই তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা আজও তাদের বৌদ্ধধর্মের স্বাধীনতাসহ বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দিরের মুক্তি কামনা করেন। কোটি কোটি বৌদ্ধের প্রশ্ন, সম্রাট অশোকের বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দিরকে হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসী নেতারা এখনো পর্যন্ত কেন দখল করে আছে? অনেকের মতো আমাদেরও প্রশ্ন, বিগত ৬ ডিসেম্বর ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক বাবরি মসজিদ ভেঙে হিন্দু ধর্ম ও সমাজের এমনকি লাভ হয়েছে?
এখানে উল্লেখ করা যায়, ভারতীয হিন্দু সমাজের কাছে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপদেশ ছিল, 'রামের জন্মভূমি অযোধ্যার চেয়েও সত্য জানো/হে কবি, তব মনোভূমি।' বিশ্ববাসী জানে, হিন্দু সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসবাদী অপশক্তি অযোধ্যায় রামের জন্মভূমির নামে ১৯৯২ সালে দাঙ্গা বাঁধিয়ে ভারতের এক হাজারেরও বেশি মুসলমানকে হত্যা করেছে। যাকে রীতিমত বলা যায়, পাইকারী গণহত্যা। আরো প্রায় দেড় লাখ মুসলমান নর-নারীকে আহত করেছে। হাজার হাজার মুসলিম নারীর সম্ভ্রমহানি করা হয়েছে। আর মুসলমানদের কোটি কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ লুটে নিয়ে উল্লাস করেছে সন্ত্রাসী হিন্দুরা। অথচ ভারতের তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীদের কী প্রতারণাপূর্ণ প্রচার-প্রচারণা কৌশল! 'মুসলমান ভারতের নয়নমণি (?), হিন্দু তাহার প্রাণ'। গবেষক ও ইতিহাসবিদরা বলছেন, বুদ্ধগয়া দখলে নেয়ার পর হিন্দু সন্ত্রাসবাদীরা বাবরি মসজিদ গুঁড়িয়ে দিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছে। তারপর হযরত ঈশা (আঃ) খৃস্টান ধর্মাবলম্বীদের ভগবান যিশুকে হিন্দুদের অবতার বানিয়ে ভবিষ্যতে খৃস্টান চার্চ দখলে নেয়ার আশংকা কেবল দিন দিন বেড়েই চলছে। বৌদ্ধধর্মের পন্ডিতদের মতে, ভগবান গৌতম বুদ্ধ বেদবিরোধী ধর্ম প্রচার করার পরও গৌতম বুদ্ধকে হিন্দুর নবম অবতার বানিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা ফায়দা লুটে নিচ্ছে। সম্রাট আকবরের আমলে হিন্দু পন্ডিতরা জালিয়াতির মাধ্যমে 'আল্লাহ উপনিষদ' রচনা করে মোগলে আজমের রাজনীতির বাজার দখল করেছিলেন।

গবেষক ও ইতিহাসবিদের মতে, হিন্দুধর্ম ত্যাগ করার পর সম্রাট অশোকের প্রার্থনা ছিল, 'বুদ্ধং শরণং গচ্ছামি'। ভূপালে সাঁচীর তোরণদ্বারের দক্ষিণ তোরণের পশ্চিম পাশের স্তম্ভের মধ্যের দুটো প্যানেলে সেই সম্রাট অশোকের তীর্থভূমি বুদ্ধগয়ায় মহাবোধিবৃক্ষে বুদ্ধ বন্দনার অমর অ্যালবাম আজো অম্লান রয়েছে। ২৫৫৪ বছর আগে ভারতের বিহার প্রদেশে গৌতম বুদ্ধের 'বুদ্ধত্ব লাভের' জায়গাটির নাম 'বুদ্ধগয়া'। ভারতের হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির কৌশলী খেলোয়াড়রা 'কীর্তনে ভাগ সমানে সমান' নীতিতে বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির শত শত বছর ধরে দখল করে আছে। ভারতের দৈনিক পাটনা, ২৪ মে, ২০০৮ সংখ্যায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, মানুষের সব মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী ও মানবাধিকার বিরোধী এক কালো আইনের নাম 'বুদ্ধগয়া মহাবোধি ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যগণের নীতিমালা'। স্মরণ করা যায়, সম্রাট অশোক কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহ পরিণাম দেখে শান্তির অন্বেষায় ত্রাহি ত্রাহি করতে করতে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন। সম্রাট অশোক কারণ হিসাবে দেখতে পান যে, হিন্দু সমাজে মানবাধিকার বলতেই নেই। কেননা, ধর্মনিরপেক্ষতা হিন্দু মৌলবাদী সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর চাতুর্যপূর্ণ প্রচারণা কৌশল মাত্র। তাই হিন্দু ধর্মনিরপেক্ষ (?) রাজনীতি বৌদ্ধদের হাত থেকে বৌদ্ধ ধর্ম, অশোকচক্র এবং বুদ্ধগয়া কেড়ে নিতে পেরেছে। 

