Welcome

Website counter
website hit counter
website hit counters

Monday, December 10, 2012

ভারতীয় বাজনীতি দুগ্ধপোষ্য নিস্পাপ শিশু, করপোরেট লবি সম্পর্কে কিছুই জানে না।ওয়ালমার্টের করপোরেট লবি মাহাত্ম থেকে প্রতিবেশি বাংলাদেশও বন্চিত নয় কিন্তু। পলাশ বিশ্বাস http://basantipurtimes.blogspot.in/

ভারতীয় বাজনীতি দুগ্ধপোষ্য নিস্পাপ শিশু, করপোরেট 

লবি সম্পর্কে কিছুই জানে না


ওয়ালমার্টের করপোরেট লবি মাহাত্ম থেকে প্রতিবেশি বাংলাদেশও বন্চিত নয় কিন্তু

পলাশ বিশ্বাস


খোলা বাজার অর্থব্যবস্থায় বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাজার দখলের, করপোরেট লবি হল সম্পর্কিত সরকারগুলোকে প্রভাবিত করার সেরা হাতিয়ার।বৈশ্বায়নের বহু পূর্বে প্রতিরক্ষার নামে করপোরেট লবি ও সরাসরি কমিশন সুত্রি ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলাই ছিল বিধির বিধান।করপোরেট লবি ও প্রতিরক্ষার নামে অন্ধ জাতীযতাবাদ উসকে কালো টাকার খেলা এমন কি নূতন ব্যাপার, যে ওয়ালমার্টের লবি নিয়ে এত হইচই। রিলায়েন্সের চমকপ্রদ উত্থান ও ভারতের সর্বোচ্চ রাজনেতাদের কলন্কিত মুখ এখনও সর্বজনসমক্ষে। নীরা রাডিয়ার লবি টেপও সার্বজনীন

বিশ্ব বাজার ব্যবস্থায় করপোরেট স্বার্থ ঠিক করে যুক্তরাষ্ট্রের সিভিকো-মিলিটারী করপোরেট ত্রিভুজ। ভিতর থেকে যাদের নিয়ন্ত্রণ করে একটি শক্তিশালী ইহুদী লবি। বর্তমানে ৩১ কোটি ৪৭ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে যাদের সংখ্যা মাত্র ৬৫ লাখ (২.১ %)। অথচ ১৯৬৭ সাল থেকে তারাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিয়ামক। সেদেশের ব্যাংক, বীমা, ব্যবসা, মিডিয়া সব তাদের হাতে। আমেরিকার করপোরেট স্বার্থ রক্ষায় সারা বিশ্বের দেশগুলির কর্তৃত্ব বা হেজেমনি একজোট, যা এই উপমহাদেশে ভারতবর্ষের হাল হকীকত দেখলেই মালূম হবার কথাযুক্তরাষ্ট্রের সিভিকো-মিলিটারী করপোরেট ত্রিভুজ এই উপমহাদেশে সমান সক্রিয়, যেমন ভারতে, ঠিক তেমনিই বাংলাদেসে এবং পাকিস্তানেও

ভারতের বাজারে ঢুকতে বিভিন্ন স্তরে প্রভাব খাটানোর জন্য ওয়ালমার্ট বিপুল অঙ্কের টাকা খরচ করেছে। এই তথ্য সামনে রেখে নিরপেক্ষ তদন্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর জবাবের দাবিতে সোমবার ঐক্যবদ্ধ ভাবে বিরোধীরা চেপে ধরল সরকারকে। দফায় দফায় ভণ্ডুল হয় রাজ্যসভার কাজকর্ম। বিজেপি, বাম, তৃণমূল কংগ্রেস, সমাজবাদী পার্টি, জেডিইউ, অগপ, এআইএডিএমকে-- সব দলেরই একবাক্যে দাবি, খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগ কার্যকর করার প্রক্রিয়া এখনই বন্ধ করতে হবে। কেননা, তথাকথিত 'লবিইং' ভারতে ঘুষের সামিল। আমেরিকায় ওয়ালমার্ট জানিয়েছে, গত চার বছরে তারা প্রায় ১২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে ভারতে বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য 'লবি' করতে। যার মধ্যে 'বিনিয়োগের জন্য বাজারে বর্ধিত প্রবেশগম্যতা'র মতো বিষয়টিও রয়েছে। ওয়ালমার্টের দাবি, চলতি বছরেই তারা খরচ করেছে ১৮ কোটি টাকারও কিছু বেশি। 

তাত্পর্য্যপূর্ণভাবে ফের কেন্দ্রের কাজে ক্ষোভ প্রকাশ করলেন রতন টাটা৷ জানালেন, একাধিক দুর্নীতি ও মান্ধাতার আমলের কর-ব্যবস্থা নিয়ে ভারতে বিনিয়োগের যে ছবিটা স্পষ্ট হচ্ছে তাতে তিনি 'মর্মাহত'৷ তাঁর মতে, সরকার যদি এই অবস্থার পরিবর্তন চায় তাহলে প্রমাণ করতে হবে যে এ দেশে আইনি ব্যবস্থার মর্যাদা রয়েছে৷ আর্থিক সংস্কার নিয়ে করপোরেট ইন্ডিযার লবিতে অগ্রগণ্য টাটারা, যদিও ব্যবসা ও লগ্নি স্বার্থে এগিয়ে রিলায়েল্স, কিন্তু বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতায ও সারা বিশ্বে লগ্নিতে টাটাই এগিয়ে৷তাই টাটার এই বক্তব্যও কিন্তু করপোরেট লবির শামিল

 ওয়ালমার্ট ভারতে খুচরো ব্যবসার জন্য লবি করতে চার বছরে ১২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে, এই নিয়ে সংসদে হান্গামার বহর দেখে মনে হয়, ভারতীয় বাজনীতি দুগ্ধপোষ্য নিস্পাপ শিশু, করপোরেট লবি সম্পর্কে কিছুই জানে না।খোলা বাজার অর্থব্যবস্থায় বৈশ্বিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাজার দখলের, করপোরেট লবি হল সম্পর্কিত সরকারগুলোকে প্রভাবিত করার সেরা হাতিয়ার।বৈশ্বায়নের বহু পূর্বে প্রতিরক্ষার নামে করপোরেট লবি ও সরাসরি কমিশন সুত্রি ভারতীয় রাজনীতিতে ক্ষমতা দখলের লড়াই চলাই ছিল বিধির বিধান।করপোরেট লবি ও প্রতিরক্ষার নামে অন্ধ জাতীযতাবাদ উসকে কালো টাকার খেলা এমন কি নূতন ব্যাপার, যে ওয়ালমার্টের লবি নিয়ে এত হইচই। রিলায়েন্সের চমকপ্রদ উত্থান ও ভারতের সর্বোচ্চ রাজনেতাদের কলন্কিত মুখ এখনও সর্বজনসমক্ষে। নীরা রাডিয়ার লবি টেপও সার্বজনীন।আসলে খুচরো ব্যবসায় একচেটিয়া কারবারের রাজনীতি এখন সবচেয়ে বড় ধরনের লগ্নি, যা প্রতিরক্ষাকেও ছাড়িয়ে গিয়েছে। এফডিআই মানেই হল লবি ও কমিশন বাবদ হাসিল বিদেশী ব্যান্কে গচ্ছিত বেপিসাবি কালো টাকা শে.যার বাজার মারফত সাদা করে নেওয়ার খেলা। 

 অর্থনৈতিক মন্দার প্রভাব এখনও কাটেনি আমেরিকা, ইউরোপে৷ তারই মধ্যে এক লক্ষ লোক ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করেছে ১০টি সংস্থা৷ এই লোক ছাঁটাই করা হবে চলতি বছরেই৷এইচপি, গুগল, সিটি গ্রুপের মতো সংস্থাগুলি মূলত খরচ কমানোর জন্যই এই পদক্ষেপ করছে৷ ফলে, যে সমস্ত দেশে কর্মীদের জন্য খরচ বেশি সেখানেই বেশি লোক ছাঁটাই হবে বলে মনে করা হচ্ছে৷

খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ বা এফডিআইকে ঘিরে নতুন করে বিতর্ক তৈরি হল। বিতর্কের কেন্দ্রে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বড় খুচরো ব্যবসা বিষয়ক সংস্থা ওয়াল মার্টের একটি রিপোর্ট। সম্প্রতি ওয়াল মার্ট মার্কিন সেনেটে একটি রিপোর্ট পেশ করেছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ভারতের বিশাল খুচরো ব্যবসার বাজার ধরার লক্ষ্যে, ওয়াল মার্ট ২০০৮ সাল থেকে ভারতে টানা লবি করে গিয়েছে। তার জন্য গত চার বছরে প্রায় ১২৫ কোটি টাকা খরচ করেছে ওই সংস্থা। ওয়ালমার্টের এই রিপোর্টের ভিত্তিতে উত্তাল হয়ে ওঠে আজকের রাজ্যসভা।

ওয়ালমার্ট স্টোরস ইঙ্ক (সংক্ষেপে ওয়ালমার্ট হিসেবে পরিচিত) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটিপাবলিক লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটি পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দোকান পরিচালনা করে। ওয়ালমার্ট বিশ্বের সর্ববৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান। এছাড়া আয়ের দিক থেকেও এ ধরণের প্রতিষ্ঠানের মধ্যে এটি সবচেয়ে বড়। ১৯৬২ সালে স্যাম ওয়ালটন এটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯৭২ সালে তা নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে অন্তর্ভুক্ত হয়। ওয়ালমার্ট সর্ববৃহৎ কর্মসংস্থান প্রদানকারী পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহৎ খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান।

ওয়ালমার্ট মেক্সিকোতে ওয়ালমেক্স হিসেবে পরিচালিত হয়, এছাড়া যুক্তরাজ্যে অ্যাসডা, জাপানেসেইয়ু এবং ভারতে এটি বেস্ট প্রাইস হিসেবে পরিচালিত হয়। আর্জেন্টিনাব্রাজিলকানাডা এবংপুয়ের্তো রিকোতেও এর দোকান রয়েছে। উত্তর আমেরিকার বাহিরে ওয়ালমার্টের বিনিয়োগের ব্যাপারে মিশ্র প্রতিক্রিয়া রয়েছেঃ যুক্তরাজ্যদক্ষিণ আমেরিকা এবং চীনে ওয়ালমার্টের কার্যক্রম ব্যাপকভাবে সফল হয় তবে এটি জার্মানি এবং ব্যর্থতার কারণে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে ব্যবসা কার্যক্রম তুলে নিতে বাধ্য হয়।

বিভিন্ন নারী অধিকার সংস্থা, তৃণমূল পর্যায়ের সংস্থা, শ্রমিক সংস্থা এবং অনেক সাম্প্রদায়িক সংস্থা ব্যাপক পরিমাণে বিদেশি পণ্যের বিক্রয়, অল্প পারিশ্রমিক, শ্রমিকদের স্বাস্থ-বীমায় কম অন্তর্ভুক্তি, লিঙ্গ বৈষম্য, জাতীয় নির্বাচনে শ্রমিকদের নির্দিষ্ট প্রার্থীকে ভোট দেয়ার ব্যাপারে কর্তৃত্ব ইত্যাদি কারণে ওয়ালমার্টের সমালোচনা করেছে।


ওয়ালমার্ট স্টোরস ইঙ্ক
ধরণ পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি
শিল্পখুচরা বিক্রয়
প্রতিষ্ঠাকালআরকানসাসমার্কিন যুক্তরাষ্ট্র(১৯৬২)
প্রতিষ্ঠাতাস্যাম ওয়ালটন
বিলুপ্তিকাল সদর দপ্তর
সদর দপ্তরবেন্টোভিলআরকানসাস,মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র.
36°21′51″N094°12′59″W
অঞ্চলিক পরিসেবাবিশ্বব্যাপী
প্রধান ব্যক্তি মাইক ডিউক
(প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা)
লি স্কট
(চেয়ারম্যান)
পণ্যডিপার্টমেন্টাল স্টোর, সুপারমার্কেট
আয়Green Arrow Up.svg ৪০৪.১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০০৯)[১]
বিক্রয় আয় Green Arrow Up.svg ৩০.০৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (২০০৯)[২]
নীট আয় Green Arrow Up.svg ১৩.৫৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (2009)[২]
মোট সম্পদ Green Arrow Up.svg ১৬৩.৫১৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (2007)[৩]
মোট ইকুইটি Green Arrow Up.svg ৬৪.৬০৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (2007)[৩]
কর্মীসংখ্যাপ্রায়. ২,১০০,০০০ (২০০৮)[২]
ওয়েবসাইট

www.walmartstores.com

www.walmart.com


মার্কিন সেনেটে দাখিল করা ওই তথ্য জানাজানি হতেই তা নিয়ে হইচই শুরু হয়ে যায়। আজ রাজ্যসভায় এই প্রসঙ্গ তুলে প্রাথমিকভাবে বিরোধীতা শুরু করে বিজেপি। প্রবল হট্টগোলে স্থগিত হয়ে যায় রাজ্যসভা। এফডিআই আইন সংসদে পাস হয়ে গেলেও, এই তথ্যকে হাতিয়ার করে, কেন্দ্রকে ফের চাপে ফেলতে চাইছে বিরোধীরা। বিজেপির অভিযোগ, ভারতে এধরনের লবি বেআইনি। তাই ওয়াল-মার্টের অর্থব্যয় পক্ষান্তরে ঘুষ। ওয়াল মার্টের দেওয়া রিপোর্টের প্রেক্ষিতে তদন্ত দাবি করেছে বিজেপি এবং বামেরা। একই সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি দাবি করা হয়েছে।
দিন রাজ্যসভার জিরো আওয়ারে প্রসঙ্গটির উত্থাপন করেন বিজেপি-র সাংসদ রবিশংকর প্রসাদ। তিনি বলেন, ভারতের বাজারে ঢোকার জন্য ওয়ালমার্ট যে টাকা খরচ করছে, সে অভিযোগ আগেই ছিল। এবার প্রমাণিত হল, তা সত্য। বিজেপি সাংসদের তোপ, 'ভারতে এ ভাবে প্রভাব খাটানো বেআইনি। এক ধরনের ঘুষ। যদি ওয়ালমার্ট বলে ভারতে তারা কোটি কোটি টাকা খরচ করেছে, তা হলে আমরা একে ঘুষই বলব। এবার সরকারকে বলতে হবে, ঘুষটা কাকে দেওয়া হয়েছিল। খুচরো ব্যবসায় এফডিআই রূপায়ণে এটা একটা বড় প্রশ্ন।' 

তৃণমূল সাংসদরা সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন রিপোর্ট তুলে ধরে প্রতিবাদে সামিল হন। যোগ দেয় সিপিএম, সিপিআই-ও। সিপিআই নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি তোলে। তাদের দাবি, ফেমা আইন সংশোধনের আগেই ওয়ালমার্ট ভারতে বিনিয়োগ করতে শুরু করেছিল। 

বিরোধের এই আবহেই অবশ্য মজার উপাদানেও ঘাটতি ছিল না। ঘুষের অভিযোগ থেকে দলকে বাঁচাতে গিয়ে বিড়ম্বনা বাড়ান সমাজবাদী পার্টি সাংসদ মোহন সিং। ওয়ালমার্টের তরফে তাঁদের দলের কারও সঙ্গেই যোগাযোগ করা হয়নি। এই দাবির পক্ষে যুক্তি দিতে গিয়ে মোহন সিং বলে ফেলেন, 'ওয়ালমার্ট কোনও ভাবেই সমাজবাদী পার্টির কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে না। আমাদের কোনও নেতা-ই নেই, যিনি ইংরেজি বলতে পারেন।' 

ভারত এবং দেশটির করপোরেট স্বার্থের সঙ্গে জড়িত যুক্তরাষ্ট্রের এমন গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো প্রভাবিত করতে ভারত সরকার এবং দেশটির বিভিন্ন কোম্পানি 'আমেরিকার পাওয়ার করিডোর' হিসেবে পরিচিত লবিংয়ের পেছনে ২০১০ সালে ১ দশমিক ৫ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। অবশ্য মার্কিন আইন প্রণেতাদের সঙ্গে লবিং করতে গিয়ে ভারতের এ ব্যয় ২০১০ সালে এক-তৃতীয়াংশ কমে আসে। এর আগের বছর এ খাতে ব্যয়ের পরিমাণ ছিল প্রায় ২ দশমিক ২ মিলিয়ন ডলার। উল্লেখ্য, সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের লবিং নিয়ে ভারতে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। একটি করপোরেট লবিস্টের সঙ্গে রাজনীতি, ব্যবসা, গণমাধ্যম এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে জড়িত বেশ কয়েক ব্যক্তিত্বের আলোচনার বিষয়টি ফাঁস হয়ে গেলে এ বিতর্কের সৃষ্টি হয়।

এ বিতর্ক লবিং কার্যক্রমের জন্য বিধিবিধান ঠিক করে দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে ভারত সরকারকে আলোচনায় বসতে বাধ্য করেছে। ভারত সরকার এবং দেশটির প্রাইভেট কোম্পানিগুলো মার্কিন সরকার ও আইন প্রণেতাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে অগ্রগতি অর্জনের জন্য বিগত বছরগুলোতে দাপ্তরিকভাবে লবিং চালিয়ে আসছে। 
প্রসঙ্গত, যুক্তরাষ্ট্রে লবিং একটি বৈধ বিষয়। এ জন্য প্রতি তিন মাস পর লবিস্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাদের মক্কেল, লবি সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্টের বিস্তারিত তথ্য এবং ফি সংক্রান্ত বিষয় সংবলিত প্রতিবেদন সিনেটে জমা দিতে হয়। সিনেটে জমা দেয়া প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১০ সালের শেষ তিন মাসে ভারত সরকার এবং দেশটির বিভিন্ন কোম্পানি তাদের ইস্যুগুলো মার্কিন আইন প্রণেতাদের সামনে উপস্থাপনের জন্য লবিস্টদের ৪ লাখ ডলার পরিশোধ করেছে। সব মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে লবিং করতে গিয়ে ২০১০ সালে ভারত সরকার এবং দেশটির বিভিন্ন কোম্পানির ব্যয় দাঁড়ায় ১ দশমিক ৫৭ মিলিয়ন ডলার। ২০০৯ সালে এর পরিমাণ ছিল ২ দশমিক ২ মিলিয়ন। 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, লবিং ব্যয়ের পরিমাণ তুলনামূলক কমে আসা প্রমাণ করে এ খাতে ব্যয় কমিয়ে আনার বিষয়ে সরকার এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১০ সালে শুধু ভারত সরকার বিখ্যাত লবিস্ট 'বারবার গ্রিফিথ অ্যান্ড রজারসকে (বিজিআর) চার লাখ ২০ হাজার ডলার পরিশোধ করে। একই সময় ভারতীয় প্রাইভেট কোম্পানিগুলো প্রায় সাড়ে ১১ লাখ ডলার পরিশোধ করে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্র-ভারত দ্বিপক্ষীয় পরমাণু চুক্তি সংক্রান্ত ইস্যুতে ভারত সরকার ২০০৫ সাল থেকে লবিং করে আসছিল। এ খাতে লবিং ব্যয় ৩ মিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। বিজিআর এই বেসরকারি পরমাণু খাতে লবিং করেছিল।


মায়াবতীকে ভবিষ্যতে বিত্তীয় আইনগুলি পাসকরিয়ে আর্থিক সংস্কারের পথ প্রশস্ত করার লক্ষে তুষ্ট করতে সংসদে আজ আবার পেশ হতে চলেছে সরকারি চাকরিতে তপশিলি জাতি-উপজাতি সংরক্ষণ সংক্রান্ত বিলটি।এই বিল, সামাজিক ন্যায়, সমতা ও সাবার জন্য সমান অবসরের প্রতি কর্তৃত্বের কোনও দায়বদ্ধতা নেই।কর্তৃত্বের দায়বদ্ধতা বর্তায় করপোরেট লবির প্রতি, সংরক্ষনে তেমন করপোরেট লবি থাকার কথাই নয়। করপোরেট জগতে ও পুঁজির দনিয়ায় তফসিলী, ওবিসি, সংখ্যালঘু এমনকি বর্নহিল্দুদের কতিপযজাত ছাড়া সবাই ব্রাত্য রাজ্যসভায় আজ বিলটি পেশ হওয়ার কথা। সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায়, সংসদের উচ্চকক্ষে বিলটি পাস করাতে কেন্দ্রীয় সরকারকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহল। ইতিমধ্যেই বিলটিকে সমর্থনের কথা জানিয়েছে বহুজন সমাজ পার্টি। 

অন্যদিকে, সমাজবাদী পার্টি এই সংরক্ষণের বিরোধিতা করেছে। সমাজবাদী পার্টিকে রাজি করিয়ে বিলটি পাস করানোই এখন সরকারের কাছে বড় চ্যালেঞ্জ। সূত্রের খবর, সংরক্ষণ বিলটি সংসদে পেশ হবে, এই শর্তেই এফডিআই ইস্যুতে রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় সরকারকে সমর্থন করেছিল বহুজন সমাজ পার্টি। অন্যদিকে, সংসদের দুকক্ষেই এফডিআই নিয়ে ভোটাভুটিতে অনুপস্থিত থেকে সমাজবাদী পার্টিও কেন্দ্রের সুবিধা করে দিয়েছিল। তাই কোনওপক্ষকেই না চটিয়ে বিলটি নির্বিঘ্ন পাস করানোই এখন সরকারের কাছে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

 খুচরো ব্যবসায় এফডিআই নিয়ে কেন্দ্রকে সংসদের বৈতরণি পার করতে সাহায্য করার পর এবার সরকারি চাকরিতে তফশিলি জাতি/উপজাতিদের পদোন্নতি নিয়ে চাপ বাড়ালেন মায়াবতী। অবিলম্বে বিলটি পাশ করানো না-হলে 'কঠোর অবস্থান' নেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়ে রেখেছেন তিনি। একই সঙ্গে রাজ্যসভার কাজ থমকে দেওয়ার জন্য বিজেপি-কে এবং বিলটি আটকে দেওয়ার প্রচেষ্টার জন্য সমাজবাদী পার্টিকেও একহাত নিয়েছেন তিনি। 

সোমবার সংসদভবনের বাইরে মায়াবতী সাংবাদিকদের বলেছেন, 'আমরা আরও তিন-চার দিন অপেক্ষা করব। এ বিষয়ে সরকারের অবস্থান দেখব। তারা কী করছে এবং রাজ্যসভার চেয়ারম্যান কী বলছেন, সে দিকে নজর থাকবে। তার পর আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করব, একটি কঠোর অবস্থান নেব।' রাজ্যসভার কাজ স্বাভাবিক করতে সরকারকে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেছেন, 'আমি ইউপিএ-কে বলতে চাই, সংসদ স্বাভাবিক ভাবে চালানো তাদের দায়িত্ব। তাই এবার পুরো দায় সরকারেরই।' 

আলোচনা, বিতর্ক এবং ভোটাভুটির পর ফের এফডিআই ইস্যু তোলায় বিজেপি-কে তোপ দেগে বহুজন সমাজ পার্টি নেত্রী বলেছেন, 'সরকারি চাকরিতে তফশিলি জাতি/উপজাতিদের পদোন্নতি সংক্রান্ত বিলটি সোমবারই আসার কথা ছিল। দুঃখজনক ভাবে বিলটি আটকে দেওয়া হল। বিজেপি এবং কোম্পানি লবিবাজির বিষয়টি তুলে পুরো ব্যাপারটাই গুলিয়ে দিয়েছে।' তাঁর প্রশ্ন, 'ওরা তো লোকসভায় কোনও প্রশ্ন তুলল না! লোকসভায় এফডিআই প্রসঙ্গ তোলা যেত না? এটা প্রমাণ করে, বিজেপি এবং তার সমর্থকরা চায় না, বিলটি পাশ হোক।' 

দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে কোনও কড়া কথা রতন টাটা বলেননি। টাটা সন্সের তরফে গতকাল এই দাবি করা হয়েছে। এর আগে একটি ইংরেজি দৈনিকে রতন টাটার সাক্ষাতকার নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। অভিযোগ, ওই সাক্ষাতকারে দেশের শিল্পক্ষেত্রে বিনিয়োগের পরিবেশ নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন রতন টাটা। ভারতের চেয়ে চিনে ব্যবসা করা সহজ বলে মন্তব্য করেন তিনি। অভিযোগ, সরকারের নিষ্ক্রিয়তার কারণেই ভারতের শিল্পক্ষেত্র চিনের শিল্পক্ষেত্রের চেয়ে পিছিয়ে রয়েছে বলে মন্তব্য করেন রতন টাটা। এর পাশাপাশি, কোনও প্রকল্পে ছাড়পত্র দিতে প্রশাসনের দীর্ঘসূত্রিতা, শুধুমাত্র টাকার বিচারে শিল্পের মূল্যায়ণ এবং সরকারের বিভিন্ন মহলে বিনিয়োগ নিয়ে নানা মুণির নানা মতের অভিযোগ করেন রতন টাটা। 

সাক্ষাত্কারটি প্রকাশিত হওয়ার পর তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। তারপরই বিবৃতি দেয় টাটা সন্স। সংস্থার দাবি, ওই ইংরেজি দৈনিক রং চড়িয়ে রতন টাটার সাক্ষাতকার প্রকাশ করেছে। 

রবিবার মুম্বইয়ে এক সাংবাদিক বৈঠকে টাটা সন্সের বিদায়ী চেয়ারম্যান রতন টাটা বলেন, 'নানান সরকারি কেলেঙ্কারি, জটিল বিচার-প্রক্রিয়া এবং পুরনো কর-ব্যবস্থার কারণে ভারত সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে একটা অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, যা শেষ পর্যন্ত সরকারের গ্রহণযোগ্যতার দিকেই আঙুল তোলে৷' ভারতে বাণিজ্য সংক্রান্ত আইনি গোলযোগের উল্লেখ করে টাটার কটাক্ষ, 'মনে করুন এ দেশে বিনিয়োগ করার জন্য এফআইপিবি অনুমোদন পেলেন৷ কোম্পানি চালাতে প্রয়োজনীয় লাইসেন্সও জোগাড় করলেন৷ কিন্ত্ত তিন বছর পর একই সরকার জানাবে যে আপনার সমস্ত লাইসেন্স অবৈধ৷ তখন আপনি পথে বসবেন৷ ফলে এক ভয়ানক অনিশ্চয়তা তৈরি হচ্ছে, যেখানে যা খুশি হতে পারে৷ এ রকম পরিস্থিতি আগে কখনও আসেনি৷ আমি মর্মাহত৷ ভারতকে প্রমাণ করতে হবে যে এখানে আইনের শাসন চলে এবং সরকারি অনুমোদনের গুরুত্ব রয়েছে৷ নয়তো ভারত নিজেই গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে৷' তাঁর কথায়, 'নতুন আইন হলে তার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করতে হবে৷ কোনও সময়ে আইন পরিবর্তনের প্রয়োজন থাকলে তা যুক্তিসঙ্গত ভাবেই করতে হবে, যাতে পিছিয়ে যাওয়ার বদলে দেশের প্রগতি হয়৷'

বর্তমান পরিস্থিতির সমালোচনা করলেও ভারতের অর্থনৈতিক ভবিষ্যত সম্বন্ধে আশা হারাতে রাজি নন টাটা৷ বললেন, 'এফডিআই নিয়ে যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তাতে বিনিয়োগকারীদের বিশ্বাস কিছুটা হলেও ফিরবে৷' তবে তাঁর মতে, এই পদক্ষেপ 'গুরুত্বপূর্ণ' হলেও 'যথেষ্ট' নয়৷ তিনি বলেন, 'এফডিআই-য়ের ফলে ক্রেতাদের কম দামে বেশি পছন্দের সুযোগ পাওয়া উচিত৷ না হলে এই উদ্যোগকে ব্যর্থ বলেই ধরে নিতে হবে৷' এদিন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং সম্পর্কে টাটা বলেন, 'উনি নব্বইয়ের দশকের আর্থিক সংস্কারের রূপকার, এবং নেতা হিসেবেও দৃঢ় চরিত্রের৷ কিন্ত্ত চারিদিক থেকে আক্রমণ আসলে উনি কাজ করবেন কী ভাবে?'

উল্লেখ্য, শুক্রবার রতন টাটা অভিযোগ করেছিলেন যে সরকারি উদ্যোগহীনতার জন্য বিনিয়োগকারীরা ভারত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন এবং দেশীয় ব্যবসায়ীদেরও অসুবিধার মুখে পড়তে হচ্ছে৷ এ নিয়ে দেশ জুড়ে বিতর্কও তৈরি হয়৷

 ভারতের বাজারে ঢোকার সুযোগ করে দিতে গত চার বছর ধরে মার্কিন সেনেটকে তদবির করে এসেছে ওয়াল মার্ট৷ আর মার্কিন রাজনৈতিক মহলে এই 'লবি' করতে গিয়ে ১২৫ কোটি টাকা খরচও করেছে ওই সংস্থা৷ ওয়াল মার্টের তরফে প্রকাশিত এক রিপোর্টে রবিবার এ কথা জানা গিয়েছে৷

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী 'লবি' খাতে খরচ হওয়া অর্থের খতিয়ান দিতে গিয়ে একথা জানিয়েছে বিশ্বের সর্ববৃহত্‍ খুচরো ব্যবসায়ী সংস্থা ওয়াল মার্ট৷ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৩০ সেপ্টেম্বর শেষ হওয়া ত্রৈমাসিকেই মার্কিন সেনেটে ১০ কোটি টাকা দিয়েছে সংস্থাটি৷ প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ ইস্যুতে ভারতের অবস্থানকে প্রভাবিত করার জন্য পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষে ওই টাকা পাঠিয়েছে ওয়ালমার্ট৷ সেপ্টেম্বর ত্রৈমাসিকের রিপোর্ট বলছে, ভারতে ওয়ালমার্টের ব্যবসার পথ সুগম করতে মার্কিন সেনেট, মার্কিন হাউজ অফ রিপ্রেজেন্টেটিভস, মার্কিন ট্রেড রিপ্রেজেন্টেটিভ ও মার্কিন বিদেশ দফতরকে পয়সা দিয়েছে সংস্থাটি৷ উল্লেখ্য, ১৪ সেপ্টেম্বর ভারতে বহুব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের অনুমোদন দিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার৷

ওয়ালমার্টের এই রিপোর্ট নিয়ে সোমবার থেকে শুরু হওয়া সন্তাহে সংসদে জোর রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হবে বলে এখানকার রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন৷ গত সন্তাহেই সংসদের দুই কক্ষে বহুব্র্যান্ড খুচরো ব্যবসায় বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি ভোটাভুটির মাধ্যমে অনুমোদিত হয়৷ এর পর (ভারতীয় সময়) রবিবার ওয়ালমার্টের রির্পোট প্রকাশিত হয়৷

কোনও সংস্থা তাদের নিজেদের কাজ হাসিল করতে একটি গ্রুপ ঠিক করে৷ যারা জনসংযোগ আধিকারিকদের মতো সেই সংস্থা লাভের জন্য রাজনৈতিক, কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক মহলে প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে৷ এরই নাম 'লবি' করা৷

মার্কিন মুলুকে 'লবি' আইনসিদ্ধ৷ যদিও ভারতে এই প্রবণতা আইন স্বীকৃত নয়৷ লবিস্টদের কাজ হল, পরিস্থিতিকে প্রভাবিত করে তা নিজেদের অনূকূলে আনা৷ এফডিআইয়ের অনুমোদন দিতে মার্কিন সরকার যাতে ভরত সরকারকে প্রভাবিত করে তাই মার্কিন সেনেটর ও রিপ্রেজেন্টেটিভদের কাজে লাগিয়েছিল ওয়ালমার্ট৷ দেখা গিয়েছে, শুধু ২০১২ সালেই ভারত সংক্রান্ত বিভিন্ন ইস্যুতে লবি করার জন্য মার্কিন সরকারকে এখনও পর্যন্ত ১৮ কোটি টাকা দিয়েছে ওয়ালমার্ট৷ এই লবি করার জন্য টাকার লেনদেন চলেছে ২০০৮ সাল থেকে৷ যদিও মাঝে ২০০৯ সালে কিছু মাসের জন্য তা বন্ধ ছিল৷

গত বছর নভেম্বরে একক ও বহুব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় সংস্কারের প্রস্তাব দিয়েছিল সরকার৷ কিন্ত্ত, বিরোধীদের প্রবল প্রতিবাদে ডিসেম্বরে সেই সিদ্ধান্ত স্থগিত রাখে সরকার৷ ঐকমত্য না হওয়ায় সংস্কার বাক্সবন্দিই ছিল৷ ২০১১-র আগে খুচরো ব্যবসায় বিদেশি পুঁজি প্রবেশ করানোর বিরোধিতা করেছে এসেছিল খোদ সরকারই৷ এ বছর ১৪ সেপ্টেম্বর বহুব্র্যান্ডের খুচরো ব্যবসায় প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের প্রস্তাবে সিলমোহর দেয় ইউপিএ সরকার৷ যার জেরে সরকার ছেড়ে বেরিয়ে যায় অন্যতম শরিক দল তৃণমূল কংগ্রেস৷

এক বছরের মধ্যে সংস্কার নিয়ে সরকারের এই তড়িঘড়ির পেছনে অনেকেই মার্কিন সরকারের প্রভাবের ইঙ্গিত খুঁজছেন৷ দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তর বাজার ভারত৷ বিভিন্ন সংস্থার হিসাব অনুযায়ী ভারতে খুচরো ব্যবসার পরিমাণ ৪৫ লক্ষ কোটি টাকা৷ এই বাজারে ওয়ালমার্টের প্রবেশ কি মার্কিন অথর্নীতির উদ্ধারে কোনও ভূমিকা গ্রহণ করবে না? বিশেষজ্ঞদের মত, অবশ্যই করবে৷ ২০১০ সাল নাগাদ ভারতে খুচরো ব্যবসার বাজার ৫৪ লক্ষ কোটি হবে বলে অনুমান৷ যে কারণে ভারতের আর্থিক সংস্কার সম্পর্কে এত চিন্তিত ওবামা প্রশাসন৷

এ প্রসঙ্গে অবশ্য মার্কিন বিদেশনীতি 'বানানা রিপাবলিক' তত্ত্বের কথা তুলে ধরতেই হয়৷ চিলি, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস, এল সালভাদর, নিকারাগুয়া, দমিনিকান রিপাবলিকের মতো দক্ষিণ আমেরিকান রাষ্ট্রগুলিতে খুব ভালো ফলের চাষ হয়৷ বিশেষ করে কলা৷ ১৯৫০-৬০ এর দশকে আন্তর্জাতিক কলা বাজারে মার্কিন সংস্থা ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির একচেটিয়া ব্যবসা ছিল৷ দক্ষিণ আমেরিকার এসব দেশে কলার খেত নিয়ন্ত্রণ করতে ইউনাইটেজ ফ্রুট কোম্পানি৷ কিন্ত্ত সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপ্রধানরা আমেরিকার এই আধিপত্য মেনে নিতে পারেননি৷ ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির সঙ্গে লেনদেন বন্ধের সিদ্ধান্ত নেয় চিলি সরকার৷ চিলির প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সালভাদর আলেন্দে এই সিদ্ধান্তের ফলে মার্কিন রোষে পড়েন৷ ইতিহাস বলে আমেরিকা সিআইএ চর লাগিয়ে আলেন্দেকে ক্ষমতাচ্যূত করেন৷ এই কাজে লাগানো হয় চিলির তত্কালীন সামরিক প্রধান অগস্টো পিনোশেকে৷ আলেন্দের মৃত্যূদণ্ড হয়৷ দেশে একনায়কতন্ত্র চালান পিনোশে৷

১৯৫৮-এ তত্‍কালীন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট নিক্সন লাতিন আমেরিকা সফরে বেরোন৷ ঘুরে এসে লাতিন আমেরিকা অনুন্নত দেশগুলি আর্থিক উন্নতিতে সাহায্য করার কথা বলেন নিক্সন৷ ফন্দি ছিল এই ফাঁকে লাতিন আমেকিার কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিকে মার্কিন সংস্থাজের হাতের মুঠোয় এনে দেওয়া৷ ১৯৬১-এ লাতিন আমেরিকার জন্য 'অ্যালায়েন্স ফর প্রগ্রেস' নীতি প্রণয়ন করেন প্রেসিডেন্ট কেনেডি৷ যার মূল লক্ষ্য ছিল পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে মার্কিন বিরোধী মনোভাবকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলা৷ যার জেরে আলেন্দে ক্ষমতাচ্যূত হয়েছিলেন৷ একই হাল হয়েছিল বাকি দেশগুলির সমাজতান্ত্রিক নেতাদের৷ এসব দেশে মার্কিন সরকার তাদের পছন্দের লোক বসিয়েছিল৷ যাতে মার্কিন অর্থনীতি স্বার্থে এতটুকু ঘা না লাগে৷

ব্যাপক হারে কর্মী ছাঁটাই করা কথা ঘোষণা করেছে এএমআর কর্পোরেশন, পেপসিকো, মেটলাইফ, হস্টেস ব্র্যান্ডস, জেসি পেনে কোম্পানি, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল ও মরগ্যান অ্যান্ড স্ট্যানলি৷ এই সব বহুজাতিক সংস্থাগুলি সারা বিশ্বে ৯৫,৫০০ জন কর্মীকে ছাঁটাই করার কথা জানিয়েছে৷

এ বছরের গোড়ায় জেপি পেনি তাদের সংস্থা 'পুনর্গঠন' করার কথা বলে ৪,৭০০ জন কর্মী কমানোর কথা ঘোষণা করেছিল৷ আমেরিকার টেক্সাসে তাদের গৃহঋণের ইউনিট বন্ধ করে দেয় মেটলাইফ৷ একই সঙ্গে তারা ৪,৩০০ কর্মী ছাঁটাই করার কথাও ঘোষণা করে৷

স্পেন, পোর্তুগাল ইতালি আর গ্রিসের মতো ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলিতে বেকারত্বের হার দিন দিন বাড়ছে৷ পরিসংখ্যান অনুযায়ী ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের সাতাশটি দেশে এ বছর অগস্টে বেকারত্বের হার ছিল ১০.৫ শতাংশ৷ গত বছরে ওই হার ছিল ৯.৭ শতাংশ৷ তুলনায়, মার্কিন মুলুকের অবস্থা অনেকটা ভালো৷ সে দেশে গত বছর অগস্টে বেকারের হার ছিল ৯.১ শতাংশ, এ বছর ৮.১ শতাংশ৷ আমেরিকা ইউরোপিয় দেশগুলির সবচেয়ে বড় বাজার আমেরিকা৷ এখন আমেরিকাতেই যদি 'ব্যয় সঙ্কোচ' করে কর্মী ছাঁটাই হয় তাহলে তাদের কী হবে? চিন্তায় ইউরোপীয় ইউনিয়ন৷

এ বছর যে সব সংস্থা কর্মী সঙ্কোচের কথা ঘোষণা করেছে সেই তালিকায় শীর্ষে রয়েছে টেকনোলজি সংস্থা হিউলেট-প্যাকার্ড (এইচপি)৷ ৩৫০ কোটি টাকা ব্যয় সঙ্কোচের জন্য মে মাসেই তারা ২৭ হাজার কর্মী সঙ্কোচের কথা ঘোষণা করে৷

এর পরেই রয়েছে হস্টেস ব্র্যান্ডস৷ তাদের অধীনস্থ সংস্থা ওয়ান্ডার ব্রেড ও টুইঙ্কি দেউলিয়া হয়ে যাওয়ায় ব্র্যান্ড ও অ্যাসেট দুই-ই বিক্রি করতে হচ্ছে৷ গত মাসেই তারা জানিয়ে দিয়েছে যে এর ফলে ১৮,৫০০ কর্মীকে ছাঁটাই করা হবে৷

আমেরিকান এয়ারলাইনসের সংস্থা এএমআর কর্পোরেশন ফেব্রুয়ারি মাসে ঘোষণা করেছিল যে, তারা চোদ্দো হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করবে৷

বিজ্ঞাপন বাবদ আগের চেয়ে খরচ অনেক বেড়েছে, কাঁচামালের দামও বেড়েছে৷ পেপসিকো জানিয়েছে ১৫০ কোটি টাকা বাঁচাতে ২০১৪ সালের মধ্যে বিশ্বজুড়ে তারা তিন শতাংশ কর্মী সংকোচন করবে, যার অর্থ সংস্থার কর্মীর সংখ্যা ৮৭০০ জন কমে যাওয়া৷

দশ হাজার কোটি টাকা বাঁচাতে প্রথম ধাপে ২০১৩ সালে ৪১০০ জন কর্মী ছাঁটাই করার কথা ঘোষণা করেছে প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল (পি অ্যান্ড জি)৷ প্রক্রিয়া চলবে চার বছর ধরে৷

এ মাসে সবচেয়ে বড় ধাক্কা দিয়েছে সিটি গ্রুপ৷ ১০০ কোটি টাকা ব্যয় সঙ্কোচের জন্য ১১ হাজার কর্মী ছাঁটাইয়ের কথা ঘোষণা করেছে তারা৷
বছরের গোড়ায় মোটরোলা সংস্থা কিনে নিয়েছিল ইন্টারনেট সংস্থা গুগল, অগস্টে তারা ঘোষণা করে মোটরোলার ২০ হাজার কর্মীর মধ্যে চার হাজার জনকে ছাঁটাই করা হবে৷ একটি নিয়ামক সংস্থা জানিয়েছে এই সংস্থার দুই-তৃতীয়াংশই ছাঁটাই করা হবে আমেকিার বাইরে অন্য দেশে৷
মরগ্যান স্ট্যানলি ঘোষণা করেছে, ২০১১ সালের পর এ বছর তারা সন্তম বারের জন্য কর্মী ছাঁটাই করছে৷

বেকারের সংখ্যা এই মুহূর্তে ভয়াবহ আকার নিয়েছে গ্রিসে৷ গ্রিসের প্রধানমন্ত্রী অ্যান্টনিস সামারাস জানিয়েছেন, তাঁর দেশে বেকারের সংখ্যা রেকর্ড ২৬ শতাংশ হয়েছে, অর্থাত্ সে দেশে কর্মহীনের সংখ্যা ১২ লক্ষ ৯৫ হাজার৷

