Welcome

Website counter
website hit counter
website hit counters

Thursday, December 13, 2012

পন্ডিত রবিশন্কর আমাদের ধরা ছোঁযার জগতের বাইরে। বাঙ্গালির জীবনে তাঁর উচ্চমার্গীয সঙ্গীত ও সঙ্গীতের বিশ্বায়ন সম্পর্কে আবেগতাড়িত বিস্ফোরণ হয়েছে তার মৃত্যুর পর। মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কার যেমন, ঠেক তেমনটাই।তাঁর দাদা উদয়শন্কর বাঙ্গালির বিশ্বায়নের প্রথম পদক্ষেপ। সেই উদয়শন্কর নিয়ে তুমুল ভাবাবেগ ছাড়া আজ অবধি তাঁর যথাযথ মুল্যায়ন বাঙ্গালি মানসে ঠিক কতটা হয়েছে, বলা বাহুল্য।শোকের আবহে শ্রদ্ধান্জলিসাপেক্ষ রবিশন্করকে নিয়ে বাঙ্গালির মাতামাতি মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কারের পর্যায়েও পৌঁছাবে কিনা বলা বহুত মুশকিল।আসলে বাঙ্গলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হল পুজাপর্বের অবসান হয়না কখনও। সমাজবাস্তবের নিরিখে নতূনকরে আবিস্কারের স্পর্ধা বা প্রতিবার বড়ই অভাব।রবীন্দ্রকে যেমন চেনা হয়নি আজও,চিনতে পারিনি বিবেকানন্দ,মাইকেল মধুসুদন দত্ত, জসিমুদ্দীন, আব্বাসুদ্দীন, নেতাজি, নজরুল, উদয়শন্করকেও।ধর্মস্থলে নৈবদ্য সাজিয়ে পুজারির অনন্ত পন্ক্তিতে দাড়িয়ে আমরা। পলাশ বিশ্বাস http://basantipurtimes.blogspot.in/

পন্ডিত রবিশন্কর আমাদের ধরা ছোঁযার জগতের বাইরে  বাঙ্গালির জীবনে তাঁর উচ্চমার্গীয সঙ্গীত ও সঙ্গীতের বিশ্বায়ন সম্পর্কে আবেগতাড়িত বিস্ফোরণ হয়েছে তার মৃত্যুর পর মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কার যেমন, ঠেক তেমনটাই।তাঁর দাদা উদয়শন্কর বাঙ্গালির বিশ্বায়নের প্রথম পদক্ষেপ। সেই উদয়শন্কর নিয়ে তুমুল ভাবাবেগ ছাড়া আজ অবধি তাঁর যথাযথ মুল্যায়ন বাঙ্গালি মানসে ঠিক কতটা হয়েছে, বলা বাহুল্য।শোকের আবহে শ্রদ্ধান্জলিসাপেক্ষ  রবিশন্করকে নিয়ে বাঙ্গালির মাতামাতি মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কারের পর্যায়েও পৌঁছাবে কিনা বলা বহুত মুশকিল।আসলে বাঙ্গলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হল পুজাপর্বের অবসান হয়না কখনও। সমাজবাস্তবের নিরিখে নতূনকরে আবিস্কারের স্পর্ধা বা প্রতিবার বড়ই অভাব।রবীন্দ্রকে যেমন চেনা হয়নি আজও,চিনতে পারিনি বিবেকানন্দ,মাইকেল মধুসুদন দত্ত, জসিমুদ্দীন, আব্বাসুদ্দীন, নেতাজি, নজরুল, উদয়শন্করকেও।ধর্মস্থলে নৈবদ্য সাজিয়ে পুজারির অনন্ত পন্ক্তিতে দাড়িয়ে আমরা

পলাশ বিশ্বাস


মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কার পণ্ডিত রবিশঙ্করকে আমরা বাঙ্গালিরা রবীন্দ্র সঙ্গীত যতটা বুঝি বলে ভাবি, হিন্দুস্তানী শাস্ত্রীয় সঙ্গীত সেই তুলনায় আমাদের সমঝদারীর সঙ্গে কতটা তালবদ্ধ বলা মুশকিল বাঙ্গালি রবীন্দ্রনাথকে ভগবানজ্ঞানে পুজো  অবশ্য করে,কিন্তু রাবীন্দ্রিক জীবন দর্শন ও বিশ্ব দৃষ্টি কতটা আত্মস্থ করে, রাজপথে রবীন্দ্রসঙ্গীত আবহেও মালূম করা খূবই মুশকিল সেই তুলনায় পন্ডিত রবিশন্কর আমাদের ধরা ছোঁযার জগতের বাইরে  বাঙ্গালির জীবনে তাঁর উচ্চমার্গীয সঙ্গীত ও সঙ্গীতের বিশ্বায়ন সম্পর্কে আবেগতাড়িত বিস্ফোরণ হয়েছে তার মৃত্যুর পর মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কার যেমন, ঠেক তেমনটাই।তাঁর দাদা উদয়শন্কর বাঙ্গালির বিশ্বায়নের 
প্রথম পদক্ষেপ। সেই উদয়শন্কর নিয়ে তুমুল ভাবাবেগ ছাড়া আজ অবধি তাঁর যথাযথ মুল্যায়ন বাঙ্গালি মানসে ঠিক কতটা হয়েছে, বলা বাহুল্য।শোকের আবহে শ্রদ্ধান্জলিসাপেক্ষ  রবিশন্করকে নিয়ে বাঙ্গালির মাতামাতি মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কারের পর্যায়েও পৌঁছাবে কিনা বলা বহুত মুশকিল।আসলে বাঙ্গলা সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে বড় বিড়ম্বনা হল পুজাপর্বের অবসান হয়না কখনও। সমাজবাস্তবের নিরিখে নতূনকরে আবিস্কারের স্পর্ধা বা প্রতিবার বড়ই অভাব।রবীন্দ্রকে যেমন চেনা হয়নি আজও,চিনতে পারিনি বিবেকানন্দ,মাইকেল মধুসুদন দত্ত, জসিমুদ্দীন,আব্বাসুদ্দীন,নেতাজি, নজরুল, উদয়শন্করকেও।ধর্মস্থলে নৈবদ্য সাজিয়ে পুজারির অনন্ত পন্ক্তিতে দাড়িয়ে আমরা

পণ্ডিত রবিশঙ্কর শেষবার জনসমক্ষে সেতার বাজিয়েছিলেন গত ৪ নভেম্বর। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির লং বিচের ওই অনুষ্ঠানে তিনি এসেছিলেন অক্সিজেন মাস্ক পরে। বলা হচ্ছে, তার পর থেকেই পণ্ডিত রবিশঙ্করের শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা আরও প্রকট হয়। যুক্তরাষ্ট্রের স্যান ডিয়েগো হাসপাতালে এই প্রবাদতুল্য মানুষটি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন গতকাল বুধবার। শেষ হলো উচ্চাঙ্গসংগীতের এক উজ্জ্বল অধ্যায়ের। পণ্ডিত রবিশঙ্করের খুব কাছের একজন হলেন রবিন পল; একসময় পণ্ডিত রবিশঙ্করের সহকারী হিসেবেও তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বললেন, 'শ্বাস-প্রশ্বাসজনিত সমস্যা খুব ভোগালেও সহজেই কাউকে "না" করতেন না। তাই মঞ্চে ওঠার আগে অক্সিজেন মাস্ক পরে নিতেন তিনি।' 

মৃত্যু ও শোকের আবহে কীর্তন চলে, কিন্তু মানুষটির পরম্পরাকে ঠিক ঠিক চিন্হত করে তাঁকে ধরে রাখার গুরুদায়িত্ব পালন হয়না। রবিশন্কর হিল্দুস্তানী সঙগীতকে কতটা ব্যাপ্তি দিয়েছেন এবং বিশ্বায়ন বাণিজ্যে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যকে এক দেহে সমাহিত করে তাঁর বাস্তবিক পরিচিতি কতটা অক্ষুন্ন রাখতে পেরেছেন, এ প্রসঙ্গে যে গভীর আলোটনার দায়িত্বভার আমাদের পর বর্তায়, সে সম্পর্কে আমরা কতটা ওয়াকিবহাল। সাহিত্য বাংলায় বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে, কিন্তু বইমেলার ভিড় দিয়ে সাহিত্যের সমাজবাস্তব ও প্রসঙ্গিকতার বিবেচনা অসম্ভব। রবিশন্করের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত এবং তাঁর বৈচিত্রময় জীবন যাপনও খবরের শিরোনামে। শন্কর পরিবারের সংস্কৃতি জগতে আধিপাত্যও প্রশ্নাতীত। কিন্তু বাঙ্গালির সমাজজীবনে তাঁর প্রসঙ্গিকতা ঠিক কতটা, বঙ্গসন্তানের গর্বে গর্বিত বাঙ্গালি তাঁর মুল্যায়ন আদৌ করবে কি?