ইতিহাসে দেখতে পাই, সম্রাট অশোকের রাজত্বকালে ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির অবসান ঘটে। কিন্তু অশোকের মৃত্যুর পর আবার কট্টর ব্রাহ্মণ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে দিনের পর দিন বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ধ্বংস করে চলেছে। ভারতে রাজনৈতিক হিন্দুধর্ম নাম ও যশের জন্য বৌদ্ধধর্মের গলা টিপে দিয়ে বৌদ্ধদের অবলোকিতেশ্বর বোধিসত্ত্বকে হিন্দুদের শিব বানিয়ে বৌদ্ধ ঐতিহ্যগুলোসহ বুদ্ধগয়া মহাবোধি মন্দির তীর্থভূমি দখখল করে নিয়েছে। গবেষকরা আরো বলেন, বৌদ্ধদের তারা দেবীকে হিন্দু মহিষাশূর মর্দিনী দুর্গা বানিয়েছে। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, বৌদ্ধধর্মের শ্মশানের উপর হিন্দুস্থানে সম্রাট অশোকের অশোকচক্র খচিত বর্তমান ভারতের জাতীয় পতাকা শোভা পাচ্ছে। তবুও ভারতের ব্রাহ্মণ্যবাদী হিন্দু সমাজে অকাট্য সত্য কথা বলার উপায় নেই। বৌদ্ধ ধর্মের পন্ডিতরা বলেন, 'বৌদ্ধ ধর্ম তো হিন্দু ধর্মের কোনো শাখা বা প্রকাশা নয়'। এমন কথা কেউ কখনো বলতে না বলতেই মৌলবাদী হিন্দু সন্ত্রাসীরা সশস্ত্র হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বেই। অথচ বিহার শব্দের অথর্থ বৌদ্ধবিহার। ইতিহাস সচেতন ব্যক্তি মাত্রই জানেন, সম্রাট অশোকের রাষ্ট্রধর্ম ছিল গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধধর্ম। আজ সেই বৌদ্ধ ধর্ম, ভারতের অসহায় দলিত মানুষের আশ্রয়।

ভারতের শাসকরা দশকের পর দশক ধরে বৌদ্ধধর্মকে নানাভাবে ধ্বংস করে জাতিভেদ প্রথার মাধ্যমে বৈদিক রাষ্ট্রের কাঠামো গড়ে তোলেন। এ প্রসঙ্গে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর চন্ডালিকা শীর্ষক নৃত্যনাট্যে বিশ্ব মানবতার বাণী 'অহিংস পরম ধর্ম' প্রচার করেছেন। অবশ্য আমরা সবাই জানি এবং বুঝি- হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খৃস্টানসহ সব মানব সন্তান মিলেই মানবজাতি। বৌদ্ধরা অভিযোগ করে আসছেন, হিন্দু শাসকরা বুদ্ধগয়ার মাধ্যমে রাজনীতির 'ব্রহ্মজাল' পেতে রেখেছে। এই চাণক্য রাজনীতির কূটকৌশল ব্রাহ্মণ্যবাদের সমাজপাঠ। তাই জাতিভেদ প্রথার ট্র্যাজেডিতে বলতে গেলে মুসলমানসহ বৌদ্ধরা ভারতে ক্রীতদাসে পরিণত হয়েছে। যতই ধর্মনিরপেক্ষতার ঢাকঢোল পিটানো হোক না কেন, আজ বৌদ্ধধর্ম ভারতের দারিদ্র্যলাঞ্ছিত ও ভাগ্যবিড়ম্বিত আদিবাসী এবং ড. বি আর আম্বেদকরের অনুসারীদের ধর্ম। অস্বীকার করবেন-ই বা কী করে? ভারতবর্ষে স্বাধীন বৌদ্ধ জাতির অস্তিত্ব ধ্বংস করে জঙ্গিবাদী রাজনৈতিক হিন্দু ধর্মের জয়গান চলছে। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম থাকা সত্ত্বেও বাংলাদেশে 'বুদ্ধ পূর্ণিমা'র সরকারি ছুটি আছে। অথচ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পর্যন্ত বুদ্ধ পূর্ণিমার সরকারি ছুটি নেই। কিন্তু কলকাতার ধর্মনিরপেক্ষতার দাবিদার বাঙালী কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, কলামিস্ট, গবেষক, বুদ্ধিজীবী ও ইতিহাসবিদরা বুদ্ধ পূর্ণিমা সম্বন্ধে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সরকারকে কিছু বলেছেন বলে মনে হয় না।
গবেষক ও বিশ্লেষকরা বলছেন, ভারতে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শাসকদের অত্যাচারে বৌদ্ধরা চন্ডাল বা নীচ জাতিতে পরিণত হয়েছে। শান্তিকামী হিন্দু জনতা বৌদ্ধদের পরম বন্ধু। কিন্তু অত্যাচারী হিন্দু শাসকরা বৌদ্ধদের শত্রু। ধর্মনিরপেক্ষ (?) ভারতে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের মতো বৌদ্ধদের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা আছে কি? থাকলে ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর জাতিভেদ প্রথার ট্র্যাজেডি সহ্য করতে না পেরে ভারতের সাবেক আইনমন্ত্রী ও সংবিধান প্রণেতা ড. আম্বেদকর ৫০ হাজার হিন্দু জনতা নিয়ে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলেন কেন? ভারতীয় মানবাধিকারবাদী শাসকরা বুদ্ধকে হিন্দুদের অবতার বানিয়ে বৌদ্ধদের নীচ জাতি করে রেখেছেন। কিন্তু মন্দিরে বুদ্ধ পূজা করার প্রথা আছে কি? পূজা না করে হিন্দুরা গৌতম বুদ্ধকে 'শিব বা অবতার' বলে তামাশা করার কারণ কি? ভারতে বৌদ্ধ সমাজকে ধ্বংস করার জন্যই কি এই ষড়যন্ত্র?