অগস্ট মাসের ২৫.৩ শতাংশ থেকে বেড়ে সেপ্টেম্বর মাসে বেকারত্বের হার ছিল ৩৮ শতাংশ৷ এখন অবশ্য তা ২৬ শতাংশে দাঁড়িয়েছে৷ তার পরেই রয়েছে স্পেন, বেকারত্ব ২২ থেকে বেড়ে হয়েছে ২৫.৮ শতাংশ৷ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের পরিসংখ্যান নির্ণয়কারী প্রতিষ্ঠান এলস্ট্যাট এ কথা জানিয়েছে৷ তাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, অক্টোবরে স্পেনে বেকারত্বের সংখ্যা ছিল ২৬.২ শতাংশ৷

ইউরো জোনে সবচেয়ে ভাল অবস্থা অস্ট্রিয়ার, সেখানে বেকারের হার ৪.৩ শতাংশ৷ ইংল্যান্ডে এই হার ৭.৯ শতাংশ৷

ওয়ালমার্টের করপোরেট লবি মাহাত্ম থেকে প্রতিবেশি বাংলাদেশও বন্চিত নয় কিন্তু
  বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকের ধাপ্পাবাজি বন্ধ এবং শ্রমের ন্যায্য মজুরি প্রদানে আন্তরিক অর্থে সহায়তার অঙ্গিকার না করলে নিউইয়র্কে ওয়ালমার্টের পণ্য বর্জনের হুমকি দেয়া হলো।একইসাথে শ্রমিকদের ঠকানোর তথ্য বিশ্ববাসীকে অবহিত করতে 'আন্তর্জাতিক শ্রমিক ঐক্য'র ডাক দেয়া হলো।৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্ক সিটির জ্যাকসন হাইটসে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-সমাবেশ থেকে আরো বলা হয় যে, ১১ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে ওয়ালমার্টের সামনে আবারো বিক্ষোভ করা হবে। বহুজাতিক এ সমাবেশে নিউইয়র্ক সিটি কাউন্সিলের কর্মকর্তাসহ শ্রমিক ইউনিয়ন, কম্যুনিটি এবং মানবাধিকার সংগঠনের নেতৃবৃন্দ বক্তব্য রাখেন।তাজরিন ফ্যাশনে সাম্প্রতিক অগ্নিকান্ডে নিহতদের আত্মার শান্তি এবং তাদের পরিবারের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপনের মাধ্যমে শুরু এ সমাবেশের বক্তারা ওয়ালমার্ট, ডিজনী, সিয়ার্সসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের আচরণের কঠোর সমালোচনা করে বলেন, 'এরা প্রতি বছরই বিলিয়ন ডলারের বিত্ত-বৈভব গড়ছে শ্রমিকদের জিম্মি করে। একেকটি শার্টের মূল্য নেয়া হচ্ছে ৫৫ ডলারের বেশী, অথচ ঐ শার্ট প্রস্তুতকারীর সর্বোচ্চ মজুরি হচ্ছে ঘন্টায় মাত্র ৫৫ সেন্ট এবং সারামাসে ৩৭ ডলার।'বক্তারা বাংলাদেশের এক্সপোর্ট প্রমোশন ব্যুরো (ইপিজেড)'র সমালোচনা করে বলেন, এ সংস্থার আওতায় পরিচালিত কল-কারখানার শ্রমিকের ইউনিয়নভুক্ত হবার অধিকার নেই। এভাবেই শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার হরণ করা হচ্ছে-যার সুযোগ নিচ্ছে বিশ্বের বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো।তাজরিন ফ্যাশনের আগুন নিয়ে সর্বশেষ ৫ ডিসেম্বর ওয়াল স্ট্রীট জার্নাল এবং নিউইয়র্ক টাইমসে অনুসন্ধানী সংবাদ প্রকাশের ২৪ ঘন্টার মধ্যে এ সমাবেশ হলো বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকের সাথে বিশ্ববিখ্যাত পোষাক ব্যবসায়ীদের প্রতারণামূলক আচরণের নিন্দা জানিয়ে।
আমেরিকায় দক্ষিণ এশিয়ানদের অধিকার ও মর্যাদা নিয়ে কর্মরত 'দেশীজ রাইজিং আপ এন্ড মুভিং' (ড্রাম) এর ডাকে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে অংশ নেয় রিটেইল এ্যাকশন প্রজেক্ট, এলাইন, ভ্যামোজ ইউনডোজ, কম্যুনিটি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট এ্যাট দ্য আরবান জাস্টিস সেন্টার, ন্যাশনাল ল'ইয়্যার গিল্ড ইন্টারন্যাশনাল কমিটি, সেন্টার ফর কন্সটিটিউশনাল রাইটস, সাউথ এশিয়া সলিডারিটি ইনিসিয়েটিভ, সিএসইএ লোকাল ১০০০, এএফ৩আইআরএম, নিউইয়র্ক সিটি চ্যাপ্টার ভ্যাটার্ন অব পীস, যুদ্ধ বিরোধী আন্তর্জাতিক সংগঠন 'ইন্টারন্যাশনাল এ্যাকশন সেন্টার', সাউথ এশিয়ান-আমেরিকান লিডিং টুগেদার, ইউনাইটেড ন্যাশন্স এন্টি ওয়্যার কোয়ালিশন, নিউইয়র্ক সিটি লেবার  এগেইনস্ট ওয়্যার, ডামাইয়ান, উগানিয়ান, আরব-আমেরিকান এ্যাকশন নেটওয়ার্ক, আল-আওদা এনওয়াই, সেবা-নিউইয়র্ক, পাম্পহাউজ প্রজেক্ট, সালগা-এনওয়াইসি, সিএএএভি, অর্গানাইজিং এশিয়ান কম্যুনিটি, লেবার ফর প্যালেস্টান, আরব-আমেরিকান এসোসিয়েশন অব নিউইয়র্ক, মজরিষ আস-সুরাহ, ত্রিনিটি লুথারেন চার্চ, ছায়া সিডিসি, অধিকার, রিটেইল, হোলসেল এন্ড ডিপার্টমেন্ট স্টোর ইউনিয়নের সদস্য-কর্মকর্তা এবং সমর্থকগণ।বাংলা, ইংরেজী, আরবী, হিন্দি, স্প্যানিশ প্রভৃতি ভাষার শ্লোগান ছিল 'শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি চাই', সলিডারিটি উইথ গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স', 'উই ডিমান্ডিং ওয়ার্কার্স জাস্টিস', 'ওয়ার্কার্স জাস্টিস ফর অ্যল', 'দুনিয়ার মজদুর এক হও', শ্রমের অধিকার দিতে হবে' 'শ্রমের অধিকার হলো মানবাধিকার' ইত্যাদি।বাংলাদেশের গার্মেন্টস শ্রমিকদের ন্যায্য অধিকারের প্রশ্নে আমেরিকার শীর্ষস্থানীয় দৈনিক এবং প্রধান প্রধান টিভিগুলোও প্রায় দিনই সংবাদ প্রচার ও প্রকাশ করছে। সে সবে নয়ামাত্রা যোগ করলো শ্রমিক-অধিকার নিয়ে কর্মরত সংগঠনগুলোর এ বিক্ষোভ সমাবেশ।

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানাগুলোয় বৈদ্যুতিক ও অগ্নিনিরাপত্তা বাড়ানোর একটি উদ্যোগে বাদ সেধেছিল ওয়ালমার্ট। বিশ্বের বৃহত্তম খুচরা বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানটি নিরাপত্তার জন্য কারখানাগুলোকে সহায়তা করতে বাড়তি অর্থ দেওয়ার ক্ষেত্রে এই বাধা তৈরি করে।

নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায়  প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, তাজরীন ফ্যাশনসের কারখানা থেকে পাওয়া নথিপত্রে এ বিষয়টি উঠে এসেছে। গত ২৪ নভেম্বর রাতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে তুবা গ্রুপের তাজরীন ফ্যাশনস ভবনে অগ্নিকাণ্ডে অন্তত ১১১ জন শ্রমিকের প্রাণহানি ঘটে। 

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকায় অনুষ্ঠিত একটি বৈঠকের কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বাংলাদেশি পোশাকের বিদেশি ক্রেতাদের কাছ থেকে কারখানার বৈদ্যুতিক ও অগ্নিনিরাপত্তার জন্য বাড়তি অর্থ আদায়ের প্রস্তাবে ওয়ালমার্টের প্রতিনিধি আপত্তি জানিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক কারখানার নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে ওই বৈঠকে অংশ নেওয়া দুই কর্মকর্তা নিউইয়র্ক টাইমসকে জানিয়েছেন, কারখানার বিদ্যুৎ ও অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি কমাতে 'গ্লোবাল রিটেইলারদের' কাছ থেকে বাড়তি অর্থ আদায়ের একটি উদ্যোগ থামাতে মূল ভূমিকা রাখেন ওয়ালমার্টের প্রতিনিধি।
আমস্টারডামভিত্তিক ক্লিন ক্লথস ক্যাম্পেইনের আন্তর্জাতিক সমন্বয়কারী ইনেকে জেলডেনরাস্টকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, বৈঠকে ওয়ালমার্ট ওই উদ্যোগের সবচেয়ে বেশি বিরোধিতা করে।

বৈঠকটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের খুচরা বিক্রেতা, বাংলাদেশের কারখানামালিক, সরকারি কর্মকর্তা ও এনজিও প্রতিনিধিরা অংশ নেন।

নিউইয়র্ক টাইমস বলছে, বৈঠকের কার্যবিবরণীতে আছে যে ওয়ালমার্টের এথিকাল সোর্সিং পরিচালক শ্রীদেবী কালাভাকোলানুসহ আরও কয়েকজন বৈঠকে বলেন, বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার পোশাক কারখানার বৈদ্যুতিক ব্যবস্থা ও অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটানো বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই 'বিশাল ও ব্যয়বহুল' হবে। আর এই বিনিয়োগ করা ব্র্যান্ডগুলোর জন্য আর্থিকভাবে বাস্তবসম্মত হবে না।

এ ব্যাপারে ওয়ালমার্টের মুখপাত্র কেভিন গার্ডনার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেন, বাংলাদেশে ওই ওয়ালমার্ট কর্মকর্তার এ মন্তব্য 'অপ্রাসঙ্গিক'।

ওয়ালমার্ট বাংলাদেশ সরকার, কারখানা ও সরবরাহকারীদের সঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে বলেও দাবি করেন ওই মুখপাত্র।

পত্রিকাটি আরও লিখেছে, ওয়ালমার্টকে পোশাক সরবরাহকারী তিনটি মার্কিন কোম্পানি তাজরীন ফ্যাশনসকে দিয়ে কাজ করাচ্ছিল।

বাংলাদেশের কয়েকটি শ্রমিক সংগঠনের মাধ্যমে পত্রিকাটির হাতে প্রতিষ্ঠানটির যে নথিপত্র এসেছে, তাতে দেখা যায়, ওই কারখানা থেকে প্রায়ই ওয়ালমার্টের জন্য পোশাক বানিয়ে নিতেন সরবরাহকারীরা।
গত সেপ্টেম্বরের একটি উৎপাদন প্রতিবেদন অনুযায়ী, কারখানার ১৪টি উৎপাদন পর্যায়ের মধ্যে পাঁচটি নিয়োজিত ছিল ওয়ালমার্টের পোশাক প্রস্তুতের কাজে।

নথিপত্রের সঙ্গে যুক্ত ছবিতে দেখা যায়, ওয়ালমার্টের জন্য তাজরীন ফ্যাশনস থেকে শার্ট, শর্টস আর ট্রাউজার তৈরি করত মার্কিন প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ডিরেক্ট গ্রুপ, সাকসেস অ্যাপারেলস ও টপসন ডাউনস।

এই উত্থানের পিছনে কি আছে? এত টাকা আসে কোথা থেকে? তার আগে আসুন সাধারন ব্যবহারকারী হিসেবে একটা খুচরো জিনিসপত্রের দোকান থেকে আপনার প্রত্যাশা কি কি সেটা নথিবদ্ধ করা যাক:

1। জিনিসপত্রের দাম সস্তা হতে হবে। নিশ্চিন্তে নির্ভর করা যাবে যে দাম যেটা পাব সেটা বাজারের সবচেয়ে কম দাম। এ দোকান ও দোকান ঘুরে যাচাই করবার প্রয়োজন পড়বে না।

2। সব জিনিস এক জায়গায় পাওয়া যাবে। একেকটা জিনিসের জন্য একেক জায়গায় যাওয়া লাগবে না।

3। হাতের কাছে থাকতে হবে। একটা জিনিস কিনতে শত শত মাইল পাড়ি দেবার মানে হয় না।

4। চবি্বশ ঘন্টা দোকান খোলা থাকতে হবে। যখন সুবিধা তখন গিয়ে শপিং করতে চাই।

5। কাস্টোমার সার্ভিস ভাল থাকতে হবে। জিনিস পত্র নষ্ট হলে ফিরত দিতে হবে।

6। জিনিস পত্র ভাল দিতে হবে। সস্তা জিনিসের পাশাপাশি দামী অপশনও রাখতে হবে।

ওয়ালমার্ট এই সবগুলো অপশন কাঁটায় কাঁটায় মিলিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। চীন, ইন্ডিয়া, তাইওয়ান এসব জায়গা থেকে সস্তায় প্রোডাক্ট বানিয়ে নিয়ে এসে নিশ্চিত করছে সবচেয়ে সস্তা দামের ব্যাপারটা। দুনিয়ার হেন প্রোডক্ট নেই যেটা ওয়ালমার্টে পাওয়া যায়না। আমেরিকার প্রায় প্রতি 50-100 মাইলে একটা করে ওয়ালমার্ট পাওয়া যাবে। সুতরাং চাইলেও চলে যাওয়া যায় ওয়ালমার্টে। চবি্বশ ঘন্টা খোলা থাকে তাই যাওয়া যায় যখন তখন। সার্ভিস তাদের মোটামুটি ভাল বলা যায়। আর জিনিস পত্রের ক্ষেত্রে ভাল জিনিস কেনার অপশনটা আপনার থাকে।

তাহলে ওয়ালমার্টের প্রতি সবাই এত ক্ষ্যাপা কেন? কেন নিউইর্য়কে ওয়ালমার্টের প্রবেশ নিষিদ্ধ করা হয়েছে?

আয়তনে মাইল খানেক লম্বা একেকটা ওয়ালমার্ট যখন প্রতিষ্ঠা করা হয় কোন একটা এলাকায় তখন সে এলাকার ব্যবসায়ীদের কান্নাকাটি লেগে যায়। কেননা আর কেও তো তখন ওয়ালমার্ট ছেড়ে তাদের দোকানে আসবে না। ওয়ালমার্টের সাথে পাল্লা দেয়াও তো চাট্টিখানি কথা নয়। বিশ্বব্যাপী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সবচেয়ে কম দামে জিনিস দিতে পারে তারা। ছোট্ট দোকান টিকবে কি করে?

বাইরে থেকে জিনিস পত্র তৈরী করিয়ে নিয়ে এসে ওয়ালমার্ট আমেরিকা থেকে সব কাজ বাইরে বের করে নিয়ে যাচ্ছে। কমছে কাজ, কমছে শ্রমের দাম।

দাম কমাতে গিয়ে তাদের ছাঁটতে হচ্ছে কর্মচারীদের বেতন মাত্রা। শুনেছি এখানকার শ্রমিকরা ওয়েল পেইড নয়।

অতি সস্তায় জিনিস দিতে গিয়ে কিন্তু জিনিস পত্রের গুনগত মান একেবারে যাচ্ছেতাই হয়ে যাচ্ছে। দশটা জিনিস কিনলে দুটা খারাপ জিনিস বদলাতে আবার যেতে হয় ওয়ালমার্ট। আর একারনে একটু সচ্ছল যারা তারা বেশ অপচ্ছন্দই করেন ওয়ালমার্টকে।

এভাবে ওয়ালমার্ট গরীবদের নিম্নমানের জিনিস গছিয়ে দিয়ে হচ্ছে টাকার পাহাড় আর আমেরিকাকে করছে কৃত্রিম ভাবে অপরের উপর নির্ভরশীল।



আজ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবস। রাজ্য মানবাধিকার কমিশন আমন্ত্রণ জানালেও  অনুষ্ঠানে থাকছেন না মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। দেশের প্রধান বিচারপতি আলতামাস কবীরও আজকের অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর গরহাজিরের কারণ নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা। 

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে প্রতিবছরই রাজ্য মানবাধিকার কমিশন যে অনুষ্ঠান করে তাতে উপস্থিত থাকেন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু এবার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর অনুপস্থিতর কারণ নিয়ে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠছে। গত দেড় বছরে মুখ্যমন্ত্রীর একাধিক সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেছে মানবাধিকার কমিশন, যা পছন্দ হয়নি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। সেই সব প্রসঙ্গ এড়াতেই এই অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী যাচ্ছেন না বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ। 

ঝাড়গ্রামে মুখ্যমন্ত্রীর জনসভায় এক কৃষক, শিলাদিত্য চৌধুরী, সরাসরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সারের আকাশ ছোঁয়া দাম নিয়ে প্রশ্ন করেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁকে মাওবাদী তকমা দেন মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে দাঁড়িয়ে পুলিসকে নির্দেশ দেন শিলাদিত্যকে গ্রফতার করার। তাকে মাওবাদী বলে গ্রেফতার করার নির্দেশ দেন তিনি। এ নিয়ে প্রবল সমালোচনার মুখে পড়তে হয় মুখ্যমন্ত্রীকে। মানবাধিকার কমিশনও গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানায়। সোস্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটে মুখ্যমন্ত্রীর কার্টুন শেয়ার করে সরকারের তোপের মুখে পড়েন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ মহাপাত্রকে। তাঁকেও গ্রেফতার করা হয়। এক্ষেত্রেও এইরকমভাবে সমালোচিত হন মুখ্যমন্ত্রী। অম্বিকেশ মহাপাত্রের গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে মানবাদিকার কমিশনও। নগরপাল সহ কয়েক পুলিস কর্তাকে কমিশনে ডেকে জিজ্ঞাসাবাদও করে কমিশন।  এর জন্যও মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অশোক গাঙ্গুলিকে কটাক্ষ করেন মুখ্যমন্ত্রী। 

একটি ইংরেজি টিভি চ্যানেলের অনুষ্ঠানে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী তানিয়া ভরদ্বাজের প্রশ্ন শুনে উত্তেজিত হয়ে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁকে সঙ্গে সঙ্গে মাওবাদী তকমা দিয়ে, অনুষ্ঠান ছেড়ে বেরিয়ে যান মুখ্যমন্ত্রী। এই ঘটনায় মানবাধিকার কমিশন সহ গোটা দেশের সংবাদমাধ্যমের সমালোচনার মুখে পড়েন মুখ্যমন্ত্রী। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসের অনুষ্ঠানে উঠে আসতেই পারে এইসব প্রসঙ্গ। যে প্রসঙ্গগুলিতে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকার সমালোচনা করেছে কমিশন, তাদেরই অনুষ্ঠানে ওই প্রসঙ্গ উঠলে স্বভাবতই অস্বস্তিতে পড়তে হবে মুখ্যমন্ত্রীকে। প্রশ্ন উঠছে, এই অস্বস্তি এড়াতেই কি অনুষ্ঠানে যাচ্ছেন না মুখ্যমন্ত্রী?    

অপারেশন গ্রীনহান্ট ও মাওবাদ !
 অরুন্ধতী রায়
ভারত নামের একটি রাষ্ট্র বা এর অন্তর্গত উড়িষ্যা নামের একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অনেক আগে দক্ষিণ উড়িষ্যার দোনগ্রিয়া কোন্ধের পাহাড়গুলো ছিল। পাহাড়ের ওপর কোন্ধকে দেখা যেত। এসব পাহাড়কে মানুষ জীবন্ত দেবতাজ্ঞানে পূজা করত। এখন পাহাড়গুলো বিক্রি হয়ে গেছে। এগুলোতে বক্সাইড পাওয়া যাওয়ার কারণেই এই বিক্রির ঘটনা ঘটেছে। কোন্ধের মানুষের কাছে এটা ভগবানকে বিক্রি করার মতো। তবে কোন্ধ সম্ভবত বিশ্বজনীন বিধান প্রণেতা ভগবান নিয়ম রাজার অধিষ্ঠানের পাহাড়টিকে হিন্দু দর্শনের চূড়ান্ত প্রকৃতি শিক্ষাদানকারী 'বেদান্ত' নামে এক কোম্পানির কাছে বিক্রি করায় নিজেকে ভাগ্যবান মনে করতে পারে। এটি আসলে ইরানের শাহের ম্যানশনে বসবাসকারী অনিল আগরওয়াল নামে এক ভারতীয় বংশোদ্ভূত কোটিপতি ব্যবসায়ীর মালিকানাধীন বিশ্বের একটি বৃহত্তম খনি করপোরেশনের নাম।
পাহাড়গুলো ধ্বংস করা হলে, এগুলোকে চাদরের মতো জড়িয়ে থাকা বনও উজাড় হয়ে যাবে। এভাবে এগুলো থেকে উৎসারিত নদী ও নিম্নভূমিতে এর পানিপ্রবাহ থেকে যে কৃষি সেচ চলত, তা-ও আর দেখা যাবে না এবং দোনগ্রিয়া কোন্ধ নিজেই বিস্মৃতির অতলে হারিয়ে যাবে। ভারতের বনাঞ্চলের একেবারে মধ্যাঞ্চলে বসবাসকারী লাখ লাখ উপজাতি মানুষের আবাসভূমিও এ ধরনের হামলার মধ্যে পড়ে যাবে।
আমাদের ধোঁয়াচ্ছন্ন, জনবহুল শহরগুলোতে কেউ কেউ 'এতে কী হয়েছে' বলে বিস্ময় প্রকাশ করতে পারেন। এমনকি কেউ কেউ এ-ও বলতে পারেন, প্রগতির মাশুল তো কাউকে না কাউকে গুনতে হবে! এখন এই উপজাতিদের ওপর দিয়ে এর ধকল যাবে। ইউরোপ, অস্ট্রেলিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলোতেও অতীতে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে।
এই একই চিন্তা থেকে সরকার অপারেশন গ্রিনহান্ট পরিচালনার ঘোষণা দিয়েছে। এই অপারেশনের সারমর্ম হলো_ মধ্যভারতের জঙ্গলে মাওবাদী বিদ্রোহীদের ঘাঁটিগুলোর ওপর কামান দাগা। তবে মাওবাদীরা একাই যে এখানে বিদ্রোহ করছে তা কিন্তু নয়। এদের মধ্যে আছে ভূমিহীন, দলিত, গৃহহীন, শ্রমিক, কৃষক, তাঁতিসহ সর্বস্তরের বঞ্চিত মানুষ।করপোরেটগুলোকে জনগণের জমি ও সম্পদ গড়পড়তা দখল করতে দেওয়ার নীতিসহ নানা রকম অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে তারা। এদের মধ্যে মাওবাদীদেরই জনগণের কাছে একমাত্র বৃহত্তম হুমকি বলে সরকার উপস্থাপন করছে।
দু'বছর আগে অবস্থা যখন এতটা খারাপ ছিল না, প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং দেশের একক বৃহত্তম অভ্যন্তরীণ হুমকিরূপে বর্ণনা করেছেন এই মাওবাদীদেরই। এ বছরের ৬ জানুয়ারি রাজ্য মুখ্যমন্ত্রীদের সভায় তিনি মাওবাদীদের সামর্থ্য মাঝারি গোছের বলার পর এ সম্পর্কে তার আগে দেওয়া বক্তব্য কি ধোপে টেকে? তিনি ভারতীয় সংসদকে এ সম্পর্কে তার প্রকৃত উদ্বেগের কথা জানান। তিনি বলেন, প্রাকৃতিক ও খনিজ সম্পদ রয়েছে এমন জায়গাগুলোতে এভাবে যদি বামপন্থি সন্ত্রাসবাদকে আর বাড়তে দেওয়া হয় তাহলে দেশে বিনিয়োগের পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
প্রশ্ন হলো, এই মাওবাদী কারা? এরা ১৯৬৯ সালে নকশাল অভ্যুত্থান সংঘটনকারী ও পরে ভারত সরকারের দমন করা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বংশধর বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে নিষিদ্ধ ঘোষিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (মাওবাদী) সিপিআই (মাওবাদী) সদস্য। মাওবাদীরা মনে করে, ভারতীয় সমাজের অন্তর্জাত অসাম্য দূর করা যেতে পারে একমাত্র প্রচলিত রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে সহিংস উৎখাতের মাধ্যমে। প্রথম দিকে বিহার ও ঝাড়খণ্ডে মাওবাদী কমিউনিস্ট কেন্দ্র (এমসিসি) এবং অন্ধ্রে জনযুদ্ধ গ্রুপ (পিডবি্লউজি), মাওবাদীদের বিপুল জনসমর্থন ছিল। তাদের ওপর জারি থাকা নিষেধাজ্ঞা ২০০৪ সালে সাময়িক উঠে যাওয়ার পর এদের আহ্বানে আয়োজিত জনসভায় ১৫ লাখ লোক সমাগম হয়েছিল।
কিন্তু তাদের বিভিন্ন কার্যকলাপে জনগণ বিরক্ত হয় এবং এতে তাদের প্রতি সমর্থন একেবারে কমে যায়। তারা এমন সব সহিংস ঘটনা ঘটায় যা তাদের এক সময়ের কট্টর সমর্থকরাও সমর্থন করতে পারেনি। পুুলিশ ও মাওবাদীদের হত্যা-পাল্টা হত্যার মধ্যে জনযুদ্ধ গ্রুপ অন্ধ্র থেকে প্রায় উঠেই যায়। যারা বেঁচে ছিল তারা পার্শ্ববর্তী ছত্তিশগড়ে পালিয়ে যায়। সেখানে গভীর জঙ্গলে দশকের পর দশক ধরে টিকে থাকা সতীর্থদের সঙ্গে তারা মিশে যায়।
গণপতি নামে মাওবাদীদের এক শীর্ষ নেতার একটি ম্যাগাজিনে দেওয়া সাক্ষাৎকারে দেখা যায় তাদের মনোভাব ও ধ্যান-ধারণায় কোনো পরিবর্তন হয়নি। সেই একদলীয় মতবাদই তারা আঁকড়ে ধরে আছে। তামিল টাইগারদের প্রতিও তাদের এক ধরনের সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে।
এখন মধ্য ভারতে উপজাতি বুভুক্ষু মানুষরাই মাওবাদী যোদ্ধা বাহিনীর সদস্য। এরা অধিকারবঞ্চিত ও অত্যাচারিত, এমনকি সামান্য সুযোগ-সুবিধাবঞ্চিত স্তর থেকে আগত। ভারত স্বাধীন হওয়ার ৬০ বছর পেরিয়ে গেলেও এরা শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক সুবিধা পায়নি। এরা নির্মম শোষণ-বঞ্চনার শিকার হয়েছে দশকের পর দশক। ছোট ব্যবসায়ী, দাদন ব্যবসায়ীরা এদের নিত্য ঠকিয়েছে, আর এদের মেয়েদের ধর্ষণ করা পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও বনরক্ষীদের এক ধরনের অধিকার হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এদের এই দুর্দশা থেকে উদ্ধারের নিমিত্ত তাদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দশকের পর দশক ধরে লড়াইরত মাওবাদীরা তাই এদের মর্যাদার প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
উপজাতিদের হাতে অস্ত্র তুলে নেওয়ার কারণ হলো, সরকার তাদের সহিংসতা ও অবহেলা ছাড়া কিছুই দেয়নি এবং এখন তাদের শেষ সম্বল জমিটুকুও কেড়ে নিতে চাচ্ছে। তাদের অঞ্চলকে উন্নত করার সরকারের প্রতিশ্রুতির প্রতি যে তাদের বিন্দুমাত্র আস্থা নেই এতে তাই প্রকাশ পায়। তারা মনে করে না যে, জাতীয় খনিজ উন্নয়ন করপোরেশন এয়ারপোর্টের মতো প্রশস্ত রাস্তা বানাবে তাদের ছেলেমেয়েদের স্কুলে যাওয়ার জন্য। তারা যদি তাদের ভূমি রক্ষা করার জন্য যুদ্ধ না করে তাহলে একদিন তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এ কারণেই তারা হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে। এসব মাওবাদী যোদ্ধার অনেকেই দু'বেলা পেট পুরে খেতে পায় না, এদের অনেকেই একবারের জন্যও ট্রেনে চাপতে পারেনি, এমনকি ছোট শহর পর্যন্ত অনেকের কাছে অজানা। তারা একমাত্র টিকে থাকার জন্যই লড়াই করছে।
২০০৮ সালে 'উগ্রপন্থি উপদ্রুত এলাকায় উন্নয়ন চ্যালেঞ্জ' নামে পরিকল্পনা কমিশন নিয়োজিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি এ ব্যাপারে রিপোর্ট জমা দেয়। তাতে নকশালবাদী (মাওবাদী) আন্দোলনকে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে বর্ণনা করে ভূমিহীন ও গরিব কৃষক এবং আদিবাসীদের মধ্যে এই আন্দোলনের শক্তিশালী ভিত্তি রয়েছে বলে মত প্রকাশ করা হয়। এদের উদ্ভব ও বিকাশকে সামাজিক পরিবেশের সঙ্গে অঙ্গীভূত করে চিন্তা করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয় রিপোর্টে। রাষ্ট্রের নীতি ও পারফরম্যান্সের মধ্যে বিরাট ফারাককে এজন্য দায়ী করা হয়। মাওবাদীদের বলপূর্বক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা উচ্ছেদ করার বক্তব্য মূলত সামাজিক ন্যায়বিচার, অসাম্য, সংরক্ষণ, নিরাপত্তা ও স্থানীয় উন্নয়নের আকাঙ্ক্ষা-সঞ্জাত। বিশেষজ্ঞ কমিটির এই পর্যবেক্ষণের সঙ্গে মাওবাদীদের সবচেয়ে বড় অভ্যন্তরীণ হুমকি বলে সরকারের জিগিরের কোনো মিল নেই।
রাষ্ট্র তার সচ্ছল নাগরিকদের এসব বিপজ্জনক মানুষের হাত থেকে নিরাপদ রাখার জন্য এসব অসচ্ছল মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। তারা বলছে, এই যুদ্ধ শেষ হতে তিন থেকে পাঁচ বছর লেগে যেতে পারে। ২৬/১১তে মুম্বাই হামলার পরও যখন পাকিস্তানের সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত তখন মাওবাদীদের সঙ্গে আমরা তা করতে পারি না, বিষয়টা কেমন বিসদৃশ, তাই না! ভারত সরকার এমনকি চীনের সঙ্গে পর্যন্ত আলোচনায় প্রস্তুত। কিন্তু দেশের গরিব লোকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালানোর ব্যাপারে তারা কঠিন মনোভাব প্রদর্শন করে।
সরকারের কাছে মাওবাদী নির্মূল অভিযান চালিয়ে জঙ্গলে খুনের অবাধ লাইসেন্স দেওয়া পুলিশের 'গ্রেহাউন্ড', কোবরা ও 'স্করপিওন্স'-এর মতো জংলি নামের বিশেষ বাহিনী যথেষ্ট নয়। রিজার্ভ পুলিশ বাহিনী, বিএসএফ, জংলি নাগাবাহিনী বা পিপলস মিলিশিয়াও অপর্যাপ্ত মনে হয়েছে সরকারের কাছে। এদের অভিযানের তোড়ে ইতিমধ্যে একটি এলাকা থেকেই তিন লাখ মানুষ পালিয়েছে। কিন্তু তারপরও সরকারের আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হয়নি। এজন্য তারা দুর্ধর্ষ তিব্বত সীমান্তরক্ষী বাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারা বিলাসপুরে ব্রিগেড হেডকোয়ার্টার স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এতে সেখানকার নয়টি গ্রাম বাস্তুচ্যুত হবে। রাজনন্দগাঁওয়ের বিমান ঘাঁটি স্থাপনের জন্য স্থানচ্যুত হবে সাতটি গ্রাম। এসব সিদ্ধান্ত আগেই নেওয়া হয়ে আছে। জরিপ কাজও সম্পন্ন হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যেই পুরোদমে আক্রমণ শুরু হয়ে যাবে। এখন ভারতীয় হেলিকপ্টার ও বিমান বাহিনীকে আত্মরক্ষার নামে হামলা চালানোর অধিকার দেওয়া হয়েছে। অথচ একই দেশের দরিদ্র মানুষের সে অধিকার নেই।
কার প্রতি গুলি ছোড়া হবে? নিরাপত্তা বাহিনী কীভাবে নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ ও মাওবাদীদের আলাদা করে চিহ্নিত করবে? যেসব আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়ে পালাতে থাকবে তারা কি এই হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবে না?
অপারেশন গ্রিনহান্ট নামে কী ধরনের যুদ্ধ চালানো হবে? আমরা কি এ সম্পর্কে আদৌ কিছু জানতে পারব? জঙ্গল থেকে এ ব্যাপারে বেশি খবর আসছে না। পশ্চিমবঙ্গের লালগড় বেষ্টন করা হয়ে গেছে। যারাই যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের পেটানো ও গ্রেফতার করা হয় এবং অবশ্যই মাওবাদী বলা হয়। দান্তিওয়াদায় হিমাংশু কুমার পরিচালিত গান্ধীবাদী বানভাসি চেতনা আশ্রম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাঞ্চল শুরুর মুখে এটাই একমাত্র নিরপেক্ষ জায়গা ছিল, যেখানে সাংবাদিক, অধিকার কর্মী, গবেষক ও সত্যানুসন্ধানী টিম ওই এলাকায় কাজ শুরুর আগে থাকতে পারত।
ইত্যবসরে ভারতীয় প্রশাসন তাদের অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করা শুরু করেছে। রাতারাতি আমাদের বাঁধাধরা গণমাধ্যম ইসলামী সন্ত্রাসবাদের মতো 'লাল সন্ত্রাস'কে নিয়েও একই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। এই অভিযানের মাধ্যমে 'শ্রীলংকা ধরনে'র একটা ফয়সালা সম্ভবত ভারতীয় প্রশাসন চাচ্ছে। তাই জাতিসংঘে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের ইউরোপীয় প্রচেষ্টাকে ভারত সরকারের ভণ্ডুল করে দেওয়ার ঘটনায় নয়াদিলি্লর কোনো স্বার্থ নেই বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
এই লক্ষ্যে পরিচালিত প্রথম পদক্ষেপটি হলো মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারণা চালানো। ডবি্লউ বুশের মতো সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ বিরোধিতাকারীদের সন্ত্রাসের পক্ষভুক্ত করার হুঙ্কারের মতো মাওবাদবিরোধী অভিযান বিরোধিতাকারীদের মাওবাদ সমর্থক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা আছে এই প্রচারণায়। মাওবাদী হুমকিকে বাড়িয়ে দেখানো রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ প্রচেষ্টাকে সমর্থন জোগাবে। এই নতুন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সবৈব পন্থা গ্রহণের পর রাষ্ট্র নিশ্চয়ই চাইবে এই সুযোগে শত শত প্রতিরোধ আন্দোলনকে খতম করে দিতে। এবার নিশ্চয়ই এই আন্দোলনকারীদের মাওবাদী-দরদি প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হবে।
আমি এখানে ভবিষ্যৎ ক্রিয়ার কাল ব্যবহার করলেও এটা আসলে এখনই শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার একই পন্থা নিয়েছিল নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন লালগড়ে পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি ভিন্ন ধরনের গণআন্দোলন হলেও একে মাওবাদীদের প্রকাশ্য শাখা ও তাদের দরদি বলে চিত্রিত করা হচ্ছে। এই সংগঠনের নেতা ছত্রধর মাহাতো ইতিমধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন, তাকে কোনো জামিনও দেওয়া হচ্ছে না এবং তাকে হরহামেশাই মাওবাদী নেতা বলা হচ্ছে। আমরা নাগরিক আন্দোলনের নেতা ডা. বিনায়ক সেনের কারাগারে মিথ্যা অভিযোগে দুই বছর কাটিয়ে আসার ঘটনা বিস্মৃত হইনি। তার বিরুদ্ধে মাওবাদীদের কুরিয়ার হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অপারেশন গ্রিনহান্টের আলো যখন দেখা যাচ্ছে তখন এই যুদ্ধ উপদ্রুত এলাকার দূরবর্তী দেশের অন্যান্য এলাকায় গরিব, শ্রমজীবী ও ভূমিহীনদের অধিকারের ওপর হামলা হবে এবং যাদের জমি সরকার জনস্বার্থে নিয়ে নিতে চায় সেগুলো নেওয়ার কাজ ত্বরান্বিত হবে। তাদের দুর্দশা আরও চরমে উঠবে এবং তাদের অভিযোগের প্রতি কোনো কানই দেওয়া হবে না। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্যান্য যুদ্ধের মতো এটিও গতিবেগ পাবে, যুক্তি খুঁজে পাবে এবং তার একটা অর্থনীতিও থাকবে। এটা জীবনপ্রণালির অংশে পরিণত হবে, যাকে বদলানো প্রায় অসম্ভব। মনে করা হচ্ছে, পুলিশ সেনাবাহিনীর মতো নির্মম খুনে মেশিন হিসেবে কাজ করবে। আধা-সামরিক বাহিনী পরিণত হবে পুলিশের মতো দুর্নীতিবাজ ও কলঙ্কিত প্রশাসনিক বাহিনীতে। আমরা এমনটাই ঘটতে দেখেছি নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও কাশ্মীরে। তবে হার্টল্যান্ডের এই যুদ্ধে উলি্লখিত ওইসব স্থানের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থা ততটা শোচনীয় হবে না। দুর্দশাটা বেশি মাওবাদীদেরই পোহাতে হবে। এরপর যথাসময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও জনগণের মধ্যে ব্যবধানটা কমে আসবে। গোলাগুলি কেনাবেচা চলবে, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বড়লোকদের এই যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বা মাওবাদী অথবা বেসামরিক নাগরিক নির্বিশেষে গরিব মানুষরাই নিহত হবে। তবে যারা ভাবছেন এই যুদ্ধের আঁচ থেকে রেহাই পাবেন, তাদের বিষয়টি পুনরায় ভাবা উচিত। যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে আমরা ফতুর হয়ে যাব।
উন্মাদনার রাশ টেনে ধরে কীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়, তার পথ খুঁজে বের করার জন্য সারাদেশের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সংগঠকরা নয়াদিলি্লতে একের পর এক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বিচারপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, এ দেশ থেকে এখনও মানবতাবোধ উঠে যায়নি। এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষরাও যে গণমাধ্যমের একতরফা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হননি তাই বোঝা গেল এতে। এ ধরনের সুধীজনদের লক্ষ্য করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক'দিন আগে সন্ত্রাসবাদের সহায়ক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দায়ী করে বক্তব্য দেওয়ার পর তারা ভীত না হয়ে নয়াদিলি্ল সভায় উপস্থিত হন। এতে মনে হয়, মন্ত্রীর বক্তব্য বিপরীত ফলই দিয়েছে। 
যুদ্ধ এলাকা লালগড়, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও উড়িষ্যা থেকে আগত লোকজন এসব এলাকায় পুলিশি নির্যাতন, গ্রেফতার, খুন ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। পুলিশ কখনও কখনও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বদলে খনি কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে কাজ করে বলেও তারা অভিযোগ করেছেন। জনগণ এও বলেছেন, যেখানে কর্মরত দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত নির্দিষ্ট কিছু এনজিও তাদের সন্দেহজনক কার্যকলাপের মাধ্যমে করপোরেট স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে। ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ে যারাই বিরোধী মত পোষণ করছে তাদেরই মাওবাদী অভিধায় অভিহিত করা হচ্ছে, এমনকি কাউকে কাউকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হচ্ছে। এসব হয়রানি ও অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনাই এসব এলাকার সাধারণ মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া এবং মাওবাদী হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এক সময় বনটির নাম ছিল দণ্ডকারণ্য। এটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড় হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করে ভারতের কোটি কোটি উপজাতি মানুষ। গণমাধ্যম এটিকেই লাল করিডোর বা মাওবাদী করিডোর নাম দিয়েছে। আমাদের সংবিধান আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না এবং তাদের রক্ষা করার দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর অর্পণ করলেও তাতে যেন কিচ্ছু এসে যায় না। এখন বড় বড় করপোরেশন আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে নেওয়ার পথেই এগোচ্ছে। এদের মধ্যে মিত্তাল, জিন্দাল, টাটা থেকে শুরু করে স্বল্প পরিচিত ও বহুল পরিচিত অনেক দেশি-বিদেশি ইস্পাত এবং খনি কোম্পানি রয়েছে।
প্রতিটি পাহাড়, নদী ও বনের ভেতরের ফাঁকা জায়গার জন্য আলাদা আলাদা স্বাক্ষর হয়ে আছে। করপোরেট হাউসগুলো এভাবে বিশ্বের আদি চমৎকার বনাঞ্চলকে উজাড় করে ফেলবে বলে আমি আতঙ্কিত। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্যই শুধু বিনষ্ট হবে না, এখানে বসবাসকারী আদিবাসীরা হবেন বাস্তুচ্যুত। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের দোহাই পেড়ে এসব করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে তা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সম্ভবত করপোরেট লবির তৎপরতার কারণে গণমাধ্যম এগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। 
এখানে বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থ ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত থাকবেই। সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আমলা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নানাভাবেই এই বিশাল এলাকা নিয়ে করপোরেট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের অপারেশন গ্রিনহান্টের প্রধান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তার পেশা জীবনে একজন করপোরেট আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন খনি করপোরেশনের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে 'বেদান্ত' নামের কোম্পানিটির পরিচালক ছিলেন।
খনি কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে এই যুদ্ধ চায়। এর ফলে যারা ভূমি থেকে উচ্ছেদকে এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে এসব কোম্পানির পোয়াবারো। তবে এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা, আবাসের কী হবে? 

গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত

বুভুক্ষু মানুষ কখন অস্ত্র তুলে নেয়?
জঙ্গলে যুদ্ধ
 অরুন্ধতী রায়
(গতকালের পর)
অপারেশন গ্রিনহান্ট নামে কী ধরনের যুদ্ধ চালানো হবে? আমরা কি এ সম্পর্কে আদৌ কিছু জানতে পারব? জঙ্গল থেকে এ ব্যাপারে বেশি খবর আসছে না। পশ্চিমবঙ্গের লালগড় বেষ্টন করা হয়ে গেছে। যারাই যাওয়ার চেষ্টা করে তাদের পেটানো ও গ্রেফতার করা হয় এবং অবশ্যই মাওবাদী বলা হয়। দান্তিওয়াদায় হিমাংশু কুমার পরিচালিত গান্ধীবাদী বানভাসি চেতনা আশ্রম কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মাটিতে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। যুদ্ধাঞ্চল শুরুর মুখে এটাই একমাত্র নিরপেক্ষ জায়গা ছিল, যেখানে সাংবাদিক, অধিকার কর্মী, গবেষক ও সত্যানুসন্ধানী টিম ওই এলাকায় কাজ শুরুর আগে থাকতে পারত।
ইত্যবসরে ভারতীয় প্রশাসন তাদের অত্যন্ত শক্তিশালী অস্ত্র প্রয়োগ করা শুরু করেছে। রাতারাতি আমাদের বাঁধাধরা গণমাধ্যম ইসলামী সন্ত্রাসবাদের মতো 'লাল সন্ত্রাস'কে নিয়েও একই হিস্টিরিয়াগ্রস্ত প্রচারণা শুরু করে দিয়েছে। এই অভিযানের মাধ্যমে 'শ্রীলংকা ধরনে'র একটা ফয়সালা সম্ভবত ভারতীয় প্রশাসন চাচ্ছে। তাই জাতিসংঘে শ্রীলংকার বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ তদন্তের ইউরোপীয় প্রচেষ্টাকে ভারত সরকারের ভণ্ডুল করে দেওয়ার ঘটনায় নয়াদিলি্লর কোনো স্বার্থ নেই বলে উড়িয়ে দেওয়া চলে না।
এই লক্ষ্যে পরিচালিত প্রথম পদক্ষেপটি হলো মাওবাদীদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ প্রচারণা চালানো। ডবি্লউ বুশের মতো সন্ত্রাসবাদবিরোধী যুদ্ধ বিরোধিতাকারীদের সন্ত্রাসের পক্ষভুক্ত করার হুঙ্কারের মতো মাওবাদবিরোধী অভিযান বিরোধিতাকারীদের মাওবাদ সমর্থক প্রতিপন্ন করার চেষ্টা আছে এই প্রচারণায়। মাওবাদী হুমকিকে বাড়িয়ে দেখানো রাষ্ট্রের সামরিকীকরণ প্রচেষ্টাকে সমর্থন জোগাবে। এই নতুন সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধে সবৈব পন্থা গ্রহণের পর রাষ্ট্র নিশ্চয়ই চাইবে এই সুযোগে শত শত প্রতিরোধ আন্দোলনকে খতম করে দিতে। এবার নিশ্চয়ই এই আন্দোলনকারীদের মাওবাদী-দরদি প্রতিপন্ন করার চেষ্টা হবে।
আমি এখানে ভবিষ্যৎ ক্রিয়ার কাল ব্যবহার করলেও এটা আসলে এখনই শুরু হয়ে গেছে বলা যায়। পশ্চিমবঙ্গ সরকার একই পন্থা নিয়েছিল নন্দীগ্রাম ও সিঙ্গুরে কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। এখন লালগড়ে পুলিশি সন্ত্রাসবিরোধী জনসাধারণের কমিটি ভিন্ন ধরনের গণআন্দোলন হলেও একে মাওবাদীদের প্রকাশ্য শাখা ও তাদের দরদি বলে চিত্রিত করা হচ্ছে। এই সংগঠনের নেতা ছত্রধর মাহাতো ইতিমধ্যে গ্রেফতার রয়েছেন, তাকে কোনো জামিনও দেওয়া হচ্ছে না এবং তাকে হরহামেশাই মাওবাদী নেতা বলা হচ্ছে। আমরা নাগরিক আন্দোলনের নেতা ডা. বিনায়ক সেনের কারাগারে মিথ্যা অভিযোগে দুই বছর কাটিয়ে আসার ঘটনা বিস্মৃত হইনি। তার বিরুদ্ধে মাওবাদীদের কুরিয়ার হিসেবে কাজ করার অভিযোগ আনা হয়েছিল। অপারেশন গ্রিনহান্টের আলো যখন দেখা যাচ্ছে তখন এই যুদ্ধ উপদ্রুত এলাকার দূরবর্তী দেশের অন্যান্য এলাকায় গরিব, শ্রমজীবী ও ভূমিহীনদের অধিকারের ওপর হামলা হবে এবং যাদের জমি সরকার জনস্বার্থে নিয়ে নিতে চায় সেগুলো নেওয়ার কাজ ত্বরান্বিত হবে। তাদের দুর্দশা আরও চরমে উঠবে এবং তাদের অভিযোগের প্রতি কোনো কানই দেওয়া হবে না। এই যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অন্যান্য যুদ্ধের মতো এটিও গতিবেগ পাবে, যুক্তি খুঁজে পাবে এবং তার একটা অর্থনীতিও থাকবে। এটা জীবনপ্রণালির অংশে পরিণত হবে, যাকে বদলানো প্রায় অসম্ভব। মনে করা হচ্ছে, পুলিশ সেনাবাহিনীর মতো নির্মম খুনে মেশিন হিসেবে কাজ করবে। আধা-সামরিক বাহিনী পরিণত হবে পুলিশের মতো দুর্নীতিবাজ ও কলঙ্কিত প্রশাসনিক বাহিনীতে। আমরা এমনটাই ঘটতে দেখেছি নাগাল্যান্ড, মণিপুর ও কাশ্মীরে। তবে হার্টল্যান্ডের এই যুদ্ধে উলি্লখিত ওইসব স্থানের মতো নিরাপত্তা বাহিনীর অবস্থা ততটা শোচনীয় হবে না। দুর্দশাটা বেশি মাওবাদীদেরই পোহাতে হবে। এরপর যথাসময়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সদস্য ও জনগণের মধ্যে ব্যবধানটা কমে আসবে। গোলাগুলি কেনাবেচা চলবে, যা ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। বড়লোকদের এই যুদ্ধে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য বা মাওবাদী অথবা বেসামরিক নাগরিক নির্বিশেষে গরিব মানুষরাই নিহত হবে। তবে যারা ভাবছেন এই যুদ্ধের আঁচ থেকে রেহাই পাবেন, তাদের বিষয়টি পুনরায় ভাবা উচিত। যুদ্ধের ব্যয় মেটাতে গিয়ে আমরা ফতুর হয়ে যাব।
উন্মাদনার রাশ টেনে ধরে কীভাবে যুদ্ধ বন্ধ করা যায়, তার পথ খুঁজে বের করার জন্য সারাদেশের নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সংগঠকরা নয়াদিলি্লতে একের পর এক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে শিক্ষাবিদ, আইনজীবী, বিচারপতি থেকে শুরু করে বিভিন্ন পেশার লোকজন উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে এদের উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, এ দেশ থেকে এখনও মানবতাবোধ উঠে যায়নি। এমনকি মধ্যবিত্ত মানুষরাও যে গণমাধ্যমের একতরফা প্রচারণায় বিভ্রান্ত হননি তাই বোঝা গেল এতে। এ ধরনের সুধীজনদের লক্ষ্য করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ক'দিন আগে সন্ত্রাসবাদের সহায়ক বুদ্ধিবৃত্তিক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য দায়ী করে বক্তব্য দেওয়ার পর তারা ভীত না হয়ে নয়াদিলি্ল সভায় উপস্থিত হন। এতে মনে হয়, মন্ত্রীর বক্তব্য বিপরীত ফলই দিয়েছে। 
যুদ্ধ এলাকা লালগড়, ঝাড়খণ্ড, ছত্তিশগড় ও উড়িষ্যা থেকে আগত লোকজন এসব এলাকায় পুলিশি নির্যাতন, গ্রেফতার, খুন ও দুর্নীতির অভিযোগ এনেছেন। পুলিশ কখনও কখনও তাদের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বদলে খনি কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের কাছ থেকে নির্দেশ নিয়ে কাজ করে বলেও তারা অভিযোগ করেছেন। জনগণ এও বলেছেন, যেখানে কর্মরত দাতা সংস্থার অর্থায়নে পরিচালিত নির্দিষ্ট কিছু এনজিও তাদের সন্দেহজনক কার্যকলাপের মাধ্যমে করপোরেট স্বার্থের পক্ষে কাজ করছে। ঝাড়খণ্ড ও ছত্তিশগড়ে যারাই বিরোধী মত পোষণ করছে তাদেরই মাওবাদী অভিধায় অভিহিত করা হচ্ছে, এমনকি কাউকে কাউকে গ্রেফতার পর্যন্ত করা হচ্ছে। এসব হয়রানি ও অত্যাচার-নির্যাতনের ঘটনাই এসব এলাকার সাধারণ মানুষকে অস্ত্র হাতে তুলে নেওয়া এবং মাওবাদী হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছে।
এক সময় বনটির নাম ছিল দণ্ডকারণ্য। এটি পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা, ছত্তিশগড় হয়ে অন্ধ্রপ্রদেশ ও মহারাষ্ট্রের অংশবিশেষ পর্যন্ত বিস্তৃত। এই বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বাস করে ভারতের কোটি কোটি উপজাতি মানুষ। গণমাধ্যম এটিকেই লাল করিডোর বা মাওবাদী করিডোর নাম দিয়েছে। আমাদের সংবিধান আদিবাসীদের ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যাবে না এবং তাদের রক্ষা করার দায়দায়িত্ব রাষ্ট্র ও সরকারের ওপর অর্পণ করলেও তাতে যেন কিচ্ছু এসে যায় না। এখন বড় বড় করপোরেশন আদিবাসীদের ভূমি নিয়ে নেওয়ার পথেই এগোচ্ছে। এদের মধ্যে মিত্তাল, জিন্দাল, টাটা থেকে শুরু করে স্বল্প পরিচিত ও বহুল পরিচিত অনেক দেশি-বিদেশি ইস্পাত এবং খনি কোম্পানি রয়েছে।
প্রতিটি পাহাড়, নদী ও বনের ভেতরের ফাঁকা জায়গার জন্য আলাদা আলাদা স্বাক্ষর হয়ে আছে। করপোরেট হাউসগুলো এভাবে বিশ্বের আদি চমৎকার বনাঞ্চলকে উজাড় করে ফেলবে বলে আমি আতঙ্কিত। এতে প্রাকৃতিক ভারসাম্যই শুধু বিনষ্ট হবে না, এখানে বসবাসকারী আদিবাসীরা হবেন বাস্তুচ্যুত। উন্নয়ন ও কর্মসংস্থানের দোহাই পেড়ে এসব করা হচ্ছে। কিন্তু এর ফলে যে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবে তা কিন্তু এড়িয়ে যাওয়া হচ্ছে। সম্ভবত করপোরেট লবির তৎপরতার কারণে গণমাধ্যম এগুলো এড়িয়ে যাচ্ছে। 
এখানে বিভিন্ন ব্যক্তি-গোষ্ঠীর স্বার্থ ও পারস্পরিক স্বার্থ-সংঘাত থাকবেই। সরকারি বিভিন্ন মন্ত্রী, এমপি, আমলা প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ নানাভাবেই এই বিশাল এলাকা নিয়ে করপোরেট বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে। আমাদের অপারেশন গ্রিনহান্টের প্রধান কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরম তার পেশা জীবনে একজন করপোরেট আইনজীবী হিসেবে বিভিন্ন খনি করপোরেশনের পক্ষে কাজ করেছেন। তিনি ২০০৪ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেওয়ার আগে 'বেদান্ত' নামের কোম্পানিটির পরিচালক ছিলেন।
খনি কোম্পানিগুলো মরিয়া হয়ে এই যুদ্ধ চায়। এর ফলে যারা ভূমি থেকে উচ্ছেদকে এতদিন ঠেকিয়ে রেখেছে তারা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে এসব কোম্পানির পোয়াবারো। তবে এর ফলে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ও আদিবাসী মানুষের জীবন-জীবিকা, আবাসের কী হবে? (সমাপ্ত)
- অরুন্ধতী রায় : আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ভারতের মানবাধিকার নেত্রী 
গার্ডিয়ান থেকে সংক্ষেপিত ভাষান্তর : সুভাষ সাহা

আরও চার বছর!

 আসিফ হাসান

সমীহজাগানো ব্যবধানে রিপাবলিকান চ্যালেঞ্জার মিট রমনিকে হারিয়ে ওয়াশিংটনের সাদা বাড়িতে কালো বারাক ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে এলেন৷ এরআগে ২০০৮ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস গড়েছিলেন বারাক ওবামা৷ দেশের দুই শতাব্দীর বেশি সময়ের ইতিহাসে প্রথম কৃষ্ণাঙ্গ প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রবেশ করেছিলেন হোয়াইট হাউসে৷ এবার সেই সাফল্যের রেকর্ডকে তিনি যেন নিয়ে গেলেন অনন্য উচ্চতায়৷ কারণ, মন্দায় বিপর্যস্ত অর্থনীতি, নৈরাশ্যজনক বেকারত্বের ছায়া আর শেষ মুহূর্তে জ্বলে ওঠা শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বীর কঠিন বাধা পেরিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদের জন্য জনগণের রায় পেয়েছেন তিনি৷ মার্কিন ভোটাররা তাঁর ওপর আস্থা রেখেছেন৷
প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ৫৩৮টি ইলেকটোরাল কলেজ (নির্বাচকমণ্ডলী) ভোটের মধ্যে তিনি পেয়েছেন ৩৩২টি৷ যেখানে জয়ের জন্য প্রয়োজন ২৭০ ভোট৷ ওবামার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী মিট রমনি পেয়েছেন ২০৬ ভোট৷ সর্বশেষ ফলাফলে ২৯ ইলেকটোরাল ভোটের অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডায়ও জিতেছেন ওবামা৷ 
তবে দুই প্রার্থীর ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের পার্থক্য কিন্তু জনসমর্থন আদায়ের ক্ষেত্রে প্রকৃত লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে না৷ সে ছবি পাওয়া যাবে 'পপুলার' অর্থাত্‍ সাধারণ জনগণের ভোটের হিসাব থেকে৷ সাধারণ ভোটারদের ৫০ শতাংশের ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ রমনি পেয়েছেন তাঁর চেয়ে মাত্র ২ শতাংশ কম অর্থাত্‍ ৪৮ শতাংশ৷ নির্বাচনের কিছুদিন আগে থেকে শেষ পর্যন্ত চলা জনমত জরিপে যে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখা গেছে তার সঙ্গেও মেলে না এই ফল৷ এবারের নির্বাচনকে বলা হয়েছে সবচেয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনগুলোর একটি৷
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে ব্রেকিং নিউজের মাধ্যমে পুনর্নির্বাচিত হওয়ার খবর প্রচারের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সামাজিক যোগাযোগের ওয়েবসাইট টুইটারে বার্তা পাঠিয়ে সমর্থকদের ধন্যবাদ জানান ওবামা৷ তাঁর প্রথম বার্তা ছিল, 'আরও চার বছর৷' পরে শিকাগোয় প্রথম বিজয় ভাষণে সমর্থকদের উদ্দেশে ওবামা বলেন, 'আপনারা মনে করিয়ে দিলেন, আমাদের পথ কঠিন এবং যাত্রা দীর্ঘ হলেও আমরা সামলে নিয়েছি৷ আমরা লড়াই করে ফিরে এসেছি৷'
পরাজয় স্বীকার করে ওবামাকে অভিনন্দন জানিয়েছেন রমনি৷ পরাজয়ের পর বোস্টনে সমর্থকদের উদ্দেশে বক্তৃতায় রমনি বলেন, 'আমি তাঁদের সবাইকে, বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট, ফার্স্ট লেডি ও তাঁদের কন্যাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি৷ এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জের সময়৷ আমি প্রার্থনা করছি যেন জাতিকে দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রেসিডেন্ট এই চ্যালেঞ্জে জয়ী হন৷'
রমনির শুভকামনার জবাবে ওবামা বলেন, 'রমনি ও তাঁর পরিবার জনসেবার মাধ্যমে মার্কিন জনগণের জন্য কাজ করতে পছন্দ করেন৷ আমরা তাঁদের এই সেবামূলক মানসিকতাকে অভিনন্দন জানাই৷'
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দোদুল্যমান ১১টি অঙ্গরাজ্য যাদেরকে পার্পল স্টেট বলা হয় তার মধ্যে নয়টিতেই জিতে বাজিমাত করেছেন ওবামা৷ তিনি জয় পেয়েছেন কলোরাডো, আইওয়া, মিশিগান, নেভাডা, নিউ হ্যাম্পশায়ার, ওহাইও, পেনসিলভানিয়া, ভার্জিনিয়া ও উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যে৷ শুধু নর্থ ক্যারোলাইনায় জয়ী হয়েছেন রমনি৷ দোদুল্যমান অন্য অঙ্গরাজ্য ফ্লোরিডায় ভোট গণনা স্থগিত রয়েছে৷ এখানে সামান্য ব্যবধানে এগিয়ে ছিলেন ওবামা৷
রমনি তাঁর নিজের অঙ্গরাজ্য ম্যাসাচুসেটসেও জয় পাননি৷ ২০০৩ থেকে ২০০৭ সাল পর্যন্ত ম্যাসাচুসেটসের গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন রমনি৷ শুধু ম্যাসাচুসেটসে নয়, রমনির জন্মস্থান মিশিগানেও জয় পেয়েছেন ওবামা৷ মিশিগানের গভনর্র ছিলেন রমনির বাবা জর্জ ডবি্লউ রমনি৷ দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর বাইরে এই দুই অঙ্গরাজ্যে ওবামার জয়কে বড় সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে৷
তুলনামূলক চিত্র: সিএনএনের বুথফেরত জনমত জরিপে দেখা যায়, পুরুষ ভোটারদের ৫২ শতাংশ সমর্থন গেছে রমনির পক্ষে৷ ওবামা পেয়েছেন ৪৫ শতাংশ৷ নারীদের ক্ষেত্রে অবশ্য এগিয়ে আছেন ওবামা৷ তিনি নারীদের ৫৫ শতাংশ ভোট পেয়েছেন৷ আর রমনি পেয়েছেন ৪৪ শতাংশ৷
তরুণ ভোটারদের সমর্থনও ওবামার পক্ষে গেছে৷ ১৮ থেকে ২৯ বছর বয়সী ৬০ শতাংশের ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ রমনি পান ৩৭ শতাংশ৷ শ্বেতাঙ্গদের ভোট অবশ্য বেশির ভাগই গেছে রমনির পক্ষে৷ শ্বেতাঙ্গ ৫৯ শতাংশের ভোট পেয়েছেন রমনি৷ ওবামা পেয়েছেন ৩৯ শতাংশ৷ এ ছাড়া আফ্রিকান বংশোদ্ভূতদের ৯৩ শতাংশের এবং স্পেনীয়ভাষী হিস্পানিক বা লাতিনোদের ৭১ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ওবামা৷
কংগ্রেসে তেমন রদবদল নেই: প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সঙ্গে নিয়ম অনুযায়ী এক-তৃতীয়াংশ সিনেট আসন ও প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবগুলোতেই ভোটগ্রহণ করা হয়৷ 
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ১৯৬০ সালের পর থেকে ওহাইওতে হেরে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে পারেননি৷ এবারও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি৷ ১৮ ইলেকটোরাল কলেজ ভোটের এই অঙ্গরাজ্যে জয়ী হয়েই দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসে প্রবেশ করছেন ওবামা৷
\'সেরাটা এখনও বাকি\'
দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ইলিনয়ের শিকাগোয় বিজয় ভাষণ দেন বারাক ওবামা৷ নির্বাচনের দিন মঙ্গলবার মধ্যরাতে দেওয়া ওই ভাষণে ওবামা বলেন, সেরাটা এখনও বাকি রয়েছে৷ এ সময় তিনি দেশকে এগিয়ে নিতে পরাজিত প্রার্থী মিট রমনির সঙ্গে আলোচনায় বসারও ঘোষণা দেন৷ উত্‍ফুল্ল সমর্থকদের সামনে ওবামা বলেন, \'আমরা আমেরিকানরা সবাই এক পরিবার, আমরা একসঙ্গে বাঁচব, এক সঙ্গে মরব৷\' তিনি বলেন, \'২০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ঔপনিবেশিক শাসন থেকে নিজেদের ভবিষ্যত্‍ নির্ধারণের অধিকার আদায় করার পর আমাদের ঐক্যকে সুসংহত করার কাজ আরও সামনে এগিয়ে গেল আজ রাতে৷\' 
বিজয় ভাষণে ওবামা বলেন, \'যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এখনও সেরাটা দেওয়ার বাকি রয়ে গেছে৷\' তিনি পরাজিত প্রার্থী মিট রমনির সঙ্গে কথা বলেছেন৷ তিনি রমনি ও তার রানিংমেট পল রায়ানকে কঠিন নির্বাচনী প্রচারের জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন৷ দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য ওবামা রমনির সঙ্গে একত্রে বসে আলোচনারও ঘোষণা দেন৷ তিনি বলেন, \'আমরা হয়তো কঠিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছি৷ এটি করেছি কারণ আমরা এ দেশকে গভীরভাবে ভালোবাসি এবং এর ভবিষ্যত্‍ নিয়ে আমরা সত্যিকার অর্থেই যত্নশীল৷\' ওবামা বলেন, \'দেশকে এগিয়ে নিতে কোন কোন ক্ষেত্রে আমরা একত্রে কাজ করতে পারি তা ঠিক করতে আগামী দিনগুলোয় আমি গভর্নর মিট রমনির সঙ্গে বসতে চাই৷\' বিরোধী দলের সমর্থকদের উদ্দেশে ওবামা বলেন, \'আমি আপনাদের ভোট পেয়েছি কি পাইনি সেটি ব্যাপার নয়, আমি আপনাদের মনোভাব বুঝতে পেরেছি৷ আপনাদের কাছ থেকে শিখতে পেরেছি৷ আপনারা আমাকে একজন ভালো প্রেসিডেন্টে পরিণত হতে সাহায্য করেছেন৷\'
ওবামা বলেন, \'এতসব হতাশা ও প্রতিকূলতা সত্ত্বেও আমাদের ভবিষ্যত্‍ নিয়ে আমি এর আগে কখনোই এতটা আশাবাদী হইনি৷ আমেরিকাকে নিয়েও আমি এতটা আশাবাদী কখনও হইনি৷\' যুক্তরাষ্ট্রের আরও এগিয়ে যাওয়া নিয়ে আশাবাদী ওবামা বলেন, \'আমাদের রাজনীতি যে ইঙ্গিত দিয়েছে আমরা প্রকৃতপক্ষে ততটা বিভক্ত নই৷ পণ্ডিতরা যেমনটা ভাবেন আমরা অতটা হতাশাবাদী নই৷ সমন্বিত ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষার চেয়েও আমরা অনেক বড়৷\' ওবামা বলেন, \'আপনাদের সহযোগিতা ও ঈশ্বরের দয়ায় আমাদের এগিয়ে যাওয়া অব্যাহত রাখতে পারব এবং বিশ্বকে বুঝিয়ে দিতে পারব কেন আমরাই বিশ্বের বুকে সেরা জাতি৷\' 
পর্যবেক্ষকদের মতে, ওবামা জিতলেন, সেই সঙ্গে জেতালেনও৷ জয় হলো গণতন্ত্র ও মানবতার মর্মবাণীর, জয়ী হলো আশাজাগানিয়া 'আমেরিকান ড্রিম'... বিজয়ী হলো আমেরিকা, সেই সঙ্গে বিজয়ী হলেন বিশ্বের কোটি কোটি শান্তিপ্রিয় মানুষ৷ প্রত্যাশার ঔদ্ধত্যের দুর্বিনীত পুরুষ, কেনেডির পর সবচেয়ে বেশি বিশ্বপ্রিয় প্রেসিডেন্ট৷ প্রিয়তমা স্ত্রী মিশেলের ভাষায়-  স্বপ্ন, সংগ্রাম আর প্রত্যাশার মন্ত্রে উজ্জীবিত বিশ্বস্ত ও সত্যবাদী মানুষ, যিনি শত প্রতিকূলতার মাঝেও রাজনীতির হাওয়া বুঝে কখনও সুর বদলান না৷ আগামী দিনের বিশ্বের আশা ও আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, বিশ্বরাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের সত্যিকারের যুগস্রষ্টা, আমেরিকান গণতন্ত্রের ঐন্দ্রজালিক অগ্রগতির প্রতিশ্রুত মানব প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ওপর আবারও আস্থা রাখলো আমেরিকা৷ 
নির্বাচনী ফলের পরপর তাত্‍ক্ষণিক বিশ্লেষণে নির্বাচনে ওবামাকেয়ার, অভিবাসন নীতি, আফ্রিকান আমেরিকা ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ, নারী ভোটার ও ল্যাটিন ভোটারদের শক্তিশালী সমর্থন এবং কোন কোন রাজ্যে সমকামী ভোটারদের সমর্থন ওবামার বিজয়কে ত্বরান্বিত করেছে৷ এছাড়া বিশেষ করে মধ্যবিত্ত ভোটারদের কাছে ওবামার নীতি ও কর্মসূচি এবং ব্যক্তি ওবামার প্রতি এখনও অটুট অবিচল আস্থা প্রেসিডেন্ট ওবামার নির্বাচনকে নিরঙ্কুশ বিজয়ের পথে নিয়ে গেছে৷
উল্লেখ্য, সিএনএন-এর রাজনৈতিক বিশ্লেষক ডেভিড রথকোফ-এর মতো বিশ্লেষকরা বলছেন, দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলেও প্রেসিডেন্ট ওবামাকে বিভিন্ন ইস্যুতে এত বেশি ব্যস্ত থাকতে হবে যে তিনি তার এ বিজয়কে সেলিব্রেট করার মতো ফুরসত পাবেন না৷ আর পুলিত্‍জার পুরস্কার বিজয়ী ইতিহাসের প্রফেসর ডেভিড এম কেনেডি নির্বাচনী ফলাফল পরবর্তী সিএনএন-এর এক মন্তব্য কলামে বলছেন, রাষ্ট্রক্ষমতায় এক ওবামার বিজয়ই আমেরিকারকে পরিবর্তন করে দেবে না৷ এরপরও আশাবাদী আমেরিকার বেশির ভাগ জনগণ, আশাবাদী বিশ্বের সব শান্তিবাদী মানুষ- এই মুহূর্তে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের আশা ও আকাঙ্ক্ষর প্রতীক, প্রত্যাশার ঔদ্ধত্যের স্বপ্নবান পুরুষ, প্রেসিডেন্ট ওবামার বিজয়ের এ মাহেন্দ্রক্ষণে অভিনন্দন প্রেসিডেন্ট ওবামা৷
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, নির্বাচনী মাঠে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই এড়াতে পারলেও অর্থনীতির মাঠের লড়াইয়ে এত সহজে জয় পাবেন না ওবামা৷ শিল্পায়নে ধীরগতি, বেকারত্ব, বাজেট ঘাটতি-সব মিলিয়ে ইতোমধ্যে মার্কিন অর্থনীতি খাদের কিনারায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ এখান থেকে অর্থনীতিকে টেনে তুলতে হবে৷ স্থবির হয়ে পড়া অর্থনীতিতে ফেরাতে হবে গতি৷ আর এটিই হবে বারাক ওবামার প্রথম ও প্রধান চ্যালেঞ্জ৷ যুক্তরাষ্ট্রের পত্রপত্রিকা আর বিশ্লেষকদের ভাষ্যে, অর্থনীতির ইস্যুটিই প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে উঠে এসেছে৷
বিশ্লেষকরা মনে করেছিলেন অর্থনৈতিক ইসু্যগুলো নির্বাচনের জয়-পরাজয়েও বড় ভূমিকা রাখতে পারে৷ বর্তমানে দেশটির অর্থনীতি মোটেও স্বস্তিদায়ক অবস্থানে নেই৷ আর এ কারণেই নির্বাচনী মাঠে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে আবির্ভূত হন রিপাবলিকান নেতা মিট রমনি৷ ক্ষমতার পালাবদল হলে বিদ্যমান আর্থিক নীতিমালায় আমূল পরিবর্তন হতে পারে, সঙ্কট থেকে বেরিয়ে আসতে পারে দেশ, এমন আশাবাদে ভোটাররা রমনিকে বেছে নিতে পারেন বলে মনে করছিলেন তারা৷ কিন্তু শেষ পর্যন্ত নারী, এশিয়ান, অভিবাসী আর হিস্পানিদের ভোটে এই হিসাব-নিকাশ পাল্টে যায়৷ তবে মোহনীয় ক্যারিশমায় নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া যতটা সহজ, অর্থনীতির হিসাব-নিকাশ মেলানো ততটা সহজ নয়৷
বেশ কিছুদিন ধরেই পশ্চিমা অর্থনীতিতে এক ধরনের স্থবিরতা চলছে৷ ইউরো অঞ্চল ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক মন্দায় আক্রান্ত হয়েছে৷ মার্কিন অর্থনীতির অবস্থা ততটা খারাপ না হলেও পরিস্থিতি যে কোনো সময় সেদিকেই যেতে পারে৷ অর্থনীতি নিয়ে সবচেয়ে জটিল পরিস্থিতির মুখোমুখি হবেন কর হার বাড়ানোর ইস্যুতে৷ মার্কিন নাগরিকরা যতটা আশাবাদী হয়ে তাকে নির্বাচিত করেছেন, কর ইস্যুতে ততটাই হতাশ ও ক্ষুব্ধ হতে পারেন৷
দেশটির সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডবি্লউ বুশ যে বিলের মাধ্যমে কর হার কাঁটছাট করেছিলেন, আগামী বছরের ১ জানুয়ারি তার মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে৷ ফলে ওবামা প্রশাসনকে হয় নতুন করে বিল এনে কর কমাতে হবে৷ নতুবা স্বয়ংক্রিয়ভাবে করের হার বেড়ে যাবে৷ কর হার বাড়লে স্বাভাবিক কারণেই রুষ্ট হবেন ওবামার ভোটাররা৷ কিন্তু এ ছাড়া তার গত্যন্তরও নেই৷ কারণ অর্থনীতির যে হালহকিকত তাতে কর হার না বাড়ালে বিপুল পরিমাণ বাজেট ঘাটতির মুখে পড়তে হবে৷ আর এই ঘাটতি মেটাতে হবে বৈদেশিক ঋণের মাধ্যমে৷ বিশ্বের সবচেয়ে বড় ঋণগ্রস্ত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে সেটি খুব সহজ হবে না৷ ওবামাকে তাই অপ্রিয় পথেই যেতে হবে৷ কর হার বাড়ানোর পাশাপাশি শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ খাতে ব্যয় কমাতে হবে৷ কিন্তু তা না করে উল্টো পথে হাঁটলে যে চাপ তৈরি হবে তা সামলাতে পারবে না মার্কিন অর্থনীতি৷ তখন মন্দাই হয়ে উঠতে পারে অনিবার্য পরিণতি৷
যেসব কারণে জিতলেন ওবামা
দ্বিতীয়বারের মতো যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বারাক ওবামা৷ ওবামার ব্যাপক বিজয়ের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার অর্থনৈতিক কৌশল, অভিবাসন আইন সংস্কারের প্রতিশ্রুতি, সমকামী বিবাহে সমর্থন, গর্ভপাত সমর্থন, উদার নীতি ও কৌশলগুলো৷ এছাড়া গতবারের মতো এবারও ওবামার হোয়াইট হাউসের পথ সুগম করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নারী, তরুণ, কৃষ্ণাঙ্গ ও সংখ্যালঘু হিস্পানিক ভোটাররা৷ নির্বাচনকে ঘিরে স্পষ্ট বিভক্ত হয়ে পড়েছেন বৃদ্ধ, তরুণ, নারী ও পুরুষ ভোটাররা৷ নির্বাচনী ফল বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এতে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করেছে রাজনৈতিক, ভূতাত্তি্বক ও সাংস্কৃতিক বিভক্তি৷ সংখ্যালঘু হিস্পানিকদের অধিকাংশ ভোট পড়েছে ওবামার পক্ষে৷
নির্বাচনী জরিপে দেখা গিয়েছিল, ওবামার প্রতি নারী ভোটারদের সমর্থন কিছুটা কমে আসছে; কিন্তু এক গর্ভপাত ইস্যুতে অবস্থানের কারণে শেষ পর্যন্ত নারীরা তাকেই বেছে নিয়েছেন৷ ওবামা গর্ভপাত সমর্থন করেন এবং এটাকে নারীর অধিকার বলে মনে করেন৷ রমনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে গর্ভপাতের বিরোধিতা করলেও ম্যাসাচুসেটসের গভর্নর থাকাকালীন এর পক্ষে ছিলেন৷
এ নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় প্রজন্মের কিউবান আমেরিকানদের ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ প্রেসিডেন্ট ওবামার শাসনামলে দ্য আমেরিকান রিকভারি অ্যান্ড রিইনভেস্টমেন্ট অ্যাক্ট পাস করেছেন৷ এ আইন অনুযায়ী সরকার সাত লাখ ৬৮ হাজার কোটি ডলারের এক প্রণোদনা কর্মসূচি হাতে নেয়৷ ওবামা অনেকে ধরনের কর হ্রাস করলেও প্রত্যেক গৃহায়ণ খাতে কর মওকুফ করে বুশ প্রশাসন যে আইন জারি করেছিল, সেটি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেন৷ এছাড়া যেসব নাগরিক স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় ইন্স্যুরেন্স বা বীমা করতে অক্ষম, তারাও যাতে স্বাস্থ্যসেবা পান, সেটি নিশ্চিত করতে চান ওবামা৷ অন্যদিকে রমনি ওবামার স্বাস্থ্যনীতি বাতিল করতে চান৷ প্রেসিডেন্ট হিসেবে ওবামা নির্বাহী ক্ষমতাবলে বয়সে তরুণ এমন অবৈধ অভিবাসীদের বৈধতা দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছেন, যা ভোটারদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে৷
নির্বাচনের ফলাফলে দেখা গেছে, ওবামা সবচেয়ে এগিয়ে গেছেন নারী ভোটারদের সমর্থনে৷ কৃষ্ণাঙ্গ ও শ্বেতাঙ্গসহ সব ধরনের নারীর ভোটে ওবামা রমনির চেয়ে ১২ পয়েন্টে এগিয়ে৷ এটাই মূলত ওবামার দ্বিতীয় মেয়াদে হোয়াইট হাউসের পথ সুগম করে দিয়েছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা৷ ২০০৮ সালে নারীদের ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী জন ম্যাককেইনের চেয়ে ১৩ পয়েন্ট এগিয়ে ছিলেন ওবামা৷ এবার তিনি এগিয়ে ১২ পয়েন্টে৷ যদিও এবার বিভিন্ন জরিপে ওবামার প্রতি নারীদের সমর্থন বেশ কমেছে বলে দেখানো হয়েছে৷ এ বিষয়ে ল্যানচেস্টারের ফ্রাঙ্কলিন ও মার্শাল কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক টেরি ম্যাডোনা বলেন, মূলত এবারের নির্বাচনেও ২০০৮ সালের পুনরাবৃত্তি ঘটেছে৷ একই ধরনের জনসংখ্যাতত্ত্বের প্রতিফলন ঘটেছে এবারের নির্বাচনেও৷ ওবামাতেই বেশি আস্থা মার্কিন নারীদের৷
২০০৮ সালের নির্বাচনে ওবামা শ্বেতাঙ্গদের ৪৩ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন৷ এবারের নির্বাচনে যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৯ শতাংশ৷ তবে শ্বেতাঙ্গদের ভোট আদায়ের ক্ষেত্রে ওবামা এগিয়ে আছেন ওহাইওতে৷ সেখানে তিনি ৪২ শতাংশ শ্বেতাঙ্গের ভোট পেয়েছেন৷ ২০০৮ সালে ওবামা আফ্রো-আমেরিকানদের ভোট পেয়েছিলেন ৯৫ শতাংশ৷ এবার যা কমে ৯৩ শতাংশে এসেছে৷ তবে ওহাইওতে ভালো করেছেন তিনি৷ এ রাজ্যে কৃষ্ণাঙ্গদের ৯৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি৷ তবে হিস্পানিকদের মধ্যে ওবামার ভোট এবার বেড়েছে৷ রমনির চেয়ে হিস্পানিকদের ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে ৪৪ পয়েন্টে এগিয়ে ওবামা৷ গতবার এ ক্ষেত্রে রিপাবলিকানরা পেয়েছিল ৩১ শতাংশ ভোট, এবার পেয়েছে ২৭ শতাংশ৷
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যের কাউন্টিগুলোতে ভোট পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে ওবামা৷ বিশেষত দোদুল্যমান রাজ্যগুলো৷ ক্যালিফোর্নিয়ার অরেঞ্জ কাউন্টিতে এবারও রিপাবলিকানদের চেয়ে এগিয়ে ওবামা৷ এখানে ৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি৷ মোট জনসংখ্যার ২৭ শতাংশ হিস্পানিক৷ যারা ঐতিহ্যগতভাবেই ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করেন৷ ২০০৮ সালে ওবামা ফ্লোরিডার ৬৭টি কাউন্টিতে যে ভোট পেয়েছিলেন, এবার তা ছাড়িয়ে গেছেন৷ ফ্লোরিডার সবচেয়ে জনবহুল দুটি কাউন্টি মিয়াডি ও দাদে৷ এ দুটি কাউন্টিতে ওবামা ৬২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন৷ গতবার এ দুটি কাউন্টিতে তিনি ৫৮ শতাংশ ভোট পেয়েছিলেন, যেখানে সমগ্র ফ্লোরিডায় তিনি ৪৯ দশমিক ৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন৷ নেভাডার ক্লার্ক কাউন্টিতে (যার মধ্যে লাস ভেগাস ও হেন্ডারসন এলাকা অন্তর্ভুক্ত) ওবামা ৫৬ শতাংশ ভোট পেয়েছেন৷ এ এলাকায় হিস্পানিকদের খুব বেশি বসবাস নেই, যা প্রমাণ করে যে এ এলাকার শ্বেতাঙ্গদের ভোট পেয়েছেন তিনি৷
ওহাইও বিগত মার্কিন নির্বাচনগুলোয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে৷ ওহাইওতে জিতলে প্রেসিডেন্ট হবেন, এমনটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ এখানে ৫০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ দেখা গেছে, এসব এলাকায় জিততে ওবামাকে সহায়তা করেছে রাজ্যের কাউন্টিগুলো৷ ওহাইওর জনবহুল হ্যামিলটন কাউন্টিতে ৫২ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ ফ্রাঙ্কলিন কাউন্টিতে ৬০ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি৷ কুয়াগোগা কাউন্টিতে পেয়েছেন ৬৯ শতাংশ ভোট৷ এ ছাড়া কলোরাডো, কানসাসসহ অন্য রাজ্যগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কাউন্টিগুলোতে বেশি ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ এ ছাড়া বিভিন্ন রাজ্যের শহরতলি এলাকায় বেশির ভাগ ভোট পেয়েছেন তিনি৷
দেখা গেছে, যেসব ভোটার নিয়মিত ধর্মকর্ম পালন করেন বা সাপ্তাহিক প্রার্থনালয়ে যান, তাদের ৫৯ শতাংশ ভোট পেয়েছেন ওবামা৷ প্রোটেস্ট্যান্টদের ৫৭ শতাংশ ভোট পেয়েছেন তিনি৷ অন্যদিকে ক্যাথলিকদের পেয়েছেন ৫০ শতাংশ ভোট৷
দেখা গেছে, ভোট দেওয়ার সময় সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক ইস্যুটি বিবেচনায় এনেছেন ভোটাররা৷ প্রতি ১০ জনের মধ্যে ৬ জন ভোট দেওয়ার বিষয়ে অর্থনৈতিক ইস্যুগুলো বিবেচনায় এনেছেন৷ একই সঙ্গে ভোটাররা এও জানিয়েছেন, তারা যুক্তরাষ্ট্রে এ অর্থনৈতিক দুরবস্থা ও বেকারত্বের জন্য ওবামাকে নয়, বুশ প্রশাসনকে দায়ী করেন৷ যার কারণে তারা রিপাবলিকান মিট রমনি নয়, ডেমোক্র্যাট বারাক ওবামাকে বেছে নিয়েছেন৷ রয়টার্স ও বিজনেস উইক ওয়াশিংটন পোস্ট অবলম্বনে৷ 
রমনি হারলেন যে কারণে
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জনমত জরিপ অনুযায়ী, জয়ের এত কাছে এসেও রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী মিট রমনি কেন হারলেন, তা নিয়ে এখন আসছে নানা মত৷ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক টিমোথি স্ট্যানলি সিএনএনের জন্য লেখা এক বিশ্লেষণী প্রতিবেদনে বলেছেন, পরস্পরবিরোধী আচরণ ও কর্মকাণ্ডের জেরে এই পরিণতি মানতে হয়েছে রমনিকে৷ অধ্যাপক টিমোথি স্ট্যানলি বলেছেন, মিট রমনি পরস্পরবিরোধিতার প্রতিমূর্তি৷ রমনিকে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় তিনি একজন খাঁটি রিপাবলিকান৷ তবে অনেক দিক বিবেচনায় তিনি এখনো বাইরের একজনই রয়ে গেছেন৷ যেসব কারণে রমনি বাইরের, তার একটি হচ্ছে তাঁর ধর্মীয় পরিচয়৷ মার্কিন ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট বা ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থীদ্বয়ের কেউই প্রোটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান সমপ্রদায়ভুক্ত ছিলেন না৷ প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রমনি মরমন সমপ্রদায়ভুক্ত৷ বিজয়ী হলে তিনিই হতেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম মরমন প্রেসিডেন্ট৷ আর ভাইস প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী পল রায়ান ক্যাথলিক সমপ্রদায়ভুক্ত৷
ম্যাসাচুসেটসের মানুষ সাবেক গভর্নর রমনিকে চেনে উভয় দলের সমর্থিত মধ্যপন্থী হিসেবে৷ অথচ তিনি জাতীয় পর্যায়ে নিজেকে একজন 'প্রচণ্ড রক্ষণশীল' হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন৷ নিজ অঙ্গরাজ্যে রমনি এমন এক স্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচি চালু করেছিলেন, যা অনেকের মতে 'ওবামাকেয়ার'-এর অনুরূপ৷ প্রেসিডেন্ট ওবামার আলোচিত স্বাস্থ্যবিষয়ক কর্মসূচি 'ওবামাকেয়ার' নামে পরিচিতি পেয়েছে৷ অথচ রমনি প্রচারণায় ঘোষণা দিয়েছিলেন যে তিনি ক্ষমতায় গেলে ওবামার ওই স্বাস্থ্য কর্মসূচি বাতিল করবেন৷ বিশ্লেষণে টিমোথি স্ট্যানলি বলেছেন, রমনি আসলে মধ্যপন্থী, নাকি রক্ষণশীল মতাদর্শের, তা প্রশ্নসাপেক্ষ৷ একই প্রশ্ন তোলা যেতে পারে তাঁর রিপাবলিকান পার্টির ব্যাপারেও৷ তাঁর মতে, নিজেদের মতাদর্শের ব্যাপারে রিপাবলিকান নিজেরাই নিশ্চিত নয়৷ এ কারণেই দলটি রমনির মতো প্রার্থীকে মনোনয়ন দিয়েছে৷
এখনকার রিপাবলিকানরা এক উভয় সংকটের মধ্যে পড়েছেন৷ এক দিকে তাঁদের রয়েছে দলীয় আদর্শের ব্যাপারে আবেগপ্রবণ বিশালসংখ্যক ভোটার, যাঁরা অর্থনৈতিক ও সামাজিক রক্ষণশীলতার সমর্থক৷ নির্বাচনে জয়ী হতে দলকে এই ভোটারদের চাঙা করতে হয়েছে৷ অন্যদিকে নির্বাচনে জয়ের জন্য ছোট হলেও দলের গুরুত্বপূর্ণ যে গোষ্ঠীটির সমর্থন প্রয়োজন, তারা মধ্যপন্থী ও স্বতন্ত্র৷ এই গোষ্ঠী চায় তাদের রাজনীতি আরেকটু বাস্তবসম্মত হোক৷
রিপাবলিকানদের জন্য এবারের নির্বাচনের চ্যালেঞ্জ ছিল দলের কট্টরপন্থী পক্ষ 'টি পার্টির' কর্মসূচি গ্রহণ করে তাকে নতুন মোড়কে ভরা৷ এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, যাতে করে তা দলের ডানপন্থীদের পছন্দের প্রতি খেয়াল রাখে আবার মধ্যপন্থীদের মনও জয় করতে পারে৷ এটাই ছিল রমনির কাজ, যাতে তিনি ব্যর্থ হয়েছেন৷
ভোটের আগে অনুষ্ঠিত টিভি বিতর্কে রমনি খুবই সফলতা পেয়েছিলেন৷ তবে নিজের ও দলের মধ্যে যে স্ববিরোধিতা বর্তমান, তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি৷ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে রক্ষণশীল রিপাবলিকান প্রার্থী মিট রমনি সম্ভাব্য সবকিছুই করেছেন৷ এরপরও পরাজয় তাকে ছাড়েনি৷ এর কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে বিশ্লেষকসহ অনেকে অনেক কথাই বলছেন৷ এ ক্ষেত্রে কেউ বিতর্কে নিজেকে সঠিকভাবে তুলে ধরার ব্যর্থতাকে দায়ি করেছেন৷ কেউ আবার নির্বাচনী অঙ্গীকারে জনগণকে তার খুশি করতে না পারার বিষয়টিকে দোষ দিয়েছেন৷ বুধবার \'হাফিংটন পোস্ট\'-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে রমনির হেরে যাওয়ার কারণ সম্পর্কে একটি বিশ্লেষণ এভাবে তুলে ধরা হয়৷ রমনির সমর্থকরা বলছেন, নির্বাচনের আগ মুহূর্তে হারিকেন স্যান্ডির আঘাত যুক্তরাষ্ট্রকে লণ্ডভণ্ড করে দিলেও প্রেসিডেন্ট ওবামাকে অনেকটাই এগিয়ে নেয়৷ কেননা তিনি ওই সময় নির্বাচনী প্রচারণা বাদ দিয়ে দুর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্ত জনগণের পাশে দাঁড়ান৷ এতে তার জনপ্রিয়তা অনেকটাই বেড়ে যায়৷ বিশ্লেষকদের মতে, অভিবাসন আইনের কড়াকড়ির বিরোধীপক্ষ, অভিবাসনের সমর্থক গোষ্ঠী, আগ্নেয়াস্ত্রের মালিক এমন একক গোষ্ঠীকে যথেষ্ট পরিমাণে খুশি করতে পারেননি রমনি৷ মতাদর্শ নিয়ে বিভিন্ন রকম বুলি কপচালেও তিনি কোনো উপসংহার টানতে ব্যর্থ হন৷ একই সঙ্গে সরকার পরিচালনার বিষয়ে সঠিক কোনো দিক নির্দেশনাও তিনি দিতে পারেননি৷ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে অবশ্য সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলার সুযোগ তার ছিল৷ তিনি যখন ম্যাসাচুসেটসের গভনর্র ছিলেন ওই সময় ডেমোক্রেটিক শাসনাধীনে থেকে স্বাস্থ্যসেবা বিষয়ক একটি সার্বজনীন পরিকল্পনা তৈরিতে কাজ করেছেন৷ ওই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি এ ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা দিতে পারতেন৷ সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে তার রানিং মেট পল রায়ানের সঙ্গে পরিকল্পনা নিয়ে মতভেদ ছিল৷ রমনি ছিলেন সরকারের আকার ছোট করার পক্ষে৷ কিন্তু পল ছিলেন এর উল্টো অবস্থানে৷ এ জিনিসটিও ভোটাররা ভালোভাবে গ্রহণ করেননি৷
রিপাবলিকানরা দুশ্চিন্তায়
মার্কিন কোনো প্রেসিডেন্ট কি অথনৈতিক মন্থরতা সত্ত্বেও দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার আশা করতে পারেন? এর উত্তর এ যাবতকাল নেতিবাচকই ছিল৷ কিন্তু এবারের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে বারাক ওবামা এই রাজনৈতিক যুক্তিকে মাড়িয়ে নির্বাচনে বিজয় অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন৷ তাই এবারের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বের নির্বাচন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা অনেক কাটাছেঁড়া করবেন৷ তারা দেখতে চেষ্টা করবেন, কী সেই জাদুরকাঠি যার ছোঁয়ায় ওবামা রমনির আশায় জল ঢেলে দিয়ে পুনরায় হোয়াইট হাউসের ওভাল অফিসের চেয়ারখানিতে বসার সুযোগ পেলেন?
রমনি যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ওবামার হাত ধরে একটুও উন্নতি করেনি বলে ভয় দেখিয়ে ভোটারদের কাবু করতে চেয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি কিন্তু এখন ততখানি খারাপ নয়৷ ২০০৮ সালে মার্কিন বিপর্যয়কর অর্থনৈতিক মন্দা জর্জ ডবি্লউ বুশের কাছ থেকে ওবামা পেয়েছিলেন৷ ওই অর্থনৈতিক হারিকিরি ওবামার সৃষ্টি নয়৷ ওবামা মার্কিন অর্থনীতিকে রাতারাতি উন্নতির ধারায় ফেরাতে না পারলেও তখন স্টিমুলাস কর্মসূচি বাস্তবায়নের মাধ্যমে আরেকটি ধেয়ে আসা অর্থনৈতিক মন্দাকে আটকে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন৷ এটি নিশ্চয়ই তার কম কৃতিত্ব নয়৷ আর এ জন্য তিনি রিপাবলিকানদের সঙ্গী করেছিলেন৷ তাদের অনেককে গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রীর পদেও রেখেছিলেন অনেকদিন৷ অর্থাত্‍ বাইপার্টিজানগতভাবে তিনি পরিস্থিতি সামাল দিতে চেষ্টা করেছিলেন৷ তিনি যখন ২০০৯ সালে দায়িত্ব গ্রহণ করেন তখন প্রত্যেক মাসে ৭ লাখ মার্কিনি চাকরি হারাচ্ছিলেন৷ এ বেকারত্বের সংখ্যা বৃদ্ধির হার আটকাতে ওবামার মাসের পর মাস লেগে গেলেও এ ক্ষেত্রে তিনি সফল হয়েছিলেন৷ জনমত জরিপেও দেখা গেছে, অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য মানুষ যতটা ওবামাকে দায়ী করছে তার চেয়ে বেশি দায়ী করেছে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডবি্লউ বুশকে৷ এবার নির্বাচনের শেষের দিকে এসে মার্কিন অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রবণতা দেখা দেয়৷ ভোক্তা আস্থা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শেয়ারবাজারে ধীরে ধীরে চাঙ্গাভাব ফিরে আসতে শুরু করে৷ বেকারত্বের হারও মনস্তাত্তি্বকভাবে উদ্বেগজনক ৮ শতাংশের নিচে নেমে আসে৷ বাড়ি-ঘরের মূল্যও বৃদ্ধি পেতে থাকে আস্তে আস্তে৷ জেনারেল মোটর্সকে বেইল-আউট করে এবং বাবু-কর্মীদের কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করে তিনি কর্মসংস্থান ও উত্‍পাদনশীল ব্যবসায় তার ইতিবাচক ও কার্যকর ভূমিকাকে প্রমাণ করতে সক্ষম হন৷ এভাবে তিনি রিপাবলিকান যুক্তির বিপরীতে প্রত্যক্ষভাবে ভোটারদের বোঝাতে সক্ষম হন, বেসরকারি খাতে কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতেও সরকারের ভূমিকা রয়েছে৷ এবার মার্কিন স্বর্ণযুগের প্রেসিডেন্ট হিসেবে পরিচিত সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন তার পক্ষে আন্তরিকভাবে নামায় তিনি ভবিষ্যতে ভালো অর্থনীতি উপহার দিতে সক্ষম বলে আশাবাদ সৃষ্টি করেন৷ ধনীদের ওপর অধিকহারে করারোপ এবং কর ছাড় বাতিল করার ক্ষেত্রে ওবামার চেষ্টাকে ৬০ শতাংশ ভোটার সমর্থন দিয়েছেন৷ এর ওপর রয়েছে নারীদের গর্ভপাতের অধিকার, কর্মক্ষেত্রে সমান সুযোগ ও মজুরি প্রদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করাকে বেআইনি করে আইন পাস, সমকামিতা ইত্যাদি নাগরিক অধিকার৷ এসব বিষয়ে ওবামা উদারনীতি গ্রহণ করায় নারী ও তরুণ ভোটারদের তার প্রতি আকর্ষণ করতে সহজ হয়েছে৷ অভিবাসন সংক্রান্ত আইনের ব্যাপারেও ওবামা উদারনীতি নিয়েছিলেন৷ এ কারণে ওবামাকেই অভিবাসীরা ব্যাপকহারে ভোট দিয়েছেন৷ বাংলাদেশি আমেরিকানরাও ওবামাকেই তাদের নেতা মেনেছেন৷
ওসামা বিন লাদেনকে হত্যা করার মাধ্যমে ওবামা সেনাবাহিনীর সুপ্রিম কমান্ডার হিসেবে তার দৃঢ়তা ও যোগ্যতা প্রমাণ করেছেন৷ যদিও গোয়েন্দা বিমান ব্যবহার করে জঙ্গি হত্যার ব্যাপারে অনেক প্রশ্ন রয়েছে কিন্তু তার নির্দেশিত এ কার্যক্রমকে আমেরিকানরা তাদের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনীয় মনে করে৷ এতে আমেরিকান সৈন্যের প্রাণহানির ঝুঁকি ছাড়াই শত্রুকে ঘায়েল করা সম্ভব হচ্ছে৷ আফগানিস্তান থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করার ঘোষণাকেও ভোটাররা অনুমোদন দিয়েছেন৷ সামরিক বাজেট হ্রাস ও কর বৃদ্ধি করে ঘাটতি কমিয়ে আনা; অন্যদিকে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির পরিধি বৃদ্ধি এবং নাগরিক নিরাপত্তা বৃদ্ধিকেও সমর্থন দিয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ৷ বস্তুত সমাজের প্রতিটি অংশকেই অ্যাড্রেস করেছেন ওবামা৷ ধনীদের কর অবকাশ সুবিধা বন্ধ করে তাদের ওপর করহার বৃদ্ধির নীতিকে বিরোধিতা করছে তারা৷ তাছাড়া ওয়ালস্ট্রিটে ইনসাইড ট্রেডিংয়ের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণসহ ব্যাংক ও ব্যবসার ব্যাপারে কিছুু নিয়মনীতি চালু করায় ব্যবসায়ী বা সুযোগ সন্ধানী করপোরেট হাউসগুলো ওবামার বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে৷ এ কারণে বড় ব্যবসায়ী ও ওয়ালস্ট্রিটকে একযোগে ওবামার বিরুদ্ধে কাড়ি কাড়ি অর্থ ঢালতে দেখা গেছে৷ সম্ভবত এই লবির প্ররোচনাতেই মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট রাজনৈতিক দলকে করপোরেট হাউসগুলোর ওপর চাঁদা প্রদানের ওপর বাঁধনকোষণকে আলগা করে দেয়৷ তবে ওবামা গণচাঁদা ও মডারেট ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে বড় করপোরেট হাউসগুলোর আর্থিক অনস্লটকে সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করতে সক্ষম হন৷ এভাবে আর্থিক সংস্থানের উদ্যোগ বিভিন্ন গণতন্ত্রের জন্য উপকারী উদাহরণ হতে পারে৷
এদিকে নির্বাচনে জয়লাভের জন্য তার রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী বিপুল অর্থকড়ি ঢালা, ব্যাপক নির্বাচনী প্রচার চালানো থেকে সবকিছু করার পরও তার ভরাডুবি হলো কেন- সেটা লাখ টাকার প্রশ্ন৷ আসলে নির্বাচনী কর্মকাণ্ডের শুরুতে টি-পার্টি নামে ভারতের বজরং দল বা আমাদের দেশের উগ্রবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর মতো সংস্থার কাছে নাকে খত দিয়েছিলেন রমনি৷ যে কারণে নির্বাচনী প্রচারের প্রথমদিকে তার কথাবার্তায় ধর্মীয় উগ্রবাদী গন্ধ খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল৷ গেলবার ওবামা কেন একজন কৃষ্ণাঙ্গ হলেও প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বনি্দ্বতা করে আমেরিকার নির্বাচনে ইতিহাস সৃষ্টি করতে সক্ষম হন, সেটা রমনি বা তার দল সঠিকভাবে পর্যালোচনা করতে ব্যর্থ হন৷ সাদা সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে একজন কৃষ্ণাঙ্গ, তাও আবার মুসলমান পিতার সন্তান কি শুধু অর্থনৈতিক মন্দা ও যুদ্ধবিরোধী মনোভাবের কারণে ভোটাররা পছন্দ করল? রিপাবলিকানরা সম্ভবত তাই ভেবে থাকবেন৷ আসলে মার্কিন জনসংখ্যায় অভিবাসীদের দ্রুত হার বৃদ্ধি এবং জনগণের বিরাট অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ প্রকট হয়ে ওঠার কারণে এটা সম্ভব হয়েছে৷ তাদের এ সত্যটি অনুধাবন করে দলের নীতিকে যুগোপযোগী করার কাজে হাত দেওয়া উচিত ছিল৷ কিন্তু তা তারা করেননি৷ এবার এ প্রশ্নে রিপাবলিকান পার্টির নেতৃত্বের মধ্যেই মতভেদ প্রকাশ হয়ে পড়েছে৷
রমনির কট্টরপন্থি অভিবাসন বিরোধী নীতি তাকে অভিবাসীদের মধ্যে অপ্রিয় করেছে৷ রিপাবলিকান পার্টির দীর্ঘকালের পরামর্শদাতা মাইক মারফি মনে করেন, এভাবে পার্টি হিস্পানিক, কৃষ্ণাঙ্গ, তরুণ ভোটার, কলেজ পাস করা মহিলা ভোটারদের ধর্মযাজক বা চরম রক্ষণশীল মতবাদের কাছে সঁপে দিয়ে তাদের সমর্থন পাওয়ার আশা করা যায় না৷ রক্ষণশীলরা ধর্মীয় অনুশাসনের একচুল নড়চড়ও পছন্দ করেন না৷ অথচ, এসব তরুণ ও মহিলারা এখন আর এসব মানতে নারাজ৷ এদের বিপুল ভোট ডেমোক্র্যাটদের ঝুলিতে গেছে৷ রিপাবলিকান পার্টির রক্ষণশীল নেতারা এখনও গ্রাম ও শহরতলির হোয়াইট-ভোটারদের ওপর বেশি মাত্রায় নির্ভর করেন৷ অথচ, শহরে অধিকসংখ্যক মানুষের বাস৷ তাই শহরের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে ধারণ না করে রিপাবলিকান পার্টি জয়লাভ করতে পারে না৷ এ জন্য সিনেট নির্বাচনেও রিপাবলিকান পার্টি কয়েকটি আসন ডেমোক্র্যাটদের কাছে এবার খুইয়েছে৷ তবে প্রতিনিধি পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা বজায় রাখতে পারার ফলে রক্ষণশীলরাও দলকে আরও হার্ডলাইনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতে পারে৷ এদিকে রমনির রক্ষণশীল অবস্থান থেকে নির্বাচনের শেষ দিকে সরে এসে মধ্যপন্থা গ্রহণের চেষ্টাকেও চরমপন্থিরা পরাজয়ের অন্যতম কারণ বলে মনে করছে৷ মধ্যপন্থিরা মনে করে, রমনি মধ্যপন্থায় না ফিরলে যেটুকু প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়তে পেরেছিলেন তাও সম্ভব হতো না৷
এবারের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে মার্কিন ভোটারদের জনসংখ্যাতাত্তি্বক, বর্ণগত, জেন্ডারগত, নৃতাত্তি্বক বিভাজন এবং ঐক্যসূত্রটা আরও প্রকটভাবে ধরা পড়েছে৷ আর মহিলা ও তরুণশক্তির পুরনো চিন্তায় আচ্ছন্ন না থাকার প্রবণতা মার্কিন রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে বিরাট পরিবর্তনেরই ইঙ্গিত করে৷ এই পরিবর্তনকে হিসাবে নিয়ে রিপাবলিকান পার্টি নতুন চিন্তাধারার ভিত্তিতে দলকে বিন্যস্ত করতে পারে কি-না সেটাই দেখার বিষয়৷ কংগ্রেস অধিবেশন শুরু হলেই বোঝা যাবে তারা আসলে পুরনো পথকে আঁকড়ে থাকবে না-কি যুগের চাহিদা উপযোগী পথ আবিষ্কার করবে৷
দ্বিখণ্ডিত আমেরিকা!
নির্বাচন শেষ৷ দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার রায়ও পেয়েছেন ওবামা৷ কিন্তু নির্বাচনের ফল বলছে, কয়েক দশক আগেও মার্কিনিরা যেমন দ্বিধাবিভক্ত ছিল, এখনো তা-ই আছে৷ দেখা যাচ্ছে, সংখ্যাগত দিক দিয়ে জনগণের দুই অংশের মধ্যে পার্থক্য খুব কম৷ কিন্তু, আদর্শ ও আনুগত্যের দিক দিয়ে এই পার্থক্য ক্রমে বাড়ছে৷ অনেক দূর থেকে যারা যুক্তরাষ্ট্রের দিকে তাকাবেন, এ বিভক্তি দেখে তারা বিস্মিত হতে পারেন৷ দেশটির ৫১-৪৯ শতাংশ জনসমর্থন পাওয়া দলগুলো নির্বাচনী প্রচারাভিযান থেকে শুরু করে সব জায়গায় বারবার বিবাদে জড়িয়ে পড়েছে৷ দেখে মনে হয়, এ যেন ডান ও বামপন্থীদের মধ্যকার অমীমাংসিত লড়াই৷ সমপ্রতি \'দিস অ্যামেরিকান লাইফ\' শিরোনামের একটি রেডিও অনুষ্ঠানে যুক্তরাষ্ট্রের সামাজিক জীবনে মতবিরোধের প্রভাব কতটুকু, সে বিষয়টি উঠে এসেছে৷ এক ব্যক্তি জানান, রাজনৈতিক মতপার্থক্যের জন্য আরেক বন্ধুর সঙ্গে তার সম্পর্ক নষ্ট হয়ে গেছে৷ একজন শিক্ষার্থী বলেছে, তার বন্ধু ওবামার স্বাস্থ্যনীতি সমর্থন করে না, যেন মনে হয় তার কাছে জীবনের কোনো মূল্যই নেই৷ এ কারণে ওই বন্ধুর সঙ্গে সে সব ধরনের সম্পর্ক ত্যাগ করেছে৷ আরেক ব্যক্তি তার বন্ধুর সঙ্গে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছেন৷ দুই বোন একমত হতে না পারায়, একজন আরেকজনের ওপর চড়াও হয়েছে৷ কিন্তু, একটু ভেবে দেখলে বোঝা যায়, অবস্থাটি আসলে খুব অদ্ভুত৷ যদি মার্কিনিরা সত্যিই দুটি বিপরীতমুখী রাজনৈতিক আদর্শে বিভক্ত হয়ে থাকে, তবে একই সঙ্গে আরো একটি ঘটনা ঘটার কথা৷ দেশটির দার্শনিকরাও সমান রকম দুটি অংশে বিভক্ত হয়ে সমর্থন জানানোর কথা৷ এটা হলে বোঝা যেত পরিস্থিতি স্থিতিশীল৷ কিন্তু, প্রকৃত পরিস্থিতি এমন কথা বলে না৷ দেখা গেছে, দুই দলের মতাদর্শের প্রতি অনুগতদের মধ্যে বিকাশ বা পরিবর্তন হচ্ছে অনেক কম৷ এ কারণে জনসংখ্যাভিত্তিক হিসাবটি ৫০ শতাংশের আশপাশেই থাকছে৷ এ বিভক্তিকেও যদি আপাতভাবে স্থিতিশীল ধরে নেয়া হয়, তবু প্রশ্ন থেকেই যায়৷ 
খুবই প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দুটি দলের মূল প্রবণতা হলো নিজের সমর্থকদের ধরে রাখা৷ সব ধরনের কাজকর্মের মধ্য দিয়ে দুদলই একই কাজ করতে চাইছে৷ অবিশ্বাস্য হলেও যুক্তরাষ্ট্রের মতো একটি যুক্তিবাদী সামজে এমনটাই ঘটছে৷ রাষ্ট্রীয় নীতির ক্ষেত্রে দুদলের সমর্থকদের সংখ্যাগত তফাত্‍ও বেশ কম৷ কর ছাড়ের সর্বোচ্চ মাত্রা কত হবে, এ বিষয়ে দুদলের সমর্থন ৩৫ ও ৩৯.৬ শতাংশ৷ স্বাস্থ্যবীমাসহ অন্যান্য বিষয়েও একই অবস্থা৷ কিন্তু, আদর্শগত জায়গা থেকে দেখলে এই রাজনৈতিক বিভক্তিকে যৌক্তিক বলে মনে হয় না৷ রিপাবলিকানরা বুঝাতে চাইছে, ডেমোক্র্যাটরা আসলে সমাজতান্ত্রিক৷ ডেমোক্র্যাটরা বুঝাতে চাইছে, রিপাবলিকানরা আসলে সামাজিক ডারউইনবাদী এবং জঙ্গি সাম্রাজ্যবাদী৷ কিন্তু, এসব তর্কের মধ্যে আপনি কীভাবে প্রগতিশীল বিশ্বাস খুঁজে পাবেন? কার্যত দুই দলের সমর্থকদের মধ্যকার এ তিক্ত বিভক্তির গোড়ায় আছে দুই ধরনের উপাদান৷ একটি হলো দুই দল নিজেরা, আরেকটি হলো গণমাধ্যম৷ দল দুটির মধ্যে পেশাদারী বেড়েছে, বিভিন্ন প্রযুক্তির ব্যবহারও বেড়েছে৷ এসবের মধ্যদিয়ে তারা নিজেদের সমর্থকদের অংশত ধরে রাখতে সমর্থ হচ্ছে৷ আর গণমাধ্যমও এমনভাবে সংবাদ প্রচার করছে, যাতে মনে হচ্ছে, সবকিছু এ দুই দলকে কেন্দ্র করেই ঘটছে৷ ঘোড়দৌড়ের খবর যেমন সব পত্রিকা একই রকম করে প্রচার করে, এ ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটছে৷ গণমাধ্যম আর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের যৌথতায় এই প্রবণতা কেবল বেড়েছে৷ আমরা বাজারে অনেক পণ্যের তুলনা করে একটি নিতে চাইছি, কিন্তু পণ্যের প্রস্তুতকারকরা আগেই সব এক রকম করে রেখে দিয়েছেন৷ অধিকাংশ মার্কিনির মধ্যে দলের প্রতি আনুগত্য খুব নৈতিক নিরপেক্ষতা থেকে আসে না, তাদের টেনে নেয়া হয়৷ কর্মনীতি নিয়ে খুব বেশি বিতর্কও দেখা যায় না৷ দুই রাজনৈতিক দলের মূল আগ্রহের বিষয়টি এমন জায়গায়, যাতে কেউই কারো চেয়ে খুব কম বা বেশি ক্ষমতাবান হবে না৷ দুদলের মধ্যে একরকম ভারসাম্য থাকবে৷ কিন্তু, এজন্যও দল দুটির মধ্যে প্রতিযোগিতা চলছে৷ দুদলের বিতর্ক গড়াচ্ছে সমর্থকদের মধ্যেও৷ 
এখন ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের ওপর দায়িত্ব বর্তেছে, নিজেদের সম্পর্ক উন্নয়নের৷ দর্শন ও নৈতিকতার মৌলিক বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন৷ এর বাইরে নতুন কোনো উদ্যোগেরও হয়তো দরকার নেই৷ বারাক ওবামা ক্ষমতায় ফিরে এসেছেন৷ আগের বারের মতো এবারো তার পাশে থাকছে রিপাবলিকান কংগ্রেস ও ডেমোক্রেট সিনেট৷ রাজনৈতিক বিতর্কও হয়তো আগের মতো জারি থাকবে৷ রক্ষণশীল ও উদারপন্থীরা হয়তো রাজনৈতিক দর্শনের মৌলিক বিষয়গুলোতে পুরোপুরি একমত হবেন না৷ কিন্তু, আমেরিকান নেতাদের উচিত হবে তর্ককে রেষারেষির পর্যায়ে যেতে না দেয়া৷ সমর্থকদের মধ্যে এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হওয়া উচিত নয়, যাতে তাদের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে যায়৷ 
তথ্যসূত্র : অনলাইন