মার্গ সঙ্গীতে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের প্রথম সেতু পণ্ডিত রবিশঙ্কর ভারতীয় সময় বুধবার ভোরে শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন। 

পণ্ডিত রবিশঙ্কর নেই এবং  বড়দিনের আনন্দে মেতেছে গোটা মার্কিন মুলুক। আম আদমির সঙ্গে আনন্দে মেতেছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার পরিবারও। রবিবার অংশ নেন সপরিবার ওবামা। নানা কারণে যারা বড়দিনের আন্দন্দে সামিল হতে পারবেন না, তাদের জন্য প্রার্থনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। পণ্ডিত রবিশঙ্কর নেই এবং আমরা বাঙালিরা এপার ওপার বাংলায় মরণোত্তর শিরোণামপর্ব পেরিয়ে আবার রাজনৈতিক নৈরাজ্যে নিমজ্জিত। সমাজে ও সংস্কৃতিতেও আধিপাত্যবাদ প্রবল।  পেশী ও বাহুবল, সাম্প্রদায়িক মেরুকরণই বাঙ্গালি জীবনের একমাত্র রীতি। মার্কিন মুলুকে সমাজজীবনে বহুলতার যে সমাহার, সেখানে রবিশন্করের ফিউজনের ইন্দধনুষ খেলেছে যথাযথ। রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে যে শুদ্ধতাবাদী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিধি নিষেধে বাঙ্গালি আবদ্ধ, সেকানে রবিশন্করের সঠিক তাত্পর্য অনুধাবন সত্যিই অসম্ভব। নজরুল , জসিম ও আব্বাসকে নিয়ে আমাদের যে ধর্ম ঝাতীয়তাবাদী টানাপোড়েন সেই নিরিখে রবিশন্কর কোথায় দাঁড়াবেন। 

বাড়িতে সোনার গ্রামোফোনের সংখ্যা তিনটি। চতুর্থবারের দৌড়ে নাম উঠেছিল এবার। কিন্তু আগামী বছর ১০ ফেব্রুয়ারির গ্র্যামি সন্ধের আগে ১২ ডিসেম্বর সুরলোকে যাত্রা করলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সঙ্গীতজগতে জীবনভর অবদানের তাঁকে জন্য মরণোত্তর গ্র্যামি পুরস্কার প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্তৃপক্ষ। গতকালই গ্র্যামি কমিটি এই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়। 


ক্যারল কিং, দ্য টেম্পটেশন সহ সাত মোননীতদের অন্যতম ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তবে মৃত্যুর কারণে নয়। এবছর ৭ জনের মধ্যে থেকে লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্টের জন্য তাঁকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। অ্যাওয়ার্ড কমিটির পক্ষ থেকে স্টেফানি শেল সংবাদ সংস্থা এএফপিকে জানান গত সপ্তাহেই টেলিফোনে রবিশঙ্করকে জানানোও হয়েছিল সেকথা। 

'একজন শিল্পী বেঁচে থাকেন তাঁর সৃষ্টির মাধ্যমে' এই সৃষ্টি যে শুধুমাত্র শৈল্পিক অঙ্গনে সীমাবদ্ধ নয়, এর ব্যাপ্তি যে আরও বিশাল যা কিনা অনায়াসে ছুঁয়ে যেতে পারে বিশ্ব মানবতার মমতাময় আঁচল, তার প্রত্যক্ষ উদাহরণ হলেন সুরসম্রাট ও সেতারের জাদুকর পণ্ডিত রবিশঙ্কর

মারা গেলেন কিংবদন্তী সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বয়স হয়েছিল বিরানব্বই বছর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান দিয়েগোর এক হাসপাতালে ভারতীয় সময় আজ সকাল ছটায় মৃত্যু হয় তাঁর। গত বৃহস্পতিবার থেকে চিকিত্সার জন্য সেখানে ভর্তি ছিলেন তিনি। 



এরপর বিদেশের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতকে নিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি প্রবেশ করেন চলচ্চিত্র জগতেও। সৃষ্টি হয় পথের পাঁচালির অমর আবহ সঙ্গীতের মতো বেশ কিছু সুরের। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সাহায্যার্থে নিউইয়র্কে আয়োজিত হয় ঐতিহাসিক কনসার্ট। বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিটলসকে সঙ্গে নিয়ে অনুষ্ঠিত সেই কনসার্ট ফর  বাংলাদেশের শুরু হয় রবিশঙ্কর ও ওস্তাদ আলি আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দী `বাংলা ধুন` দিয়ে। বাংলার লোকগীতি ও পল্লিগীতির সুর থেকে তাঁর সৃষ্ট নতুন সুরে ভেসে যায় পাশ্চাত্যের সঙ্গীত দুনিয়া। রবিশঙ্করের কাছেই মার্গ সঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন বিটলস্ খ্যাত জর্জ হ্যারিসন। ইউরোপ-আমেরিকার কোনায় কোনায় ছড়িয়ে পরে ভারতীয় সঙ্গীত। 
 
ঐতিহ্যধর্মী ধ্রুপদী সঙ্গীতের মাধ্যমেই নতুনভাবে দেশকালের সীমা ছাড়িয়ে যান রবিশঙ্কর। ভারতরত্নের সঙ্গে অনন্য প্রতিভার স্বীকৃতি হিসেবে রবিশঙ্করের নাম উঠে আসে গিনেসবুকে। সঙ্গীত জগতের সেরা সম্মান গ্র্যামি পান তিনবার। মনোনীত হয়েছিলেন ২০১৩ সালের গ্র্যামি পুরস্কারে জন্যও। কিন্তু তার আগেই চলে গেলেন তিনি। মঙ্গলবার সঙ্গীতের দুনিয়ার অনন্য সেই নক্ষত্রের মৃত্যু হল সান দিয়েগোর হাসপাতালে।

১৯২০-র ৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জন্মগ্রহণ করেন ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। প্রথম জীবনে নাম ছিল রবীন্দ্রশঙ্কর চৌধুরী। মাত্র দশ বছর বয়সে দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালে ট্রুপে যোগ দিয়ে ইউরোপ সফর করেছিলেন তিনি। ১৯৩৮-এ নর্তকের  জীবন শেষ করে যন্ত্রসঙ্গীতের তালিম নিতে শুরু করেন। মাইহার ঘরানায় শাস্ত্রীর সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন প্রখ্যাত সেতারশিল্পী উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে। প্রিয় ছাত্র রবিশঙ্করকে ধ্রুপদ, ধামার ও খেয়ালের তামিল দিয়েছিলেন উস্তাদ আলাউদ্দিন। 

সঙ্গীতশিক্ষা শেষে ইন্ডিয়ান পিপলস থিয়েটার অ্যাসোসিয়েশনে যোগ দেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। মাত্র পঁচিশ বছর বয়সেই সারে জাঁহাতে আচ্ছা গানটিতে নতুন করে সুরারোপ করে সাড়া ফেলে দেন তিনি। সাত বছর তিনি অল ইন্ডিয়া রেডিওর ডিরেক্টর ছিলেন। সত্যজির রায়ের পথের পাঁচালি, অপরাজিত ও অপুর সংসার, এই তিনটি ছবিরও সুরকার ছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। 

প্রতিবছরের মতো এবারও জাকজমকের সঙ্গে অনুষ্ঠিত হল ক্রিস্টমাস ইন ওয়াশিংটন কনসার্ট। ন্যাশানাল চিলড্রেন্স মেডিক্যাল সেন্টারের অর্থ সাহায্যের জন্য প্রতিবছর এই কনসার্ট অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এবারের কনসার্ট ছিল ব্যতিক্রমী। কনসার্টে অংশ নেন একদা মার্কিন বিরোধী দক্ষিণ কোরিয়ার র‌‌‌্যাপার সাই (PSY)। যদিও সম্প্রতি মার্কিন বিরোধীতার জন্য দুঃখপ্রকাশ করেছেন তিনি। এই গণতন্ত্রের আবহে আমরা অপরিচিত। 

রবিবারের এই কনসার্টে হাজির ছিলেন ফার্স্ট লেডি মিসেল ওবামা সহ প্রেসিডেন্টের দুই কন্যা সাসা আর মালিয়া। নানা কারণে যাঁরা বড়দিনের আন্দন্দে সামিল হতে পারবেন না, তাদের জন্য প্রার্থনা করেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। 


প্রায় তিন দশক বহির্বিশ্বে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন রবিশঙ্কর। 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন এই সেতারশিল্পী। বিটলস ব্যান্ডের সংগীতশিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গে নিয়ে রবিশঙ্কর আয়োজন করেছিলেন সাড়া জাগানো 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।জীবদ্দশায় বহু সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই মহান শিল্পী। ১৯৯৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'ভারতরত্ন' দেওয়া হয় তাঁকে। চারটিটি গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছেন এই কিংবদন্তি সংগীতজ্ঞ।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার অকৃত্রিম বন্ধু ও উপমহাদেশের সুরসম্রাট পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই। গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়াগো শহরের একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। বুধবার 'দ্য টাইমস অব ইন্ডিয়া'র অনলাইনে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। 

মৃত্যুকালে রবিশঙ্করের বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। সেতার-সুরের এই মহান স্রষ্টা গত এক সপ্তাহ চিকিত্সাধীন ছিলেন। শ্বাস-প্রশ্বাসের জটিলতা নিয়ে গত বৃহস্পতিবার হাসপাতালে ভর্তি হন তিনি। 