ইতিহাস গবেষক অধ্যাপক মনীন্দ্র মোহন বসু যথার্থই লিখেছেন, 'অবশেষে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধমত তিববত, নেপাল প্রভৃতি দেশে যাইয়া আশ্রয় লাভ করিয়াছে। বৌদ্ধ ধর্মের এই পরাজয় এত সম্পূর্ণ হইয়াছিল যে, ধর্মের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থসমূহও ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে। খেরবাদী সম্প্রদায়ের গ্রন্থগুলো সিংহল ও ব্রহ্মদেশ হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। আর মহাযান মতের শাস্ত্রসমূহ পাওয়া গিয়াছে প্রধানত চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে। চর্যাপদের পুঁথি নেপালে আবিষ্কার হইয়াছিল। আর ইহার অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে তিববতী ভাষায়। এখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধ ধর্মের সমাধির স্মৃতিচিহ্ন মাত্রই দৃষ্ট হইয়া থাকে।' অথচ চীন ও জাপানসহ অনেক দেশের কোটি কোটি মানুষ বুদ্ধের ধর্ম গ্রহণ করে বৌদ্ধ হলেন।
গৌতম বুদ্ধের মৃত্যুর প্রায় পনের শত বছর পর একশ্রেণীর মৌলবাদীর দল বুদ্ধকে রাতারাতি হিন্দুর নবম অবতার করে সর্বগ্রাসী হিন্দু ধর্মের ফায়দা লুটে নিতে বাংলাদেশের সেন রাজত্ব স্থাপনের পর বৌদ্ধদের নির্মূল করার অভিযান শুরু হলো। বৌদ্ধ ধর্মের শত্রু রাজা পুষ্যমিত্র (খৃঃ পুঃ ১৫০) থেকে রাজা শশাঙ্ক (৬৫০ খৃস্টাব্দে) যুদ্ধগায়া মন্দিরকে দখল করার ষড়যন্ত্র করেছেন। বৌদ্ধ ধর্মের অন্যতম শত্রু ও যুদ্ধাপরাধী শঙ্কারাচার্য (অষ্টম শতাব্দী) একটানা ১০ বছর গণহত্যা চালিয়ে বৌদ্ধ ধর্মকে নির্মূল করেন। বর্বর এই গণহত্যা ভারতের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চিরস্থায়ী ক্ষতের জন্ম দিয়েছে। তার ভয়ঙ্কর ফল, বিশ্বের বৌদ্ধদের শ্রেষ্ঠতম তীর্থস্থান 'বুদ্ধগয়ার মহাবোধি মন্দির' উগ্রবাদী হিন্দুরা বহু আগেই দখল করে নিয়েছে। আর বাংলাদেশের বৌদ্ধরা ছিল ব্রাহ্মণ্যবাদী ধর্মের পথের কাঁটা।

ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, জাতিভেদ প্রথামূলক ধর্মের মাথা বিক্রি করে গণতান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মকে বৈদিক ব্রাহ্মণরা ধ্বংস করেছিলেন। অধ্যাপক হরলাল রায় চর্যাগীতি গ্রন্থে লিখেছেন, 'ধর্ম কোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বনিদ্বতায় পালি সাহিত্যের উৎপত্তি। হিন্দু ধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণেই বৌদ্ধ ধর্ম ভারত হতে বিতাড়িত হয়েছিল। তিনি আরো লিখেছেন, বৌদ্ধধর্ম তার জন্মভূমি ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। যারা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল, তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে কুক্ষিগত করে। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবীরা রিক্ত সর্বস্বান্ত হয়ে ধীরে ধীরে ভারত থেকে তিববত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।'

ইতিহাস গবেষকরা বলছেন, বাংলাভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন, চর্যাপদগুলো নেপাল ও ভুটানে পাওয়া গেল কেন? চর্যাকারদের জীবনী গ্রন্থগুলোই বা তিববতী ভাষায় লেখা কেন? পুরীর বৌদ্ধ বিহারকে কারা জগন্নাথ মন্দিরে রূপান্তরিত করলো?

ইতিহাস গবেষকরা বলছেন, সাম্প্রদায়িক শাসকরা বুদ্ধগয়ায় মহাবোধি মন্দির দখল করার জন্য দিনের পর দিন মন্দিরের ভেতরে শিবলিঙ্গসহ হিন্দুদের দেব-দেবী স্থাপন করেছেন। বৈদিক হিন্দু রাজা ইন্দ্র মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পার প্রাগৈতিহাসিক বৌদ্ধধর্ম (গৌতম বুদ্ধের আগে আরো ২৭ জন বৌদ্ধ ছিলেন) ধ্বংস করে বৈদিক সভ্যতা স্থাপন করেন। বৌদ্ধ সভ্যতা বিরোধী এক কালো আইন বা প্রথার নাম 'অবতার বাদ'। রামায়নের অযোধ্যা অধ্যায় ৩২ নম্বর শ্লোকে বুদ্ধকে গালাগাল দেয়ার পর রাজনৈতিক হিন্দুত্ববাদ আবার বুদ্ধকে হিন্দুদের নবম অবতার বানিয়ে ভারতীয় বৌদ্ধদের অস্তিত্ব সমূলে ধ্বংস করেছে। আজো ভগবান (?) মহাবীর ও গুরু নানক হিন্দুদের 'অবতার' হতে পারেননি। তবে ভবিষ্যতে তাদেরকেও অবতার বানানোর পরিকল্পনা চলছে। তাই বলছি, বৌদ্ধ, মুসলিম ও খ্রিস্টান দলনই কি ভারতীয় শাসকদের ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা?