http://www.weeklymanchitra.com/details.php?id=2706&nid=13


ভেনটিকেল রামাকৃষ্ণন ● স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ২০১০ সালের নভেম্বরটা কলঙ্কিত হয়ে থাকবে। কারণ এ মাসে বেশ কয়েকটি দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে এবং ফলে এর সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। রাজনীতিক, সরকার, প্রশাসনিক ও প্রতিরক্ষা বিভাগের কর্মকর্তাদের একাধিক দুর্নীতির কেলেঙ্কারি এবং একই সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর লুটপাট ও দুর্নীতির প্রকাশ সারা দেশে অশান্ত পরিবেশের সৃষ্টি করেছে।

এ প্রক্রিয়ায় নামকরা রাজনৈতিক নেতা যেমন মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের অশোক চ্যাবন ও কেন্দ্রীয় টেলিযোগাযোগমন্ত্রী দ্রাবিড় মুন্নেত্রা কাঝাগাম দলের (ডিএসকে) এ রাজা পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অন্যদিকে কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী কেন্দ্রের প্রধান বিরোধী দল ভারতীয় জনতা পার্টির বিএসই ইয়েড্ডিউরাপ্পার পদে টিকে থাকার জন্য কৌশলগত জোর লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।

টু-জি স্পেকট্রাম বরাদ্দের দুর্নীতির সঙ্গে এ রাজার জড়িত থাকার অভিযোগের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের নীরবতা ও কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সুপ্রিমকোর্ট তার ব্যাপারে প্রশ্ন তুলেছেন। পার্লামেন্টের উভয় কক্ষের শীতকালীন অধিবেশন স্থবির হয়ে পড়েছে। কারণ বিরোধী দল টু-জি স্পেকট্রাম বরাদ্দের অভিযোগ তদন্তে যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটি গঠনের দাবি জানাচ্ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সিনিয়র ও মধ্যম স্তরের আমলাদের অবৈধ যোগাযোগের একাধিক দুর্নীতির ঘটনা মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। রিয়েল এস্টেট করপোরেশন, সরকারি খাতের ব্যাংক ও বীমা কোম্পানির কর্মকর্তারা গৃহনির্মাণ ঋণ প্রদানে যে কেলেঙ্কারি করেছেন তার বিবরণও মিডিয়ায় প্রকাশ পেয়েছে। ইতোমধ্যে দিল্লি কমনওয়েলথ গেমসের অবকাঠামো উন্নয়নে রাজনীতিক ও সরকারি কর্মকর্তাদের নেতৃত্বে পরিচালিত তদন্তে সন্দিগ্ধ যোগাযোগের বিষয়টা উঠে এসেছে। এমনকি গেমস পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট অন্যান্য বিষয়েও দুর্নীতির কাহিনী ক্রমাগতভাবে প্রকাশ পাচ্ছে। কোনো কোনো মিডিয়া এবং করপোরেট লবিস্টের মধ্যকার প্রশ্নবোধক যোগাযোগও এ সময় প্রকাশ পাচ্ছে। সংক্ষেপে বলা যায়, একাধিক দুর্নীতির বন্ধ করা গেট যেন খুলে দেওয়া হয়েছে।

মাত্রা, গভীরতা ও ব্যাপকতার দিক থেকে প্রকাশিত দুর্নীতির এসব কেলেঙ্কারি নজিরবিহীন। টু-জি স্পেকট্রাম বরাদ্দের দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের পর কম্পট্রোলার ও অডিটর জেনারেলের রিপোর্টে বলা হয়, সুবিধা পাওয়া এবং সীমা লঙ্ঘনের জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষতির পরিমাণ ১ লাখ ৭৬ হাজার কোটি রুপি।

মহারাষ্ট্রের আদর্শ হাউজিং সোসাইটি কেলেঙ্কারি থেকে রাজনীতিক, বিল্ডার্স লবি ও প্রতিরক্ষা কর্মকর্তাদের শুধু অশুভ অাঁতাতই প্রকাশ পায়নি, বরং সিনিয়র রাজনীতিক এবং প্রতিরক্ষা কর্মকর্তারা সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করতে বিবেকের দংশনও অনুভব করেননি। এমনকি ব্যাপকভাবে সমৃদ্ধশালী হওয়ার জন্য তারা সেনাবাহিনীর শহীদদের উপেক্ষা করতেও ইতস্তত করেননি। হাউজিং ঋণ কেলেঙ্কারিতে সরকারি খাত, ব্যাংকের কর্মকর্তা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা জড়িত তার পুরো বিষয় প্রকাশ করতে কেন্দ্রীয় তদন্ত ব্যুরোর কয়েক মাস লাগতে পারে। তবে এতে কোনো সন্দেহ নেই যে, এ ঘটনায় বেশ কয়েক কোটি রুপির দুর্নীতি ঘটেছে। ইয়েড্ডিউরাপ্পার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগের মধ্যে আছে তার দুই ছেলে বি ওয়াই রাঘবেন্দ্র, বি ওয়াই বিজয়েন্দ্র ও জামাতা আর এন সোহানকুমার চুক্তির অংশ হিসেবে বেলারিভিত্তিক খনি ফার্ম থেকে ২০ কোটি রুপি গ্রহণ করেছেন। এর সঙ্গে জড়িত আছে ব্যাঙ্গালুরুর অত্যন্ত উচ্চ শ্রেণীর তথ্য-প্রযুক্তি পার্কের ছয় একর প্লট বিক্রির বিষয়।

কমনওয়েলথ গেমসে জড়িত কথিত দুর্নীতির সঙ্গেও কয়েকশ' কোটি রুপির দুর্নীতি আছে। এসব দুর্নীতির সঙ্গে বিভিন্ন বিষয় জড়িত। যেমন অতি উচ্চমূল্যের তরল সাবান বণ্টন ও গোলাকার বেল্ট কেনা, নিয়ম না মেনে ব্রডকাস্টিং অধিকার অনুমোদন এবং তফসিলি শ্রেণী ও তফসিলি উপজাতিদের সরিয়ে নেওয়ার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অজানা একটি ব্রিটিশ ফার্মকে প্রদান, যে বিষয়ে ব্রিটিশ সরকার নিজেই প্রশ্ন তুলেছে। সার্বিক ধরনের এ দুর্নীতির বিষয়টা আরো বেশি করে প্রকাশ পেয়েছে নভেম্বরে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক অ্যাডভোকেসি গ্রুপ গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির এক গবেষণাপত্রে। ওই গবেষণাপত্রের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো, কয়েক বছরে দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও ব্যবসায়ে মূল্য কারচুপির জন্য ভারত হাজার হাজার কোটি ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ওই গবেষণার নেতৃত্বে ছিলেন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটির প্রধান অর্থনীতিবিদ দেব কর। তিনি বলেন, দুর্নীতি, কর ফাঁকি ও ব্যবসায়ে মূল্য কারচুপির চক্রবৃদ্ধি প্রক্রিয়ায় ভারতের বাইরে নির্দিষ্ট গন্তব্যস্থানে অবৈধভাবে অর্থ পাচার হয়েছে ক্রমবর্ধমানভাবে।

গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্টে তাৎপর্যভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, এ প্রক্রিয়া জোরদার হয় ১৯৯১ সালে ভারত তার অর্থনৈতিক সংস্কারের পথ গ্রহণ করার পর। রিপোর্টের হিসাব অনুযায়ী স্বাধীনতার পর অবৈধভাবে অর্থ পাচারের শতকরা ৬৮ ভাগ সংঘটিত হয়েছে ১৯৯১ সালের পর। আগে অবৈধভাবে অর্থ পাচারের হার ছিল শতকরা নয় দশমিক এক ভাগ, কিন্তু অর্থনৈতিক সংস্কার বা মনমোহন সিংয়ের নেতৃত্বে নয়া উদারবাদী নীতি গ্রহণের পর শতকরা ওই হার দাঁড়ায় ১৬ দশমিক চার ভাগ। ওই রিপোর্টের হিসাবে বলা হয়, ২০০২ থেকে ২০০৬ সালের মধ্যে প্রতিবছর ভারত গড়ে এক হাজার ৬০০ কোটি ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

একের পর এক দুর্নীতি প্রকাশ এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্ট সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে সাবেক আমলা ও পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এসপি শুকলা বলেন, দুর্নীতি কেলেঙ্কারির বিস্ফোরণ এবং গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিগ্রিটি রিপোর্টে উল্লেখিত অবৈধভাবে অর্থ পাচার সম্পর্কে বিস্ময়ের কিছু নেই। তিনি বলেন, প্রথমে একজন আমলা এবং পরে সমাজ ও সরকারের একজন সক্রিয় পরিদর্শক হিসেবে আমার অভিজ্ঞতা থেকে আমি দেখেছি কীভাবে এই দুর্নীতির প্রক্রিয়া আবর্তিত হয়। অর্থনৈতিক সংস্কার-পরবর্তী যুগে দুর্নীতির ধারাবাহিক বৃদ্ধির মূল কারণ হলো, সরকারের অভ্যন্তরে বাজার অনুপ্রবেশ করে। এ সময় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো নীতি ও সরকারি আদান-প্রদানের মূল্য নির্ধারণ করতে শুরু করা। তারা শুধু নির্দিষ্টভাবে কর্মকর্তা বা রাজনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ এবং তাদের কাজে হস্তক্ষেপ নয়, বরং সামগ্রিকভাবে রাজনৈতিক দল ও পদ্ধতির ওপর হস্তক্ষেপ করে। পদ্ধতির বিষয়ে হস্তক্ষেপ সম্পর্কে শুকলা টু-জির আগে মোবাইল সার্ভিসের নিলামের কথা উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বিজেপির নেতৃত্বে পরিচালিত ন্যাশনাল ডেমোক্র্যাটিক অ্যালায়েন্স সরকার প্রাথমিক পর্যায়ে নিলাম করে এবং একাধিক করপোরেট প্রতিষ্ঠান তাদের নিজ নিজ এলাকায় দরপত্র দাখিল করে কাজ পায়। কিন্তু যখন তারা দেখতে পায় যে, দরপত্রে উল্লেখিত অর্থ তারা তুলে আনতে পারবে না তখন তারা লাইসেন্স ফি পদ্ধতিতে ফিরে আসার জন্য সরকারকে বাধ্য করে। লাইসেন্স ফি পদ্ধতিতে তাদের অনেক কম অর্থ দিতে হয়। শুকলা আরো উল্লেখ করেন, অর্থনৈতিক সংস্কারপ্রক্রিয়াকে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এবং বড় বড় মিডিয়া ব্যাপকভাবে প্রশংসা করে। মনে হয় ওই প্রক্রিয়া 'দুর্নীতিপরায়ণ' লাইসেন্স-পারমিট সরকারের কাছ থেকে যেন ভারতকে মুক্ত করে দিয়েছে। কিন্তু গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, এই প্রক্রিয়ায় দুর্নীতির পথকে শুধু পরিবর্তন করেছে এবং এর মাত্রা গভীরতর ও তা পাওয়ার পথকে সহজ করে দিয়েছে।

ফ্রন্টলাইনকে শুকলা বলেন, ''লাইসেন্স-পারমিট সরকারের আমলে দুর্নীতির আদান-প্রদান গোপনে হতো এবং এর সঙ্গে লজ্জার বিষয় জড়িত ছিল। কিন্তু সংস্কারের সঙ্গে সঙ্গে দুর্নীতি অনুপ্রবেশ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে। ফলে গোপনে আদান-প্রদান ও লজ্জার অনুভূতি একেবারেই অদৃশ্য হয়ে যায়। আসলে রাজনৈতিক শ্রেণী ও আমলাদের কাছে দুর্নীতি তখন একটা গ্রহণীয় বিষয় হয়ে পড়ে । দুর্নীতিকে এখন তাদের আর বৈধ করতে হয় না।

ক্ষমতাসীন কংগ্রেস ও বিরোধী দল বিজেপি যখন কোনো দুর্নীতির অভিযোগের মুখোমুখি হয় তখন যে ধরনের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তা থেকে তার পর্যবেক্ষণের সমর্থন পাওয়া যায়। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয় তাদেরকে প্রথমে রক্ষার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়। অতঃপর বিভিন্ন ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় যার লক্ষ্য হলো দুর্বোধ সৃষ্টি করা। দুর্নীতির অভিযোগ বেশি হওয়ার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। তবে এ ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়ার পর ওই ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে রাজনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ কম হয়েছে। নভেম্বরে একের পর এক দুর্নীতির কেলেঙ্কারি প্রকাশ হওয়ার পর অতীতের মতো একই রকম ধারা পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংসহ কংগ্রেস নেতৃত্ব এ রাজা এবং অশোক চ্যাবনকে বিরাট রকম ছাড় দিয়েছেন। তারা এ কারণে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন-তাদের পদত্যাগ করা ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকার অন্য কোনো উপায় ছিল না।

আসলে রাজার প্রতি অসাধারণভাবে উদারতা দেখানো হয়। তার বিরুদ্ধে তদন্তের বিষয়টা ১৫ মাস বিলম্বিত করা হয় এবং এ কারণে সুপ্রিমকোর্ট প্রধানমন্ত্রীর আচরণ নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপন করেন। এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, কংগ্রেস ও তার নেতৃত্বাধীন সরকার দুর্নীতির অভিযোগ সম্পর্কিত বিষয়ে দুর্বোধ্যতার সৃষ্টি করেছে। মনমোহন সিংয়ের পক্ষে সুপ্রিমকোর্টে পেশকৃত এফিডেভিটে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর অফিস শুধু কেন্দ্রীয় আইন মন্ত্রণালয়ের পরামর্শ অনুসরণ করেছে। ওই পরামর্শে বলা হয়, জনতা পার্টি নেতা সুব্রামনিয়াম স্বামী রাজার বিরুদ্ধে মামলা করার যে অনুমোদন চেয়েছেন সে সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য টু-জি স্পেকট্রাম বরাদ্দের বিষয়ে সিবিআইয়ের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হোক। প্রধানমন্ত্রীর কাছে স্বামী যে চিঠি দিয়েছেন সে সম্পর্কে আইন মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যা ওই এফিডেভিটে দেওয়া হয়।

ইয়েড্ডিউরাপ্পার বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে সে বিষয়ে বিজেপির কর্মধারাও ভিন্ন কিছু নয়। পার্টির জাতীয় নেতৃত্ব একসময় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন, মুখ্যমন্ত্রীকে পদত্যাগ করার জন্য বলা হবে এবং এই সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য তাকে দিল্লি ডেকে পাঠানো হয়। কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী কর্নাটক রাজনীতিতে তার ব্যাপক প্রভাবকে কাজে লাগিয়ে ওই সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করতে থাকেন। পরে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব থেকে সরে এসে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে অভ্যন্তরীণ তদন্তের কথা বলেন। একইভাবে বিজেপি উত্তরখন্ড মুখ্যমন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিশাঙ্কের বিরুদ্ধে অভিযোগের ক্ষেত্রে নমনীয় দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে। ওইসব অভিযোগের মধ্যে ছিল ৫৬টি হাইড্রো-ইলেকট্রিক প্রকল্পে অনিয়ম এবং ৪০০ কোটি রুপির ১৫ একরের শিল্প প্লট মাত্র তিন কোটি রুপিতে একটি রিয়েল এস্টেট ডেভলপারের কাছে বিক্রি করা। স্পষ্টত এ থেকে লক্ষ্য করা যায়, প্রধান ধারার মূল রাজনৈতিক দলগুলো অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়ে শুধু একই রকম দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না, দুর্নীতির বিষয় নিষ্পত্তির ক্ষেত্রেও তারা একই রকম মনোভাব পোষণ করে।

ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিআই-এম) পলিটব্যুরোর সদস্য সীতারাম ইয়েচুরি হিন্দুস্তান টাইমসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে বলেন, টু-জি স্পেকট্রাম কেলেঙ্কারি বিষয়ে তদন্তের জন্য যৌথ পার্লামেন্টারি কমিটি গঠনের দাবি নিয়ে পার্লামেন্টে বর্তমানে যে অচলাবস্থা চলছে তা থেকে স্পষ্ট হয় যে, ভারত পুঁজিবাদের অনুসঙ্গকে লালন করতে না পারার ঘোষণা সত্ত্বেও দেশকে পুঁজিবাদের অনুসঙ্গের গভীর ও অস্পষ্ট জলাভূমিতে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে।

http://budhbar.com/?p=3708


দুর্ঘটনার ২৬ বছর পর ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি মামলার প্রাথমিক পর্যায়ের রায় হয়েছে। রাজ্য আদালতের রায়ে দায়ী কোম্পানির মূল কর্ণধাররা পার পেয়ে গেছেন। সাজা পেয়েছেন কোম্পানির মধ্যমসারির কয়েকজন কর্মকর্তা। সাজার পরিমাণও ২০ হাজার মানুষের প্রাণ ও হাজার হাজার মানুষের ক্ষতিগ্রস্ততার তুলনায় নস্যিতুল্য। মাত্র ২৫ হাজার রুপি করে জরিমানা এবং ২ বছরের জেল। কিন্তু যেহেতু মামলাটি উচ্চ আদালতে আপিল হবে সেজন্য দায়ীরা জামিনে মুক্ত। কিন্তু তৎকালীন ইউনিয়ন কার্বাইডের প্রধান অ্যান্ডারসনকে যেভাবে পার করা হয়েছে এবং এর মধ্য দিয়ে বহুজাতিক করপোরেট বাণিজ্যের সঙ্গে ভারতীয় শাসক সম্প্রদায়ের যোগসূত্র ও গাটছড়ার যে বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে তাতে ভারতীয় বুদ্ধিজীবী মহল আশঙ্কা করছেন, দেশটির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই ধ্বংস হয়ে যেতে বসেছে। বহুজাতিক করপোরেট ব্যবসায়ী ও ভারতীয় শাসক সম্প্রদায়ের এই মেলবন্ধন বিনিয়োগ ও উন্নয়নের ধুয়া তুলে কোটি কোটি ভারতবাসীকে বঞ্চনা ও দারিদ্রে্যর শিকারে পরিণত করছে। এই ক্ষোভের প্রকাশ ঘটেছে ভারতের দন্ডকারণ্যে। রাষ্ট্রের তিন স্তম্ভ বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আমলাতন্ত্র একজোট হয়ে যে গণতন্ত্র বিনাশী পথে এগিয়ে চলেছে তারই দৃশ্যমান নমুনা ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডি ঘটনার পরম্পরা। বিষয়টিকে বোঝার জন্য এখানে ভারতের প্রভাবশালী দৈনিক ডেকান হেরাল্ডে প্রকাশিত প্রখ্যাত দুই সাংবাদিক কুলদীপ নায়ারের 'কংগ্রেস, পয়লা নম্বরের অপরাধী' ও এম জে আকবরের 'ধ্বংসাত্মক নীরবতা' শিরোনামের দুটি লেখা প্রকাশ করা হলো।

কংগ্রেস, পয়লা নম্বরের অপরাধী : কুলদীপ নায়ার

ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির বিবরণ প্রকাশিত হওয়ার মধ্য দিয়ে ভারতের গণতান্ত্রিক প্রশাসন ব্যবস্থার স্বরূপ পুনর্বার উন্মোচিত হচ্ছে। বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আমলাতন্ত্রের মধ্যে এক অবিচ্ছেদ্য অর্থনৈতিক বন্ধন রয়েছে। এই তিনে মিলেই (ভুপাল) গ্যাস প্ল্যান্টের স্বত্বাধিকারী ইউনিয়ন কার্বাইডের চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসনকে চলে যেতে সাহায্য করেছিল। এরাই কোম্পানির প্রতিশ্রুত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ কমিয়ে আনে এবং আদালতের রায় ২৬ বছর পর্যন্ত বিলম্বিত করে।

এটা সেই জরুরি অবস্থার মতো যা (এই ঘটনার) এক দশক আগে জারি করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন মৌলিক অধিকারকে অস্বীকার করে প্রশাসনিক ব্যবস্থার ওপর আঘাত হেনেছিলেন। এটা সেই একই গল্প : বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ ও আমলাতন্ত্র কর্তৃত্ববাদী শাসন কায়েমের জন্য এক সূত্রে গ্রথিত হয়ে গিয়েছিল। গণতান্ত্রিক সংবিধানকে সামান্যই তোয়াক্কা করা হয়েছিল। আসলে রাষ্ট্রীয় অঙ্গসংগঠনগুলোকে কর্তৃত্ববাদী শাসনের যথেচ্ছাচারের অংশ বিশেষ করে ফেলা হয়েছিল।

দুটো ক্ষেত্রেই কেন্দ্রে এবং যে মধ্যপ্রদেশে গ্যাস প্ল্যান্টটি অবস্থিত সেখানে বর্তমান শাসক দল কংগ্রেস ক্ষমতাসীন ছিল এবং দুটো ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীদ্বয় ইন্দিরা গান্ধী এবং তার ছেলে রাজীব গান্ধী- আইন নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন এবং গণতান্ত্রিক কাঠামোতে যে গভীর ক্ষত সৃষ্টি করা হয়েছিল সেই প্রবল মুষ্ঠাঘাত থেকে মুক্ত হতে আজও চেষ্টা চলছে।

অ্যান্ডারসনকে চলে যেতে দেওয়ার জন্য রাজীব রাজ্য মুখ্যমন্ত্রী অর্জুন সিংকে আদেশ দিতে বলেছিলেন। একে কংগ্রেসের শীর্ষ পর্যায়ের একজন নেতা 'মার্কিন চাপ' বলে ধারণা দিতে চেয়েছেন। রাজীব যদি মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে আলোচনা করেও থাকেন তা করেছিলেন আদেশ দানের পর। ইন্দিরা গান্ধীও জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন নিজে থেকে। মন্ত্রিপরিষদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলেন এর পর।

দুটো ঘটনাতেই দেখা যায়, বিচার বিভাগ, নির্বাহী বিভাগ এবং আমলাতন্ত্রকে এক পায়ে এক লাইনে দাঁড় করাতে সেনাবাহিনী এগিয়ে আসেনি। প্রধানমন্ত্রীরাই প্রয়োজনীয় জবাবদিহিতার সব নিয়মনীতি লঙ্ঘন ও আইন ভঙ্গ করার মতো ক্ষমতা নিজেদের কুক্ষিগত করেছিলেন। পাকিস্তানে জেনারেল আইয়ুব যেমন তার ক্ষমতা গ্রহণকে প্রধান বিচারপতি মুনিরের 'দ্য ডকট্রিন অব নেসেসিটি'র মাধ্যমে বৈধ করেছিলেন, সেই একইভাবে জরুরি অবস্থার মাধ্যমে ইন্দিরা তার কর্তৃত্ববাদী শাসনকে সুপ্রিমকোর্টে ৫-১ রায়ে বৈধ করে নিয়েছিলেন। এসব দৃষ্টান্ত নির্দেশ করে যে, বিচারপতিরা 'অন্য সব বিবেচনায়' বেসামরিক আমলাদের মতোই কারো নির্দেশ দ্বারা পরিচালিত হন। তারা সরকারের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে ভীরুতা প্রদর্শন করেন। প্রধান বিচারপতি এএইচ আহমদি ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির দায়ীদের দোষ স্খলনের ধারাটি হালকা করে দেন। তিনি ভারতীয় পেনাল কোডের ৩০৪ ধারা যাতে দোষী হলে সাজা ১০ বছরের জেল থেকে ৩০৪-এ ধারা যাতে সর্বোচ্চ সাজার পরিমাণ ২ বছরের জেল এ পরিবর্তন করেন।

অন্যদিকে সিবিআই কর্মকর্তাসহ আমলাতন্ত্রও বড় বেশি দুর্ভাগা ও বাধিত হয়ে পড়ে। তারা প্রস্ত্তত হয়ে যায় যখন যে দল ক্ষমতাসীন হয় তার 'সেবা' করতে। সময়ের তালে এরা বিবেকের তাড়না যদি সত্যিই থাকে তা বিসর্জন দেয় এবং ভয় ও অনুকম্পাহীন সেবা প্রদানের মহত্তম আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়।

মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ : এটা খুবই কৌতুকজনক ছিল যে, একই ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপার গ্যাস ট্র্যাজেডির পর ভুপালে আসা অ্যান্ডারসনকে আটক করেন, তারাই আবার তাকে পাহারা দিয়ে বিমানবন্দরে নিয়ে গিয়ে রাষ্ট্রীয় বিমানে তুলে দেন চলে যাওয়ার জন্য। তাদের কার্যকরণের এই পার্থক্য ঘটে মুখ্যমন্ত্রীর আদেশে। এ দুজনের একজনও সংবিধান ও দেশের সংহতিকে সমুন্নত রাখার জন্য যে শপথবাক্য পাঠ করেছেন তা রক্ষা করতে সচেষ্ট হননি।

আমি একই বিষয় লক্ষ্য করেছি পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলংকা এবং নেপালের বেলায়। শাসককেই গণ্য করা হয়েছে, আইনকে নয়। আমলাদের অন্তর থেকে নীতিগত বিবেচনা বোধ যেন উবে গেছে এবং অনেক ক্ষেত্রেই তাদের মানসিক বিবেচনাবোধ রহিত হয়ে গেছে। তাদের সামনে যখন যে সমস্যা আসে তা কীভাবে মোকাবিলা করলে রক্ষা পাওয়া যাবে সে দুশ্চিন্তাতেই তারা সব সময় তাড়িত হন।

জবাবদিহিতার একমাত্র উপায় হচ্ছে একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিয়ম ভঙ্গকারী যাতে পার না পায় তার উদ্যোগ নেয়া। কিন্তু আমি কখনো দেখলাম না, একজন ভ্রান্ত বিচারক, একজন কালিমালিপ্ত মন্ত্রী কিংবা একজন অপরাধী আমলা শাস্তি পেয়েছেন। তারা সবাই একই দেয়ালের ইট। যে কোনো ট্রাইব্যুনালের সামনে তারা একাট্টা হয়ে যান পরস্পরকে রক্ষা করতে।

বাস্তবে কংগ্রেস তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর কাঁধে সব দোষ চাপিয়েছে। এই মুখ্যমন্ত্রীও একজন কংগ্রেসী। এমনকি দল যদি দায় এড়িয়েও যেতে চায় – যেমনটি ইন্দিরা গান্ধীকে বাঁচানোর জন্যও করা হয়েছিল, তারপরও মূল্যবোধ বলে একটা কথা থাকে। সত্যি, আজ রাজনৈতিক দলগুলো মূল্যবোধের বিকল্প হিসেবে ক্ষমতাকেই বেছে নিয়েছে। তবে এক্ষেত্রে তারা যেন মাওবাদী অথবা তালিবানদের মতো মরিয়া হওয়া কোনো শক্তির সহিংসতার জন্য প্রস্ত্তত থাকে।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদাম্বরমকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়েছেন 'গ্রুপ অব মিনিস্টার'-এর সভাপতি হিসেবে এবং ভুপাল গ্যাস ট্র্যাজেডির বিচার কাজ দেখভাল করতে। অথচ তিনিই অর্থমন্ত্রী হিসেবে ইউনিয়ন কার্বাইডের ক্রেতা ডাউ কেমিক্যাল যাতে দায় এড়িয়ে যেতে পারে তার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সব সমালোচনাকে চিৎকার করে থামিয়ে দিতে শাসক কংগ্রেস দল ক্ষমতার দম্ভকেই কাজে লাগাচ্ছে। এর উচিত নিজের দায়দায়িত্ব স্বীকার করে নিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাওয়া। নিদেনপক্ষে কংগ্রেস এই হাজার হাজার ক্ষতিগ্রস্ত যারা এখনো নীরব রয়েছেন তাদের এখনই পুনর্বাসনের পদক্ষেপ নিতে পারে। কংগ্রেসের উচিত অতীত থেকে শিক্ষা নেওয়া। নাহলে তাদের জন্য অপেক্ষা করছে পরাজয়ের গ্লানি।

এরপরও যদি জাতি একটি গণতান্ত্রিক সমাজের মৌলিক মূল্যবোধগুলো সংরক্ষণ করে তাহলে প্রত্যেক নাগরিক তা তিনি সরকারি লোকই হোন অথবা সাধারণ নাগরিকই হোন তাকে অবশ্যই সচেতন হতে হবে এবং আত্মনিবেদনের ইচ্ছায় জাগরুক হতে হবে। কোনটি সঠিক, সে সম্পর্কে সচেতন না হলে কোনটি বেঠিক তা বোধগম্য করা সম্ভব নয়।

ধ্বংসাত্মক নিরবতা : এম জে আকবর

ভুপাল নিয়ে ছলনার ব্যাপারে যে নীরবতা তার নিচে ধূমায়িত যে ক্রোধ সঞ্চারিত হচ্ছে তা কি দেখতে পাচ্ছেন? ভারতের সবচেয়ে ক্ষমতাধর তিন ব্যক্তিত্ব- প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং, সোনিয়া গান্ধী এবং হবু প্রধানমন্ত্রী রাহুল গান্ধী ২৬ বছর আগে ঘটে যাওয়া গণহত্যার প্রথম ধাপের বিচার বিভাগীয় রায় নিয়ে যে জাতীয় অসন্তোষ দেখা দিয়েছে সে ব্যাপারে একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি।

এটা সত্যি, নীরবতাও একটা বিবৃতি, তবে তা বন্দি প্রশ্নের ঘেরাটোপে। সম্ভবত তারা এ ব্যাপারে বড় বেশি নীরব। শীর্ষ পর্যায়ে এ ধরনের নীরবতা কংগ্রেসের জন্য স্বাভাবিক নয়। জনমতের চাপের কাছে দ্বিতীয়সারির নেতারা পুরো বিষয়টিকে অযাচিতভাবে বড় বেশি এলোমেলো করে ফেলেছেন। মোসাহেবি বা চামচাপনা কখনো স্বচ্ছতার সমার্থক হতে পারে না। কংগ্রেসীদের মাত্র একজন যিনি কিছু বলতে উদ্যোগী হয়েছিলেন কিন্তু উচ্চকণ্ঠে ধমক দিয়ে তাকে বলা হয়েছে, চুপ থাকো।

বাচালতা এমন কোনো কাজ নয় যা সব সময়ই আপনার জন্য সুখকর সংবাদ বয়ে আনবে। জয়রাম রমেশ, যিনি তার চুলের মতোই কণ্ঠকেও ভালোবাসেন। তিনি মনে করেছিলেন ভুপালে তার গ্রিন ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের ঘোষণা দিয়ে (কংগ্রেসকে এবং ক্ষতিগ্রস্তদের) সাহায্য করবেন। এতে তিনি একমাত্র মিডিয়াকে এই তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছেন ভুপালে পরিবেশমন্ত্রী হিসেবে এটাই তার একমাত্র সফর। সেখানে তার বক্তব্য বরং ক্ষতিগ্রস্তদের মনে ক্ষোভেরই জন্ম দিয়েছে। রমেশ বিজয়ের সুরে বলেছিলেন, 'আমি বিষাক্ত বর্জ্য হাতে নিয়েছি। আমি এখনো বেঁচে আছি এবং কাশছি না। গ্যাস ট্র্যাজেডির ২৫ বছর পার হয়ে গেছে। আসুন আমরা এগিয়ে যাই।'

জাতির কী সৌভাগ্য যে রমেশ ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরের সে রাতে ভুপালের একটি বস্তিতে ঘুমাননি যখন ইউনিয়ন কার্বাইডের প্ল্যান্ট থেকে মিথাইল আইসোসাইয়ানাইড নির্গত হচ্ছিল যা প্রায় ২০ হাজার মানুষকে হত্যা করে এবং আরো প্রায় ১ লাখ মানুষকে মৃতপ্রায় করে তোলে! আমরা অবশ্যই ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দেব যে, রমেশ কোনো অজানা মাতৃগর্ভের ভ্রূণ হিসেবে মারা যাননি। অথবা তিনি বিকলাঙ্গ এবং অন্ধকার ও ক্রোধান্বিত চোখের এক যুবক হিসেবে ২৬ বছরে পা রাখেননি যাকে তার মা ভালোবাসার অসহায়ত্বর শালে জড়িয়ে রাখেননি।

কী সৌভাগ্য যে, রমেশের কখনো রঘু রাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ ঘটেনি। এই মহান ও সংবেদনশীল চিত্র গ্রাহক যিনি ভারত সরকার তার শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্র এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মানবাধিকারের প্রতি মহান অঙ্গীকার নিয়ে যা করতে পারেননি তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি করেছেন। তবে আসুন আমরা হাসির ঝিলিকের আড়ালে বিষাক্ত মাটি ছুঁয়ে এগিয়ে যাই!

ভুপালের মূল সত্যটি হচ্ছে ধৃষ্টতাপূর্ণ ছলনার রূপক কাহিনী যাতে ভারতীয়দের ক্ষোভ উপেক্ষা করে মার্কিনি করপোরেট স্বার্থকে সাহায্যকারী যে কেউই পুরস্কৃত হওয়ার যোগ্য। সরকারি বিমানে ওয়ারেন অ্যান্ডারসনকে পালিয়ে যেতে সাহায্য করার মধ্য দিয়ে লজ্জায় ম্রিয়মাণ হওয়া শুরু তবে এটা গল্পের শেষ নয় শুরুমাত্র।

দন্ডযোগ্য নরহত্যা : ১৯৮৭ সালে সিবিআই-এর চার্জশিট প্রদানকারী দন্ডযোগ্য নরহত্যার জন্য ১০ বছরের জেল সাজার আবেদন করেছিলেন। প্রধান বিচারপতি এএইচ আহমদি জলন্ত এই আগুনে পানি ঢেলে সাজার মেয়াদ যাতে কম হয় সে ব্যবস্থা করেন। এটা অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, একজন মুসলমান প্রধান বিচারপতিকে এমন একটি মামলায় চূড়ান্ত সমঝোতায় ব্যবহার করা হয়েছে যার অধিকাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন দরিদ্র মুসলমান। আহমদিকে অবসর গ্রহণের পর লোভনীয় পুরস্কারও প্রদান করা হয়েছে।

ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে যদিও বন্দিবিনিময় চুক্তি রয়েছে, তারপরও অ্যান্ডারসনকে মামলা মোকাবিলা করতে ভারতে আনার মতো ঝামেলা তাকে কখনো পোহাতে হবে না। তার জামিনের বন্ড মাত্র ২৫ হাজার রুপি। এটা ঠিক সেই পরিমাণ যা ২৬ বছর পর মামলার রায়ে দোষীদের জরিমানা করা হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে ভারত সরকারের ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রথম দাবি ছিল ৩৩০ কোটি রুপি। পরে এটা সমঝোতা হয় মাত্র ৪৮ কোটি রুপিতে।

সময়ে সময়ে টোকেন হিসেবে যৎসামান্য কিছু ছিটিয়ে দেওয়া হয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র মানুষের সামনে। এর সর্বশেষ দৃষ্টান্ত হচ্ছে পি চিদাম্বরমকে প্রধান করে গ্রুপ অব মিনিস্টারস পুনর্গঠন। চিন্তা করুন, এর আগে কে ছিলেন গ্রুপ অব মিনিস্টারসের প্রধান? অর্জুন সিং। এবং চিদাম্বরমের ঝোলায় কোন সুনাম সংরক্ষিত? অর্থমন্ত্রী হিসেবে তিনি কমল নাথ, মন্টেক সিং আহলুয়ালিয়া এবং রনেন সেনের সঙ্গে ডাউ কেমিক্যালের পক্ষে লবি করেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে লোভনীয় মুচলেকা দেন, ডাউ কেমিক্যালকে দায়মুক্ত করলে মার্কিন বিনিয়োগ পাওয়া যাবে। ডাউ সত্যিকার অর্থে কেন এখানে আবার ফেরত আসতে চেয়েছিল? কারণ কোম্পানিটি কার্বাইড কিনেছিল। ভুপাল ট্র্যাজেডির দায় এড়িয়ে এবং সে চেয়েছিল ভারতে কার্বাইডের যে স্থাবর সম্পত্তি রয়েছে তা ফেরত পেতে। ডাউ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অন্য একটি মামলায় অ্যাসবেস্টসে ক্ষতিগ্রস্ত মার্কিনিদের জন্য ২০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রেখেছে, কিন্তু ভারতীয়দের জন্য তার কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই।

এটা কেন? ভারতীয়দের জন্য ভারতীয়দের কোনো অর্থের দাবি নেই। নতুন গ্রুপ অব মিনিস্টারসে জয়রাম রমেশও অবশ্যই একজন সদস্য। তারা সম্ভবত কংগ্রেস মুখপাত্র অভিষেক সিংভিকেও গ্রুপ অব মিনিস্টারসে রাখতেন যদি তিনি মন্ত্রী হতেন। কারণ সিংভি ছিলেন ডাউ কোম্পানির আইনজীবী এবং কংগ্রেস প্যাডে তিনি ডাউয়ের জন্য তদবির করেছিলেন। কার্বাইড জানতো গ্যাস নিঃসরণের বিপদের মাত্রা কতটা, কিন্তু এটা জেনেও তারা প্রতিরোধের জন্য কিছু করেনি এবং এই সত্যটি ভারতীয় পক্ষ এড়িয়ে গেছেন।

এ ব্যাপারে বড় বেশি নীরবতা চলছে। দ্বিদলীয় ব্যবস্থার অবজ্ঞার শিকার ক্ষতিগ্রস্তদের পক্ষে যে স্বেচ্ছাসেবীরা বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম করছেন তারা বিবেকের তাড়নাতেই করছেন কোনো রকম পুরস্কারের আশা না করেই। আমি কি স্বপ্ন দেখছি অথবা এমন দিন কি আসবে যেদিন প্রতিটি ভারতীয়ের বিবেকে ভুপালের ঘটনা দাগ কাটবে?

http://budhbar.com/?p=1909


ছোট্ট অগ্নিশিখা কবে দাবানলের রূপ নেবে

Ahmed.Rafiq's picture

কোনো মতাদর্শের রাজনীতিতেই বাড়াবাড়ি সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ বাড়াবাড়ির ফল কখনো ভালো হয় না। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র নিয়ে প্রশস্তিবাচনের পাশাপাশি পরোক্ষে এ কথাটা রবীন্দ্রনাথ বুঝিয়ে দিতে চেয়েছিলেন সোভিয়েত নীতিনির্ধারকদের। সেসব কথা সমাজতন্ত্রীরা বোঝেননি। বোঝার কথা নয় গণতন্ত্রের লেবেল-আঁটা ধনতন্ত্রী তথা সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলোর। দীর্ঘ সময় ধরে ভিত পোক্ত করা ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্রী দুনিয়ার পতনের পর মহাদাপটে বিশ্ব শাসন করে আসছিল। এবার অর্থনৈতিক মন্দা কিছুটা হলেও শিকড় ধরে টান দিয়েছে বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রিক ব্যবস্থায়।
ধনতন্ত্রের পতন তার আপন নিয়মে, ক্রিয়াকলাপের বদৌলতে এমন তত্ত্ব মানি বা না মানি এটা সত্য যে লোভ ও আগ্রাসন সাময়িক সুফল দেখালেও আগ্রাসী রাজনীতির পরিণাম শেষ পর্যন্ত সুফল আনে না। বিশ্বে অর্থনৈতিক মন্দা আগেও দেখা দিয়েছে, যেমন তিরিশের দশকের শুরুতে, সঠিকভাবে বলতে গেলে আরো বছর কয়েক আগে।

সে মন্দার বরপুত্র হিসেবে জার্নাল রাজনীতিতে আবির্ভূত অ্যাডলফ হিটলার সাম্রাজ্যবাদী বা আধিপত্যবাদী রাজনীতিকে ভয়াবহ রকম অমানবিক (আসলে মানববিদ্বেষী) মেরুতে পেঁৗছে দিয়েছিলেন। হত্যা, গুম ও নির্যাতনের রাজনীতি থেকে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনের বিশ্বপরিক্রমা, কিন্তু টেকেনি সে আধিপত্যবাদ। অবশ্য তাঁর লোভের আগুনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা, আর সে আগুনে হিটলারসহ ফ্যাসিস্ট রাজনীতি পুড়ে ছাই।

অবশ্য এখন আণবিক-পারমাণবিক অস্ত্রের কল্যাণে বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা নেই বললে চলে। সে জায়গা দখল করে নিয়েছে আঞ্চলিক যুদ্ধ_প্রধানত বিশ্ব পরাশক্তির আগ্রাসী চেতনার খাঁই মেটাতে। তাতে লুটপাটের কমতি নেই, কোষাগার ভরে তোলার চেষ্টা ভালোভাবেই চলছে। কিন্তু যুদ্ধের ব্যয়জনিত ঘাটতি মেটানো বলে একটা কথা আছে না?

সে ঘাটতি মেটাতে আরো যুদ্ধ, আরো ব্যয়। নীতিগত প্রতিষ্ঠার জন্য ও যুদ্ধ বা অন্য খাতে ব্যয়ও তো কম নয়। তাই অর্থনৈতিক সংকট। কোনো সরকার বা রাষ্ট্র যদি মর্মে মর্মে যুদ্ধবাদী হয়ে ওঠে এবং সে সুবাদে বিশ্ব শাসনের প্রবল আকাঙ্ক্ষা পোষণ করতে থাকে, তখন তাকে সে আকাঙ্ক্ষার মাসুল গুনতে হয় দেশের অর্থনীতিকে চাপে রেখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কয়েক দশক ধরে এমনটাই করে চলেছে।
কিন্তু তাদের হাতে বিশ্ব শাসনের সোনার হরিণ ধরা দেয়নি, দেওয়ার সম্ভাবনাও নেই। করণ শাসিত বিশ্ব বা তৃতীয় বিশ্ব অর্থনৈতিক দুর্বলতা বা অনৈক্যের কারণে সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ জানাতে না পারলেও পরোক্ষ বিরোধিতা তো আছেই, আছে কিছু সাম্রাজ্যবাদবিরোধী রাষ্ট্র (যদিও ওদের একে একে খতম করে আনা হচ্ছে)। সর্বোপরি ঘটনাক্রম পুরোপুরি তাদের পক্ষ নয়। অনেকটা হাতির কাদায় পড়ার মতো। সে কাদা অবশ্য এখনো গভীর আঠালো হয়ে উঠতে পারেনি।

যে দ্রুততায় বাগদাদ দখল, সে দ্রুততায় ইরাক দখল পূর্ণতা পায়নি। এতগুলো বছর পার করে পুতুল সরকার বসিয়েও উদ্দেশ্য শতভাগ সিদ্ধ হয়নি। পুষতে হচ্ছে ব্যয়বহুল সেনাবাহিনী। তাদের ফিরিয়ে আনার ঘোষণা দিয়েও কাজটা সম্পূর্ণ করতে পারেননি জনগণের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত বারাক ওবামা। তাঁর ভোল বদল বিস্ময়ের নয়, বরং মার্কিনি রাজনীতির বাস্তবতাসম্মত। ইহুদি লবির টানে ওবামার বিচ্যুতি। হুংকার সত্ত্বেও আফগানিস্তানের গুহা-কন্দরে সাফল্য এমনই আটকে পড়েছে যে দিনের পর দিন ড্রোন হামলায় নরহত্যার তাণ্ডব ঘটিয়েও কবজায় আনা যাচ্ছে না আফগানদের। বরং দেশটাকে ঠেলে দেওয়া হলো কট্টর ইসলামী জঙ্গি তালেবানদের হাতে। এখন বলতে হচ্ছে : 'এসো বন্ধু, আলোচনায় বসি।' কিন্তু এখান থেকে সহজে মুক্তি পাবে না যুক্তরাষ্ট্র, পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে পিছু হটা ছাড়া।

বিপুল অস্ত্রভাণ্ডার তৈরি করে সেসব এদিক-ওদিক বেচে তাল তাল ডলার অর্জন করলেও তা করপোরেট হাউসের ভোগে লাগছে। ভোগবাদী সমাজের যে আদর্শ দিনের পর দিন প্রচারে ও ব্যবহারে সামাজিক সত্য হয়ে উঠেছে, তা কিন্তু খুবই সীমাবদ্ধ বৃত্তে বন্দি। অথচ ভোগ ও পণ্যের আদর্শের প্রচার অবারিত। সে ক্ষেত্রে বঞ্চিতদের অসন্তোষ দেখা দেবেই। তারা কেন ওই ভোগের পাত্রে চুমুক দিতে পারবে না? কেন আরো শৌখিন জীবন যাপন করতে পারবে না, স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা কেন আরো সহজলভ্য হবে না?

অর্থ আছে, তবু অর্থ নেই, কাঁড়ি কাঁড়ি ডলার আছে, তবু সাধারণ মানুষের হাতে ভোগবাদী আকাঙ্ক্ষার উপযোগী ডলার নেই। সেখানে যত সমস্যা। আর সে সমস্যার শিকড় ধরেই 'ওয়াল স্ট্রিট দখল কর' আন্দোলন। ওই ১ শতাংশের ভোগবিলাসের বিরুদ্ধে হঠাৎ জেগে ওঠা ৯৯ শতাংশের আন্দোলন। এবং তা ১৭ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে এই নভেম্বর মাস অবধি চলছে। শুধু চলছে বললে ভুল বলা হবে, এর বিস্তার ঘটছে নানা মাত্রায় বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে।

ভাবতে ভালো লাগছে, রাষ্ট্রীয় শাসনতান্ত্রিক ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র যত আধিপত্যবাদী ও আগ্রাসী এবং নির্মম হোক না কেন, সেখানকার জনগণ মাঝেমধ্যে প্রতিবাদী চেতনার প্রকাশ ঘটিয়ে চমক সৃষ্টি করে। 'মে দিবসের' উৎস কিন্তু এই যুক্তরাষ্ট্র। ভিয়েতনাম যুদ্ধের অমানবিকতার বিরুদ্ধে এদেরই একটি অংশ রাজপথে নেমে ইতিহাস সৃষ্টি করে। এমনকি অন্যায় ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে সংখ্যায় কম হলেও এদের প্রতিবাদ করতে দেখা গেছে। এক মা ইরাকে তাঁর সৈনিক সন্তানের জন্য দিনের পর দিন রাস্তায় ও সমাবেশে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।

শেষ পর্যন্ত এবার অর্থনৈতিক টানাপড়েনে ক্ষুব্ধ আমেরিকানদের মুখে ধনকুবেরদের আস্তানা ওয়াল স্ট্রিট দখলের স্লোগান। কারো কারো ধারণা, আরব বিশ্বের রাজপথে জাগরণ এ আন্দোলনে প্রেরণা জুগিয়েছে। আমার তা মনে হয় না। আরবদের প্রতি সাধারণ আমেরিকানেরও বোধ হয় ভালো ধারণা নেই, মূলত ধর্মীয় জঙ্গিবাদিতার কারণে।
আসলে নিজস্ব সমাজের চাহিদা মেটাতে সরকারের ব্যর্থতা, অন্যদিকে ছোট্ট এক শ্রেণীর হাতে পর্বতসমান সঞ্চয় হঠাৎ জেগে ওঠা অর্থনৈতিক মন্দার কারণে হয়তো তাদের কারো কারো চোখ খুলে দিয়েছে। শুরুতে প্রতিবাদীদের সংখ্যা খুব বড় ছিল না। ক্রমে তা বেড়েছে। আমার ধারণা (ভুলও হতে পারে) আমেরিকান জনতা অনেকটা বাঙালিদের মতোই হুজুগে, হুজ্জতে যদি নাও হয়।

অনেকেই ভেবেছিলেন, ওয়াল স্ট্রিট দখলের উত্তাপ কয়েক দিনের মধ্যে ঠাণ্ডা মেরে যাবে, কিন্তু তা হয়নি। বরং নিউ ইয়র্ক থেকে ওয়াশিংটন ডিসির দিকে প্রতিবাদী যাত্রার (মিছিল শব্দটা ইচ্ছা করেই ব্যবহার করছিল না। সেটা মার্কিন মানসিকতার সঙ্গে লাগসই না-ও হতে পারে) গন্তব্য। জুকোটি পার্কের ছোটখাটো সমাবেশ পুলিশ ছত্রভঙ্গ করে দিয়েছে। কিন্তু তাতে আন্দোলনকারীরা হতোদ্যম হননি। তাঁরা তাঁদের প্রতিবাদ কর্মসূচির কোনো প্রকার পরিবর্তন ঘটাননি (ভাগ্যিস পার্ক খালি করতে নিউ
ইয়র্ক পুলিশ বাংলাদেশি পুলিশের মতো প্রতিবাদীদের বেধড়ক লাঠিপেটা করেনি)।

এ প্রতিবাদ একেবারেই স্বতঃস্ফূর্ত। তার চেয়েও বড় কথা, এ আন্দোলন পরিচালনায় কোনো রাজনৈতিক দল বা নেতা নেই। যদিও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ মানুষগুলোর মূল উদ্দেশ্য। এ অবস্থার সুবিধা-অসুবিধা দুই-ই আছে। কারণ নেতৃত্ববিহীন প্রতিবাদী আন্দোলন অনেক সময় দিকভ্রান্ত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে। সে জন্য প্রতিবাদীদের উদ্দেশ্য সফল করতে অন্তত একজন মুখপাত্র দরকার। তার রাজনৈতিক পরিচয় না-ই থাকল, বরং না থাকাও এক অর্থে ভালো। কারণ তাতে আন্দোলনের গায়ে লেবেল এঁটে দিতে পারবে না শাসকগোষ্ঠী। তাদের তো আবার লালজুজুতে ভয়ানক ভয়। এমনকি লালের পরিবর্তে 'পিংক' হলেও ভয়।

মজার ব্যাপার যে এ প্রতিবাদীরা আমেরিকান ঢঙে তাঁদের যাত্রা অব্যাহত রেখেছেন; অর্থাৎ নেচে-গেয়ে মহাউল্লাসে। এখানেই অনেক প্রভেদ তৃতীয় বিশ্বের প্রতিবাদী আন্দোলনের সঙ্গে। এতে একটা সুবিধা যে সরকার আর যা-ই হোক এদের সন্ত্রাসী আখ্যা দিতে পারবে না। 'আমরাই ৯৯ শতাংশ' এ-জাতীয় স্লোগানের তাৎপর্য অনেক। ৯৯ না হোক সংখ্যাগরিষ্ঠতা তো বটেই। বড় কথা হলো, একাধিক অঙ্গরাজ্যের মধ্য দিয়ে এই যে প্রতিবাদী যাত্রা এবং এর পক্ষে যে ক্রমবর্ধমান জনসমর্থন তা একসময় পুলিশি চাপে স্তব্ধ হয়ে গেলেও বলার অপেক্ষা রাখে না যে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে খোদ যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াল স্ট্রিট দখলের এই যে জনঘোষণার তাৎপর্য অনস্বীকার্য। দেশে-বিদেশে এর পক্ষে ক্রমবর্ধমান সমর্থন যেমন তৎপর্যপূর্ণ, তেমনি এর প্রভাব আমেরিকার শাসনব্যবস্থায় একটা বড়সড় ঝাঁকুনি দিয়ে শেষ হবে। কুবের প্রাসাদ দখলের ঘোষণা সম্ভবত এই প্রথম।

বাংলাদেশ তার সংখ্যাগরিষ্ঠ দুস্থদের নিয়ে সংকটতাড়িত সন্দেহ নেই। মুক্তবাজার অর্থনীতি ও করপোরেট বাণিজ্য শক্তির খবরদারিতে এ দেশে একদিকে যেমন সমাজের ভোগবাদী আদর্শের প্রবল প্রভাব (অবশ্য উচ্চশ্রেণীর সামান্য কয়েক শতাংশে), তেমনি এ স্বল্পায়তন বৃত্তে হঠাৎ করে অগাধ বিত্তের মালিকদের কী যে প্রতাপ গোটা সমাজে, মূলত রাজনৈতিক দলগুলোর সমর্থনে! সেই সঙ্গে মার্কিনি আদর্শে, মার্কিনি যোগসাজশে!

শেয়ারবাজারে বিশাল ধস সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শূন্য থেকে ডোবায় ফেলে দিয়ে যে সামাজিক আলোড়ন তৈরি করেছে, অবাক হয়ে লক্ষ করছি তার প্রতিক্রিয়ায় গভীর কোনো আন্দোলন তৈরি হয়নি, ক্ষুব্ধ প্রতিবাদে তা শেষ হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের খ্যাতি আন্দোলনের দেশ হিসেবে। ইতিহাসে তেমন প্রমাণ ধরা আছে।

কিন্তু রাজনীতিকদের কলাকৌশলে রাজনীতি এমনি দূষিত হয়ে গেছে যে এখানে এত দুর্যোগের পরও 'স্টক এঙ্চেঞ্জ দখল করো' এ ধরনের কোনো স্লোগান ওঠেনি, আন্দোলন গড়ে ওঠেনি। আমাদের সুশীল সমাজ এ বিষয়ে সামান্যতম প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। বিরোধী দল তো নয়ই। যে বঙ্গে এক পয়সা ট্রাম ভাড়া বাড়ানোর প্রতিবাদে বিশাল আন্দোলন হয়, যে পূর্ববঙ্গে ভাষা থেকে নানা অধিকারের দাবিতে শুধুই আন্দোলন, সে বাংলাদেশ প্রয়োজনে নিথর, কিন্তু শক্তি বা দলীয় স্বার্থে মুখর। এ দেশের কি উল্টোবাসে বিবর্তন ঘটছে?