১৯২০ সালে ভারতের বেনারসে জন্মেছিলেন রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী; যিনি 'রবিশঙ্কর' নামেই বিশ্বে সুপরিচিত। শৈশবে ভাই উদয় শঙ্করের নাচের দলে কাজ করেছেন। ১৯৩৮ সালে নাচ ছেড়ে দিয়ে সংগীতজ্ঞ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতার শেখা শুরু করেন। ১৯৪৪ সালে সংগীতপরিচালক হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটে তাঁর। ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংগীতপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সত্যজিত্ রায়ের 'পথের পাঁচালী' (১৯৫৫), 'অপরাজিত' (১৯৫৬) এবং 'অপুর সংসার' (১৯৫৯) ছবির গীতপরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসিত হন রবিশঙ্কর।

১৯৫৬ সাল থেকে বেশ কটি সফরের মাধ্যমে ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত জনপ্রিয় করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন এই গুণী শিল্পী। ষাটের দশকে তিনি কয়েকটি দেশে শিক্ষক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। এসব কাজ করতে গিয়ে বিটলস ব্যান্ডের জর্জ হ্যারিসন ও প্রখ্যাত মার্কিন বেহালাবাদক মেনুহিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরবর্তী সময়ে তাঁরা একসঙ্গে কাজ করেন। 

"রবিই প্রথমজন যিনি আমাকে মুগ্ধ করার কোনও চেষ্টাই করেননি বরং আমিই ওনাকে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম"।


 মার্টিন স্কোর্সের তথ্যচিত্র জর্জ হ্যারিসন: `লিভিং ইন দ্য মেটিরিাল ওয়ার্ল্ডে` রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের কথা এভাবেই জানিয়েছেন বিটলস সম্রাট জর্জ হ্যারিসন।

প্রথম সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাত শুধুমাত্র দীর্ঘমেয়াদী বন্ধুত্বেই পরিণত হয়নি, রবিশঙ্করের মাধ্যমেই হ্যারিসন পরিচিত হন ভারতীয় দর্শনের সঙ্গে। যা পরবর্তীকালে তাঁর জীবনে অনেক পরিবর্তন এনছিল। "রবির সঙ্গে জর্জের সাক্ষাত শুধু দু`জন পৃথক মানুষের সাক্ষাত ছিল না, দুটো পৃথক সংস্কৃতির সাক্ষাত ঘটেছিল সেদিন"।গতবছর স্কোর্সের তথ্যচিত্র প্রদশর্নীর সময় বলেছিলেন জর্জের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন। সেই তথ্যচিত্রে কিছুটা অংশ জুড়েও স্থান পেয়েছিলেন রবিশঙ্কর। 

১৯৬৬ সালে লন্ডনে প্রথম দেখা হয় দুই মহীরুহর। রবিশঙ্করের সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ জর্জ ভারতে এসেছিলেন শুধুমাত্র তাঁর কাছে সেতার শিখবেন বলেই। রবিশঙ্কর শুধু তাঁকে সেতারই শেখাননি তাঁর আধ্যাত্মিক জীবনকেও প্রভাবিত করেছিলেন। জর্জের সঙ্গে রবিশঙ্করের যোগাযোগ আন্তর্জাতিক মঞ্চে তাঁর জনপ্রিয়তাকে এক নতুন মাত্রা দিয়েছিল। বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সঙ্গীতকে উচ্চাসনে বসিয়ে দেয়। ১৯৬৭ সালে মনটেরে পপ ফেস্টিভ্যালে টানা ৪ ঘণ্টা বাজিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। ১৯৬৯ সালে উডস্টক ফেস্টিভ্যালের উদ্বোধন করেন তিনি। ১৯৭১ সালে বাজান কনসার্ট ফর বাংলাদেশে। 

জর্জ হ্যারিসেনর প্রচুর গানেই পাওয়া গেছে ভারতীয় সঙ্গীতের ছোঁয়া। বিটলসের ৩টি অ্যালবামে সেতারের ব্যবহার করেছিলেন জর্জ। `রাবার সোল`, `রিভলভার` ও `লোনলি হার্টস ক্লাব ব্যান্ড` ৩ টি অ্যালবামে পাওয়া যায় সেতারের মূর্ছনা। 


পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই। চলে গেছেন না ফেরার দেশে। যুক্তরাষ্ট্র থেকে এই কিংবদন্তির মৃত্যুর খবর ভারতে এসে পৌঁছার পর পুরো সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে আসে শোকের ছায়া। অনেকেই শোক প্রকাশ করেছেন, শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, স্মৃতিচারণা করেছেন। তার মধ্য থেকে কিছু দেওয়া হলো এই প্রতিবেদনে।

মনমোহন সিং, প্রধানমন্ত্রী
একটি যুগের পরিসমাপ্তি হলো পণ্ডিত রবিশঙ্করের সঙ্গে। আমার সঙ্গে পুরো জাতি তাঁর অনতিক্রম্য মেধার প্রতি সম্মান জানাচ্ছে, সম্মান জানাচ্ছে তাঁর শিল্প এবং বিনম্রতার প্রতি। তিনি ছিলেন আমাদের জাতীয় সম্পদ এবং বিশ্বের দরবারে ভারতীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের শুভেচ্ছাদূত।
পণ্ডিত বিরজু মহারাজ
তাঁকে আমি ভাইয়া বলে ডাকতাম। ছেলেবেলা থেকে তাঁর শুভকামনা পেয়ে এসেছি। আমার কাজে সব সময় খুশি হতেন, বলতেন আরও কঠোর পরিশ্রম করতে। দেশের মানুষের সামনে যে কজন সেতারের সুর পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন, তাঁদের একজন তিনি। সেতার বাজাতে পছন্দ করতেন। যখন বাজাতেন, তখন প্রতিটি সুরের প্রকাশ থাকত তাঁর মুখে।
এ আর রহমান 
সবচেয়ে বড় শুভেচ্ছাদূতকে হারাল ভারতের উচ্চাঙ্গসংগীত। আর ভারত হারাল ভারতরত্ন। সৃষ্টিকর্তার কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করছি।
সাজন মিশ্র
সেতারের রাজা পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই—এটা আমাদের জন্য বড় কষ্টের। তাঁর দেখানো পথে হাঁটছি আমরা। তাঁর মতো শিল্পী ১০০ বছরে একজন জন্ম নেয়। খুব কষ্টের দিন আমাদের জন্য। পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা, তাঁর আত্মা যেন শান্তি পায় এবং তাঁর ঐতিহ্য যেন আরও সামনে নিয়ে যেতে পারেন তাঁর অনুসারীরা।
রাজন মিশ্র
তিনি কেবল ভারতের শিল্পী ছিলেন না, ছিলেন গোটা বিশ্বের শিল্পী। সেতার এবং পণ্ডিত রবিশঙ্কর সমার্থক।
তনুশ্রী শঙ্কর
উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পীদের জন্য এটা বিরাট ক্ষতি। তরুণ প্রজন্মের জন্যও বিশাল ক্ষতি। আমি বঞ্চিত হব মহান এক শিল্পীর সুরের মূর্ছনা থেকে। সংগীতের ঈশ্বর ছিলেন তিনি।
করণ জোহর
শান্তিতে থাকুন পণ্ডিত রবিশঙ্কর, যিনি সৃষ্টি করেছেন কালজয়ী ও চিরন্তন অনেক কিছু।
মহেশ ভাট
জাতির সম্পদ পণ্ডিত রবিশঙ্কর আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন। তবে তাঁর সংগীত গোটা বিশ্বের চেতনায় অনুরণিত হবে আজীবন।
ঋতুপর্ণ ঘোষ
সকালটি ছিল অপার্থিব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত, কারণ হয়তো সকালটি উদ্যাপন করছিল পণ্ডিত রবিশঙ্করের বিদায়ের রাগ! শান্তিতে থাকুন।
প্রিয়াঙ্কা চোপড়া
সংগীতের একটি যুগের পরিসমাপ্তি হলো। এ বছর আমরা কয়েকজন লিজেন্ডকে হারিয়েছি। তাঁর পরিবারের প্রতি সমবেদনা। শান্তিতে থাকুন পণ্ডিত রবিশঙ্কর।
সূত্র: এএনআই, আইএএনএস


সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যৃতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া। 

এক শোকবার্তায় তিনি বলেছেন, "তার মৃত্যু বিশ্ব সংগীত জগতে বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করল।" 

মঙ্গলবার যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগোর একটি হাসপাতালে মারা যান এই সংগীতগুরু। তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর। 

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী স্বাক্ষরিত ওই শোকবার্তায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে রবি শংকরের অবদানের কথা স্মরণ করে খালেদা জিয়া বলেন, "তিনি বাংলাদেশের একজন অকৃত্রিম বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময় রবিশঙ্করের ভূমিকা বাংলাদেশের মানুষ চিরদিন স্মরণ রাখবে।" 

সেতারের এই জাদুকর একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বন্ধু হয়ে। মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা এবং জনমত সৃষ্টির জন্য নিউ ইয়র্কে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ' এর আয়োজন করেন তিনি। 

বিরোধী দলীয় নেতা বলেন, "পণ্ডিত রবিশঙ্কর সংগীত জগতের এক অনন্য কিংবদন্তি। উপমহাদেশে যে কয়জন সংগীত গুরুর সাধনায় শাস্ত্রীয় সংগীত সারাবিশ্বে সমাদৃত হয়েছে, রবিশঙ্কর তাদেরই একজন।" 