http://www.theanuranan.com/news_detail.php?news_id=3577


 অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ এবং একজন বাবাসাহেব | ০১/৮ |

untitled
[স্বীকারোক্তি: বিশেষ প্রয়োজনে গুগল-অনুসন্ধানেও প্রয়োজনীয় কিছু তথ্যের অপর্যাপ্ততা দেখে শেষে নিজেই কিছু একটা লিখে ফেলার সিদ্ধান্ত হিসেবে এ লেখাটার জন্ম । মূল লেখাটা বেশ দীর্ঘ হয়ে যাওয়ায় আগ্রহী পাঠকের ধৈর্য্যচ্যুতির আশঙ্কা মাথায় রেখে লেখাটার গুরুত্ব বিবেচনায় (একান্তই নিজস্ব ধারণা) প্রথম অংশটাকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করে সিরিজ আকারে এখানে পোস্ট করার ইচ্ছা পোষণ করলাম। তবে মূল অখণ্ড লেখাটা এখানে সংরক্ষিতআছে।]

অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পর্ব:[*] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮]


কলঙ্ক
খুব বেশিকাল আগের কথা নয়, একসময় সাধারণ পৌর শহরগুলোতেই কিছু কিছু ভ্রাম্যমান নারী-পুরুষ দেখা যেত যাদের কোমরে অনিবার্যভাবে বাঁধা থাকতো একটি ঝাড়ু, আর গলায় বা কোমরে ঝুলানো থাকতো একটি টিনের মগ জাতিয় পাত্র। ঝাড়ুটি হলো তার পেশাগত প্রতীক বা পরিচয়। তাদের কাজ হচ্ছে লোকালয়ের ময়লা আবর্জনা পরিষ্কার করে শহরটিকে পরিচ্ছন্ন রাখা। পেশাগতভাবে এরা পৌর-কর্তৃপক্ষের শুধু যে বেতনভুক কর্মচারী তা-ই নয়, সম্প্রদায়গতভাবেও এদের পেশাটা তা-ই। সামাজিক শ্রমবিন্যাস অনুযায়ী তাদের জন্য অন্য পেশা বরাদ্দ ছিলো না। তাই জন্মগতভাবে বা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত এ পেশাই তাদের জীবিকার একমাত্র উৎস। আর সাথের মগটি ছিলো তাদের সামাজিক অবস্থানের এক ভয়াবহ অস্পৃশ্যতার প্রতীক। অর্থাৎ সব ধরনের ছোঁয়াছুয়ির উর্ধ্বে থেকে অন্য কাউকে যাতে কোনরূপ অশূচি হবার বিড়ম্বনায় পড়তে না হয় সেজন্যেই এ ব্যবস্থা। পানির তেষ্টা পেলে কোন হোটেল বা চা-দোকানের বাইরে থেকে মগটা বাড়িয়ে দিয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে দোকানের কেউ হয়তো নিরাপদ অবস্থান থেকে ওই মগটিতে পানি ঢেলে দিতো। এমনকি কোন পাবলিক টিউবওয়েলে ছোঁয়ার ঝুঁকি না নিয়ে এরা অপেক্ষায় থাকতো দয়া করে কেউ যদি টিউবওয়েল চেপে কিছুটা পানি ঐ মগে ঢেলে দেয়। কিংবা টাকা দিয়ে দোকান থেকে চা খেতে চাইলেও চায়ের কাপ স্পর্শ করার অধিকার নেই বলে গরম চা ওই মগেই ঢেলে দেয়া হতো। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অন্য লোকজনের সাথে এক কাতারে বসার তো প্রশ্নই উঠে না! নিরাপদ দূরত্ব বাঁচিয়ে মাটিতে বসে পড়াটাই তাদের জন্য অনুমোদিত ব্যবস্থা। তারপরও তাদের ছোঁয়ায় ঐ স্থানটা নোংরা হয়ে যাবার সম্ভাবনা প্রবল থাকতো সবসময়। এরা হলো ধাঙড়, মেথর বা সুইপার। তাদের বসবাসের ব্যবস্থাও সেরকমই। ভদ্রপাড়া থেকে দূরে স্বতন্ত্র কোন বস্তি বা পল্লীতে এদের গোষ্ঠিগত বসবাস। এদের সংস্কৃতি ভিন্ন, জীবনধারা ভিন্ন, উৎসব-উদযাপন সবই ভিন্ন এবং অনিবার্যভাবে গোষ্ঠিগত।