সবশেষে আবারও ওয়াল স্ট্রিট প্রসঙ্গ। আকাঙ্ক্ষিত নাগরিক সুবিধাবঞ্চিত মার্কিন নাগরিকদের এতকাল পরে হুঁশ হয়েছে যে তারা বঞ্চিত এবং সম্পদের পাহাড় গড়েছে করপোরেট বাণিজ্য-সংশ্লিষ্ট এক শ্রেণীর মানুষ, সংখ্যায় তারা অতি অল্প। তাই ধনকুবেরদের আস্তানা দখলের স্লোগান। যত কর (ট্যাঙ্) গরিব ও মাঝারি আয়ের মানুষের ওপর। ওবামার স্বস্তিদায়ক কোনো প্রতিশ্রুতিই বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি ধনকুবের প্রতিনিধিদের বিরোধিতার মুখে।

এ আন্দোলন সফল হোক না হোক, এর প্রভাব পড়েছে ইউরোপের অনেক দেশে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ছে যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক শহরে। প্রতিবাদের এ জোয়ার কি কোনো পলিস্তর রেখে যাবে না, যেখান থেকে অঙ্কুরিত হতে পারে দারিদ্র্য, বৈষম্য, দুর্নীতি, স্বার্থের যুদ্ধ ও পর্বতপ্রমাণ অনড় পুঁজির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বৃক্ষ। পুঁজিবাদী দেশে পুঁজির বিরুদ্ধে এ প্রবল প্রতিবাদ এ মুহূর্তে স্থায়ী পরিবর্তন আনতে পারবে না জানি।

কারণ জুকোটি পার্ক তাহিরি স্কোয়ার হতে পারেনি। কারণ মার্কিন প্রশাসন এখনো প্রচণ্ড রকম শক্তিশালী। কিন্তু বাস্তিল গুঁড়িয়ে দেওয়ার সময় রাজতন্ত্রে যে ঘুণ ধরেছিল, সে ঘুণ হয়তো এখনো মার্কিন পুঁজিবাদকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়ার মতো যথেষ্ট নয়। কিন্তু নিঃসন্দেহে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের এ সূচনা কোনোক্রমেই গুরুত্বহীন নয়। এ ক্রোধে শিখা অনেক আকারে জ্বলে ওঠা সময়ের ব্যাপার মাত্র। জুকোটি পার্ক থেকে তার যাত্রা শুরু।

http://blog.priyo.com/ahmed-rafiq/2011/12/08/6848.html


যুদ্ধাপরাধী বিচার বানচালে দেশ বিদেশে জামায়াতী লবিস্ট নিয়োগ, ঢালা হচ্ছে অর্থ

2 NOVEMBER 2011 AUTHOR: শংকর কুমার দে ORIGINAL SOURCE: LINK
পদ্মা সেতুর অর্থায়ন ঠেকানো চেষ্টায় নাম এসেছে এক ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধীর

যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল করতে বিদেশে লবি করছে জামায়াত_শিবির ও যুদ্ধাপরাধীদের দোসররা। আর লবিংয়ে নেতৃত্ব দিচ্ছে গ্রেফতার এড়িয়ে চলা এক ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধী। ওই ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধীর নেতৃত্বে বিশ্বব্যাংক যাতে পদ্মা সেতুর অর্থ বরাদ্দ না দেয় সেজন্যও লবি করার অভিযোগ রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছে। বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে লবিংয়ের জন্য তারা দেশে ও বিদেশে বিপুল অর্থ ছড়াচ্ছে। এ খবর গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানা গেছে। সূত্র জানায়, ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখার মাধ্যমে জঙ্গী, সন্ত্রাসী ও দলীয় কর্মকাণ্ডে প্রতিবছর এই বিরাট অঙ্কের টাকা লেনদেন হয়। ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি, ওষুধ শিল্প, শিৰা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, ক্লিনিক, ট্রাস্টি, রিয়েল এস্টেট, ছাপাখানা, ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া, এনজিওসহ বিভিন্ন ধরনের সহস্রাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে জামায়াতের এসব টাকা লেনদেন হচ্ছে। পাকিস্তান, সৌদি আরব, কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন বেসরকারী সংস্থার কাছ থেকে এই অর্থ পাচ্ছে জামায়াত। দেশের ভেতরে ব্যাপক জঙ্গী তৎপরতা, ধারাবাহিক গ্রেনেড-বোমা হামলা, বিপুল পরিমাণ অস্ত্র ও বিস্ফোরক সংগ্রহ, তথ্য প্রযুক্তি, জঙ্গী ও দলীয় ক্যাডারদের প্রশিৰণ, গ্রেফতারকৃত নেতা, কর্মী, ক্যাডার ও জঙ্গীদের মুক্তকরণ, প্রচার ও দলীয় বিভিন্ন কাজে জামায়াত এই অর্থ ব্যয় করে চলেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পৰ থেকে জঙ্গী অর্থায়নে ইসলামী ব্যাংককে একাধিকবার জরিমানা করার বিষয়ে বিভিন্ন সময়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে।
জামায়াতের অর্থ সংস্থানের নেপথ্যে প্রধান ভূমিকা রেখেছে গ্রেফতার এড়ানো এক ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধী। দলীয় তহবিল, কর্মী কল্যাণ তহবিল ও জরুরী পরিস্থিতি মোকাবেলা তহবিল, বিশেষ বরাদ্দ তহবিল ইত্যাদি নানা নামে চার স্তরে তহবিল গঠন করেছে তারা। জামায়াত_শিবিরের বরাদ্দ এই অর্থ পাচ্ছে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গী সংগঠনের সদস্যরাও। কথিত মুসলিম জাহান ও পাকিস্তান থেকে বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচ্ছে জামায়াত-শিবির।
যুদ্ধাপরাধী বিচার শুরম্ন হওয়ার পর জামায়াত_শিবির পাকিসত্মানসহ ওসব মধ্যপ্রাচ্যের দেশের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিরাট অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বানচাল করতে তারা বিদেশে লবিস্ট নিয়োগ করেছে। এমনকি বিভিন্ন দাতা সংস্থাকে অর্থায়ন স্থগিত করেছে, নানাভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। পদ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক যে অর্থ বরাদ্দ বন্ধ করে দিয়েছে তাতে এক ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধীর হাত রয়েছে বলে গোয়েন্দা সংস্থা জানতে পেরেছে।
গোয়েন্দা সংস্থার এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জামায়াত-শিবিরের নীতিনির্ধারক মহলের অন্যতম গ্রেফতার এড়ানো ওই যুদ্ধাপরাধীর নামে ও বেনামে ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল, এনজিও, সংবাদপত্র, টেলিভিশনসহ বিভিন্ন ব্যবসাবাণিজ্য রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলাকালেও গ্রেফতার এড়িয়ে ওই ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধী মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে ঘুরে সরকারের বিরম্নদ্ধে লবি করে এসেছেন। সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে ওই ধনাঢ্য যুদ্ধাপরাধীর নেতৃত্ব্ পে;দ্মা সেতুতে বিশ্ব ব্যাংক যাতে অর্থ বরাদ্দ না করে সেজন্য লবিং করা হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীর বিচার নিয়ে বিদেশের বিভিন্ন প্রভাবশালী মহলে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে তারা।

http://icsforum.org/mediarchive/2011/11/02/jamati-lobbyist-appointed-for/


তানভীর মাহমুদ কি একা?

মিনা ফারাহ
তারিখ: ১৪ নভেম্বর, ২০১২

হলমার্ক প্রসঙ্গে নিউ ইয়র্কের অ্যাডভোকেট আহমেদের গল্প বলতে হয়। একসময় সাধারণ চাকুরে, এরপর রিয়েল স্টেট ব্রোকার থেকে হলমার্কের মতোই রাতারাতি মিলিয়নিয়ার। মার্কিন অর্থ কেলেঙ্কারি যখন তুঙ্গে তখন আবাসন খাত আর ওয়ালস্ট্রিটের কোনো জবাবদিহিতা নেই; মার্জিন ছাড়াই লোন। অর্থাৎ গরুর চেয়ে ঘাসের দাম বেশি। সব রকম জালিয়াতির মাধ্যমে সঙ্ঘবদ্ধ চক্রগুলো এক টাকার বাড়ি তিন টাকায় কিনে একই দিনে তিনবার বিক্রি অর্থাৎ সিটি প্রশাসনে রেকর্ড হওয়ার আগেই বারবার বিক্রি দেখিয়ে বিপুল অর্থ আত্মসাৎ। এরপর ভুয়া ক্রেতা হাওয়া। বাধ্য হয়ে ব্যাংক সেই বাড়িটি আবার বিক্রিতে তুললে আবার ফিরে আসে সাজানো ক্রেতা। গ্র"পটির মধ্যে ব্রোকার, উকিল, টাইটেল কোম্পানি, ইন্স্যুরেন্স ও ব্যাংক। এদের হাতেই পুরো নীলনকশা। এরা পাকিস্তানি, ইটালিয়ান, মেক্সিকান, আমেরিকান, পুয়ের্টোরিকান ইত্যাদি। এআইজি, গোল্ডম্যান স্যাক্স, ফেনি মে, ফেডিম্যাক, বিয়ারস্ট্যার্ন, সিটি ব্যাংক, লেম্যান ব্রাদার্স… প্রায় সাত ট্রিলিয়ন ডলার আবাসন আর স্টক মার্কেট জালিয়াতির সাথে কয়েকজন বাংলাদেশীও জড়িত। দুই-একজন জেল খাটছে, এফবিআইয়ের লিস্টে থাকা বাকিরা বাংলাদেশে পালিয়ে গেছে। দু-একজন কুইক রেন্টাল করে বলেও জানা গেছে। অর্থাৎ সবাই মিলে যে হারে ব্যাংক লুট করেছে তা মার্কিন ইতিহাসে প্রথম।

গ্লোবাল ধসের শুরুতে ঋণ প্রদানকারী সংস্থাগুলোর জালিয়াতিতে ধস নামতে শুরু করে মার্কিন অর্থনীতিতে। ২০০৮ সালে প্রথমে গেল বিয়ারস্ট্যার্ন। ৬০ ডলারের স্টক ৬ ডলার। ডাউজোন্স এক দিনে নেমে যায় ৫০০ পয়েন্ট। মহাপ্লাবনে অংশ নিয়ে একটার পর একটা ব্যাংক নগ্ন হয়ে যায়।

একদা রাজকীয় জীবনের আহমেদ এখন রাজসাী। তার বিরুদ্ধে ৫০০ মিলিয়ন ডলার জালিয়াতির অভিযোগ, এখন দায়িত্ব গ্যাং ধরিয়ে দেয়া। তানভীরের মতো সে-ও প্রশাসনের হাইপ্রফাইল লোকের সাথে চলাফেরা করত। কুইন্স ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রেসিডেন্ট, পার্টি ডোনার, গায়ানার প্রেসিডেন্ট তার বাড়িতে দাওয়াত খান। স্টক মার্কেট আর আবাসন ব্যবসায় করি বলে এসব ঘটনা খুব পরিচিত। মার্কিন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, ফেড চেয়ারম্যান, ট্রেজারি সেক্রেটারি, মুক্তবাজার অর্থনীতি, আবাসন আর ইন্টারনেট বাবল…। ৬০ ট্রিলিয়ন ডলার জালিয়াতি করে ১৫০ বছরের জেল খাটছেন বার্নি ম্যাডফ আর ৭৫ হাজার টাকায় নাশতা খাওয়া তানভীরের বরাদ্দ এখন ১৫ টাকা। যা বলতে চাই, হলমার্ক আর বিয়ারস্ট্যার্ন ১০ হাজার মাইল দূরে হলেও জালিয়াতিতে সাদা-কালো-পূর্ব-পশ্চিম, হিন্দু-খ্রিষ্টান নেই। মুজিবের অর্পিত আইন গেজেটের সাথে সাথে আওয়ামী লীগারেরা হামলে পড়েছিল পরিত্যক্ত সম্পত্তির ওপর। রাষ্ট্রের নির্দেশে দখল হয়েছে লাখ লাখ বিঘা। তখন বিএনপি ছিল না। পরে অর্পিত সম্পত্তি দখলে দুই দলই চ্যাম্পিয়ান (দ্র : লিভিং ইউথ ভেস্টেড প্রপার্টি, প্রফেসর আবুল বারকাত)। ঠিক সেই রকমই মিথ্যা কাগজ দেখিয়ে হাইপ্রফাইল সহায়তায় দুই গোলার্ধের দুই পই বিভিন্ন ব্যাংক থেকে বিপুল অর্থ লুট করেছে। তফাৎ একটাই, জবাবদিহিতা ও বিচার। মার্কিন লুটেরাদের জেলে পাঠানো হলেও অর্থমন্ত্রীর জেদ, মহামানবদের (মহাদানবদের) মানসম্মানের স্বার্থে 'স্টক মার্কেটের তদন্ত রিপোর্টের নাম প্রকাশ করা যাবে না'।

প্রসঙ্গত, দুদক আর রিমান্ডের অন্ধকার গুহা নয়, বরং সংসদীয় কমিটির লাইভ টিভি শুনানি জরুরি কেন? কারণ এর মাধ্যমেই জনগণকে জানানো যায়, জালিয়াতি বা অর্থ কেলেঙ্কারির রহস্য। এখন লাইভ বাগ্যুদ্ধ চলছে লিবিয়ায় মার্কিন দূতাবাসের প্রকৃত ঘটনা নিয়ে ওবামা সরকারের মিথ্যাচার। কংগ্রেসের দাবি, ছবির জন্য নয়, এটি আরেকটি ১/১১। ভিন্ন ভিন্ন তদন্ত করছে কংগ্রেস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট এবং গোয়েন্দা সংস্থা। সমস্যা, ওয়াশিংটনে কোনো জজ মিয়া তৈরি হয় না।

২০০৮ সালের বিশাল করপোরেট জালিয়াতির শুনানি সারা বিশ্ব লাইভ দেখেছে। হিয়ারিং কমিটিতে বাঘা বাঘা কংগ্রেসম্যানের উল্টো দিকে ফেড চেয়ারম্যান, ব্যাংক আর বীমা কোম্পানি সিইওদের বাক্যবাণে তপ্ত কড়াইয়ে ভেজে ফেলা। একেকজন সিইওর বেতন বোনাস ২০০ থেকে ৩০০ মিলিয়ন ডলার ছেঁটে দেয়া হয়েছে। জেলজরিমানা এখন পর্যন্ত অব্যাহত। সিইওদের ব্যক্তিগত জেট আর হীরা-জহরতের জীবন কেড়ে নেয়া হয়েছে। বিচারকাজে এই মাপের শুনানি বিশাল ভূমিকা পালন করে (চাইলে ডিভিডি কিনে ওয়ালস্ট্রিট, ইনসাইডার জব, আমেরিকান গ্রিড জাতীয় ছবিগুলো বিভিন্ন পাবলিক প্লেসে দেখানো যেতে পারে। এতে গণসচেতনতা বাড়বে)। ৪৮ হাজার ডলার মাথাপিছু আয়ের মার্কিন অর্থনীতি যা হজম করবে, মাথাপিছু ৮০০ ডলারের বাংলাদেশ কি তা পারবে?

শক্তিশালী গোয়েন্দা আর প্রভাবমুক্ত বিচারের বদলে রবিাহিনী, কিনহার্ট, দুদক, রিমান্ড এবং র‌্যাব নামে মানবাধিকার বিরোধীদের কর্মকাণ্ডে সারা বিশ্বে দুর্নাম ছড়িয়ে গেছে। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই মানবাধিকার ভঙ্গের খবর পশ্চিমের মিডিয়ায়। প্রতিদিনই দুঃসংবাদে আমরা কত অসহায় হয়ে গেছি। বিশাল আকারের তৃতীয় বিশ্ব আছে বলেই টিকে আছে আজকের প্রথম আর দ্বিতীয় বিশ্ব। ঠিক তেমনই দুর্নীতিবাজেরা সফল, কারণ ৪২ বছরের অ্যামেচার সরকারযন্ত্রটি যথেষ্ট দুর্বল। খোলনলচে পাল্টে না ফেললে ১৭০ মিলিয়ন মানুষের দেশটি আর ২০ বছর পরে ভয়াবহ দুর্যোগ সামলাতে পুরোপুরি ব্যর্থ হবে। শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, পানির জন্য যুদ্ধ হবে, শস্যেেত হবে খরা। ওরা রাজনীতি বোঝে না, বোঝে মতা। দুই নেত্রীকে একবার ডিবেটে আনতে পারলেই গোমর ফাঁস হয়ে যাবে। ৪২ বছরের উৎপাদনহীনতায় সৃষ্টি হয়েছে গার্মেন্ট আর ম্যানপাওয়ারের অদ্ভুত অর্থনীতি। সৃষ্টি হয়েছে কয়েক হাজার গার্মেন্ট মালিক, যারা বিলিয়নিয়ার পুঁজিপতি। প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিকের ৯৫ ভাগই নারী, যারা দুই গোলার্ধের বিলিয়নিয়ারদের হাতে মাসে মাত্র ৩৭ ডলার বেতনে জিম্মি (ভিুকেরাও এর চেয়ে অধিক আয় এবং মানবাধিকার ভোগ করে)। বৈদেশিক মুদ্রা বাড়ার সাথে সাথে ধনী-গরিবের বৈষম্য যে হারে বাড়ছে তাতে শোষক শ্রেণীর কব্জায় জনশক্তি এবং গার্মেন্ট শিল্পটি আধুনিক দাসপ্রথার মতোই মনে হয়। একসময় এই দাসপ্রথাও বিলুপ্ত হবে।

কারা সৃষ্টি করেছে হলমার্ক? রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক পরিচালনায় নিয়োগপ্রাপ্ত অনভিজ্ঞ দলীয় লোকদের অনেকেই লবিস্ট আর দুর্নীতিবাজ বলে প্রমাণ হয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে অতিরিক্ত ব্যাংকিং খাত সৃষ্টি করে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মতাহরণ ও লুটপাটের শুরুতেই, সরকারি আর বেসরকারি ব্যাংকের জন্য আলাদা নীতিমালা করে হলমার্ক সাজানোর পথ উন্মুক্ত করা হয়। আর এর সাথে জড়িয়ে যায় প্রশাসনের লোক, অন্যথায় যা সম্ভব নয়। প্রাইভেট ব্যাংকের পরিচালক হতে পকেট থেকে যদি ২০ থেকে ৩০ কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে হয়, তাহলে বিনা খরচে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের 'জান্নাত আরা হেনরী'দের লুটপাটের লিমিট কত? সুদের হারে অসংখ্য কালো বিড়ালের কারণ, অর্থহীন অর্থনীতি। ১৫ থেকে ২১ ভাগ হারে সুদে কত ভাগ 'ইনফেশন' যোগ করলে ঘণ্টায় ঘণ্টায় কোটিপতি হওয়া যায়? সুতরাং জলবায়ু পরিবর্তনসহ অর্থহীন অর্থনীতির দেশে গরিব মানুষের সংখ্যা প্রতি বছরই বৃদ্ধির সাথে সাথে রাজধানীতে প্রতিদিন ঢুকছে চার হাজার মানুষের বেশি। মেয়েরা গার্মেন্টে আর পুরুষেরা রিকশা চালায়। বিশ্বের সবচেয়ে সস্তা শ্রমের সুযোগ নিতে সাম্রাজ্যবাদী পশ্চিমাদের অর্থে গার্মেন্ট শিল্পে যে অভাবনীয় উন্নতি হচ্ছে, তাতে নতুন আরেক ধাপ ধনী-গরিবের বৈষম্য উদ্বেগজনক। এরা ৭০ টাকা খরচ করে একটি জিন্স বিক্রি করে প্রায় আট হাজার টাকায়। এমনো অভিযোগ, শ্রমিকদের দুরবস্থার একটি তথ্যচিত্র মার্কিন টিভিতে প্রচার রহিত করেছে বিলিয়নিয়ার মার্কিন ক্রেতা (দ্র : নিউ ইয়র্ক টাইমস ২ সেপ্টেম্বর)। গার্মেন্টশ্রমিকের মাসিক বেতন তিন হাজার টাকা। বুঝলাম, চালের কেজি ২৫ কিন্তু মাছ-গোশতের কেজি কত? আগের এই ৯৯ ভাগের খবর পশ্চিমে ছড়ালে গার্মেন্ট শিল্প প্রত্যাখ্যাত হতে পারে, যেমনটি হয়েছিল দণি আমেরিকার বেলায়। অনভিজ্ঞ ও অদূরদর্শী সরকারের সিদ্ধান্তের কারণে মূল্যস্ফীতির কারণ না হয়েও মাশুল দিচ্ছে নিম্নবিত্তরাই। কোনোরকম গণশুনানি ছাড়াই তেল-গ্যাসের দাম বারবার বাড়ানো হয়। কিন্তু চার আনা ট্রেন ভাড়া বৃদ্ধির জন্য গণশুনানির অপোয় নিউ ইয়র্কবাসী। এ জন্য দায়ী প্রশাসন নয় বরং মওসুমি অ্যাক্টিভিস্ট যারা আন্দোলনের ধুয়ো তুলে অদৃশ্য কারণে বারবার কেটে পড়ে। এই দশকের 'হুজুর ভাসানী'রা এখন পর্যন্ত ডাইন্যাস্টির পে কথা বলছেন, কারণ তারাও বিশ্বাস করেন, রাষ্ট্রের চেয়ে ব্যক্তি এবং বংশ বড়। আরো বিশ্বাস করেন, এ দেশে কোনো ওবামা নেই। কিন্তু তাদের ধারণা ভুল।

বসবাসের সবচেয়ে অযোগ্য করপোরেট রাজধানীতে কত মানুষ ফুটপাথে ঘুমায়? কী উদ্ভট অর্থনীতি! বাঁয়ে গেলে কঙ্গো, ডানে নিউ ইয়র্ক, সামনে প্যারিস, পেছনে রায়েরবাজারের স্লামডগ মিলিয়নিয়ার, গণভবন নামক বাকিংহাম প্যালেসের কথা না-ই বললাম। কিন্তু ৪১ লাখ বর্গফুটের শপিংমলে ঢুকলে মনে হতেই হবে, বাংলাদেশের জিডিপি কাতারের চেয়েও বেশি? আইনস্টাইনরা যা-ই বলুন, রাতের ঢাকা নগরীর দৃশ্য কি তারা দেখেন? আমি দেখেছি রাত জেগে, সাভারের খোলা মাঠ আর হাইকোর্টের মাজার থেকে টঙ্গী রেলস্টেশনে হাজার হাজার গৃহহীন। বুঝলাম আইয়ুব খান ভোলায় যাননি কিন্তু মানুষ জানতে চায়, ২২ বছরে এতগুলো ঘূর্ণিঝড় হলো, দুই নেত্রী কতবার উপকূলে গেছেন? অভাব-অনটন, ঝড়-বাদল সম্বল করে উপকূলের মানুষেরা কেমন থাকেন? এভাবে চলতে দিলে দণি আমেরিকা আর পূর্ব ইউরোপীয় 'সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা' অনিবার্য হয়ে উঠবে। বৈষম্য ঠেকাতে পশ্চিমে বাম রাজনীতির উত্থানে ৯৯ ভাগের আন্দোলনে যোগ দিচ্ছেন হলিউড থেকে হার্ভার্ডের তারকারাও। কয়েক হাজার ভোগবাদী, পুঁজিবাদীর জন্য 'মাল মুহিত' বাজেটে পানসুপারির পয়সাও পায় না গরিব মানুষেরা। যারা বলেন ৫০ ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে নয়, তাদের যুক্তি কি এখনো খণ্ডন করিনি? ৩০০ টাকা ভাতার জন্য তিন মাইল হাঁটতে হয়। তিনবেলা তিন কেজি বাতিল চাল আর প্রজন্মের পর প্রজন্ম বস্তিতে রেখে ভোটব্যাংকের স্থায়ী ব্যবস্থার বিরুদ্ধে বাস্তব পরিস্থিতি বিবেচনায় কোমরভাঙা বাম রাজনীতি উঠে না দাঁড়ালে পরিস্থিতি হবে বৈষম্যের গিনেস বুক। উদ্ভট অর্থনীতির দেশে বাম রাজনীতির বাস্তবতা এখন সবচেয়ে বেশি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর কিছু দিন আগে উত্তর আমেরিকায় মিথ্যাচার করে গেলেন। বিশ্বে মন্দা হলেও বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নাকি হাঁচিও হয় না; হলমার্কের পর ডুব দিয়েছেন তিনি। তার প্রয়োজন গদি। সরকারের উচ্চমহল যখন খাতাকলমে হলমার্কের উপদেষ্টা, বিচারের সাহস কার? এ রকম বহু হলমার্ক পাইপলাইনে। সুতরাং ব্যাংকগুলোকে রাষ্ট্রায়ত্ত করার সাথে সাথে কেন লুটপাট শুরু হলো, টকশোর অর্থনীতিবিদেরা জানেন না বলা যাবে না কারণ মাত্র ১৫ ভাগ সমালোচানার বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর গাত্রদাহ ইতোমধ্যেই টক অব দ্য টাউন।

 

প্রশাসনের লেজেগোবরে হওয়া মোটেও কাম্য না হলেও কেন তানভীর? একে মেরে ফেললেই কী লাভ? যারা তাকে সৃষ্টি করল তাদের ধরা হচ্ছে না কেন? জনগণের অর্থে পরিচালিত সংসদের এখন বিভিন্ন কমিটি ও লাইভ টেলিভিশন কি শুধুই এক পরে? নখদন্ত হয়ে ওঠা দুদকের হঠাৎ নড়েচড়ে ওঠার আসল কারণ নির্বাচন থেকে বিএনপি-জামায়াতকে দূরে রাখা। নির্বাচন যতই এগোবে, বিরোধী দলের মামলাগুলো প্রাধান্য পাবে। হলমার্ক, ডেসটিনি চুলোয় যাবে।

জগাখিচুড়ি বটে! ৫০০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করে ব্যবসায় খুললেই আমেরিকায় গ্রিন কার্ড পাওয়া যায়। ১০০ হাজার ডলার দিয়ে বাড়ি কিনলে হালাল হওয়ার পথ সহজ হয়। মালয়েশিয়ায় প্রায় আড়াই হাজার বাংলাদেশী ২০০ হাজার ডলার ব্যয় করে দ্বিতীয় বাড়ির মালিক হওয়ার সুযোগ নিয়েছেন (অতীতে বাঙালিদের চুষে খাওয়া বদনাম পাকিস্তানিরা নিয়েছে মাত্র ৬৫০ জন, কে কার সম্পদ লুট করে?)। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদ আর শিল্পীরা আমেরিকাকে মনে করে কলকাতা। রাস্তায় বের হলেই টকশোর হোস্ট আর গেস্ট। বিখ্যাত ব্যক্তিরা জ্যাকসন হাইটসের রেস্টুরেন্টে খায় আর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারে। নির্বাচনে ভরাডুবি নিশ্চিত জেনে টিআইবির রিপোর্টে উল্লিখিত দুর্নীতিবাজদের আগাম প্রস্তুতির হিড়িক লণীয়। ভাই-ব্রাদারের নামে বাড়িঘর, টাকা-পয়সা রাখার হিড়িক। অন্য দল মতায় এলে বেশির ভাগই পালিয়ে যাবে (১৪/১০/১২ তারিখে টিআইবির ঘোষণা ৯৭ ভাগ মন্ত্রী-এমপিরাই অনৈতিক কাজে জড়িত)। শেষ বছরে সরকার হাজার হাজার কোটি টাকা স্থানীয় উন্নয়নের নামে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জোর-জবরদস্তি বরাদ্দ নিয়ে মুদ্রা পাচারকারীদের জীবন আরো সমৃদ্ধ করছেন। পৃথিবীর যেকোনো দেশ থেকে বাংলাদেশে লুটপাট এবং মুদ্রাপাচার অনেক সহজ। দুর্বল সরকারের চোখে ধুলো দিয়ে আইয়ুব আমল থেকে মাড়োয়ারি বাবুসহ আন্তর্জাতিক মুদ্রাপাচারকারীরা রাজধানীতে বিশাল সিন্ডিকেট করে নিয়মিত অর্থনীতি ধ্বংস করছে। একটি ফোন করলেই হংকং, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়ার স্যাটেলাইটের কল্যাণে লাখ লাখ ডলার পশ্চিমে চলে যায়। উত্তর আমেরিকা এখন মুদ্রা পাচারের অন্যতম দেশ। বিশ্বমন্দার কারণে বেহায়া পশ্চিমারা টাকার সূত্র নিয়ে আগের মতো মাথা ঘামায় না। মানি এক্সচেঞ্জগুলো পর্যন্ত ডলার জমা নিয়ে হুন্ডি ব্যবসায় লিপ্ত হয়েছে বলে অভিযোগ। যখন বাংলাদেশ থেকে ফিরি, কাস্টমস বলে, দুই হাজার টাকার বেশি কেন? প্রশ্ন, মাত্র দুই হাজার টাকা আমার জন্য লিমিট হলে ডেসটিনি, হলমার্ক কার চোখ ফাঁকি দিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাঠায়, জবাব সরকারকেই দিতে হবে আগামী নির্বাচনে। ওয়াশিংটন গরম হলে ঢাল-তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দারেরা কেমন ঠাণ্ডা হয়ে যান, পদ্মা সেতু এবং ড. ইউনূসের ঘটনাই যথেষ্ট প্রমাণ।

বিরোধী দলের অভিযোগ, দেশটা এখন পুলিশি রাষ্ট্র এবং সর্বত্রই প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ। দেখা যাক তাদের অভিযোগ কতটা সত্য। মায়ের আইটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বললেন,  ফোর-জি পেতে হলে আওয়ামী লীগকে আবার ভোট দিয়ে মতায় আনতে হবে। অর্থাৎ বুঝে নেবো, অন্যথায় এ দেশে কখনোই ফোর-জি আসবে না। বিষয়টি কি ঠিক? আমরা জানি দেশের ৯৯ ভাগ উন্নতির মূল কারণ প্রাইভেট সেক্টর। এ দেশের মানুষ গরিব কিন্তু মেধাবী, পরিশ্রমী এবং বেঁচে থাকার জন্য অসাধ্য সাধন করে, যা পৃথিবীতে অন্যতম দৃষ্টান্ত। বাংলাদেশে প্রচুর আইটি বিশেষজ্ঞ আছেন, এমনকি নাসাতেও আছেন বাঙালি বিজ্ঞানী। সুতরাং সরকার নিয়ন্ত্রণ না করলে প্রাইভেট সেক্টরের হাত ধরে ২০১১ সালেই চলে আসত ফোর-জি টেকনোলজি। তেমনি নির্বাচন নিয়ে কু-উদ্দেশ্য না থাকলে নির্দলীয় সরকারেরও প্রশ্ন উঠত না। এখন শুরু হয়েছে '৭৫-এর মতো জাতীয়করণ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে খেয়ে ফেলার পাঁয়তারা। অর্থাৎ গণতান্ত্রিক সরকার এখন ক্যাস্ট্রো কিংবা গণচীন। আমাদের প্রয়োজন নিজস্ব ফর্মুলায় 'সমবণ্টনের' এমন একটি সংবিধান যেখানে ৪২ ভাগকে ৪২ বছরে আর ৯৯ ভাগে পরিণত করবে না। অবস্থা ভয়ানক তাই মতাসীন, জ্ঞানীগুণী, বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিক, সামর্থ্যবান দেশপ্রেমিকদের সন্তানেরা দেশে থাকেন না। এমনকি যারা ঘোর সাম্রাজ্যবাদী, তারাও। বাংলাদেশ এখন প্রতিদিনের মৃত্যুপুরী। নিউ ইয়র্ক মানবাধিকার কমিশনের রিপোর্ট অনুযায়ী আগস্টেই খুন হয়েছে ৪০৭ জন (প্রকৃত নম্বর ৪ থেকে ৫ ভাগ বেশি)। ভয়ঙ্কর ঘটনা একটার চেয়ে আরেকটা বড়। সেই ভয়েই হয়তো অত্যন্ত দেশপ্রেমিক প্রধানমন্ত্রীও বাংলাদেশের প্রতি সব আস্থা হারিয়ে সন্তান এবং ঘনিষ্ঠজনদের দেশে রাখেন না। নিরাপত্তার অভাবে অনেক মানুষ এখন রাতে ঘুমান না কিংবা পালা করে ঘুমান। প্রবাসীরাও দেশে গেলে বন্দুকধারী নিরাপত্তারক্ষী ভাড়া করেন। সুতরাং বিরোধী দলের অভিযোগ সাধারণ মানুষেরও অভিযোগ।

রান্না শেষ, চেখে দেখা যাক জগাখিচুড়ি। পালা করে এ দেশের সর্বময় মতার অধিকারী দুই নারী, বিশ্বে একমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান যাদের হাতে একই সাথে দল, সরকার এবং কয়েকটি মন্ত্রণালয়। জুলাই মাসে বিবিসির সাাৎকারে 'দুই টার্ম' মতার আশা প্রকাশে যে প্রশ্নটি তুলেছিলেন ব্রিটিশ সাংবাদিক, আমাদের টকশোর বিশ্লেষকেরা কেন ধরতে পারলেন না? সন্দিহান সাংবাদিকের প্রশ্ন, ম্যাডাম হাসিনা! 'আমি আবার মতায় গেলে'Ñ এই কথাটির মানে কী? 'উপকূলের জেলেরা না হয় আবহাওয়া সঙ্কেত বুঝতে ভুল করে কিন্তু আমরা যারা এর বাইরে কেন বারবার ২০২১ সাল পর্যন্ত মতায় থাকার সঙ্কেতটি ধরতে পারছি না?' পরিকল্পনামন্ত্রীর ছক অনুযায়ী উন্নতি চাইলে এই সরকারকেই আরো দুই টার্ম মতায় রাখতে হবে। ইন্ডিয়ার মিডিয়ায় সজীব ওয়াজেদ জয়ের ঘোষণা, 'শেখ ডাইন্যাস্টি সত্য'। তার লবি যথেষ্ট সফল, কারণ কোনো কারণে শেখ ডাইন্যাস্টিকে আমেরিকা প্রত্যাখ্যান করলেও সার্ক অঞ্চলের ইজারাদার ভারত আর কাকাবাবু প্রণব তো আছেন। রাজনীতিতে যারা ঝুনো নারিকেল সত্ত্বেও ইয়েস স্যার, ইয়েস স্যার, সেই তোফায়েল কিংবা খন্দকার মোশাররফ হোসেনরা রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার যোগ্য নন, উল্কার বেগে জিয়াউর রহমান কিংবা ওবামার উত্থান ও সাফল্য কি শাসকদের ধারণা ভুল প্রমাণ করেনি? এই মুহূর্তে দেশে অন্তত ৫০ জন আছেন যারা রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্য (বয়স রাষ্ট্রপতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে জাপটে ধরেছে, সেটাও আমলে নিতে হবে)। আমার আশঙ্কা, সরকার নির্বাচন এবং পদ্মা সেতু দুটোই আটকাবে, যার আলামত ইতোমধ্যে স্পষ্ট হয়েছে। '৭৫-এর মতো সংশোধনী এনে আরো দুই টার্ম মতা কিংবা একটি এনজিওকে দিয়ে রিট পিটিশন করিয়ে সিটি করপোরেশনের মতো নির্বাচন ঝুলিয়ে দেবে (প্রধানমন্ত্রী সঙ্কেত দিয়ে যাচ্ছেন ১/১১-এর)। শেখ পরিবারের ধারণা, একমাত্র মুজিব ছাড়া স্বাধীনতায় কারোই কৃতিত্ব নেই। শেখ ডাইন্যাস্টি ছাড়া মতার ভাগিদারও নেই। দুই নেত্রীই মনে করেন, সংবিধান এবং পতাকা পারিবারিক। দুই দলেরই ইয়েস স্যারেরা কোমর মাটিতে ঠেকিয়ে বলতে থাকেন হা-হা…, দেশ এবং পতাকা পারিবারিক, কারণ নেত্রী বলেছেন, 'পারিবারিক'। বলির পাঁঠা জামায়াত। ভারতে হইচই শুরু হয়ে গেছে, কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভূমিকম্প ঘটাবে বিজেপি। সব দলেই শিতি, উন্নত, প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ আছে। আছে নতুন নেতৃত্বের সম্ভাবনা। জামায়াত আর বিজেপি ধর্মভিত্তিক আদর্শের হলেও '৭৩ সাল থেকে 'জজ মিয়া জামায়াত' না ঘরকা না ঘাটকা।

লেখক : নিউ ইয়র্ক

farahmina@gmail.com

http://www.dailynayadiganta.com/new/?p=40280


খাঁটি গণতন্ত্রের দেশে গণতন্ত্র বেচাকেনার রাজনীতি
Sunday,February 19, 2012 2:39 am     Bookmark and Share

বিশ্বে সবচে খাঁটি গণতন্ত্রের দেশ মনে করা হয় যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেখানে করপোরেশন, ইউনিয়ন এবং তথাকথিক রাজনৈতিক জোটগুলো (সুপার প্যাক) কীভাবে প্রার্থী বাছাই পর্বের নির্বাচনী প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে তা জানলে 'নিখাদ গণতন্ত্রের দেশ' যুক্তরাষ্ট্রের সুনাম প্রশ্নবিদ্ধ হবে বলেই মনে করেন ওয়কিবহাল মহল। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে চলছে আসন্ন নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী বাছাই পর্বের প্রাথমিক নির্বাচন। কিন্তু এই মুহূর্তে একটা প্রশ্ন বারবার সামনে আসছে- অর্থের প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে (গণতন্ত্রকে!) যেভাবে দুর্নীতিগ্রস্ত করে ফেলেছে সেখান থেকে উদ্ধার কি সম্ভব? সুপ্রিমকোর্টে বহুল আলোচিত সিটিজেন ইউনাইটেড বনাম ফেডারেল ইলেকশন কমিশন মামলার রায় হলো- করপোরেশন, ইউনিয়ন অথবা স্বাধীন রাজনৈতিক কমিটির কেউ চাইলে নির্বাচনে ইচ্ছে মতো ভূমিকা রাখতে পারে। আর তাতে কোনো সীমা নির্ধারিত নেই। সুতরাং এখন প্রার্থীরা তাদের নির্বাচনী প্রচারণার জন্য ধনী আমেরিকানদের ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছেন। যদিও তাদের অনেকেরই তৃণমূল পর্যায়ে শক্ত সমর্থন নেই।


গত ১ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী প্রচারণায় প্রার্থীদের তহবিল সরবরাহকারী তথাকথিত সুপারপ্যাক ২০১১ সালের শেষ নাগাদ পর্যন্ত সংগৃহিত অর্থের পরিমাণ এবং তাদের পরিচয় তুলে ধরে। তাতে দেখা যাচ্ছে, প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী মিট রমনির সমর্থক সুপার প্যাক 'রেস্টোর আওয়ার ফিউচার' সবচে বেশি অর্থের জোগান দিয়েছে। রমনির জন্য তাদের দেওয়া অর্থের পরিমাণ ৩ কোটি ২ লাখ ডলার। তার প্রতিদ্বন্দ্বী নিউট গিংরিচের সমর্থক সুপার প্যাক 'উইনিং আওয়ার ফিউচার' একই সময় তহবিল সংগ্রহ করেছে ২১ লাখ ডলার। অবশ্য এই প্রতিবেদন প্রকাশের পরেই গিংরিচের সুপারপ্যাক বিলিয়নেয়ার ক্যাসিনো মুঘল শেলডন অ্যাডেলসনের কাছ থেকে এক কোটি ডলার অর্থ অনুদান নেয়। এদিকে প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশের উপ-চিফ অব স্টাফ এবং জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা কার্ল রোভের পক্ষেও একটি সুপার প্যাক রয়েছে। আমেরিকান ক্রসরোডস নামের এই গ্রুপটি ২০১১ সালে এক কোটি ৮৪ লাখ ডলার সংগ্রহ করে।

কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশনের নথিপত্রের হিসাবে দেখা যাচ্ছে, এই সুপার প্যাকে ১০ জন বিলিয়নেয়ার রয়েছে। অপর সুপারপ্যাক জোট আমেরিকান ক্রসরোডসের ক্রসরোডস জিপিএস নামে একটি সহযোগী সংগঠন রয়েছে। কিন্তু তারা তাদের দাতাদের নাম কখনো জানায় না। তবে আমেরিকায় এভাবে অর্থ সংগ্রহ এবং খরচের ব্যাপারে কোনো সীমা নির্ধারিত তো নেই-ই বরং তা আইন দ্বারা সংরক্ষিত। আর এইসব তথাকথিত সুপারপ্যাকগুলো নির্বাচনে ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আর যেসব নেতাদের পেছনে টাকার জোর আছে তারাই নির্বাচনী ময়দান দাপিয়ে বেড়ান। তারাই বিভিন্ন টেলিভিশন, পত্রিকায় ঘনঘন আমন্ত্রিত হন। তাদের প্রতাপে ভিন্ন মতাবলম্বি বা সংস্কারবাদীরা হালে পানি পান না। তেমনি এক নেতা লুইজিয়ানা অঙ্গরাজ্যের সাবেক গভর্নর বাডি রোয়েমার। রিপাবলিকানদের টেলিভিশন বিতর্কে তিনি আমন্ত্রিত হননি কারণ ন্যূনতম ২ শতাংশ ভোট পেতে ব্যর্থ হয়েছেন। তবুও রিপাবলিকান পার্টির পাশের আসনে বসে লড়ে যেতে চান তিনি। তার প্রচারণার অন্যতম অংশ হলো নির্বাচনী প্রচারণার তহবিল সংগ্রহ ও খরচের নীতিতে সংস্কার আনা। তিনি প্যাক বা সুপার প্যাক অথবা করপোরেট দাতাদের দ্বারস্থ হননি। সমর্থকদের কাছ থেকে সর্বোচ্চ ১০০ ডলার নিয়েছেন মাত্র।

এমএসএনবিসি টেলিভিশনের একটি বিশেষ শো'র আয়োজক ডিলান র‌্যাটিগান যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে সরকার ও করপোরেশনের মধ্যকার সম্পর্কের সমালোচনা করে যাচ্ছেন ক্লান্তিহীনভাবে। তার মতে, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা ঠিকভাবে মোকাবেলা করতে পারেনি যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র সরকারের ব্যাংক ব্যবস্থা, বাণিজ্য, কর নীতির কঠোর সমালোচক র‌্যাটিগান। তিনি ওয়ালস্ট্রিট দখল করো আন্দোলনের সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। বহিরাগত অর্থ এবং রাজনীতির মধ্যকার সম্পর্ককে 'অপবিত্র' বলে অভিহিত করেছেন এই জনপ্রিয় টিভি উপস্থাপক। প্রাথমিক বাছাই পর্বের নির্বাচন এবং নির্বাচনে কূট কৌশল অবলম্বন নিষিদ্ধসহ বেশকিছু বিষয়ে সংস্কার আনা দরকার বলে মনে করেন র‌্যাটিগান। তিনি সংবিধান সংশোধন করে রাজনীতিতে বহিরাগত অর্থ অনুপ্রবেশ বন্ধ করার প্রস্তাব করেছেন। এছাড়া, এই সংশোধনীর আগে পর্যন্ত নির্বাচনী তহবিলের ওপর শতভাগ কর ধার্য করার পরামর্শ দিয়েছেন র‌্যাটিগান।

র‌্যাটিগান এই তহবিল সংগ্রহের রাজনীতির বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে 'গেট মানি আউট' স্লোগানে প্রচারণাও শুরু করেছেন। এর বিরুদ্ধে ওয়েবসাইটে গণস্বাক্ষরের আয়োজনও করেছেন তিনি। এই আবেদনে গত ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২ লাখ ৫০ হাজারেও বেশি আমেরিকান সই করেছে। কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় নির্বাচনী প্রচারণায় নানা উৎস থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং বেপরোয়াভাবে খরচের প্রবণতা দিন দিন বাড়ছে। যেমন রিপাবলিকান প্রাইমারিতে রাজনৈতিক বিজ্ঞাপনের পেছনে ২০০৮ সালের তুলনায় এবার ১৬০০ শতাংশ বেশি খরচ হয়েছে। আর এসব ব্যয়ের প্রায় অর্ধেকই বহন করেছে সুপারপ্যাকগুলো।

অ্যানিমেটেড বিজ্ঞাপনগুলোতে অর্থায়ন করছে গিংরিচপন্থী সুপারপ্যাক উইনিং আওয়ার ফিউচার। এরা ব্লাড মানি নামে রমনি বিরোধী একটি তথ্যচিত্রও বানিয়েছে। তবে মিট রমনির সঙ্গে গিংরিচ খুব একটা পেরে উঠছে বলে মনে হয় না। তার অর্থদাতারা অনেক বড় মাপের সব বিলিয়নেয়ার। একদিনে এক কোটি ২৫ হাজার ডলার তহবিল সংগ্রহ করেছে রমনির সুপারপ্যাক। নববর্ষের প্রথম দিনে তিনি পেয়েছেন নগদ ২০ লাখ ডলার। রমনিপন্থী সুপারপ্যাক রেস্টোর আওয়ার ফিউচার গিংগ্রিচের সমালোচনা করে একটি বিজ্ঞাপন তৈরি করেছে। তবে এটি কোনো নির্দিষ্ট সুপারপ্যাকের সরাসরি অর্থায়নে নয়।