খালেদা জিয়া এই সংগীতজ্ঞের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং তার পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা প্রকাশ করেন। 

সুরের আকাশে রবির অবসান
নুষ্ঠানটা পিছোতে হয়েছিল তিন বার। নবতিপর সুরস্রষ্টার শরীর সায় দিচ্ছিল না। চতুর্থ দফায়, সেই তিনিই শাসন করলেন সব অসুস্থতাকে। সেতার হাতে মঞ্চে যখন বসলেন, তখন নাকে বাঁধা অক্সিজেন মাস্ক। সঙ্গে কন্যা অনুষ্কা। '৯ দশকব্যাপী এক সঙ্গীতজীবনের চূড়ান্ত উদ্যাপন' সে দিনের অনুষ্ঠান সম্পর্কে বলেছিলেন তাঁর গুণমুগ্ধরা। 
ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট ইউনিভার্সিটির পারফর্মিং আর্ট সেন্টারে গত ৪ নভেম্বরের ওই অনুষ্ঠানেই শেষ বার প্রকাশ্যে বাজিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। ঘনিষ্ঠরা বলেন, অনুষ্ঠানের অনুরোধ ফেরাতে চাইতেন না তিনি। চাইতেন না ছুটি। 
তবু গত কাল ছুটি হয়েই গেল তাঁর। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগোয় ৯২ বছর বয়সে প্রয়াত হলেন কিংবদন্তি সেতারবাদক। 
হৃদ্যন্ত্র ও শ্বাসপ্রশ্বাসের সমস্যায় ভুগছিলেন বেশ কয়েক বছর ধরে। সম্প্রতি অসুস্থতা বেড়েছিল। লা জোলা-র স্ক্রিপস মেমোরিয়াল হাসপাতালে গত বৃহস্পতিবার তাঁর হৃদ্যন্ত্রের ভাল্ভ প্রতিস্থাপন হয়। অশক্ত শরীর সেই অস্ত্রোপচারের ধকলটাই আর সামলাতে পারল না। রবিশঙ্করের জীবনাবসান হয় হাসপাতালেই। বিবৃতি দিয়ে সেই খবর জানায় প্রয়াত শিল্পীর পরিবার।
রবিশঙ্করের স্ত্রী সুকন্যা এবং মেয়ে অনুষ্কাশঙ্কর ওই বিবৃতিতে বলেছেন, "অস্ত্রোপচার হয়তো ওঁকে নতুন প্রাণশক্তি দিত। কিন্তু চিকিৎসকদের সব চেষ্টা সত্ত্বেও শরীর সেই ধকল সামলাতে পারেনি। ওঁর মৃত্যুর সময়ে আমরা পাশে ছিলাম।" অসুস্থতার সময়ে যাঁরা শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, পাশে থেকেছেন সকলকে ধন্যবাদ দিয়েছেন সুকন্যা-অনুষ্কা। আর বলেছেন, "ওঁকে আমাদের জীবনে পেয়ে আমরা কৃতজ্ঞ। ওঁর সৃষ্টির ধারা বেঁচে থাকবে।" 
সেই ধারা বহনের ভার রবিশঙ্কর দিয়ে গেলেন দুই মেয়ে, সেতারশিল্পী অনুষ্কা এবং সঙ্গীতশিল্পী নোরাকে (ওরফে গীতালি)। রইল অনেকগুলি নাতি-নাতনি। রইলেন ছাত্রছাত্রীরা।
সুরের এ হেন উত্তরাধিকারের সার্থক সমাপতনের এক মুহূর্তে মাত্র ক'দিন আগে উচ্ছ্বসিত শুনিয়েছিল সেতার-সাধককে। যখন তিনি জেনেছিলেন, ৫৫তম গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য বিশ্ব সঙ্গীতের বিভাগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে তাঁর এবং অনুষ্কার। গর্বিত বাবা বলেছিলেন, "অদ্ভুত লাগছে। আশা করি অনুষ্কাই জিতবে।" আর মেয়ের প্রতিক্রিয়া ছিল, "বাপি মনোনয়ন পেয়েছে! আমি কিছুতেই জিতব না।" 
অনুষ্কার 'বাপি'র ইতিমধ্যেই তিনটি গ্র্যামি রয়েছে। দিদি নোরার গ্র্যামির সংখ্যা বাবার তিনগুণ। কিন্তু এ বার একেবারে বাবা বনাম ছোট মেয়ে! শেষ পর্যন্ত বাবার অ্যালবাম 'দ্য লিভিং রুম, সেশনস পার্ট ১' এ বারের গ্র্যামি জেতে, না মেয়ের অ্যালবাম 'ট্র্যাভেলার' সেই উত্তর জানতে এখনও অনেক দেরি। ২০১৩-র ১০ ফেব্রুয়ারি লস অ্যাঞ্জেলেসের স্টেপলস সেন্টারে গ্র্যামি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। কিন্তু সেই সন্ধের অপেক্ষা আর করলেন না রবিশঙ্কর। 
যদিও মৃত্যুর ঠিক আগের কয়েকটা দিনে তিনি তৈরি করে গেলেন ওই গ্র্যামি-নাটকের মতোই কিছু অভাবনীয় মুহূর্ত। যার প্রতিক্রিয়া একত্রিশ বছরের অনুষ্কার মতোই ঝাঁকিয়ে দেয় সত্তর ছোঁয়া এক মুম্বইবাসী 'যুবক'কে। 
এ বারের অস্ত্রোপচারের আগের দিন রবিশঙ্কর ফোন করেন অমিতাভ বচ্চনকে। তার পর উত্তেজনায় ফেটে পড়তে পড়তে অমিতাভ ব্লগে লেখেন, "অদ্ভুত ভাবে জীবনে এই প্রথম বার পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাড়ি থেকে ফোন পেলাম। উনি আমার সঙ্গে কথা বলতে চাইলেন। আগে কয়েক বার ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছে। বাবাকে চিনতেন। আমিও ওঁর ছেলে-পুত্রবধূকে চিনতাম। কিন্তু এই প্রথম বার এমন একটা ব্যাপার!... ওঁর শরীরটা কিন্তু ভাল নেই। বৃহস্পতিবার অস্ত্রোপচার। বললেন, ওঁর এবং ওঁর স্ত্রীর আমার কাজ ভাল লাগে। উফ্! তার পর আশীর্বাদ করলেন আমাকে!" 
সাত সমুদ্র পেরিয়ে এ ভাবেই তাঁর চিঠি পেত তাঁর দেশ, তাঁর শহর। মার্কিন প্রবাসের অবসরে তিনিও শুনেছেন ঘরের ডাক। চলতি বছরের গোড়ায় যখন ভারতে এসেছিলেন, বাজিয়েছিলেন বেঙ্গালুরুতে। যদিও ওই শহরে সেটাই যে তাঁর শেষ অনুষ্ঠান, সে কথা লেখা ছিল শিরোনামেই 'ফেয়ারওয়েল টু বেঙ্গালুরু'। ৭ ফেব্রুয়ারি ২০১২। এ দেশের অনুরাগীদের কাছে তখন ঈষৎ অচেনা চেহারা তাঁর। বাজানোর মাঝে মাঝে দাড়িগোঁফের ফাঁকে ঝকঝক করছে হাসি। তার পর আবার সেতারে খেলা করছে প্রবীণ আঙুলগুলো। 
বেঙ্গালুরুর ওই কনসার্টের ঠিক তিন বছর আগে শেষ বার বাজিয়েছিলেন কলকাতায়। সে-ও ৭ ফেব্রুয়ারি, সাল ২০০৯। ঘনিষ্ঠরা জানাচ্ছেন, এ বছরের শীতে আরও এক বার আসতে চেয়েছিলেন কলকাতায়। প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতে চাইছিলেন। তাঁর প্রিয় শিল্পীদের নিয়ে একটা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনাও চলছিল। তবে রবিশঙ্কর নিজে ওই অনুষ্ঠানে বাজানোর মতো সুস্থ থাকেন কি না, সেটা নিয়েই ছিল চিন্তা।
তখন কে জানত, এ শহরের সঙ্গে আর দেখাই হবে না তাঁর!
http://www.anandabazar.com/13binodan1.html