এদেরই একটি অংশ আবার চর্মকার বলে পরিচিত, ভাষার অপভ্রংশতায় যাদেরকে চামার বলে ডাকা হয়। যারা মূলত মৃত পশুর চামড়া সংগ্রহ থেকে শুরু করে জুতো বা চামড়া জাতিয় দ্রব্যাদি তৈরির সাথে জড়িত। এরা সমাজের অনিবার্য অংশ হয়েও অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। সমাজের যে কোন সামাজিক কর্মকাণ্ডে এদের শ্রমের প্রয়োজন পড়ে, কিন্তু কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের অধিকার এদের নেই। এধরনের আরো বহু সম্প্রদায় রয়েছে আমাদের সমাজে একই রকম অস্পৃশ্য। স্বভাবতই অধিকতর সভ্য ও শিক্ষিত নাগরিকদের বাসস্থান শহরের চিত্র থেকে যদি আমাদের দৃষ্টিটাকে দূরবর্তী পল্লী অঞ্চলের দিকে নিয়ে যাই, তাহলে এই বাস্তবতাই আরো অনেক কঠিন ও তীব্র হয়ে দেখা দেবে। কেননা গ্রামের সামাজিক কাঠামোতে জীবিকার উৎস আরো অনেক বেশি সঙ্কুচিত বলে এসব অস্পৃষ্য সম্প্রদায়গুলোর মানবেতর জীবন-ধারণ খুবই শোচনীয় পর্যায়ে ঘুরপাক খেতে থাকে। তাদের বসবাস থাকে গ্রামের বাইরের দিকে অত্যন্ত অবহেলিতভাবে অবস্থায়। দেখতে শুনতে চেহারায় আকারে অন্য বর্ণ বা সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মতো হয়েও কেন এরা সামাজিকভাবে এতো অস্পৃশ্য অপাঙক্তেয় ? যুগে যুগে এ প্রশ্নটা যে উত্থাপিত হয়নি তা নয়। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, এদের পেশার অনেক ক্ষেত্রেই অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষ ইদানিং জীবিকার তাগিদে ভাগ বসালেও এই অস্পৃশ্যদের জন্য অন্য পেশায় জড়িত হওয়া কিছুতেই সম্ভব হয়নি আজো। কারণ অস্পৃশ্যতা এদের গা থেকে মুছে যায়নি বা মুছা হয়নি। অথচ তাদের পেশায় ভাগ বসালেও অন্য সম্প্রদায়কে কিন্তু এই অস্পৃশ্যতার দায় বইতে হয় না। এতেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, সমাজ নিয়ন্ত্রিত এই অস্পৃশ্যতার দায় আসলে পেশা বা কর্মগত নয়, সম্পূর্ণই জন্মগত একটা অভিশাপ। কর্মদোষ নয়, জন্মদোষটাই এখানে একমাত্র উপাত্ত। কিন্তু সমাজ বা সামাজিক ব্যবস্থা কি চাইলেই কোন সম্প্রদায়কে অছ্যুৎ বা অস্পৃশ্য বানিয়ে দিতে পারে ? প্রশ্নটা যত সহজে করা যায়, উত্তরটা বোধ করি তত সহজ বা সাবলীল নয়। এর পেছনে আমাদের এই ভারতীয় উপমহাদেশের হাজার বছরের রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক কাঠামো তৈরিতে যে ধর্মীয় বর্ণাশ্রমগত নিপীড়নের ইতিহাস তথা মানব-দলনের যে ঐতিহ্য বা কালো অধ্যায় মিশে আছে তার শিকড় এতোটাই গভীরে প্রোথিত যে, গোটা সামাজিক সত্তাটাই বুঝি এই বর্ণবাদের সাথে একাত্ম হয়ে মিশে আছে। অর্থাৎ আচারে বিচারে জীবনে যাপনে সামাজিকতায় এই ধর্মীয় বর্ণবাদী ব্যবস্থা থেকে সমাজকে বা সমাজের কোন অংশকে পৃথক করা শরীর থেকে চামড়া আলগা করার মতোই দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। চামড়ার কোথাও একটু টান পড়লে গোটা শরীরটাই আৎকে ওঠে, বিগড়ে যায়। তাই বলে কি এই সভ্য জগতের তথাকথিত সভ্য মানুষদেরকেও এভাবেই হাজার বছরের কলঙ্ক বয়ে বয়ে যেতে হবে ?

সভ্য মানুষরা তা বয়ে যাচ্ছে বৈ কি ! কেননা আজো যারা এই সমাজ সংসারের অধিকর্তা হিসেবে জন্মগতভাবে মহান উত্তরাধিকার বহন করছে, সেইসব ক্ষমতাসীন উচ্চবর্ণীয়দের অনুকূল এই প্রাচীন ব্যবস্থাকে পাল্টানোর খায়েশ তাদের হবেই বা কেন ! কিন্তু সমাজের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ হয়েও একটা আরোপিত ব্যবস্থায় কেবল জন্মগত কারণে নিম্নবর্ণীয় বা অস্পৃশ্য হবার অভিশাপে যাদের সমস্ত অর্জন কুক্ষিগত হয়ে চলে যায় অন্যের অধিকারে, তারা এটা মানবেন কেন ? আসলে এরা কখনোই মানেনি তা। ক্ষমতাহীন এই না-মানার প্রতিবাদ-বিদ্রোহকে তাই দমন করা হয়েছে বড় নিষ্ঠুরভাবে, নির্দয় প্রক্রিয়ায়। প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস সে সাক্ষ্যই দেয় আমাদেরকে।