অরাজনৈতিক এবং অলাভজনক প্রতিষ্ঠান দ্য সান লাইট ফাউন্ডেশন সরকারের মধ্যে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। এরা সিটিজেন ইউনাইটেড রায়ের সমালোচনা করে সমগ্র বিষয়টিকে ব্যঙ্গ করে একটি স্যাটায়ার ভিডিও তৈরি করেছে। তারা দেখানোর চেষ্টা করেছে, এই রায় ২০১২ সালের নির্বাচনী ফলাফলকে কীভাবে প্রভাবিত করবে। তবে দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো- মাত্র অর্ধেক আমেরিকান নাগরিক এই সিটিজেন ইউনাইটেড রায় সম্পর্কে সচেতন, যে রায় সুপার প্যাকগুলোকে অর্থ সংগ্রহ এবং খরচের অবাধ সুযোগ করে দিয়েছে। যারাই এই রায় সম্পর্কে একটু সচেতন তাদের বেশিরভাগই এর নেতিবাচক দিকটিই উল্লেখ করছেন। প্রিন্সটন সার্ভে রিসার্চ অ্যাসোসিয়েশন ইন্টারন্যাশনালের এক জরিপে এমন তথ্যই পাওয়া গেছে। সব রাজনৈতিক দলের বেশিরভাগ ভোটারই মনে করেন, সিটিজেন ইউনাইটেড রায় অনুযায়ী সুপার প্যাকের এই যে অবাধ অর্থ খরচের সুযোগ করে দেওয়া এতে রাজনৈতিক প্রচারণায় নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। তবে মার্কিন রাজনীতিতে শুধু যে টাকার খেলাই আছে, তা কিন্তু নয়। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সাম্প্রদায়িক অনেক স্পর্শকাতর বিষয় নিয়েও সেখানে রাজনীতি হয়। রাজনীতিতে রয়েছে ইহুদি লবির ভয়াবহ প্রভাব। এর একটা উদাহরণ: ফিলিস্তিনিরা অনাহুত এরা এই ভূখণ্ডের নয় বলে মন্তব্য করেছিলেন গিংরিচ। যা ছিল সরাসরি ইতিহাস বিকৃতি এবং সে সময় বিশ্বব্যাপী বিতর্কের ঝড় তোলে।

আরো আছে চাঁদে বসতবাড়ি করে দেওয়ার মতো হাস্যকর প্রতিশ্রুতি। তবে অনেকে আবার বিষয়টি খুব গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছেন। তবে বিষয়টা নিয়ে অন্য ধরনের প্রতিক্রিয়াও আছে। কারণ, এই প্রতিশ্রুতিটা এমন- যেনো চাঁদের মাটি আমেরিকানদের পৈত্রিক সম্পত্তি। চাইলেই ভাগবাটোয়ারা করে নিতে পারবে তারা। দুনিয়ার বাদবাকি মানুষ আর প্রাণীর কথা না ভাবলেও চলবে। মার্কিনিদের এই বিশ্ব অভিভাবকসূলভ মানসিকতাকে ভালভাবে নিতে পারেননি যুক্তরাষ্ট্রের বাইরের অনেকে। এ কথাকে কেন্দ্র করে মার্কিনিদের দোষারোপ করা হচ্ছে- কারণ এই প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর একজন মার্কিনিও এর প্রতিবাদ বা সমালোচনা করেনি।

বাংলানিউজ/নোয়াখালী ওয়েব/১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১২/০২৩৮ঘ./নিউ

আনু মুহাম্মদ

হিলারী ও মেরুদন্ড সমস্যা

মে ১৯, ২০১২

anu-f11111বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার 'গরীব' দেশগুলো রফতানি করে খাদ্য বস্ত্রসহ এমন ভোগ্যপণ্য, যা দিয়ে মানুষ বাঁচে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ 'ধনী' দেশগুলো রফতানি করে অস্ত্র, যা দিয়ে মানুষ মরে।

সংবাদ মাধ্যম জানাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারী ক্লিনটন বাংলাদেশে এসেছিলেন নিরাপত্তা, সন্ত্রাসবাদ দমন ও বিনিয়োগ-বাণিজ্য নিয়ে কথা বলতে। সংবাদপত্র, টিভি টকশো, বিবরণী, 'আড্ডা' সর্বত্র এটাকে বাংলাদেশের জন্য 'বিরাট সুযোগ' 'বিরাট সম্ভাবনা' হিসাবেই দেখানো হয়েছে। হিলারী ক্লিনটনের সফরের আসল বৃত্তান্ত নিয়ে কমই জানা যাবে। বোঝার জন্য কোন সুযোগও রাখা হয়নি। সরকার, প্রধান বিরোধী দল, মিডিয়া, সুশীল সমাজ সর্বত্র এত মুগ্ধতা, গদগদভাব আর সম্মতি ছিল যে কোথাও কোন ভিন্নমত, যথাযথ তথ্য উপস্থাপন কিংবা প্রশ্নেরও সুযোগ ছিল না। মাঝে মধ্যে মনে হয়, আমাদের ভদ্রলোকদের চরিত্রে কি মেরুদন্ডের কোন স্থায়ী সমস্যা আছে? নইলে দেশি বিদেশি ক্ষমতাবানদের সামনে সবসময় এরকম প্রভুতোষণ চেহারা দেখা যায় কেন? তোষণ, তোষামোদ, হাত কচলানো, নতজানু , নতমস্তক, হাত পা ধরা, নুইয়ে পড়া, নিজেদের ছোট করে ধন্য হওয়া এগুলোর এত উপদ্রব কেনো? এই স্বভাব যাদের তাদের সম্পদ আছে, ক্ষমতা আছে। বোঝা যায়, আরও দরকার। এরাই যেহেতু সমাজের নানাক্ষেত্রে ক্ষমতাবান, সেহেতু এদের সমষ্টিগত উচ্ছাসে আচ্ছন্নতা তৈরি হয় চারিদিকে। আগ্রাসনকে ভালবাসা, যুদ্ধকে শান্তি, ধ্বংসকে তখন উন্নয়ন মনে হতে থাকে তখন।

সেজন্য শুধু হিলারী কেন, একের পর এক সফররত কোনো মার্কিনী কর্মকর্তার সামনেই বাংলাদেশের জন্য বহু প্রয়োজনীয় প্রশ্ন উত্থাপিত হয়না। মিডিয়ার আত্মনিয়ন্ত্রণমূলক ভূমিকার কারণে সমাজের মধ্যেও এই জরুরী প্রশ্নগুলো যায় না। অনেক চুক্তি, গোপন সমঝোতা দেশের ভাগ্য নির্ধারণ করে, যেগুলো জনগণের আড়ালেই থাকে। হিলারীও তাই বাংলাদেশে মার্কিন সেনাবাহিনীর অবস্থান, বাংলাদেশ-মার্কিন গোপন সামরিক চুক্তি, মার্কিন-ভারত চুক্তি, ফুলবাড়ীতে উন্মুক্ত খনি করা ও সমুদ্রের গ্যাস ব্লক মার্কিন কোম্পানিকে দেবার জন্য মার্কিন রাষ্ট্রদূতের চাপ, শেভ্রনের পরিবেশ বিধ্বংসী তৎপরতা সত্ত্বেও তার জন্য মার্কিন অব্যাহত তদ্বির, সারা বিশ্বে মার্কিনী সন্ত্রাস, বাংলাদেশের পণ্যের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক, মার্কিন কোম্পানির কাছে আমাদের পাওনা ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি কোনো প্রশ্নেরই মুখোমুখি হননি।

এটা কেন হয়? কীভাবে হয়? এই বিষয় নিয়ে নৃবিজ্ঞানী রেহনুমা আহমেদ তাঁর সাম্প্রতিক লেখায় বিশ্লেষণ করেছেন। এই লেখায় ক্রিস হেজেস-এর এম্পায়ার অব ইল্যুশন(২০০৯) থেকে যে উদ্ধৃতি দেয়া হয়েছে তার সারকথা হল, এই অবনত সংস্কৃতি এমন একটি মায়াময় বিশ্ব তৈরি করে যে, তা মানুষের সামনে বিশ্বের প্রাকৃতিক অবক্ষয়, বিশ্ব পুঁজিবাদের নিষ্ঠুরতা, ক্রমবর্ধমান তেল সংকট, বিশ্ব অর্থখাতের ধ্বস, সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধ সবকিছুকে তুচ্ছ কিংবা অদৃশ্য করে দেয়। …. এই মায়ার সংস্কৃতি আমাদের মায়া থেকে সত্যকে আলাদা করবার ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। আমরা শিশুর মতো পুতুল চালক, যারা নিজেরাই পুতুল, তাদের দ্বারা পরিচালিত হই। টেলিভিশন, প্রচার, বাজারজাত করণের কৌশল, ফটোগ্রাফ, খবর, সাজানো প্রশ্নোত্তর সবকিছু একের পর এক আমাদের বোধবুদ্ধি ভোঁতা করে দিয়ে এক মায়ার জগতে সম্মতি নিয়ে হাজির হতে প্ররোচিত করে। ( 'ইয়েস','ওয়াও', ইয়ুথ আড্ডা উইথ হিলারী, নিউ এইজ, ১৪ মে ২০১২)

আমাদের 'কর্তা'দের কথায় মনে হয়, বাংলাদেশের পণ্য যে যুক্তরাষ্ট্র আমদানি করে সেটা তাদের প্রয়োজন নয়, তাদের দয়া। তারা আমদানি করলেও দয়া, রফতানি করলেও দয়া। তারা বিনিয়োগ করলেও সেটা অনুগ্রহের বিষয়। অথচ তারা ঋণ অনুদান নামে যে তহবিল বরাদ্দ করে তার ৪ গুণ বেশি অর্থ বাংলাদেশ শুল্ক হিসেবে প্রদান করে যুক্তরাষ্ট্রকে। মার্কিন তেল কোম্পানি শেভ্রন যে পরিমাণ বিনিয়োগ করেছে তার কয়েকগুণ ইতিমধ্যে দেশে প্রেরণ করেছে। গত ৬ বছরে তাদের কাছ থেকে গ্যাস কিনতে আমাদের খরচ হয়েছে ১৬ হাজার কোটি টাকা, যে পরিমাণ গ্যাস আমাদের জাতীয় সংস্থা ২ হাজার কোটি টাকায় সম্পাদন করতে পারতো। তাদেরই আরেকটি কোম্পানি অক্সিডেন্টাল মাগুড়ছড়ায় যে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছে তা পুরো বাংলাদেশের বিদ্যুৎ ১ বছরে যে গ্যাস ব্যবহার হয় তার সমান। আন্তর্জাতিক বাজার থেকে এই গ্যাস কিনতে বাংলাদেশের যে অর্থ প্রয়োজন তা তাদের ১০ বছরের বার্ষিক ঋণ অনুদানের সমান।

২০১০-১১ সালে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রে রফতানি করেছে ৫০০ কোটি মার্কিন ডলার পণ্য, এর মধ্যে শতকরা ৯০ ভাগই গার্মেন্টস। অন্যদিকে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আমদানি করে মাত্র ৬৭ কোটি মার্কিন ডলার। দুনিয়াজুড়ে অস্ত্র রফতানিতেই যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান অবস্থান। বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার 'গরীব' দেশগুলো রফতানি করে খাদ্য বস্ত্রসহ এমন ভোগ্যপণ্য, যা দিয়ে মানুষ বাঁচে। আর যুক্তরাষ্ট্রসহ 'ধনী' দেশগুলো রফতানি করে অস্ত্র, যা দিয়ে মানুষ মরে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ যা রফতানি করে তার ওপর শুল্ক দিতে হয় শতকরা ১৫.৩ ভাগ। অথচ তাদের গড় শুল্কহার শতকরা ২ ভাগেরও কম। ফ্রান্স, বৃটেন ও সৌদী আরব থেকে পণ্য আমদানির ওপর শুল্ক শতকরা ১ ভাগেরও কম। অতএব বাংলাদেশ একটি বড় আকারের বৈষম্যের শিকার। স্বল্পোন্নত দেশগুলোর পণ্য আমদানি বিষয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধি ও সাধারণ চর্চার সাথে এটা অসঙ্গতিপূর্ণ। সুতরাং যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে বাংলাদেশের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার, কিংবা বিদ্যমান বৈষম্যের অবসান কোনো দয়াদাক্ষিণ্যের ব্যাপার নয়, বাংলাদেশ এটা নিশ্চয়ই দাবি করতে পারে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস দিয়ে তাদের রাষ্ট্র, ব্যবসায়ীরা এই দেশের মালিকদের থেকে বেশি মুনাফা করে। শুল্কমুক্ত না হলেও শুধু যদি শুল্ক শতকরা ৫০ ভাগ কমে তাহলেও তথাকথিত বিদেশি সাহায্য নামের তহবিলের তুলনায় তার পরিমাণ বেশি হবে।

হিলারীর এই সফর বাংলাদেশের নিরাপত্তা, শান্তি আর সন্ত্রাসবাদ দমনের প্রক্রিয়া শক্তিশালী করবে বলে আমরা বারবার শুনছি। এত ভক্তি এত সালাম এত নিবেদনের মধ্যে খুব সরল কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করাই কঠিন। মার্কিন প্রশাসন ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বরের ঘটনার যে বর্ণনা দেয়, তাতে কোন রাষ্ট্রশক্তি ছাড়াই কতিপয় সন্ত্র্রাসী যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুটি ভবন টুইন টাওয়ার গুড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিল, এমনকি পেন্টাগনেও হামলা পরিচালনা করেছিল। বিশ্বের সবচাইতে দক্ষ যুক্তরাষ্ট্রের নিরাপত্তা ব্যবস্থা তাদের ঠেকাতে পারেনি, সেজন্য সিআইএ, এফবিআই বা সম্পর্কিত কোন সংস্থার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাও নেয়া হয়নি। এনিয়ে কোনো তদন্তকাজও ঠিকভাবে সম্পন্ন হয়নি। তাদের বর্ণনা যদি সত্যিও ধরি তাহলে প্রশ্ন হল, যে রাষ্ট্র কতিপয় ব্যক্তি সন্ত্রাসীর হাত থেকে নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে অক্ষম, তার কোন কুলকিনারাও করতে পারে না সে কী করে অন্যের নিরাপত্তা দেবে? নিরাপত্তার নাম দিয়ে বঙ্গোপসাগর নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ বহুদিনের। ঐ অঞ্চলে মার্কিন সামরিক বেসামরিক লোকজনের ঘন ঘন সফর থেকে যে কেউ এটা উপলব্ধি করবেন। কিন্তু কাকে কার বিরুদ্ধে নিরাপত্তা দেবে যুক্তরাষ্ট্র? যারা আমাদের জন্য হুমকি হতে পারে তাদের সাথেই তো যুক্তরাষ্ট্রের যৌথ মহড়া। ইরাকসহ বিভিন্ন দেশে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধের কথা আমাদের কখনোই ভুলে যাওয়া উচিৎ হবে না। যে রাষ্ট্র সম্পূর্ণ মিথ্যাচার করে ইরাকে লক্ষ লক্ষ মানুষ হত্যা করলো, তাদের ওপর আমরা বাংলাদেশের নিরাপত্তার ভার ছাড়বো?

প্রকৃতপক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ সারাবিশ্বের মানুষ, সহযোগী সারাবিশ্বের তাবৎ সন্ত্রাসীরা। এই তথ্য তাই সবার সবসময় মনে রাখা উচিৎ যে, বর্তমান বিশ্বে সবচাইতে বড় সন্ত্রাসী শক্তি যুক্তরাষ্ট্র নিজেই। মার্কিন গবেষক উইলিয়াম ব্লুম যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের সন্ত্রাসী তৎপরতার প্রামাণ্য বিবরণ দিয়ে কয়েকটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাদের রেকর্ডে এশিয়া আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে নির্বাচিত সরকার উচ্ছেদ, নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধান হত্যা, সামরিক অভ্যুত্থান, গণহত্যা, অন্তর্ঘাতসহ সব বর্বরতা অন্তভর্'ক্ত। বিশ্বে বর্তমানে সামরিক খাতে বার্ষিক ব্যয় বা হত্যা ধ্বংসের প্রধান অংশই যুক্তরাষ্ট্রের ভাগে, একাই শতকরা প্রায় ৬০ ভাগের বেশি। যুক্তরাষ্ট্র এখন নিজেই একটি সামরিক দুর্গ, একটি ক্যান্টনমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্রের বহু মানুষ এখন অনাহারে, কর্মহীন, চিকিৎসার সুযোগ বঞ্চিত। অথচ মার্কিন অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ ইরাক যুদ্ধব্যয়ের হিসাব করে দেখিয়েছেন, প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে ইরাকে গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞে, যার সুবিধাভোগী অস্ত্র ও তেল ব্যবসায়ী, ঠিকাদার ও আমলা। কৃত্রিম বানানো শত্রুর ভয়ংকর চেহারা তৈরি করে আতংকিত আবহাওয়া তৈরি করা হয় মার্কিন জনগণের মধ্যে। এবং তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য বা নিরাপত্তার অর্থ বিনা বাধায় যুদ্ধখাতে স্থানান্তরিত হয়। সেখানেই মার্কিন ক্ষমতাবানদের মুনাফার পাহাড়।

যে কাজ সরাসরি হত্যা, দখল, ধ্বংস আর কিছু নয়- তাই মানুষের সামনে উপস্থিত করা হয় 'সার্বভৌমত্ব' 'মুক্তি' 'নিরাপত্তা' 'গণতন্ত্র' 'স্বাধীনতা' রক্ষা, কিংবা 'সন্ত্রাস' দমনের উপায় হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্র তার সামরিক কার্যক্রমের জন্য বরাবর 'নিরাপত্তার হুমকি' হিসেবে কোন না কোন দেশ বা শক্তিকে দেখিয়েছে। ক্ষুদ্র কিউবা বা নিকারাগুয়াকেও আগ্রাসী শক্তি হিসেবে উপস্থিত করা হয়েছে। প্রচারণার কল্যাণে এসব দেশও, কিংবা বহু দূরের ভিয়েতনাম বা কোরিয়া বা ইরান মার্কিন জনগণকে আতংকিত করতে পেরেছে। এখন আতংক আরও বিস্তৃত হয় কোন গুহায় বসবাসরত কল্পিত কিংবা নিজেদের নির্মিত 'ইসলামী সন্ত্রাসী' দিয়ে। অনেক সরল তথ্যকেও এসব প্রচারণা আড়াল করে ফেলে।

২০০১ সাল থেকে আফগানিস্তান সরাসরি মার্কিনী নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনীর হাতে। এই সময়কালে জাতিসংঘের ড্রাগ অফিসের তথ্য অনুযায়ী আফগানিস্তানে হিরোইন উৎপাদন দ্বিগুণ হয়েছে। এর আগে তালিবান, তারও আগে মুজাহিদীনরাও মার্কিনী মদদেই ক্ষমতায় বসেছিল। মার্কিনী বাহিনী মুজাহেদীনদের মদদ দিয়েছিল এমন সরকারের বিরুদ্ধে – যারা ভূমি সংস্কার করতে উদ্যোগ নিয়েছিল, নারীর শিক্ষা ও চিকিৎসার পথে সব বাধা দূর করতে উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন মার্কিন কর্তৃত্বাধীন আফগানিস্তান থেকে পশ্চিমে হিরোইনের শতকরা ৭০ ভাগ যোগান যায়, যেখানে আফগানিস্তানের শতকরা ৭৫ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার অনেক নীচে বাস করেন। আর এই মাদক সরববরাহের রাস্তাও পরিষ্কার রাখা হয়েছে মার্কিনী নিয়ন্ত্রণাধীন কেন্দ্রীয় এশীয় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নভুক্ত দেশসমূহ দিয়ে, এর মধ্যে অন্যতম তাজিকিস্তান। এই দেশের মানুষদের এখন প্রধান কর্মসংস্থান এই মাদকদ্রব্য চালান কাজ। করপোরেট বিশ্বের মুখপাত্র ইকনমিস্ট পত্রিকা জানাচ্ছে, 'তাজিকিস্তানের জিডিপির শতকরা ৩০-৫০ ভাগ এই মাদকদ্রব্য চালান 'শিল্প' থেকেই আসে।' পত্রিকাটি আরও জানাচ্ছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন যুদ্ধ জোট ন্যাটো তাজিকিস্তানের এই তৎপরতায় বাধা দিতে আগ্রহী নয়। বরং সেখানকার মার্কিন সাহায্যে পরিচালিত মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কর্মকর্তারাই এই কাজে নেতৃত্ব দেয়, তা তাদের অনুমোদনেই ঘটে। ন্যাটো যুক্তরাষ্ট্র এই অবস্থার পরিবর্তন চায় না। কেন? তাদের যুক্তি, কারণ তা করতে গেলে আফগানিস্তানে তাদের যুদ্ধ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাজিকিস্তানে তাদের ভারসাম্য নষ্ট হবে। সেই দেশে দারিদ্র এখন ভয়াবহ, অনেক স্থানে এখন ২৪ ঘন্টায় ২ ঘন্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। (ইকনমিষ্ট, এপ্রিল ২১-২৭, ২০১২) এই হল যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাস দমন, শান্তি ও নিরাপত্তায় সহযোগিতার ধরন।

হিলারীর সফরের পর 'একুইজিশন এ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট' নামে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য চাপও বাড়ছে বলে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরে জানা যায় (নিউ এজ, ১৩ মে, ২০১২)। সামরিক বাহিনীর আধুনিকীকরণের নামে বিপুল অস্ত্রক্রয়েরও চাপ আছে। যুক্তরাষ্ট্রের 'ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারী এফেয়ার্স' এর সহকারী সেক্রেটারী এন্ড্রু জে শেপিরো ঢাকা সফর করেন গত ১৯ এপ্রিল। ২৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে তিনি এক বক্তৃতায় বলেন, 'এই আধুনিকীকরণ কর্মসূচি আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা সম্প্রসারণের সুযোগ দেবে…আমাদের বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র সহযোগীদের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে।'

বঙ্গোপসাগরের কৌশলগত গুরুত্ব এবং খনিজ সম্পদের বিপুল আধার বাংলাদেশের ভূমি ও সমুদ্রে কর্তৃত্ব বৃদ্ধিতে যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনকে বিশেষভাবে সক্রিয় করে তুলেছে। আর এই সক্রিয়তা দেখে আমাদের দেশের অনেক নির্বোধ কিংবা অনুগত কর্তাব্যক্তি বা সুশীল 'বিশেষজ্ঞরা' মুগ্ধ। এতেই নাকি বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা উন্মুক্ত হবে! যুক্তরাষ্ট্র যদি কোনো দেশের ওপর ভর করে, আর সেই দেশ যদি তাদের ভৃত্য হিসেবে সার্ভিস দিতে থাকে তার কী পরিণতি হয় তা দেখার জন্য আছে পাকিস্তান নামক তাবেদার রাষ্ট্রটি।

মেরুদন্ডের সমস্যাওয়ালা লোকেরা এই দেশের নানা ক্ষেত্রে মাথা হয়ে থাকায় জাতির মাথা বারবার হেঁট হচ্ছে, বিপদ ও বিপর্যয় তৈরি হচ্ছে নানা মাত্রায়। এদের হাত থেকে বাংলাদেশকে মুক্ত না করতে পারলে আমাদের কোন উদ্ধার নাই। এটাই ভরসার কথা যে, এরাই বাংলাদেশ নয়। ১৯৭১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব ও ইচ্ছা প্রত্যাখ্যান করেই মানুষ যুদ্ধ করে বাংলাদেশ এনেছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে মার্কিন প্রশাসনের প্রবল চাপ ছিল বাংলাদেশ থেকে গ্যাস রফতানি করা আর চট্টগ্রাম বন্দর তাদের এক জালিয়াত কোম্পানির হাতে তুলে দেয়া। জনগণ মেরুদন্ড নিয়েই এর সবই প্রতিরোধ করেছেন। দেশের পানি, আবাদী জমি ও মানুষের সর্বনাশ করে ফুলবাড়ী উন্মুক্ত খনি করতে চেয়েছিল এরা। মানুষ জীবন দিয়ে তা ঠেকিয়েছেন। এটা হয়নি, হবে না। মেরুদন্ডহীনদের তোষামোদী সত্ত্বেও কনোকো ফিলিপসের সাথেও জনগণের মোকাবিলা চলছে। বঙ্গোপসাগরের সম্পদ লুট ও পাচার এদেশের মানুষ কোনভাবেই হতে দেবে না। বিশ্বজুড়ে যুক্তরাষ্ট্রের দানবীয় আগ্রাসনের মুখেও, তাকে আমাদের প্রত্যাখ্যান করবার সাহস দেখানোর তাই যথেষ্ট কারণ আছে।
১৮ মে ২০১২

আনু মুহাম্মদ: শিক্ষক, অর্থনীতিবিদ, গবেষক এবং তেল-গ্যাস রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্যসচিব ।

Tags: 

http://opinion.bdnews24.com/bangla/2012/05/19/%E0%A6%B9%E0%A6%BF%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80-%E0%A6%93-%E0%A6%AE%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A7%81%E0%A6%A6%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A1-%E0%A6%B8%E0%A6%AE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%AF%E0%A6%BE/


মন্দাকাহন-আমেরিকান রিশেসন

(১) টেলিকম নিউক্লিয়ার উইন্টার / ২০০১-২০০৩

আমেরিকাতে "রিশেসন" টার্মটার ব্যাবহার লোকের মুখে মুখে। সব কিছুর কনভার্জড উত্তর-রিশেসন ম্যান রিশেসন। এটি কোন এক্সপেশন না-প্রত্যেকটি খেটে খাওয়া আমেরিকানদের উপলদ্ধি থেকে উঠে আসা গভীর "বোধ"।

Homeless American

আমার আমেরিকাতে পদার্পন ২০০১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে। ন্যাসডাক তখনো সাড়ে তিন হাজারে দাঁড়িয়ে-প্রতিদিনই প্রায় শ খানেক করে নামছে। ব্যাঙ্করাপ্সি ফাইলিং নিত্য অভিজ্ঞতা। আর যেসব ভারতীয়রা জলের মতন আমেরিকাতে ঢুকে ছিল ভাগ্যের সন্ধানে, অনেকেই তাদের নতুন কেনা গাড়িটিকে সানফ্রান্সিকো এয়ার পোর্টে চিরতরে পার্ক করে দেশে ফিরে গেছে!

আমেরিকাতে টেলিকমের সব থেকে দুর্দিনে টেলিকম স্টার্টআপে চাকরি দিয়ে আমার পেশাদার জীবন শুরু। তবে তখনো মন্দার গোলমরিচ রোদ গায়ে লাগে নি। তার আগের বছর অপটিক্যাল নেটওয়ার্কে প্রায় ছ বিলিয়ান ডলার ঢালা হয়েছিল নানা স্টার্ট আপে। অধিকাংশ কোম্পানীতেই ঠিক ঠাক লোক ছিল না, শুধু টাকা ছিল। আমাদের ম্যানেজমেন্ট ছিল লুসেন্ট এর অবসরপ্রাপ্ত লোকেরা। সুতরাং সেই অর্থে বরং আমি ভাগ্যবান যে ঠিক ঠাক লোকেদের সাথেই ছিলাম এবং যার জন্যে পথে বসতে হয় নি। অন্য অনেক ভারতীয়দের কপালে সেই সোভাগ্যটুকুও ছিল না। ফেব্রুয়ারী মাসে আমার সাথে অনেকেই যারা এসেছে, তাদের বেশ কিছু লোক এখানে এসে দেখে তাদের চাকরী নেই। ভাল কোম্পানী হলে রিটার্ন টিকিট দিয়ে দিয়েছে-আর অধিকাংশের ভাগ্যে সেটাও জোটে নি।

তবে সেই শীতে নিউজার্সি তখনো আপবিট। আমার সঙ্গীরা যেহেতু সবাই লুসেন্টের প্রাত্তনী-এদের অনেকেই রিয়ারমেন্টের টাকা লুসেন্টের স্টকেই ঢেলে ছিলেন। প্রায় সবার রিটারমেন্ট বেনিফিট আমার সামনেই সাফ হয়েছে। তবে এরা এক সময় আমেরিকাতে অনেক কামিয়েছেন-বাড়ির লোন শোধ করা হয়ে গিয়েছিল। তাই তাদেরকে খুব বেশী চিন্তা করতে দেখিনি। শুধু ওরা হেঁসে বলত প্রতি ছমাসে ওদের রিটারমেন্ট সঞ্চয়ে একটা করে শুন্য কমছে! তবে সেই সোভাগ্যত আর ভারত থেকে আসা সদ্য সফটওয়ার কর্মীদের ছিল না। তাদের অবস্থা এত খারাপ হয় আপার্টমেন্ট থেকে মল সর্বত্র ভারতীয় দেখলেই জিজ্ঞেস করত " দাদা আপনাদের কোম্পানীতে কর্মখালী আছে? আমরা সব পারি-জাভা, ডটনেট-যা বলবেন সব কিছু। একটু দেখুন প্লিজ -গত ছমাস বেঞ্চে বসে আছি"।

আমি যে আপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সে থাকতাম-সেখানে প্রায় সবাই লুসেন্টের হোমডেল ভবনে চাকরী করত। আমি যখন আসি, তখন দুমাস বাদে এপার্টমেন্ট পেয়েছিলাম। তারপরে জুন মাসের মধ্যে কমপ্লেক্স খালি হতে শুরু করে। লুসেন্টে তখন প্রতি ১৫ দিনে তিন চার হাজার করে ছাঁটাই হচ্ছে। আমি শুধু দেখছি পার্কিং লটে গাড়ির সংখ্যা কমছে। আগে জম জমাট থাকত সুইমিং পুল টেনিস কোর্ট- আস্তে আস্তে সেখানেও লোক কমছে। ২০০২ সালের মধ্যে ওই কমপ্লেক্সে লুসেন্টের একটি বন্ধুও রইল না। সবাই ছিটকে গেল নানা কোনে। আমাদের ঘনিষ্ঠ পরিবার যিনি লুসেন্টের খুব বিখ্যাত গবেষক ছিলেন-কোপ তার ওপর ও পড়ল! কেও বাদ রইল না! আই আই টি, প্রিন্সটনের ডিগ্রি, বছরে ২০ টি করে পেপার-কিছুই তাকে বাঁচাতে পারল না! আমার সেই বন্ধুটি যিনি এখন কম্পুটার সায়েন্সের একজন বিখ্যাত অধ্যাপক-তিনিও বেকার ছিলেন প্রায় একবছর।

২০০১ সালের আগষ্ট মাসে মন্দার প্রথম উত্তাপ টের পেলাম। তখন কোম্পানীতে ছিল ৭০ জন। হঠাৎ একদিন দেখি আমার পাশের ঘরের ছেলেটি নেই। ভাবলাম ছুটি নিয়েছে। লাঞ্চের সময় জানলাম কোম্পানী ১০ জনকে লে অফ করেছে। মাইল্ড শক। সি ই ও ইমেল করে জানালো দ্বিতীয় দফার ফান্ডিং এখন আসতে দেরী আছে-তাই ক্যাশ বাঁচাতে এই সিদ্ধান্ত।

খেয়াল রাখতে হবে আমেরিকার স্টার্টআপ কালচারে আমি যখন ঢুকেছি-আমার সহকর্মীদের অনেকেই মিলিয়ানার। স্টার্ট আপ করেই। আমি ওই কোম্পানীর প্রথম দশজন কর্মীর একজন ছিলাম-আমাকেও প্রচুর স্টক দেওয়া হয়েছিল। আশে পাশের মিলিয়ানারদের দেখে যারা বেঞ্জ বা বি এম ডব্লু তে করে আসতেন এবং প্রাসাদসম বাড়িতে থাকতেন-আমার ও ধারনা হল, আগামী তিন চার বছরের মধ্যে আমিও মিলিয়নার হতে চলেছি। উচ্ছাসে ভাবী স্ত্রীকে জানিয়ে দিলাম-চিন্তা করোনা, আমাদের পঞ্চম বিবাহবার্ষিকীকে তোমাকে একটা বেঞ্জ উপহার দিচ্ছি!! কারন আমাকে এর বেশী স্টক দেওয়া হয়েছে, আই পি ও হওয়ার পর, আমি বেশ কয়েক মিলিয়ানডলারের মালিক হতে চলেছি। সেই আশাতেই সবাই সপ্তাহে সাত দিন কাজ করত। তবে কাজ করে মজা ছিল-শেখার ছিল অনেক কিছু-শিক্ষকরাও ছিলেন সেরা-তাই বাজে লাগে নি। দরকার হলে রাত দুটো তিনটে অব্দি কাজ করতাম। ভাবটা ছিল-মোটে তিন চার বছরের ব্যাপার। তারপরে মিলিয়নার হয়ে দেশে ফিরে বাকী জীবন স্ফূর্তি করব।

"আশা" বস্তুটি এতই নিরেট-নিরাশাকে সে মানতে চাইত না। ২০০২ সালের গ্রিষ্মেও যখন সেকন্ড রাউন্ড ফান্ডিং এলো না, সবার মাইনে কমানো হল, চাকরী গেল ৩০ জনের। চোখের সামনে এতজনকে ফায়ারড হতে দেখে, রাতে ঠিক ঠাক ঘুম হত না। আমদের পরিশ্রম আরো বাড়ল। তখনো হাল ছাড়ার প্রশ্ন নেই। প্রোডাক্ট প্রায় রেডি। ভারিজন ট্রায়াল নেবে-এবং ট্রায়ালে সফল মানে টাকা অনেক আসবেই!

হায়রে ধণতন্ত্র! আমাদের ক্ষুদে টিমটা যে আপটিক্যাল ট্রান্সপোর্ট প্ল্যাটফর্ম তখন বানিয়েছিল-সেটি সময়ের থেকে অনেক এগিয়েছিল। ভারিজনের ট্রায়াল সফল হল। কিন্ত টাকা এলো না। কারন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাঙ্কাররা অপটিক্যাল নেটোয়ার্কে এত টাকা হারিয়েছে, কেও এক ডলার ও দেবে না। ২০০৩ সালে ছাঁটাই করতে করতে কোম্পানী যখন মোটে ১২ জনে দাঁড়িয়েছে, সিই ও বললেন এবার ফুলস্টপ!

তার পরের দিনটা ভুলতে পারব না। সবাই যে যা পারছে খুলে নিয়ে যাচ্ছে। ল্যাবে তখন প্রায় ত্রিশ কোটি টাকার ওপরে বাক্স টাক্স আছে। সেগুলোর মার্কেট ভ্যালু একদিনে শুন্য। ফাইবার এম্পিফায়ার ইত্যাদি দামি বেশ কিছু জিনিস আমিও খুলে নিই যা পরে মাদ্রাস আই আই টিতে ছাত্রদের জন্য পাঠিয়ে দিই। যার জন্যে এত লড়াই, এত মারামারি, এত ঘাম, এত বিনিদ্র রজনী-একদিনে শেষ! আমাদের আড়াই বছরের সবার পরিশ্রম শুন্যে এসে ঠেকল। কারন মার্কেট আমাদের চাইছে না। বিশ্বাস করতেও চাইছে না। মার্কেটই আমাকে আমেরিকাতে এনেছে-সন্মান অর্থ সবই দিয়েছে-আবার সেই মার্কেটই আমাদের জীবনের তিনটে বছর মুছে দিল। আমাদের বড় বড় রথী মহারথিরা চাকরী না পেয়ে সরকারি কেরানীর চাকরি নিলেন। আর আমাদের মতন তরুনদের ভাগ্যে পড়ে রইল কঠিন জীবন সংগ্রাম।

এর পরবর্তীতে তিন মাসে আমি প্রায় ১৯ টি ইন্টারভিউ দিই চাকরির জন্যে। এর মধ্যে ১৭ টি ছিল আমার নিজের ফিল্ডে। বাকী দুটি অন্য এলাকাতে যাতে আমার জ্ঞান ছিল ভাসা ভাসা। সেই ১৭ টি ইন্টারভিউ এর একটিতেও চাকরি হল না নিজের ফিল্ডে-কারন তখন ইন্টারভিউ ও প্রহসন বা ভবিষ্যতের জন্যে। বাকী যে দুটো ফিল্ডে চাকরি পেলাম, সেটি আমার দুনিয়া না-অভিজ্ঞতাও ছিল না। তবে ভাসাভাসা জ্ঞান ছিল।

আরেকবার প্রনাম করলাম বাজার সরকারকে। কি অপূর্ব তার মহিমা। তিন বছর আগে, আমি যখন পি এই চ ডি শেষ করছি , কিন্ত অভিজ্ঞতা অল্প, আমার বাজার দর উঠেছে চর চর করে। কারন ন্যাসডাক বিলিয়ানস অব ডলার ঢেলেছে টেলিকম শিল্পে। ১৯৯৭-২০০০ ছিল টেকনোইউটোপিয়ার যুগ। প্রযুক্তিই একমাত্র সমৃদ্ধি আনবে এই বিশ্বাসে প্রতিটা আমেরিকান জীবনের সঞ্চয় খুইয়ে সর্বশ্রান্ত হয়েছে। বলা যায় তাদের টাকার জোরেই শুধু আমেরিকাতে থেকেই তিনটি চাকরি পেয়েছিলাম ভারতে পি এই চ ডি শেষ করার আগেই এবং দুটিতে স্যালারি ছিল ছয় অঙ্কের ওপরে। থিসিস জমা দেওয়ার পরের দিনই আমি আমেরিকা আসি এবং তার পরের দিন থেকেই কার্যত কাজে। কারন তখন অপটিক্যাল ট্রান্সমিশনে এক্সপার্ট লোক প্রায় ছিল না। আর তিন বছর বাদে- বাজারই আমাকে তুলেছিল-আবার যথাস্থানে নামিয়েও দিল। তখন আমার আট বছরের অর্জিত অভিজ্ঞতার কোন মূল্য নেই। আমি ত ছার। আমার বসের মতন লোকেরা যিনি এম আই টির প্রাত্তন অধ্যাপক এবং ত্রিশ বছরের অভিজ্ঞতা -তার ও দুর্দিন গেছে।

এর নাম বাজার। জীবনের শুরুতেই এর যে অপূর্ব মহিমা আমি দেখেছি-তারপরে ধনতন্ত্রের প্রতি আস্থা আমার উবে গেছে।

এর মানে এই নয় যে লেনিনিজমে বা সমাজতন্ত্রে আমার বিশ্বাস এসেছে-বরং আমার চিন্তাধারা সিস্টেম এগনস্টিক হয়েছে।

আমি পর্যবেক্ষক মাত্র। খুব অদ্ভুত এই বাজার। এখানে যুক্তির স্থান নেই-সবাই লাস ভেগাসের স্লট মেশিনের মতন ফাটকা খেলছে। প্রথমে বিশ্বাস করতে কষ্ট হত-আস্তে আস্তে নিজেকে বোঝাকে সমর্থ হয়েছি ধনতান্ত্রিক এই প্রক্রিয়াতে জ্ঞান এবং কোন সাবজেক্টের প্রতি ডেডিকেশনের কোন মূল্য নেই-শেষ কথা ডলার। বিশ্ববিদ্যালয় গুলিতেও এই ভাইরাস এখন সংক্রামিত। সব প্রফেসরটা চাকরি টেকাতে যেভাবে টাকা আনার পেছনে ছুটছে বড় বাজারের মারোয়ারীরা ওদের দুহাত তুলে প্রনাম করবে।

রিশেসনের আরেকটা গল্প না বললে এই অধ্যায় শেষ হবে না। আমার কোম্পানীতে বাহাত্তর বছরের এক বৃদ্ধ রবার্ট হাউসেন ছিল আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু।

রেড ব্যাঙ্ক নদীতে ও আমাকে সেইলিং করতে শিখিয়েছিল। হার্ভাড ইলেক্ট্রিক্যালের পি এচ ডি এবং টি ওয়ান প্রযুক্তি যা পৃথিবীর প্রথম ব্রডব্যান্ড প্রযুক্তি- তার আবিস্কারক এই হাউসন সাহেব। ২০০২ সালে তার ক্যান্সার ধরা পরে। প্রস্টেট ক্যান্সার। আমি বল্লাম তুমি রেস্ট নাও। ও বললো তাহলে আমার চিকিৎসা কে করবে? রিয়ারমেন্টের সব টাকা, পেটেন্টের সব টাকা টিস্যু পেপার এখন!

ওর মতন একজন কৃতবিদ্য লোককে শুধু মেডিক্যাল ইন্সোরেন্সের জন্যে ক্যান্সার নিয়ে প্রতিদিন অফিসে আসতে হচ্ছে-আমার খারাপ লাগত। ও বলত এই বেশ ভাল আছি। আর কদিনই বাঁচাবো! বরং কাজ করেই বাঁচি। হাউসন আমার বাবার সম বয়সী। আমার বাবা গ্রামের হাইস্কুলের শিক্ষক ছিলেন-তার ও পেনসেন আছে। তিনি অবসর জীবন নিশ্চিন্তেই কাটাচ্ছেন। আর হাউসন সাহেবের মতন একজন বিখ্যাত প্রযুক্তিবিদ ধনতন্ত্রের জাঁতাকলে চিরকারই তেল বার করে গেলেন! কে জানে-এই মানবিকতাটুকু নেই বলেই হয়ত ধনতন্ত্র কাজ করে-সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে লালবাতি জ্বলছে!