তাঁর সেতারে সরোদের বোলবাট
মি তাঁকে 'দাদা' বলতাম। আমাকে ডাকতেন 'ভাই'। আমরা যে আসলে একই ঘরানার। 
পণ্ডিত রবিশঙ্করের গুরু উস্তাদ আলাউদ্দিন খান এবং আমার বাবা ও গুরু উস্তাদ হাফিজ আলি খান ছিলেন গুরুভাই। সেই সম্পর্ককে আজীবন সম্মান করে এসেছেন পণ্ডিতজি। তাই আমিও রবিশঙ্করজি-র ভাই, উনি দাদা।
উস্তাদ আলাউদ্দিন এবং আমার বাবা দুজনেই বাজাতেন সরোদ। আমার ঠাকুর্দা উস্তাদ নান্হে খানের মৃত্যুর পরে বাবা রামপুরে চলে যান। সেখানে তানসেন-বংশের মহাগুরু উস্তাদ ওয়াজির খানের কাছে তালিম শুরু হয় তাঁর। অল্পদিন পরে সেই ঘরেই শিক্ষা নিতে যান উস্তাদ আলাউদ্দিন খান। তখন থেকেই ওঁরা গুরুভাই। 'সেনিয়া বীণকার' ঘরানা।
পণ্ডিত রবিশঙ্করের সেতার বাদনের বৈশিষ্ট্য বেশ লক্ষ করার মতো। কারণ, তিনি সেতার শিখেছেন সরোদের উস্তাদের কাছে। সে বিষয়ে আলোচনার আগে বলে নিই, তাঁর 'মাই লাইফ, মাই মিউজিক' বইতে পণ্ডিতজি লিখেছেন, তিনি প্রথমে উস্তাদ বিলায়েত খানের বাবা উস্তাদ এনায়েত খানের কাছে সেতার শেখার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু তাঁর কাছে শেষ মুহূর্তে রবিশঙ্করের নাড়া বাঁধা হয় নি। এরপরেই তিনি উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের শিষ্যত্ব নেন।
রবিশঙ্করের সেতার বাদন ছিল প্রাণবন্ত। নিজস্ব ভঙ্গি যুক্ত করে তিনি এতে দিয়েছিলেন আকর্ষণীয় মাত্রা। আর এরই সঙ্গে ছিল রাগ নিয়ে গবেষণা এবং রাগের শুদ্ধতা রক্ষা। সব মিলিয়ে এটাই হয়ে উঠেছে রবিশঙ্কর-স্টাইল।
সরোদের উস্তাদকে গুরু হিসেবে পেয়েছিলেন বলেই রবিশঙ্করের সেতার বাদন হয়ে উঠেছে সরোদ অঙ্গের। সেতারে তিনি এনেছেন সরোদের বোলবাট। ধ্রুপদ এবং বীণকারি দুটি অঙ্গের উপাদানই তাঁর সেতারে ছিল স্পষ্ট। তিনি সেতারে রুদ্রবীণার 
লয়কারি সৃষ্টি করতে পারতেন। আর ছিল বিরল তালের ব্যবহার। তাঁর হাতের যন্ত্রে তিনি যুক্ত করেছিলেন দুটি বাড়তি মোটা তারখরজ-পঞ্চম এবং খরজের 'সা'।
এটা ঠিক, না ভুল সেসব নিয়ে কথা বলার অধিকার জগতে কারও নেই। কারণ, আমি মনে করি, সরোদ বা সেতার কীভাবে বাজানো হবে, তা শুধু ঈশ্বর জানেন। আমি বলার কে! আমি বুঝি, মানুষ সেই বাজনা কীভাবে গ্রহণ করল। সেটাই আমার কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। 
পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাজনা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে। আমার বিচারে এই হল একজন শিল্পীর সবচেয়ে বড় সার্থকতা। কেউ হয়তো বলতে পারেন, কারও বাজনা মুষ্টিমেয় বোদ্ধা শ্রোতার জন্য। কেউ বা বলতে পারেন, শিল্পী হিসেবে তিনি তাঁর নিজের তৃপ্তির জন্য বাজান। আমি তা মানি না। নিজের জন্য বাজাতে হলে পাহাড়ের চূড়ায় বা সমুদ্রের ধারে গিয়ে একা একা বাজালেই হয়! এসব কথা তাই অর্থহীন। মানুষ যাঁকে গ্রহণ করে হৃদয়ে স্থান দেয়, তিনিই সার্থক শিল্পী। তা না হলে শিল্পীর সার্থকতা কোথায়? পণ্ডিত রবিশঙ্করকে সারা পৃথিবীতে মানুষ বিপুলভাবে গ্রহণ করেছে। তাই তিনি রবিশঙ্কর। এটাই শেষ কথা।
কোনও রাগ বাজানোর আগে তা নিয়ে তাঁর গবেষণা করার কথা বলেছি। এবার বলি তাঁর রেওয়াজের কথা। যে কোনও কনসার্টের আগে সকালে তবলা নিয়ে পুরোদস্তুর রেওয়াজ করতেন রবিশঙ্কর। নিজের কাজের প্রতি এতটাই নিষ্ঠা ছিল তাঁর যে, 'স্টেজে উঠে বাজিয়ে দেব' জাতীয় মনোভাব কখনও প্রশ্রয় দেন নি। বাখ্, বিঠোফেন যেমন ৫০ বার রিহার্সাল দিতেন, পণ্ডিতজিও তেমনই। বিনা রেওয়াজে তিনি মঞ্চে বসতেন না। ইউরোপ, আমেরিকার যা কিছু ভাল, সব অকপটে নিয়েছেন তিনি। তা সে সঙ্গীতই হোক, বা সংস্কৃতি। এটাই তাঁকে দিয়েছে ব্যাপ্তি।
এটা ঠিক যে, পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণ সঙ্গীত জগতের এক অপূরণীয় ক্ষতি। এক বিরাট শূন্যতা। তবে ভারতে সেতারের ভবিষ্যৎ অন্ধকার বলে আমি মনে করি না। বহু নবীন প্রতিভা উঠে আসছেন, আসবেন। তাঁরাই আমাদের আগামির আশা।
http://www.anandabazar.com/13binodan2.html

সত্যজিৎকে দিতেন
বহু অজানা ছবির হদিস
রের দিনই চলে যেতে হবে আমেরিকায়। হাতে সময় নেই বললেই চলে। সারা রাত চলল সুর সৃষ্টি আর রেকর্ডিংয়ের কাজ। বাঁশি, সেতার, সরোদ-সহ অনেক বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহারে এক রাতেই 'পথের পাঁচালী'-র জন্য সুর দিলেন রবিশঙ্কর। 
'নীচা নগর' বা 'ধরতি কে লাল'-এর মতো ছবিতে সুর করা হয়ে গিয়েছে আগেই। কিন্তু অপেক্ষা ছিল ওই একটি রাতের। একটি 'পথের পাঁচালী'র। তাঁর সেই সুরমূছর্নাই বিশ্বের সেরা ৫০টি 'ফিল্ম সাউন্ডট্র্যাক'-এর তালিকায় স্থান পায় পরে।
একে অপরের অনুরাগী হলেও ছবির জন্য সঙ্গীত নিজেই তৈরি করতেন সত্যজিৎ রায়। তবে অপু-ট্রিলজি আর পরশ পাথর-এর সুর দিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। সেই সূত্র ধরেই সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর যে যোগাযোগ গড়ে ওঠে, পরেও তা বজায় ছিল বলে জানিয়েছেন সত্যজিৎ-পুত্র, চলচ্চিত্র পরিচালক সন্দীপ রায়। তাঁর কথায়, "আড্ডাবাজ, মিশুকে মানুষ ছিলেন রবিশঙ্কর। গুরুগম্ভীর বিষয় থেকে হাল্কা হাসির কথাবার্তা কত বিষয়ে কত রকম গল্প যে করতেন! সিনেমা দেখার ঝোঁক ছিল খুব। বিদেশে থাকার দৌলতে অনেক বিদেশি ছবি আগে দেখার সুযোগ পেতেন। এমন কত ছবির হদিস তিনি বাবাকে দিতেন!"