বৈদিক আধিপত্য
ইতিহাসের সাক্ষ্য থেকে জানতে পারি, মুঘলদেরও বহুকাল আগে প্রাচীন আর্যরা এই ভারতবর্ষে শুধু বহিরাগতই ছিলো না, এই আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠি ও তাদের সভ্যতা-সংস্কৃতির উপরও চালিয়েছিলো ব্যাপক আক্রমণ। আর এই আক্রমণেই একদিন ধ্বংস হয়ে যায় এসব আদিনিবাসী জনগোষ্ঠির মাধ্যমে গড়ে ওঠা সমৃদ্ধ সিন্ধু সভ্যতা। এই সিন্ধু সভ্যতাকেই কেউ কেউ হরপ্পা সভ্যতা বা দ্রাবিড়ীয় সভ্যতা হিসেবে উল্লেখ করে থাকেন। আক্রমণকারী আর্যরা আদিনিবাসী জনগোষ্ঠিকে দাসে পরিণত করার লক্ষে যে চতুর্বর্ণ প্রথা প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সংগ্রাম করে, শেষপর্যন্ত এতে সফলও হয় তারা। ফলে এককালের সিন্ধুসভ্যতার আদিনিবাসী জনগণই হয়ে যায় তাদের কাছে অনার্য অর্থাৎ শাসিত অধম। আর্যরা হয়ে ওঠে মহান শাসক। আর তাদের প্রচলিত বৈদিক ধর্ম হয়ে ওঠে সবকিছুর নিয়ন্ত্রক সত্ত্বা। এই বৈদিক ধর্মের উৎস হিসেবে স্বীকৃত হয় স্মৃতি বা বেদ নামের মহাগ্রন্থ। আর এই বেদের নির্যাস নিয়েই আরোপিত এই ধর্মটির প্রচারিত সংবিধান হয়ে ওঠলো মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা। এর মাধ্যমে যে সমাজ-কাঠামোর নির্মাণ যজ্ঞ চলতে থাকলো তার ভিত্তি এক আজব চতুর্বর্ণ প্রথা। যেখানে আদিনিবাসী অনার্যরা হয়ে যায় নিম্নবর্ণের শূদ্র, যারা কেবলই উচ্চতর অন্য তিন বর্ণ ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যের অনুগত সেবাদাস। কোনো সমাজ-সংগঠনে বা কোন সামাজিক অনুষ্ঠান যজ্ঞে অংশগ্রহণের অধিকার শূদ্রদের জন্য নিষিদ্ধ হয়ে যায়। আর যারা এই ব্যবস্থার বাইরে গিয়ে প্রতিবাদী-বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইলো, এদেরকেই সুকৌশলে করা হলো অছ্যুৎ, দস্যু, সমাজচ্যুত বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়। চাতুর্যপূর্ণ চতুর্বর্ণের এই অসম সমাজ ব্যবস্থার কুফল সমাজে গভীরভাবে সংক্রমিত হতে থাকলে এই মাটির সন্তান শাক্যমুণি গৌতম বুদ্ধ (৫৬৩-৪৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। গৌতম বুদ্ধ (Buddha) এ দেশেরই আদিনিবাসী হওয়ায় তাঁর এই সামাজিক বিদ্রোহে আদিনিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠি তাঁকে ব্যাপকভাবে সমর্থন জানায়। ফলে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটতে থাকে দ্রুত। এবং বুদ্ধের নির্বাণলাভ বা মৃত্যুর পর আরো বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে সাম্যবাদী বৌদ্ধধর্ম। গোটা উপমহাদেশ জুড়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বুদ্ধের অহিংসা পরম ধর্মের ডাক।

মৌর্য সাম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট মহামতি অশোকের (৩০৪-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) রাজত্বকালকেই (২৭৩-২৩২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) বৌদ্ধধর্মের সুবর্ণযুগ বলা হয়ে থাকে। গৌরবময় আর্যসম্রাট হয়েও মহামতি অশোক কলিঙ্গের যুদ্ধের (খ্রিস্টপূর্ব ২৬১) ভয়াবহ রক্তপাত, আহত-নিহতের বিপুল সংখ্যাধিক্য ও যুদ্ধের বীভৎসতায় বিচলিত হয়ে যান। যুদ্ধে জয়লাভ করলেও এই যুদ্ধের ক্ষয়-ক্ষতি দেখে তিনি বিষাদগ্রস্থ হয়ে পড়েন। প্রচলিত হিন্দুধর্মের মানবাধিকারহীন অসহিষ্ণুতা আর যুদ্ধের পথ ত্যাগ করে তিনি বেদবিরোধী বৌদ্ধধর্মকেই তাঁর আচরিত ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন এবং অহিংসার পথে সাম্রাজ্য পরিচালনার নীতি গ্রহণ করেন। এরপর অশোক দেশে ও বিদেশে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে উদ্যোগী হয়ে ওঠেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি বিভিন্ন জায়গায় তাঁর প্রতিনিধিদের পাঠান। জানা যায় তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে বৌদ্ধধর্ম প্রচারে শ্রীলংকা পাঠান। এছাড়া তিনি কাশ্মীর, গান্ধার, ভানাভাসী, কোংকন, মহারাষ্ট্র, ব্যকট্রিয়, নেপাল, থাইল্যান্ড, ব্রহ্মদেশ, লাক্ষাদ্বীপ প্রভৃতি স্থানেও বৌদ্ধধর্ম প্রচার করান।