তবে কিছু "জেন" উপলদ্ধিও হয়েছে ওই তিন বছর। আমেরিকা কেন উদ্ভাবন করে , আর বাকীদের গবেষনা কেন ল্যাবেরাটরীতেই পড়ে থাকে, সেই সমীকরণ পরিস্কার হয়েছে। জীবনত একটাই-আমি কৃতজ্ঞ যে ধনতন্ত্রের হৃদপিন্ডতে বসে তাকে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। যেদিন দেখলাম চ্যাসিগুলো থেকে সবাই যেযার মতন দামী দামী আম্পলিফায়ার খুলে নিয়ে যাচ্ছে -নিজেকে বোঝালাম আমি বাজারের ক্রীতদাস। বাজার মহারাজ যা চাইবে-আমি তার বাইরে একচুল কিছু করার সামর্থ্য রাখি না।

(২) মিডিয়া রিশেসন-২০০৭ এবং পরবর্তী

নিউজার্সিতে স্টার্টআপ গেমে এত মগ্ন ছিলাম-ক্যালিফোর্নিয়াতে নতুন চাকরিতে জয়েন করার পর, ঠিক করলাম -অনেক হয়েছে। এবের খাব স্ফূর্তি করব -আর ঘুরবো। এটা ছিল জার্মান কোম্পানীর রিসার্স এন্ড ডেভেলেপমেন্টের কাজ। ইউরোপে প্রায় ৪৫ দিন লোকে ছুটি পায়। ওদের সাথে কাজ করতে হত বলে, আমেরিকাতে কাজের চাপ ছিল অনেক কম। তাছারা ইউরোপিয়ানরা ব্যাবসা এবং শিল্পের ব্যাপারে রক্ষনশীল। ওদের কাজের প্রতি একটা এটাচমেন্ট আছে-যা আমেরিকানদের নেই। যেমন আমাদের এন্ড্রেস হাউসার মোটামুটি ৮০ বছর ধরে ইনস্ট্রুমেন্টেশন শিল্পেই ছিল। ওরা ওটাই করে-এবং তাতেই বিশ্বসেরা। আর কোন ব্যাবসা তারা করে না। আমেরিকাতে এবং তার দেখাদেখি ভারতে, কারুরই প্রায় শিল্পের প্রতি সেই টান নেই। সবাই ফরেদার। একটা ব্যাবসাতে সফল হলে রিয়াল এস্টেট থেকে প্লেইন কেনা সব কিছুই করে বসে। যার জন্যে আমেরিকানরা উদ্ভাবনে সফল হলেও ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাবসার ব্রান্ডিং এ জার্মানী থেকে পিছিয়ে। আমার অবাক লাগত ওখানে সবাই ১৫-২৫ বছর ধরে চাকরি করছে। ওরা হায়ার ও খুব বেশী করে না-ফায়ার ও করে নি। আস্তে আস্তে সর্বোৎকৃষ্ট প্রযুক্তি বানাতে থাকে।

একটা ফিল্ডে বহুদিন কাজ না করলে, উৎকর্ষতা আসে না। আমেরিকানরা অবশ্য উৎকর্ষতা, প্রযুক্তির প্রতি প্যাশন এসব নিয়ে চিন্তিত না-তাদের কাছে বোতলে জল ভরে ব্যাবসা করা আর ন্যানোটেকনোলজিতে কাজ করা -সব কিছু মাপার একটাই নিমকাঠি- ডলার।

যাইহোক এখানে দুর্দান্ত তিনটে বছর কাটালাম। এই বছরগুলি আমেরিকানদের জন্যেও বেশ ভাল-রিয়াল এস্টেটে সবাই টাকা বানাচ্ছে। কাজের চাপ নেই। আমেরিকা ঘুরতে হত কাজের জন্য। ইউরোপিয়ান কোম্পানীগুলিতে খানা পিনা ঘোরা এসব বেশী হয়। লেখার অবসর ছিল-লেখক হিসাবে আত্মপ্রকাশ এখান থেকেই। মোটামুটি ভাবে বড়লোক হব সেই স্বপ্নও নেই-তাই দৌড়ঝাঁপ ও নেই। টাকার পেছনে না দৌঁড়ালে জীবনটা অনেক সহজ । এন্ড্রেস হাউসারে অধিকাংশ কর্মী সারাজীবন কাজ করে ওখানেই রিটায়ার করে। মোটামুটি নচিকেতার এই বেশ ভাল আছি গেয়ে আর লেখালেখি করে কাটিয়ে দিচ্ছি-এমন সময় একটা অপ্রত্যাশিত ফোনকলে আবার জ়ীবনের ধারা বদলে গেল।

হলিউড থেকে এক ভদ্রলোক ফোন করে জানাল সে আমার সাথে কথা বলতে চাইছে। আমি তখন স্টার্টাআপের প্রতি এত বীতশ্রদ্ধ আর একটা ভালো কোম্পানীতে এত আরামে আছি-ওই ভদ্রলোকের স্টার্টাআপে জয়েন করার প্রশ্নই আসে না। উনি বললেন একবার হলিউডে আমার কোম্পানীতে এসে ঘুরে যাও-আমার কিছু প্রশ্ন আছে-তোমার রেজুমে দেখে মনে হল, এর উত্তর তুমি দিতে পারবে। আমি কোন প্রযুক্তিবিদ না-গায়ক। এখন এই কোম্পানীটা খুলেছি। আমার ধারনা মিডিয়া এখন প্রযুক্তির হাতে-শিল্পীদের হাতে আর নেই।

ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং মনে হল। জীবনত একটাই-দেখাই যাক আরেক বার স্টার্টআপ স্লট মেশিনে কয়েন ফেলে। যদি শিকে ছেঁড়ে। তাছারা আমি যা মাইনে চাইলাম -উনি আমাকে তার দেড়গুন দিলেন। ফলে না বলার আর উপায় থাকলো না। তাছারা তদ্দিনে আমি আমেরিকার স্থায়ী বাসিন্দা-তাই নতুন চাকরি পেতে অসুবিধা হবে না জেনে, এবার জীবনে দ্বিতীয়বারের মতন ঝাঁপালাম।

২০০৭ সালে আমেরিকান মিডিয়াতে ত্রাহি ত্রাহি রব উঠে গেছে। মূল কারন সোশ্যাল মিডিয়া, ব্লগ, ইউটিউব এবং ক্রেগ লিস্ট। লোক্যাল প্রিন্ট মিডিয়ার সব থেকে বড় ইনকাম সোর্স ক্ল্যাসিফায়েড বিজ্ঞাপন। ক্রেগলিস্ট বিনা পয়সাতে সে সুযোগ দেওয়াতে আমেরিকাতে লোক্যাল নিউজ পেপার বলে কিছু থাকল না। সাংবাদিকদের আঁতুর ঘরই ধ্বংশ তখন। হলিউড এবং টিভি মিডিয়া ইউ টিউবের চাপে দিশে হারা। সব সিনেমা, সব ডিভিডি পাইরেটেড হয়ে ইউ টিউবে দেখা যাচ্ছে। হলিউডের পর্ণ শিল্পও ২০০৬ সালেই শেষ-পাইরেসি এবং হোম মেড পর্নের কৃপায় লোকে আর টাকা দিয়ে নগ্নতা কিনছে না! এমন দুর্দিনে আমার হলিউডে পদার্পন। আমার কলিগরা এক সময় প্রচুর টাকা কামাত। কিন্ত ২০০৫ সাল থেকে ওরা প্রায় বেকার বসে আছে। আসলে হলিউডে দুটো ক্লাস আছে-যার একদম ওপরে তারা ডিজনি বা ফক্সে কাজ করে। হলিউডের অধিকাংশ জীবিকা সংস্থান হয় সফট পর্ন নির্ভর বি গ্রেড সিনেমাগুলিতে।

মিডিয়ার শোবিজনেসে আসলে সবাই নানা প্রকৃতির ম্যাজিশিয়ান। বাস্তবতা থেকে ইনারা অনেক দূরে থাকতে ভালোবাসেন-স্বপ্ন তৈরী করাই তাদের কাজ। সেটা করতে গিয়ে বাস্তবটাকে এরা বেমালুম ভুলে যায়। ফলে ২০০৪-৫ সালে যারা বছরে মিলিয়ান ডলার রোজগার করত, তাদের উপায় যখন শুন্যে গিয়ে ঠেকল-তারা বুঝতে পারছিল না ব্যাপারটা কি! এটা বুঝতে পারছিল, মিডিয়া আস্তে আস্তে প্রযুক্তির হাতে চলে যাচ্ছে।ফলে অনেকেই আমাদের কোম্পানীতে টাকা ঢালতে লাগলো -এবং এখানে লোকের প্রত্যাশাটাও সিনেমাতে টাকা লাগানোর মতন। হলিউডের ছোট সিনেমাগুলোতে ছোট ছোট ইনভেস্টররা টাকা খাটায়-এই ভাবেই তারা এতদিন করে খাচ্ছিল। ইউ টিউব সহ ভিডিও শেয়ারিং সাইটের জন্যে দুর্দিন তাদের সামনেও। তারাও এবার টেক স্টার্টআপে টাকা ঢালা শুরু করল। এবং এই ধরনের প্রত্যাশা থাকলে যা হয়, তাই হল। সেই হাজারটা নতুন প্রজেক্ট শুরু করে-কোনটাই শেষ না করার জন্যে লালবাতি জ্বলা শুরু হল।

হলিউড সত্যই এক অদ্ভুত সৃষ্টি- অনেক লোকের পকেটে এক পয়সা নেই-অধিকাংশ নায়ক নায়িকাই বেকার-অড জব করে দিন কাটে-এদিকে তাদের দেখাতে হবে তারা বড়সর অভিনেতা। ফলে একাধিক নায়ক নায়িকা একসাথে বেভারলি হিলসে মাত্র একটা ঘর ভাড়া করে-লোককে দেখানোর জন্যে। পোষ্টাল এড্রেসের জন্যে। নিজেরা থাকে বারব্যাঙ্কের বস্তিতে।

হয়ত ম্যাকডোনাল্ডে কাজ করে-দু একটা টিভি সিরিয়ালে মুখ দেখিয়েছে-কিন্ত পেপারে বা টিভিতে ইন্টারভিউ দেওয়ার সময় এমন ম্যাজিক ক্রিয়েট করবে যেন মনে হবে এ বোধ হয় সত্যই বেভারলি হিলসে থাকা কেও কেটা অভিনেতা।

আগে ছোট খাট লো বাজেটের সিনেমা অনেক হত হলিউড থেকে-ক্রমশ ইউটিউব আর টরেন্টের পাইরেসির দৌঁড়াত্বে তা কমতে থাকে-ফলে এদের হতাশাও ক্রমশ আরো বাড়তে থাকে। সাথে সাথে টাউটগিরি এবং ঠকানোর প্রবনতাও।

সবাই মিডিয়া ম্যাজিক সৃষ্টি করতে গিয়ে, নিজেরাই ম্যাজিকের শিকার হয়। এই ব্যাপারে সাংবাদিকদের নিয়েও দুকথা বলা দরকার। আমেরিকাতে সাংবাদিক পেশাকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয়, এই চাকরির সৌজন্যে। এর আগে অব্দি সাংবাদিকদের প্রতি আমার বিশাল শ্রদ্ধা ছিল। আস্তে আস্তে বুঝলাম এরা ওই ম্যাজিকে ম্যাজিকশিয়ানদের জাদুদন্ড। এবং অধিকাংশই নিজেদের পাতা মাইনে আহত সৈনিক। সিনেমা জগতের অধিকাংশ সংবাদই টাকা দিয়ে তৈরী হয়-সুতরাং নিরেপেক্ষ সাংবাদিকতা বলতে কিছু নেই-সব খবরই টাকার কাছে নাকখঁত দিয়ে বসে আছে। কর্পরেট জগতের বিরুদ্ধে কিছু লিখলে, সম্পাদক মোটেও সেটি ছাপাবেন না-কারন বিজ্ঞাপন বিভাগ সম্পাদকের চাকরি খাবে। বেসিক্যালি সংবাদ বলতে যেটি আমাদের পরিবেশন করা হয়-সেটি সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন দাতা ও রাজনৈতিক লবির দাদাদের সেন্সর করা একটি রসগোল্লা। যেকারনে সোশ্যাল মিডিয়া আসার সাথে সাথে মূলধারার সংবাদ পত্রগুলি একদম শুয়ে পড়েছে। এই ধরনের ধাপ্পাবাজি আর কদিন জনগণ মেনে নেবে? ফলে আমেরিকাতে প্রায় ৯০% সাংবাদিকই বেকার। সোশ্যাল মিডিয়াতে ব্লগ লিখে দুপয়সা রোজগার করছে। ভারতে এই দিন এখনো আসে নি-কারন ইন্টারনেটের ব্যাপক প্রচলন এখনো হয় নি। আস্তে আস্তে সেটা আসছে-এবং আগামী দশ বছরের মধ্যে ভারতেও সাংবাদিকরা বেকার ঘুরবে। ওটা কোন পেশা বলেই গণ্য হবে না। ব্লগার বলে একটা নতুন পেশার জন্ম হবে। সাংবাদিক পেশাটাকে যেটুকু কাছ থেকে দেখেছি-এটিকে একধরনের বুদ্ধিজীবি বেশ্যাবৃত্তি বলেই গণ্য করব।

(৩) সাবপ্রাইম ক্রাইসিস -২০০৮-২০১০ (!)

আমেরিকার সাবপ্রাইম সংকট যেভাবে গোটা বিশ্বর অর্থনীতিকে নাড়িয়ে দিল-তাতে নিশ্চয় আজকাল আর কেও অবাক হবে না। বাড়ির দামের এত অযৌত্বিক বৃদ্ধি আমি দেখেছি-এতে কোন সন্দেহই নেই ব্যাঙ্কের ঢালা টাকায় খুব সুপরিকল্পিত ভাবে এই বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। ২০০৪ সালে যখন ক্যালিফোর্নিয়াতে পৌঁছালাম, তখন এনাহেমের মতন শহরে যেখানে লোকেদের গড় উপায় ৪৪ হাজার ডলারের কম-অধিকাংশই মেক্সিকানদের বাস-সেখানেও একটা তিন বেডরুমের বাড়ির দাম ৭০০ হাজার ডলার। এনাহেম ডিজনিল্যান্ডের জন্যে খ্যাত। তার পাশেই থেকেছি তিন বছর। যে জিনিসটা অবাক করেছে-ঐ এলাকাতে ডিজনিকে কেন্দ্র করে বছরে দু বিলিয়ান ডলারের ব্যাবসা হয়-অথচ ডিজনির এলাকা বাদ দিলে শহরটাতে বস্তির সংখ্যাই বেশী। এই শহরের অধিকাংশ কর্মীই ছিল ডিজনিল্যান্ডের -যারা ঘণ্টায় ১৪-২০ ডলার রোজে কাজ করে। বা হোটেলে কাজ করে। কিন্ত এই দুই বিলিয়ান ডলার যাদের হাতে পৌঁছাত, তারা থাকত বিলাস বহুল নিউপোর্ট বিচে বা আরভাইনের মতন বড়লোকদের শহরে। এই ধনতান্ত্রিক সমাজে অর্থনৈতিক উন্নতির বৈষম্য দেখতে হলে দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়াতে আসুন। কোন জায়গায় শিল্প স্থাপন হলেই যে সেই শহরটির ভাল কিছু হবে-এই ধরনের অতি সরল অর্থনৈতিক ধারনা, আনাহেমে থাকলে উড়ে যাবে।

এবার ভাবুন এমন এক বস্তিময় শহরে যদি বাড়ির দাম ৭০০ হাজার ডলার হয়-তাহলে বাকী ভালো জায়গা গুলোর কি অবস্থা ছিল? আরভাইন, ডেনা পয়েন্ট, হানটিংটন বিচের মতন শহর গুলিতে বাড়ির দাম ছিল আরো বেশী। এমন নয় ক্যালিফোর্নিয়াতে সরকারি চাকুরেররা ভাল মাইনা পায়। বরং উলটো। ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুলে ৪০% শিক্ষক নেই। সেসব নিয়ে এখানের লোকের মাথা ব্যাথা খুব দেখি নি। সবাই বাড়ি বেচাকেনা করে পয়সা করতে দৌঁড়াচ্ছে। বাড়ি বেচা কেনা করে সবাই নাকি মিলিয়নার হয়েছে। ধণতন্ত্রের অদ্ভুত সৃষ্টি এই দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়া।

সাবক্রাইম ক্রাইসিসের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই অঞ্চল। বাড়ির দাম এত বাড়ছিল ২০০১ সাল থেকে। শহর থেকে অনেক দূরে, ১০০ মাইল দূরের ছোট ছোট মরূশহর গুলিতে লোকে অবাধে বাড়ি বানাচ্ছিল-এবং তার থেকে কখনো দ্বিগুন, কখনো চারগুন লাভ করেছে। কিন্ত এই এলাকাতে লোকের ইনকাম বলতে শুধু হলিউড, কিছু ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্প আর পর্যটন। তার ওপর ভিত্তি করে এত বড় অর্থনীতি আর বাড়ির দাম কি করে সম্ভভ? হলিউডে খুব বেশী হলে ১৫০,০০০ লোকের কর্ম সংস্থান হয়। পর্যটন শিল্পে ২০০,০০০। আর ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে ধরে নিচ্ছি খুব বেশী হলে ৩০০,০০০ এর মতন। এদিকে লোকের সংখ্যা প্রায় এক কোটি চল্লিশ লক্ষ। যাদের অধিকাংশ কর্মরত ছিল গৃহশিল্পে। ফলে সাবক্রাইম ক্রাইসিস ২০০৮ সালে শুরু হলেও ২০০৫ সাল থেকেই এখানে বাড়ির দাম পড়তে শুরু করে। অসংখ্য বেকার দেখেছি ওই তিন বছর যারা এই নির্মান শিল্পের সাথে জড়িয়ে ছিল। কোন কোন পাড়াতে ১০ টি বাড়ির মধ্যে সব কটিই ফোরক্লোজারে গেছে-সেটাও দেখেছি। নতুন নির্মিত শহরে এই প্রাদুর্ভাব ছিল অনেক বেশী। মর্টগেজ দিতে না পারার জন্যে বাড়ি ছেরে লোকে গাড়ি শুয়ে জীবন কাটাচ্ছে এই দৃশ্যও বিরল ছিল না সান বার্নেডেনোর মতন গরীব এলাকাতে। দক্ষিন ক্যালিফোর্নিয়ার অর্থনীতি সত্যই আমার কাছে মিরাকল! লোকের মাইনা যেখানে অতি সাধারন, সেখানে কি করে বাড়ির দাম এত উঠতে পারে ব্যাঙ্কের দুর্নীতি ছারা?

এই একই ভয় পাচ্ছি কোলকাতা রিয়াল এস্টেট নিয়ে। কোলকাতাতে লোকের মাইনার মিডিয়ান খুব বেশী না-বাড়ির দাম এদিকে আকাশ ছোঁয়া। কোন না কোন দিন এই বাবল বার্স্ট হবেই। প্রবাসীরা অধিকাংশ বাড়ির মালিক বলে, হয়ত খুব শিঘ্রী এখানে ফাটকাবাজি ফাটবে না। কিন্ত ব্যাপার হচ্ছে বাড়ি বিক্রি করার টেন্ডডেন্সি শুরু হলেই, কয়েক মাসের মধ্য সহজেই বোঝা যেত যে শহরের উপায় এত কম, সেখানে বেশী বাড়ির দাম ফাটকাবাজি ছারা কিছু না।

নিজেকে এই ব্যাপারে সৌভাগ্যবানই ভাবি। ২০০৫ সালে কোম্পানী লোন দিতে চেয়েছিল বাড়ি কেনার জন্যে। আমি অনেক বাড়ি দেখে এবং মোটামুটি সাধারন বুদ্ধি লাগিয়ে বুঝেছিলাম, মার্কেট সম্পূর্ন বাস্পের ওপর। বার্স্ট হল বলে। ফলে আরো দু বছর দেখার সিদ্ধান্ত নিই। এবং সেটা না করলে আজকে বিশাল দেনার দায়ে ডুবে যেতাম। ওখানে অধিকাংশ এলাকাতে বাড়ির দাম কমেছে ৫০% করে। ৭০% দাম কমতেও দেখেছি। আসলে ব্যাঙ্কের ঋন সাপ্লাই এ দাম বেড়েছিল এত। আসলে ত অধিকাংশ লোক কাজ করে ঘন্টায় ২০ ডলার রোজে-তাদের পক্ষে সম্ভব না ওই মর্টগেজ দেওয়া। তবুও তারা বাড়ি কিনেছিল-কারন ব্যাঙ্ক টাকা ধার দিচ্ছিল-প্রথম বছর শুধু ইন্টারেস্ট দিতে হবে। আর এক বছর বাড়ি রাখতে পারলেই শুধু একটা বাড়ি থেকেই ১০০-২০০,০০০ ডলার লাভ হচ্ছিল। ফলে এক বছর বা ছমাস বাদে বেচে দিয়ে অনেকেই অনেক লাভ করে বেড়িয়ে গেছে। এবং সেই লাভের টাকায় আরো বেশী যখন ইনভেস্ট করতে গেছে, সম্পূর্ন ডুবে গেছে।

কিন্ত প্রশ্ন হচ্ছে ব্যাঙ্ক ত এসব কিছুই জানত। এনালিস্টরা সাবধান করে নি কিন্ত। পরে তাদের কাছ থেকেই জেনেছি ম্যানেজাররা তাদের রিপোর্ট চেপে যেত বলত। কারন তা না হলে বিশাল বোনাস হারানোর ভয়। অর্থাৎ পরিস্কার ভাষায় প্রতিটা ব্যাঙ্কের কতৃপক্ষ ডাকাতি করেছে। কোটি কোটি আমেরিকানকে দেনার দায়ে ডুবিয়েছে। এবং পরে সরকারি টাকায় নিজেদের উদ্ধার করেছে। ডাকাতি করার জন্যে সরকারি পুরস্কার। এটা এই সমাজ ব্যাবস্থাতেই সম্ভব। আবার এটাও ঠিক ফি বছর আমেরিকাতে যতজন সি ই ও জেলে ঢোকে-কোলকাতা পুলিশ সারা বছর ততজন ডাকাত ধরতে পারে কি না সন্দেহ।

(৪) আমেরিকান অভিজ্ঞতা

এবার আমেরিকানদের অভিজ্ঞতা নিয়ে কিছু বলা দরকার।

আমেরিকানরা ছোটবেলা থেকেই পুতুল প্রিয়। গাড়ি, ভিডিও গেমস-গ্যাজেট-বিপুল খাওয়া দাওয়া। বাচ্চারা যেমন নিজেদের ছোটবৃত্তের মধ্যে পুতুল নিয়ে খুশী-আমেরিকানরাও তাই। প্রায় সবাই অর্থনীতি এবং রাজনীতির ব্যাপারে বিগ বেবী। আমি রাজনীতিতে নেই-জীবনটা উপভোগ করে কাটাব-চার্বাক দর্শনে বিশ্বাসী। এবার তাদের ওপর যখন মন্দার খাঁড়া নেমে আসে, প্রায় সবাইকে কিংকর্তব্যবিমূঢ় দেখি। আমার অনেক কলীগকে চোখের সামনে ফায়ারড হতে দেখেছি। একবারের জন্যেও এরা রাজনৈতিক সিস্টেমকে গালাগাল দিয়েছে দেখিনি-সবাই কোম্পানী ম্যানেজমেন্টকে গাল পেড়ে নতুন চাকরি খুঁজতে নামে। অবস্থা যখন নিদারুন কঠিন-এক বছর চাকরি না পেয়ে বেকারভাতায় বসে আছে-তখন বাজারকে গালাগাল দেয়। আমার এক কলীগ আমার কোম্পানীতেই তিন বার ফায়ারড হয়েছে-আবার হায়ারড ও হয়েছে।তার কোন হোলদোল দেখি না। বড়জোর ইঞ্জিনিয়ারিং পেশাকে গালাগাল দিয়ে ছেলেকে ডাক্তারী পড়াতে চাইছে। আমেরিকান জীবনের মিউজিক্যাল চেয়ার তার কাছে স্বাভাবিক।

তবে সবার সব কিছু স্বাভাবিক যায় না। লস এঞ্জেলেসে এক মেকানিকের কথা মনে পড়ল-সারাদিন একা একা ক্যাফেটেরিয়াতে কাটাত। একদিন আলাপে বুঝলাম, সদ্য ডিভোর্সী। তার বৌ নাকি খুব সুন্দরী ছিল। তিনমাস চাকরি না থাকায়, দারিদ্র সহ্য করতে না পেরে পালিয়েছে।" নো হানি উইথদাউট মানি"-কথাটা বিরবিড় করে সারাদিন বকত। মন্দার কোপে ডিভোর্স আরো প্রচুর দেখেছি। ছাঁটাই এর জন্যে মর্টগেজ দিতে পারে নি-ফলে দশ বছরের বসত বাড়ি ছেড়ে যেতে হয়েছে-এমন দৃশ্যও আমেরিকানদের মধ্যে অনেক। আসলে ভারতীয়রা অধিকাংশ ক্ষেত্রে ভাল পারফর্মার বলে, মন্দার আঁচ, খুব একটা এখানকার ভারতীয় কমিউনিটির গায়ে লাগে না। বড়জোর অজান্তে কাজের চাপ বাড়তে থাকে।

নিউজার্সির সেই প্রবল রিশেসনে একবার এক আমেরিকান ট্যাক্সিড্রাইভারের সাথে কথা বলছিলাম। সফটোয়ার থেকে ছাঁটাই হয়ে ট্যাক্সি চালাচ্ছে। ওকে জিজ্ঞেস করলাম নিউ জার্সির এই অবস্থার জন্যে ম্যাকগ্রিভি ( তৎকালীন গভর্নর) দায়ী?

ও পরিস্কার বললো -কে ম্যাকগ্রিভি? আমি রাজনীতির মধ্যে নেই। বুঝুন ঠেলা। এই ছেলেটার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা নিউ জার্সিতেই। ভাবুন আমাদের কোলকাতায় কোন বাঙালী সফটোয়ার ইঞ্জিনিয়ার বুদ্ধর নাম শোনে নি। এটা আমেরিকাতে সম্ভব। ছোটবেলা থেকে গাড়ি আর গার্লফ্রেন্ডের বাইরে এরা কিছু জানে না।

তবুও এর মধ্যে পরিবর্তন আসছে। সেই নিউজার্সিতেই এ বছর স্কুলের ছাত্ররা স্কুলের মাস্টারমশাইদের ছাঁটাই এর প্রতিবাদে বনধ করেছে। ফেসবুকে এই স্ট্রাইক অর্গানাইজ করেছিল ষোল বছরের এক কিশোরী। মাত্র তিনদিনের ডাকে হাজার হাজার ছাত্ররা পথে নেমেছিল।

কি অবস্থা এই আমেরিকার রাজনীতির। স্কুলের কলেজের শিক্ষকদের মাইনে দিতে পারে না। আমার অধ্যাপক বন্ধুদের প্রায় ফার্লো ( মানে বিনাবেতনে কয়েকদিন চাকরি) নিতে বাধ্য করাচ্ছে-আর ইরাকে আফগানিস্থানের পেছনে বছরে দেদারসে টাকা ঢালছে। ক্যালিফোর্নিয়াতে ৪০% স্কুলের শিক্ষকদের ছাঁটাই হয়েছে। যদিও সাময়িক-তবুও প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের কষ্টার্জিত ট্যাক্সের টাকা যদি আমাদের ছেলেমেয়ের শিক্ষার জন্যে ব্যয় না হয়ে-ইরাকে আমেরিকান কনট্রাক্টরদের উদরপূর্তিতে যায়-নিশ্চিত ভাবেই বলা চলে, আমেরিকান রাজনৈতিক সিস্টেম একটি বিকল ব্যাবস্থা।

তবুও মন্দার ভাল দিকটাও দেখছি। মন্দার ধাক্কায় আমার বিগত এক দশকের অভিজ্ঞতায় এই প্রথম আমেরিকানরা জিজ্ঞাসা করছে কেন এই মন্দা? রাজনৈতিক সিস্টেমের সমস্যাটা কোথায়। যদিও সি এন এন এবং ফক্স নিউজ, আপ্রান চেষ্টা করছে আসল সমস্যাটাকে ঢেকে সন্ত্রাসবাদ থেকে ভূতবাদ ইত্যাদি জেনোফোবিয়া ছড়িয়ে মানুষের মনকে ঘুরিয়ে দিতে- এই স্যোশাল মিডিয়ার যুগে-তা প্রায় অচল।

http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=11323


চলতি হাওয়া : ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন ওবামার পরবর্তী নির্বাচনে কতোটা প্রভাব ফেলবে?

মিছবাহ উদ্দিন সুমীর
আরব বিশ্বের মতো পরিবর্তনের গণজোয়ার এখন বইছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও। গত ১৭ সেপ্টেম্বর দেশটির করপোরেট বাণিজ্যের বিরুদ্ধে শুরু হওয়ায় পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন ক্রমেই ব্যাপকতর হচ্ছে। দেশটির বাণিজ্যিক শহর নিউইয়র্ক থেকে শুরু হওয়া এ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় অঙ্গরাজ্যে। তবে এ আন্দোলন এখন শুধু যুক্তরাষ্ট্রজুড়েই নয়, আরো ব্যাপক আকারে শুরু হয়েছে অস্টেলিয়াসহ বিশ্বের অন্যান্য দেশেও। প্রায়ই সংঘটিত হচ্ছে পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাবাহিনীদের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের দাঙ্গা-সংঘর্ষ। এদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের 'অকুপাই ওয়াল স্টিটে'র সঙ্গে নতুন মাত্রায় যোগ হয়েছে 'অকুপাই শিকাগো' আন্দোলন। অর্থাৎ যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে পুঁজিবাদবিরোধী এ আন্দোলন ক্রমেই দেশটির রাজনীতির পটপরিবর্তনের দিকে এগোচ্ছে। যদিও প্রথম দিকে এ আন্দোলনকে অনেকই ভেবেছিলেন কেবল পুঁজিবাদবিরোধী একটি প্রতিবাদের ভাষা হিসেবে। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এটি ওবামার ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে কঠিন থেকে আরো কঠিনের দিকে নিয়ে যাবে। আর সঙ্গত কারণেই চলমান 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন' ওবামা প্রশাসনের জন্য ভবিষ্যৎ চিন্তার বিষয়।
তবে এখানে উল্লেখ করা জরুরি, আরব বিশ্বের আন্দোলনের চেয়ে এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও ধরনে রয়েছে ভিন্নতা। আরব বিশ্বের আন্দোলন ছিল সরাসরি শাসন কাঠামোর পরিবর্তনের লক্ষ্যে। অর্থাৎ পরিপূর্ণ একটি রাজনৈতিক পরিবর্তন।
কিন্তু প্রশ্ন হলো, নিউইয়র্ক আন্দোলনের নৈপথ্য কি? মূলত এ আন্দোলনের লক্ষ্য হলো অর্থনৈতিক পরিবর্তন। গত বিশ্ব মন্দার নিম্নমুখী প্রভাব অধিকাংশ দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের ছিল প্রবল। বিক্ষোভকারীদের দাবি, দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ধনীরা আরো সম্পদের মালিক হচ্ছে, অন্যদিকে সাধারণ মার্কিন নাগরিকরা ভোগান্তির শিকার হচ্ছে। দিন দিন বাড়ছে বেকারত্বের হার। সরকারি পক্ষ থেকে কর্মসংস্থানের কোনো ব্যবস্থা করা হচ্ছে না। এতে ওয়াশিংটন তাদের কোনো সহায়তা দিতে না পারায় আন্দোলন করে যাচ্ছে তারা। তবে এ আন্দোলন যে কেবল অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে তা বলা দুষ্কর। তাই আন্দোলনকারীদের চরম প্রতিবাদের বহিঃপ্রকাশ ঘটতে পারে আসন্ন ২০১২ সালের মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে। আর এতে বড় রকমের ধাক্কায় পড়তে পারেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। প্রকৃতপক্ষে দেশের বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির জন্য বিশ্বমন্দা ও সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের পররাষ্ট্রনীতিই অনেকাংশ দায়ী। কেননা সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ দেশের অভ্যন্তরীণ উন্নয়নকে মাথায় না নিয়ে সামরকি উন্নয়নের দিকে বেশি মনোনিবেশ দিয়েছিলেন। আর এ সামরিক উন্নয়নের দাপট দেখাতেই ইরাক ও আফগানিস্তানে বছরের পর বছর মার্কিন সেনাদের ব্যয় বহন করতে হয়েছে দেশটিকে। তবে বারাক ওবামা ক্ষমতায় আসার পর বুশের প্রবর্তিত কিছু নীতিকে মেনে নিয়েছেন সত্য এবং তা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রবর্তিত স্থায়ী পররাষ্ট্রনীতির কারণে।
সম্প্রতি ওবামা ইরাক থেকে চলতি বছরে মার্কিন সেনাদের সম্পূর্ণভাবে প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন। এ ঘোষণার মধ্য দিয়ে অনেকে হয়তো ভাববেন ওবামার নীতি বুশের চেয়ে লিবারেল। কিন্তু ওবামা যা করছেন বুশ থাকলেও হয়তো তাই করতেন। অর্থাৎ বুশ ইরাক ও আফগানিস্তানে জাল বিস্তার করে গিয়েছিলেন। এর উদ্দেশ্য প্রায় শেষ। তাই অবস্থাদৃষ্টে অনেকেই ওবামার সম্প্রতি ইরাক থেকে সম্পূর্ণ সেনা প্রত্যাহারেরর ঘোষণাকে তার লিবারেল মানসিক দৃষ্টিভঙ্গিরই বহিঃপ্রকাশ ভাবার কোনোই কারণ নেই, যা মার্কিন জনগণের কাছে ভালো করেই জানা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে রিপাবলিকানদের কারো কারো সমালোচনার মধ্যেও ওবামা কেন ইরাক থেকে সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণা দিয়েছেন? এর কারণটি খুবই স্পষ্ট। বর্তমানে দেশটিতে চলছে পুঁজিবাদবিরোধী বিক্ষোভ ও আন্দোলন। আর সামনে রয়েছে দেশটির মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর মার্কিন করপোরেটমুখী এক শতাংশের স্বার্থের জন্য বিক্ষোভকারীরা ব্যাপক আকারে ওবামা প্রশাসনের নীতিকেই দায়ী করছেন। কেননা বর্তমানে তিনিই দেশের ক্ষমতায়। তাই বিক্ষোভকারীরা তার প্রশাসনের প্রতিই ক্ষোভ প্রকাশ করবেÑ এটাই স্বাভাবিক। আর এ জন্য ওবামা ইরাক থেকে সেনাদের ব্যয়ভার কমিয়ে এনে দেশের অভ্যন্তরীণ নীতি উন্নয়নে যে চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন, আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে তাই বোঝানোর চেষ্টা করছেন তিনি। 
ওয়ালস্ট্রিট আন্দোলনে বিক্ষোভকারীরা এরই মধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিকে 'টাকার খেলায়' সরগরম হয় বলে উল্লেখ করেছে। তারা অভিযোগ করছে, টাকার বিনিময়ে লবি গ্রুপগুলো তাদের অঙ্গরাজ্যের প্রতিনিধি নিয়োগ দেয়। যাকে সুষ্ঠু গণতন্ত্রের পথে বড় রকমের বাধা হিসেবে দেখছেন অনেকই। আর ওবামা এ জন্যই আগামী নির্বাচনকে সামনে রেখে এখনো এক শতাংশ পুঁজিপতিদের স্বার্থের কথা মাথায় রাখছেন বলে মনে হচ্ছে।
ওবামা প্রশাসন যে এতোদিন করপোরেট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ঋণ দিয়ে আসছে তাতে ওবামা প্রশাসনের কোনো নিয়ন্ত্রণও ছিল। তাই বিক্ষোভকারী অসম অর্থনৈতিক ব্যবস্থার জন্য ওবামার প্রশাসনকে দায়ী করে আসছে। তাই এ অবস্থায় অনেকেই আগামী ২০১২ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের জন্য নতুন একজনকে ক্ষমতায় দেখতে চান। 
মার্কিন 'অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট' আন্দোলন মার্কিন ভোক্তভোগী বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের তরুণরা বিশ্ব পুঁজিবাদবিরোধী এ আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে এ আন্দোলন। তবে এ আন্দোলন এমন সময় মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে, যখন নাকি মার্কিন নির্বাচনের আর কয়েক মাস বাকি। আর কিছুদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যাবে ওবামা ও তার প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান প্রার্থীদের মধ্যে প্রচারাভিযান ও বিতর্ক। তারা চেষ্টা করবেন বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনে জনগণের সমর্থন আদায়ে। তবে এটা নিশ্চিত, ওকুপাই ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলনকারীদের দাবি ও যুক্তির প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করবে রিপাবলিকানরা। আর এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সমালোচনা ও প্রশ্নের মোকাবিলা করতে হতে পারে দ্বিতীয় মেয়াদপ্রত্যাশী বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। ফলে আগামী নির্বাচনের মাধ্যমে মার্কিনিরা ভবিষ্যতে কেমন নেতৃত্ব দেখতে চায়, ওয়াল স্ট্রিট আন্দোলন নিঃসন্দেহে এরই একটি ইঙ্গিত বহন করছে। তাই এ আন্দোলন আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচন-২০১২-কে কিভাবে, কতোটা প্রভাবিত করবেÑ এটিই এখন দেখার বিষয়।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী

No comments:

मैं नास्तिक क्यों हूं# Necessity of Atheism#!Genetics Bharat Teertha

হে মোর চিত্ত, Prey for Humanity!

मनुस्मृति नस्ली राजकाज राजनीति में OBC Trump Card और जयभीम कामरेड

Gorkhaland again?আত্মঘাতী বাঙালি আবার বিভাজন বিপর্যয়ের মুখোমুখি!

हिंदुत्व की राजनीति का मुकाबला हिंदुत्व की राजनीति से नहीं किया जा सकता।

In conversation with Palash Biswas

Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Save the Universities!

RSS might replace Gandhi with Ambedkar on currency notes!

जैसे जर्मनी में सिर्फ हिटलर को बोलने की आजादी थी,आज सिर्फ मंकी बातों की आजादी है।

#BEEFGATEঅন্ধকার বৃত্তান্তঃ হত্যার রাজনীতি

अलविदा पत्रकारिता,अब कोई प्रतिक्रिया नहीं! पलाश विश्वास

ভালোবাসার মুখ,প্রতিবাদের মুখ মন্দাক্রান্তার পাশে আছি,যে মেয়েটি আজও লিখতে পারছেঃ আমাক ধর্ষণ করবে?

Palash Biswas on BAMCEF UNIFICATION!

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS ON NEPALI SENTIMENT, GORKHALAND, KUMAON AND GARHWAL ETC.and BAMCEF UNIFICATION! Published on Mar 19, 2013 The Himalayan Voice Cambridge, Massachusetts United States of America

BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE 7

Published on 10 Mar 2013 ALL INDIA BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE HELD AT Dr.B. R. AMBEDKAR BHAVAN,DADAR,MUMBAI ON 2ND AND 3RD MARCH 2013. Mr.PALASH BISWAS (JOURNALIST -KOLKATA) DELIVERING HER SPEECH. http://www.youtube.com/watch?v=oLL-n6MrcoM http://youtu.be/oLL-n6MrcoM

Imminent Massive earthquake in the Himalayas

Palash Biswas on Citizenship Amendment Act

Mr. PALASH BISWAS DELIVERING SPEECH AT BAMCEF PROGRAM AT NAGPUR ON 17 & 18 SEPTEMBER 2003 Sub:- CITIZENSHIP AMENDMENT ACT 2003 http://youtu.be/zGDfsLzxTXo

Tweet Please

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS BLASTS INDIANS THAT CLAIM BUDDHA WAS BORN IN INDIA

THE HIMALAYAN TALK: INDIAN GOVERNMENT FOOD SECURITY PROGRAM RISKIER

http://youtu.be/NrcmNEjaN8c The government of India has announced food security program ahead of elections in 2014. We discussed the issue with Palash Biswas in Kolkata today. http://youtu.be/NrcmNEjaN8c Ahead of Elections, India's Cabinet Approves Food Security Program ______________________________________________________ By JIM YARDLEY http://india.blogs.nytimes.com/2013/07/04/indias-cabinet-passes-food-security-law/

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS TALKS AGAINST CASTEIST HEGEMONY IN SOUTH ASIA

THE HIMALAYAN VOICE: PALASH BISWAS DISCUSSES RAM MANDIR

Published on 10 Apr 2013 Palash Biswas spoke to us from Kolkota and shared his views on Visho Hindu Parashid's programme from tomorrow ( April 11, 2013) to build Ram Mandir in disputed Ayodhya. http://www.youtube.com/watch?v=77cZuBunAGk

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS LASHES OUT KATHMANDU INT'L 'MULVASI' CONFERENCE

अहिले भर्खर कोलकता भारतमा हामीले पलाश विश्वाससंग काठमाडौँमा आज भै रहेको अन्तर्राष्ट्रिय मूलवासी सम्मेलनको बारेमा कुराकानी गर्यौ । उहाले भन्नु भयो सो सम्मेलन 'नेपालको आदिवासी जनजातिहरुको आन्दोलनलाई कम्जोर बनाउने षडयन्त्र हो।' http://youtu.be/j8GXlmSBbbk

THE HIMALAYAN DISASTER: TRANSNATIONAL DISASTER MANAGEMENT MECHANISM A MUST

We talked with Palash Biswas, an editor for Indian Express in Kolkata today also. He urged that there must a transnational disaster management mechanism to avert such scale disaster in the Himalayas. http://youtu.be/7IzWUpRECJM

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICAL OF BAMCEF LEADERSHIP

[Palash Biswas, one of the BAMCEF leaders and editors for Indian Express spoke to us from Kolkata today and criticized BAMCEF leadership in New Delhi, which according to him, is messing up with Nepalese indigenous peoples also. He also flayed MP Jay Narayan Prasad Nishad, who recently offered a Puja in his New Delhi home for Narendra Modi's victory in 2014.]

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICIZES GOVT FOR WORLD`S BIGGEST BLACK OUT

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICIZES GOVT FOR WORLD`S BIGGEST BLACK OUT

THE HIMALAYAN TALK: PALSH BISWAS FLAYS SOUTH ASIAN GOVERNM

Palash Biswas, lashed out those 1% people in the government in New Delhi for failure of delivery and creating hosts of problems everywhere in South Asia. http://youtu.be/lD2_V7CB2Is

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS LASHES OUT KATHMANDU INT'L 'MULVASI' CONFERENCE

अहिले भर्खर कोलकता भारतमा हामीले पलाश विश्वाससंग काठमाडौँमा आज भै रहेको अन्तर्राष्ट्रिय मूलवासी सम्मेलनको बारेमा कुराकानी गर्यौ । उहाले भन्नु भयो सो सम्मेलन 'नेपालको आदिवासी जनजातिहरुको आन्दोलनलाई कम्जोर बनाउने षडयन्त्र हो।' http://youtu.be/j8GXlmSBbbk