পথের পাঁচালীর রেকর্ডিংয়ে সৌমেন্দু রায়ের তোলা ছবি।
সত্যজিতের মৃত্যুর পরে 'ফেয়ারওয়েল মাই ফ্রেন্ড' নামে অ্যালবাম তৈরি করেন রবিশঙ্কর। সত্যজিৎও এক সময় ভেবেছিলেন, ওই সেতারশিল্পীকে নিয়ে তথ্যচিত্র তৈরি করবেন। এর জন্য নিজেই রবিশঙ্করের অনেকগুলি স্কেচ এঁকেছিলেন সত্যজিৎ। সন্দীপবাবু বলেন, "হাতে এঁকে একটি চিত্রনাট্য তৈরি করেছিলেন বাবা। কিন্তু তথ্যচিত্রটা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠেনি। হয়তো দু'জনেই ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সেটা আর হয়নি।" সন্দীপবাবুই জানান, বারাণসীতে একটি সঙ্গীত অ্যাকাডেমি করার পরিকল্পনা করেছিলেন রবিশঙ্কর। সেই অ্যাকাডেমি কেমন হবে, 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-এর শ্যুটিংয়ের সময় সত্যজিৎ, সন্দীপ-সহ অন্যদের তা দেখিয়েছিলেন সেতারশিল্পী। 
সন্দীপবাবু এখন চেন্নাইয়ে। সেখান থেকে টেলিফোনে জানালেন, 'পথের পাঁচালী' তৈরির স্মৃতি তাঁর খুবই কম। তখন তিনি নেহাতই শিশু। ঝাপসা মনে পড়ে, "রাফ-কাট (অসম্পাদিত) অবস্থায় 'পথের পাঁচালী' রবিশঙ্করকে দেখিয়েছিলেন বাবা। ওঁর সেটাই খুব ভাল লেগে যায়।" 
সেই ইতিহাসের পাতাই হাতড়াচ্ছিলেন 'তিন কন্যা', 'গুপী গাইন বাঘা বাইন', 'সোনার কেল্লা', 'জয় বাবা ফেলুনাথ'-সহ সত্যজিতের বহু ছবির সিনেমাটোগ্রাফার সৌমেন্দু রায়। শেষ বিকেলের নিভু নিভু রোদে বসে তিনি ছেঁড়া ছেঁড়া কিছু কথা শোনাচ্ছিলেন পথের পাঁচালী-র রবিশঙ্কর সম্বন্ধে। জানালেন, এত কম সময়ে ওই সুর তৈরি হয়েছিল যে, ছবির কিছু জায়গার জন্য তখনও রেকর্ডিং হয়নি। সেই দৃশ্যগুলির জন্য পরে সেতার বাজান ওই ছবির সিনেমাটোগ্রাফার সুব্রত মিত্র। সৌমেন্দুবাবু তখন সুব্রতবাবুর সহযোগী।
একটি নির্বাক ছোট চলচ্চিত্রের শ্যুটিংয়ে রবি শঙ্করকে ক্যামেরাবন্দি করার গল্প শোনাচ্ছিলেন রূপকলা কেন্দ্রের উপদেষ্টা, আশি ছুঁইছুঁই সৌমেন্দুবাবু। তাঁর কথায়, "সত্যজিৎ রায়ের নির্দেশনায় 'টু'-সহ আরো দু'টি ছোট ছবি নিয়ে একটি ট্রিলজি তৈরি হয়েছিল। তারই একটিতে ছিল খাজুরাহোর স্থাপত্যের সঙ্গে রবিশঙ্করের সেতারের আবহ।" ছবিটির কিছু দৃশ্যে রবিশঙ্কর নিজেও ছিলেন। সৌমেন্দুবাবুর কথায়, "মুম্বইয়ের মেহবুব স্টুডিওয় তেমনই একটি দৃশ্যের শ্যুটিংয়ের আগে রবিশঙ্কর আমাকে নীচের দিক থেকে (লো-অ্যাঙ্গেল) ওঁর ছবি তুলতে বারণ করলেন। কেন জিজ্ঞাসা করায় বলেন, "আমার নাকটা খুব বড়। নীচ থেকে ছবি উঠলে নাকের ফুটোগুলো আরও বড় দেখাবে!"
ছবির ব্যাপারেও এমন সজাগ বলেই হয়তো তিনি বলতে পারতেন, "তোমার ছবির একটা সংগীত-রূপ আমি ভেবে রেখেছি।" যার একটা সুর ভেঁজে শোনাতেই 'অভিভূত' হন সত্যজিৎ। তার পর এগারো ঘণ্টা টানা সুর-সৃষ্টির এক পর্ব। মূলত দেশ ও টোড়ি রাগ আশ্রয় করে সে রাতে যে সঙ্গীত তিনি তৈরি করেছিলেন, এখন তা ইতিহাস। কিংবা বলা যায়, সেই সুর রেখে অস্তে গেলেন রবি।
http://www.anandabazar.com/13binodan3.html

আমার দাদা
কী আর বলব দাদার সম্বন্ধে! ছোটবেলায় বছর দশেক বয়স থেকে দাদাকে পেয়ে এসেছি একাধারে পিতা, গুরু এবং বন্ধু হিসেবে। ওঠা, বসা, চলা, দেখা; প্রথম শিক্ষাও ওঁর থেকে প্রায়। জীবনের রং রঙ্গরস সুর লয় রাগ অনুরাগের প্রতি আমার যে অশেষ টান সেটাও দাদার অনুপ্রেরণায়। দেবতা ছিলেন না উনি। দোষে গুনে মানুষই ছিলেন তবে অসাধারণ অসামান্য মানুষ ছিলেন। 
সেই যে ১৯৩০ সালে ভারত থেকে ট্রুপ নিয়ে গেলেন প্যারিসে, সঙ্গে আমরা তিন ভাই মেজদা রাজেন্দ্র, সেজদা দেবেন্দ্র ও আমি (আমি তখন রবীন্দ্রশঙ্কর মাত্র, অত্যন্ত নাবালক), আমার খুড়ো কেদারশঙ্কর ও তাঁর মেয়ে কণকলতা, বেচুদা অন্নদা ভট্টাচার্য, মাতুল ব্রজবিহারী ও তিমিরবরণ এবং বিষ্ণুদাস শিরালী। প্যারিসে ওঁর সঙ্গে ওঁর বান্ধবী সিমকিও এল। শুরু হল উদয়শঙ্কর কোম্পানি অফ হিন্দু ড্যান্সার্স অ্যান্ড মিউজিসিয়ান্স এবং প্যারিসে একটা বাড়ি ভাড়া করে কেন্দ্রটা চালু হল। আমার মা-ও বছর দুয়েকের জন্য ওখানে গিয়েছিলেন। ওই বাড়িতেই আমরা সবাই থাকতাম আর দিনরাত রিহার্সাল চলত। তার পর আট বছর ধরে যা হল সে তো একটা ইতিহাস। দেশে ও বিদেশে উনিই প্রথম ভারতীয় শিল্পী যিনি সুপার স্টারডম পেয়েছিলেন। মনে আছে বাইরের লোকেরা সে সময়ে রবীন্দ্রনাথকে কিছু কিছু জানত। আর জানত মহাত্মা গান্ধীকে। কিন্তু ভারতকে সেই অর্থে জানতে ও ভালবাসতে শুরু করল লক্ষ লক্ষ মানুষ সেই সময়টায় দাদাকে দেখে। ভগবানের অশেষ কৃপা ও আর্শীবাদ ছিল এই মানুষটার উপর।
ওঁর রূপ গুন যশ অর্থ বীর্য যেন উপচে পড়ছিল অনবরত স্টেজে সাপুড়ের চেহারায়, গন্ধর্বের সাজে ইন্দ্র, রাজপুত বীর, কিংবা কৃষ্ণরূপে। যখনই যে নাচে নামতেন মানুষ মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে দেখত। আর জগাসুর বধ বা হর পার্বতী নৃত্যম্বন্ধে যখন শিবের ভূমিকায় নামতেন সঙ্গে পার্বতীর নাচে সিমকিকে নিয়ে, তখন কার না মনে হয়েছে ওঁরা সাক্ষাৎ হর-পার্বতী? অদ্ভুত সুন্দর একটা শরীর এবং অঙ্গসৌষ্ঠব ছিল ওঁর। লালিত্যের সঙ্গে মিশে থাকত পৌরুষ।
দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে।—ফাইল চিত্রআজকাল যাকে সেক্স অ্যাপিল বলে সেটা যেন ঝরে পড়ত ওঁর দেহ থেকে! যেখানে গেছি দেখেছি সেই একটি জিনিস ওঁর সঙ্গ পাবার জন্য মেয়েরা পাগল। শুনেছি কত গল্প রাজা নবাব বাদশাহের সম্বন্ধে! কবিরেজি, হাকিমি ওষুধ হিরে সোনা মতিভস্ম খেয়ে তাদের যৌনশক্তি ও ভোগ করার ক্ষমতা সর্ম্পকে, কিন্তু দাদাকেই দেখেছি ভগবানের তৈরি এক বীর্যক্ষম মানুষ। কি অক্লান্ত ভাবে জীবনটা ভোগ করে গেলেন! সঙ্গে সঙ্গে সৃষ্টি করে গেলেন ভারতীয় নাচ গান বাজনা দিয়ে ব্যালে। মঞ্চের উপর সাজ পোষাক ডেকর এবং আলোর ইন্দ্রলোক। একটা নতুন ধারা শুরু করলেন যার উপর ভিত্তি করে আজকের ভারতের সমস্ত ক্রিয়েটিভ ড্যান্স প্রোডাকশন দাঁড়িয়ে আছে।
দাদার শিল্পী জীবনের দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু ১৯৩৯ সাল থেকে যখন উনি আলমোড়াতে উদয়শঙ্কর ইন্ডিয়া ক্যালচার সেন্টার শুরু করেন। আমার তো মনে হয় এটাই ছিল দাদার জীবনের পীক পিরিয়ড। ব্যালের ক্ষেত্রে 'রিদিম অফ লাইফ' এবং 'লেবার অ্যান্ড মেশিনারি' ওঁর এই সময়েরই কাজ। একটা উল্লেখযোগ্য কাজ করেছিলেন উনি রবীন্দ্র শতবর্ষে। কবিগুরুর লেখা 'সামান্য ক্ষতি'র উপর। সঙ্গীত আমি করেছিলাম। দাদা কিছু আলোর স্পেশাল এফেক্ট দিয়েছিলেন। তবে ওঁর শেষ বিস্ময়কর সৃষ্টি হল এই কয়েক বছর আগে করা শঙ্করস্কোপ। যাতে উনি অদ্ভুতভাবে সিনেমা ও স্টেজের সমন্বয় ঘটিয়েছিলেন এক নিজস্ব টেকনিকে। সুধিসমাজ এটা খুব পছন্দ করেননি এর বিষয়বস্তুর জন্যই হয়তো।
আমাদের দেশের অনেক সমালোচক এবং উন্নাসিক পিউরিস্টরা চিরদিনই বলে এসেছেন নানান কথা। যেমন, দাদা পিওর কোন ঢং-এ নাচেন না অথবা রচনা করেন না। অর্থাৎ কথাকলি, ভারতনাট্যম, মণিপুরী বা কত্থক কোন একটা এক ধরনের শুদ্ধতা বজায় রাখতে কিছু করেননি। তাঁদের সমালোচনা এ ধার দিয়ে হয়তো ঠিক। তবে একটা জিনিস আমি বলব যাঁরা কেবল শুদ্ধ ঢং-এ নৃত্য পরিবেশন করেছেন ও করবেন দাদাকে তাঁদের স্তরে বা তাঁদের মাপকাঠিতে বিচার করা ভুল। 
অনেকেই হয়তো জানেন লন্ডনে থাকাকালীন কিভাবে ছবি আঁকতে আঁকতে ক্রমে নাচের লাইনে এলেন। সেনসিটিভ চিত্রকরদের মনশ্চক্ষু দিয়ে তিনি তখন ভারতীয় মন্দিরে পুরাণ ভাস্কর্যের মধ্যে গতি দেখতে পেলেন। ওঁর আদি গুরু হলেন প্রসিদ্ধ নটরাজ। ওঁকে প্রেরণা জোগাল ইলোরা অজন্তা এলিফেনটা আবু কোনারক খাজুরাহো ও মহাবলীপুরমের পাথরের খোদাই করা কাজ। তারপর ১৯২৯ সালে যখন ভারতে ফিরলেন তখন প্রায় বছর খানেক চারিদিকে ঘুরে দেখলেন কথাকলি, ভারতনাট্যম, ছৌ, মণিপুরী এবং আরও অনেক আদিবাসি নৃত্য।
দাদা সাধারণ হিসাবে বেশির ভাগ লোকের মতো ভগবানকে মানা, মন্দিরে যাওয়া, পুজো দেওয়া, সাধুসন্তের কাছে গিয়ে ঢিপঢিপ প্রণাম করা এসব কিছুই করতেন না। যে কারণে ওঁকে অনেকেই এথেয়িস্ট মনে করত। কিন্তু আমি জানি উনি কতখানি পড়াশুনা করেছিলেন আমাদের পুরাণ উপকথা ইত্যাদি এবং শিব পার্বতী রাধা কৃষ্ণ ইত্যাদি কনসেপ্টকে খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করতেন, যার জন্যে উনি তাদের রূপ ওইরকম ভিভিডভাবে ফুটিয়ে তুলতে পারতেন স্টেজের উপরে। উনি পৌরুষ বা পুরুষকারে বিশ্বাস করতেন কিন্তু সেই সঙ্গে একটা শক্তি যে আছে সবকিছুর উপরেই সেটা মানতেন।
ওঁকে আমরা দেখতাম স্টেজে ঢুকবার আগে সাইড উইংস-এ দাড়িয়ে মিনিট খানেক দু'হাত জুড়ে চোখ বুজে কাকে যেন শ্রদ্ধা জানাতেনআমাদের বলেছিলেন উনি নটরাজের মূর্তিকে সামনে রেখে শ্রদ্ধা জানান।
আমার জীবনে আরও কয়েকটি প্রতিভাশালী লোককে আমি শ্রদ্ধা করে এসেছি, ভালোবেসেছি। কিন্তু দাদা আমার জীবনে এক প্রধান হিরোছিলেন ও চিরদিন থেকে যাবেন। 