সম্রাট অশোকের মৃত্যুর পর আবারো ব্রাহ্মণ্যবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠে এবং বৌদ্ধধর্ম ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের উপর নেমে আসে দলন-পীড়ন। ব্রাহ্মণ্যবাদের কালো থাবার নিচে প্রকৃতই চাপা পড়ে যায় আদিনিবাসী অনার্য জনগোষ্ঠির উজ্জ্বল আগামী। রাষ্ট্রীয় আনুকূল্যে দীর্ঘকালব্যাপী ব্রাহ্মণ্যবাদের এই অত্যাচার নির্যাতন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের কোমরটাই ভেঙে দেয়। শেষপর্যন্ত যাঁরা বেঁচে গেলো তারাও এ দেশ থেকে বিতারিত হলো।

ইতিহাস গবেষক মনীন্দ্র মোহন বসু এ প্রসঙ্গে লিখেন-

'অবশেষে এই তান্ত্রিক বৌদ্ধমত তিব্বত, নেপাল প্রভৃতি দেশে যাইয়া আশ্রয়লাভ করিয়াছে। বৌদ্ধধর্মের এই পরাজয় এত সম্পূর্ণ হইয়াছিল যে, ধর্মের সঙ্গে ধর্মগ্রন্থসমূহও ভারতবর্ষ হইতে বিতাড়িত হইয়াছে। থেরবাদী সম্প্রদায়ের গ্রন্থগুলো সিংহল ও ব্রহ্মদেশ হইতে আবিষ্কৃত হইয়াছে। আর মহাযান মতের শাস্ত্রসমূহ পাওয়া গিয়াছে প্রধানত চীন, জাপান প্রভৃতি দেশে। চর্যাপদের পুঁথি নেপালে আবিষ্কার হইয়াছিল। আর ইহার অনুবাদের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে তিব্বতী ভাষায়। এখন ভারতবর্ষে বৌদ্ধধর্মের সমাধির স্মৃতিচিহ্ন মাত্রই দৃষ্ট হইয়া থাকে।'

উল্লেখ্য হীনযান বা থেরবাদী মত ও মহাযান বা তান্ত্রিক বৌদ্ধমত বৌদ্ধধর্মেরই দুটি শাখা।

অধ্যাপক হরলাল রায় চর্যাগীতি গ্রন্থে লিখেন-

'ধর্ম কোলাহলেই বাংলা সাহিত্যের পুষ্টি ও বিকাশ। ভারতেই আমরা দেখতে পাই, ব্রাহ্মণ্যধর্মের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পালি সাহিত্যের সৃষ্টি। হিন্দুধর্মের সঙ্গে সংঘর্ষের কারণেই বৌদ্ধধর্ম ভারত হতে বিতাড়িত হয়েছিল। … বৌদ্ধধর্ম তার জন্মভূমি ভারতে প্রায় বিলুপ্ত হয়েছিল। যারা সংস্কৃতকে আত্মস্থ করে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে যে অন্য ভাষা সহ্য করা অসম্ভব ছিল, তা মনে করা যুক্তিযুক্ত। সর্বগ্রাসী হিন্দুধর্ম শক্তিশালী অনার্য সভ্যতাকে কুক্ষিগত করে। এ সময়ে বৌদ্ধ সমাজের বুদ্ধিজীবীরা রিক্ত সর্বস্বান্ত হয়ে ধীরে ধীরে ভারত থেকে তিব্বত ও আসামের দিকে সরে পড়েছেন।'

অর্থাৎ বৈদিক ব্রাহ্মণদের মাধ্যমে সৃষ্ট একটি জাতিভেদমূলক ব্রাহ্মণ্যবাদী চতুর্বর্ণ প্রথার নিগড়ে ভারতের মাটিবর্তি অহিংস বৌদ্ধধর্ম দীর্ঘকাল যাবৎ নিগৃহিত হতে হতে ধ্বংসপ্রায় অবস্থায় পতিত হলো। যদিও চীন ও জাপান সহ অনেকগুলো দেশের কোটি কোটি মানুষ বুদ্ধের অহিংস ধর্ম গ্রহণ করে ততদিনে বৌদ্ধ হয়ে গেলেন, ভারতবর্ষ রয়ে গেলো এক বিদ্বেষপূর্ণ অমানবিক বর্ণবাদী বিষাক্ত দর্শনের নিরাপদ প্রজননভূমি হয়ে।

http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=7121

No comments:

मैं नास्तिक क्यों हूं# Necessity of Atheism#!Genetics Bharat Teertha

হে মোর চিত্ত, Prey for Humanity!

मनुस्मृति नस्ली राजकाज राजनीति में OBC Trump Card और जयभीम कामरेड

Gorkhaland again?আত্মঘাতী বাঙালি আবার বিভাজন বিপর্যয়ের মুখোমুখি!

हिंदुत्व की राजनीति का मुकाबला हिंदुत्व की राजनीति से नहीं किया जा सकता।

In conversation with Palash Biswas

Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Save the Universities!