(উদয়শঙ্করের মৃত্যুর পরে ২৭ ও ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭৭, আনন্দবাজার পত্রিকায়
প্রকাশিত লেখার নির্বাচিত অংশ। মূল ভাষা ও বানান অবিকৃত।)

http://www.anandabazar.com/13binodan4.html

ঘরানা ভেঙে সেতারের বিশ্বনাগরিক
সেতার বাজিয়েই যুগযুগান্তের জাতপাত ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কে ধ্রুপদী সঙ্গীত বোঝে, কোন ঘরানা থেকে উঠে এসেছে বা রাগরাগিণী শব্দটা আদতে শুনেছে কিনা, তা নিয়ে রবিশঙ্কর কোনও দিনই ভাবিত ছিলেন না। সকলের জন্যই দরজা খুলে দিত তাঁর বাজনা। এক বার নিউ ইয়র্কের এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখলাম, অক্লেশে প্রশ্ন করল, 'হোয়েন আর ইউ কামিং ব্যাক, রবি'? আটের দশকেও ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটিশ অভিবাসন দফতরের অফিসাররা বেশ দুর্ব্যবহার করতেন। কিন্তু তখনও ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনের এক কর্তা রবিশঙ্করকে দেখেই আপ্লুত, 'একটা অটোগ্রাফ দেবেন, স্যার?'
রবিশঙ্করের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওখানেই। মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। ডোভার লেনে দেড় ঘণ্টা বা কার্নেগি হলে ১৫ মিনিটের 'পিস', তার মধ্যেই নিয়ে আসতেন যথাসম্ভব বৈচিত্র্য। তাঁর চেহারা, কথাবার্তা বা বাজানো, সর্বত্র আসল কথা একটিই। কমিউনিকেশন! সব রকমের মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করত তাঁর বাজনা।
এই কমিউনিকেশনটা তৈরি হল কী ভাবে? রবিশঙ্কর প্রথম থেকেই একটা বিষয়ে সচেতন ছিলেন। রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন! 
স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মানে? উত্তর ভারতে বেশির ভাগ ঘরানাই সৃষ্টি হয়েছে তানসেন থেকে। কিন্তু তখন যোগাযোগ এত সহজ ছিল না। একই গুরুর কাছ থেকে এসে কেউ কলকাতায় শেখালেন এক রকম, জয়পুরে অন্য রকম। ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরলিপি সে ভাবে বিশদে নেই, সবই তখন গুরুর কাছে শোনা বিদ্যা। শ্রুত বিদ্যায় কেউ হয়তো কোনও রাগের চলনে দু'টো নি লাগিয়ে দিলেন, কেউ নি-র সঙ্গে সা। কোনওটাই ভুল নয়। কিন্তু পরবর্তী কয়েক পুরুষ ধরে শিষ্যরা লড়ে গেলেন, 'আমার গুরু এই ভাবে শিখিয়েছিলেন। এটাই শুদ্ধ।'