RSS might replace Gandhi with Ambedkar on currency notes!

जैसे जर्मनी में सिर्फ हिटलर को बोलने की आजादी थी,आज सिर्फ मंकी बातों की आजादी है।

#BEEFGATEঅন্ধকার বৃত্তান্তঃ হত্যার রাজনীতি

अलविदा पत्रकारिता,अब कोई प्रतिक्रिया नहीं! पलाश विश्वास

ভালোবাসার মুখ,প্রতিবাদের মুখ মন্দাক্রান্তার পাশে আছি,যে মেয়েটি আজও লিখতে পারছেঃ আমাক ধর্ষণ করবে?

Palash Biswas on BAMCEF UNIFICATION!

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS ON NEPALI SENTIMENT, GORKHALAND, KUMAON AND GARHWAL ETC.and BAMCEF UNIFICATION! Published on Mar 19, 2013 The Himalayan Voice Cambridge, Massachusetts United States of America

BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE 7

Published on 10 Mar 2013 ALL INDIA BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE HELD AT Dr.B. R. AMBEDKAR BHAVAN,DADAR,MUMBAI ON 2ND AND 3RD MARCH 2013. Mr.PALASH BISWAS (JOURNALIST -KOLKATA) DELIVERING HER SPEECH. http://www.youtube.com/watch?v=oLL-n6MrcoM http://youtu.be/oLL-n6MrcoM

Imminent Massive earthquake in the Himalayas

Palash Biswas on Citizenship Amendment Act

Mr. PALASH BISWAS DELIVERING SPEECH AT BAMCEF PROGRAM AT NAGPUR ON 17 & 18 SEPTEMBER 2003 Sub:- CITIZENSHIP AMENDMENT ACT 2003 http://youtu.be/zGDfsLzxTXo

Tweet Please

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS BLASTS INDIANS THAT CLAIM BUDDHA WAS BORN IN INDIA

THE HIMALAYAN TALK: INDIAN GOVERNMENT FOOD SECURITY PROGRAM RISKIER

http://youtu.be/NrcmNEjaN8c The government of India has announced food security program ahead of elections in 2014. We discussed the issue with Palash Biswas in Kolkata today. http://youtu.be/NrcmNEjaN8c Ahead of Elections, India's Cabinet Approves Food Security Program ______________________________________________________ By JIM YARDLEY http://india.blogs.nytimes.com/2013/07/04/indias-cabinet-passes-food-security-law/

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS TALKS AGAINST CASTEIST HEGEMONY IN SOUTH ASIA

THE HIMALAYAN VOICE: PALASH BISWAS DISCUSSES RAM MANDIR

Published on 10 Apr 2013 Palash Biswas spoke to us from Kolkota and shared his views on Visho Hindu Parashid's programme from tomorrow ( April 11, 2013) to build Ram Mandir in disputed Ayodhya. http://www.youtube.com/watch?v=77cZuBunAGk

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS LASHES OUT KATHMANDU INT'L 'MULVASI' CONFERENCE

अहिले भर्खर कोलकता भारतमा हामीले पलाश विश्वाससंग काठमाडौँमा आज भै रहेको अन्तर्राष्ट्रिय मूलवासी सम्मेलनको बारेमा कुराकानी गर्यौ । उहाले भन्नु भयो सो सम्मेलन 'नेपालको आदिवासी जनजातिहरुको आन्दोलनलाई कम्जोर बनाउने षडयन्त्र हो।' http://youtu.be/j8GXlmSBbbk

THE HIMALAYAN DISASTER: TRANSNATIONAL DISASTER MANAGEMENT MECHANISM A MUST

We talked with Palash Biswas, an editor for Indian Express in Kolkata today also. He urged that there must a transnational disaster management mechanism to avert such scale disaster in the Himalayas. http://youtu.be/7IzWUpRECJM

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICAL OF BAMCEF LEADERSHIP

[Palash Biswas, one of the BAMCEF leaders and editors for Indian Express spoke to us from Kolkata today and criticized BAMCEF leadership in New Delhi, which according to him, is messing up with Nepalese indigenous peoples also. He also flayed MP Jay Narayan Prasad Nishad, who recently offered a Puja in his New Delhi home for Narendra Modi's victory in 2014.]

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICIZES GOVT FOR WORLD`S BIGGEST BLACK OUT

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICIZES GOVT FOR WORLD`S BIGGEST BLACK OUT

THE HIMALAYAN TALK: PALSH BISWAS FLAYS SOUTH ASIAN GOVERNM

Palash Biswas, lashed out those 1% people in the government in New Delhi for failure of delivery and creating hosts of problems everywhere in South Asia. http://youtu.be/lD2_V7CB2Is

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS LASHES OUT KATHMANDU INT'L 'MULVASI' CONFERENCE

अहिले भर्खर कोलकता भारतमा हामीले पलाश विश्वाससंग काठमाडौँमा आज भै रहेको अन्तर्राष्ट्रिय मूलवासी सम्मेलनको बारेमा कुराकानी गर्यौ । उहाले भन्नु भयो सो सम्मेलन 'नेपालको आदिवासी जनजातिहरुको आन्दोलनलाई कम्जोर बनाउने षडयन्त्र हो।' http://youtu.be/j8GXlmSBbbk