কিন্তু পঞ্চাশের দশকে দেশ স্বাধীন। রেলগাড়ি, পোস্ট অফিস, রেডিওর দৌলতে যোগাযোগ অনেক সহজ। তখন ওই ঝগড়াটা রেখে লাভ কী? কোনও বিদেশি হয়তো গান শিখতে এলেন। একই রাগ গ্বালিয়রে এক গুরু এক ভাবে শেখালেন, আগরায় আর এক গুরু অন্য ভাবে। সে তো ভয়ে পালাবে। কোনটা ঠিক?
রবিশঙ্কর শুরু থেকে রাগ রূপায়ণের এই 'স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন' তৈরির চেষ্টা করেছেন। এবং কোনও ভেদাভেদ মানেননি। একটা উদাহরণ দিই। তাঁর গুরু বাবা আলাউদ্দিন খান মেঘ রাগের অন্তরায় শুদ্ধ নিখাদ প্রয়োগ করতেন। আমির খান অবশ্য আগাগোড়া কোমল নি লাগাতেন।
রবিশঙ্কর কিন্তু নিজের প্রতিভামাফিক ব্যাপারটা 'এডিট' করে নিলেন। মাইহার ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে শুধু কোমল নি-টাই রাখলেন। ভারতের সর্বত্র ওটিই বেশি ব্যবহৃত হত যে! স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের খাতিরে এই ধরনের 'এডিটিং' ধ্রুপদী সঙ্গীতে ছিল না। যে যার ঘরানা তোতাপাখির মতো আউড়ে যেত। রবিশঙ্করই যুক্তি, বুদ্ধি এবং শিক্ষা দিয়ে তোতাকাহিনীর বাইরে ধ্রুপদী সঙ্গীতকে বের করে আনলেন। 
রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের পাশে তালকেও প্রাধান্য দিলেন রবিশঙ্কর। তিনিই প্রথম বুঝলেন, তবলার তাল মোটেই সহযোগী শিল্প নয়। কিষেণ মহারাজ, কেরামতুল্লা খান, আল্লারাখার তবলায় রয়েছে ছন্দ। ফলে, সেতার বাজাতে বসে তবলাকেও ছাড়া হল কিছুটা জায়গা। সেতারের সুরে ঢুকে এল তাল আর ছন্দ। আপনি-আমি যে ভাবে নিঃশ্বাস নিই, যে ভাবে কথা বলি, সবের মধ্যেই তো থাকে ছন্দ। রবিশঙ্করের বাজনার হাত ধরেই সঙ্গীতে সেই ছন্দ খুঁজে পেল পৃথিবী। তিনিই হয়ে উঠলেন ভারতের অন্যতম 'ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।' বছর কয়েক আগে বিবিসিতে 'ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট' নামে অনুষ্ঠান। মহাত্মা গাঁধীর জন্য বরাদ্দ ৫ মিনিট, জওহরলাল নেহরুর জন্য ২ মিনিট। আর রবিশঙ্কর ৩৫ মিনিট!
ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে দেওয়া, তালবাদ্যকে প্রাধান্য দেওয়া...এটা রাগরাগিণী ভাল না জানলে হয় না। বাবা আলাউদ্দিন খানের কাছে তাঁর পুত্র আলি আকবর খান থেকে বাহাদুর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রায় সব শিষ্যই মার খেয়েছেন। সামান্য ভুলচুক হলেই খড়মপেটা করতেন বাবা। এক মাত্র রবিশঙ্করের গায়ে কোনও দিন হাত দেননি। সেই রকম ভুল তাঁর হতই না! আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানেও তাই প্রৌঢ় রবিশঙ্কর সেতারে আলাপের পর জোড় বাজাতেন। জোড়ের চারটি ভাগ। বিলম্বিত জোড়, মধ্যলয় জোড়, গমক জোড় আর লোরি জোড়। বেশির ভাগ বাজিয়ে দু' একটা জোড় বাজিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু রবিশঙ্কর চারটিই বাজাতেন। ওই জোড় বাজানো শেষ হয়ে গেল! 
সেতারের কাঠামোও বদলে দিয়েছিলেন তিনি। রুদ্রবীণার আদলে তাঁর সেতারে খড়জ আর পঞ্চমে মোটা তার। যন্ত্রটা সুরবাহার আর সেতারের মাঝামাঝি। লখনউয়ের ইউসুফ আলি খানকে দিয়ে ওই যন্ত্র তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দিন।
প্রথাগত সেতারের বাইরে এই যন্ত্রে মন্দ্রসপ্তকে আরও একটি 'অক্টেভ' বেড়ে গেল, আলাপ এবং জোড়ে চমৎকার বাজে। কিন্তু তার পর? কলকাতার নদেরচাঁদ মল্লিকের সাহায্যে দুটো হুক তৈরি করলেন রবিশঙ্কর। খড়জ, পঞ্চমে পারফেক্ট সুরে, অনায়াস সাবলীলতায় যাতায়াত করে শেষ দিকে হুক লাগিয়ে তবলার সঙ্গে গৎ বাজাতেন। এক যন্ত্রে সুরবাহার এবং সেতার দুটোর সুবিধাই নিতেন তিনি। এখন সবাই রবিশঙ্করের আদলে সেতার তৈরি করান এবং প্রথম থেকেই হুক লাগিয়ে দেন। রবিশঙ্কর এটি করতেন না। অনায়াসেই চারটি তারে ঘোরাফেরা করে সুন্দর সঙ্গীতের সৃষ্টি করতেন।
রবিশঙ্কর কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন।
আমাদের কাছে উনি ঈশ্বরের মতোই। 
লতা মঙ্গেশকর
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হারাল তার প্রধান দূতকে।
দেশ হারাল ভারতরত্নকে।
এ আর রহমান
রবিশঙ্কর ছিলেন সঙ্গীত, শিল্প ও
সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক 'আইকন'।
প্রণব মুখোপাধ্যায়
বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতির
অন্যতম দূত ছিলেন তিনি।
মনমোহন সিংহ
ভৌগোলিক সীমানা ছাপিয়ে তাঁর
সৃষ্টিশীলতা সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করত।
এম কে নারায়ণন
বাংলার সঙ্গে রবিশঙ্করের গভীর যোগাযোগের
স্মৃতি হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
রবিশঙ্করকে চিনতাম বলে লন্ডনে
মেয়েমহলে আমার কদর বেড়ে গিয়েছিল।
শেখর কপূর
এই প্রতিভাই 'বিট্ল' জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে সেতার বাজাতে পারে, ইহুদি মেনুহিনকে দিয়ে পিলু রাগ বাজাতে পারে। ফিউসন মিউজিক তো মুম্বইয়ের ছবিতে রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক অনেক আগেই শুরু করেছিলেন। স্যাক্সোফোনের সঙ্গে সেতার বা গিটারের সঙ্গে তবলা। কিন্তু রবিশঙ্কর নিজে মিউজিক কম্পোজ করে ইহুদি মেনুইনকে দিয়ে বাজিয়েছেন। পিলুর শুদ্ধতা এক চুলও এ দিক-ও দিক না করে 'ইম্প্রোভাইজ্ড ফিউসন' নয়, 'কম্পোজ্ড ফিউসন।' 
তাঁর অস্তিত্বের আলাপ আর ঝালার মাঝে মিশেছিল আরও অনেক কিছু। সুপুরুষ চেহারা ও চর্চিত বৈদগ্ধ্য। মাইহারে রবিশঙ্করের ছবি দেখবেন, সরু গোঁফ তরুণ। দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে প্যারিসে গিয়ে যা কিছু শিখেছিলেন, সবই ঝেড়ে ফেলেছেন। শুধুই যেন বারাণসীর তরুণ।
পরে বুঝলেন, বাজনার সঙ্গে বদলাতে হবে চেহারা, হাবভাব, কথাবার্তা। সুপুরুষ রবিশঙ্কর তখন কলারওয়ালা 'গুরু' পাঞ্জাবি পরেন। তাঁর ফ্যাশনসচেতনতা প্রথম দেখাল, ট্রাউজার্সের সঙ্গে ওই রকম পাঞ্জাবিও গায়ে দেওয়া যায়। সত্তর দশকের শেষাশেষি সামান্য ভুঁড়ি হয়েছে। বালিগঞ্জ পার্ক রোডের বাড়িতে বসে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, 'না, এটা শিগ্গির বাতিল করতে হবে।' তেলমশলা তখনই বাদ, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে আসতে শুরু করল কন্টিনেন্টাল লাঞ্চ। পরের বার বিদেশ থেকে এলেন, ছিপছিপে চেহারা।
শুধু চেহারা? প্রথাগত লেখাপড়া না শিখেও হাবভাবে নিয়ে এসেছেন বৈদদ্ধ্য। নিজে মদ পছন্দ না করলেও ভাল ওয়াইন কোথায় পাওয়া যায়, ভাল ছবি কী ভাবে কিনতে হবে, লন্ডনে ভাল থিয়েটার কী চলছে সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারেন। লন্ডনের লর্ড মাউন্টব্যাটেন হলে বাজাতে নয়, ৭৫ মিনিটের বক্তৃতা দিতে এসেছেন রবিশঙ্কর। সকলে অবাক হয়ে শুনছে তাঁর কথা। মাইহারের সরু গোঁফ নিজের চেষ্টায় হয়ে উঠেছেন এক জন বিশ্বনাগরিক।
এই বিশ্বনাগরিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে ছাত্রদরদি, প্রেমিক সত্তা। আবার, নিজের স্টারডম নিয়ে পূর্ণ সচেতন। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকাররা অনেকে খেতে যেতেন। সকলে হইহই করে দরজা পেরিয়ে যেতেন, রবিশঙ্কর গ্যাঁট হয়ে গাড়িতে বসে থাকতেন। ম্যানেজার এসে দরজা না খুলে দিলে তিনি নামবেন না।
এক দিকে বারাণসীর তরুণ, অন্য দিকে ক্যারিশমাটিক তারকা। পরস্পরবিরোধী এই দুটি সত্তাকে আজীবন বয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। যিনি রেড মিটের সঙ্গে কোন রেড ওয়াইন ভাল যায়, তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চালাতে পারেন, তিনিই উড়ানে উঠে বিমানসেবিকাকে সটান জিজ্ঞেস করেন, 'মাংসটা কীসের? গোরু বা শুয়োর হলে দিয়ো না।' প্রতিভাবানরা এই রকমই হন।
প্রতিভা! মাইহার ঘরানার সন্তান রবিশঙ্করের ঘরের নাম আসলে সেটাই। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক বিখ্যাত সেতারবাদক আসবেন, কিন্তু প্রতিভা দিয়ে নতুন ব্যাকরণ তৈরি? রবিশঙ্করেই সেই ঘরানার শুরু ও শেষ!
প্রয়াত পণ্ডিত রবিশঙ্কর

ওয়াশিংটনঃ বুধবার ভোর৷ শহরের আকাশজুড়ে মেঘমল্লার৷ হাজার হাজার মাইল দূরে মার্কিন মুলুকে তখন হঠাত্ স্তব্ধ সেতারের সুর৷ চলে গেলেন ভারতীয় মার্গসঙ্গীতের যুগপুরুষ৷ আধুনিক বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম বিশ্বপথিক৷ প্রবাদপ্রতিম সেতারশিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর প্রয়াত৷ আরও একবার পিতৃহারা এ-শহর, এই দেশ৷ বুধবার ভোরে আমেরিকার সান দিয়েগোর এক হাসপাতালে মৃত্যু হয় পণ্ডিত রবিশঙ্করের৷ বয়স হয়েছিল ৯২ বছর৷ দীর্ঘদিন ধরে ভুগছিলেন শ্বাসকষ্টজনিত রোগে৷গত বৃহস্পতিবার তিনি হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর অস্ত্রোপচার করা হলেও তা সফল হয়নি বলে পরিবারের তরফে জানানো হয়েছে৷ তাঁর মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে জানানো হয়েছে পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণে শোকাহত  প্রধানমন্ত্রী৷ পণ্ডিত রবিশঙ্কর জাতীয় সম্পদ৷ তিনি ভারতীয় সংস্কৃতির বিশ্বদূত৷  রাজ্যপাল এম কে নারায়ণনও তাঁর শোকবার্তায় গভীর শোকপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, প্রবাদপ্রতিম পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে শোকাহত৷ তিনি ছিলেন সংস্কৃতির স্তম্ভ৷ সঙ্গীতের মাধ্যমে সব হৃদয়কে এক করেছিলেন তিনি৷ সব ভৌগোলিক গণ্ডি মুছে দেয় তাঁর সৃষ্টি৷ তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাই৷ ঈশ্বরের কাছে তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি৷  মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর শোকবার্তায় জানিয়েছেন, ভারতীয় ধ্রুপদী সঙ্গীতের প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্ব ও বিশিষ্ট সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রয়াণে আমি গভীর শোক প্রকাশ করছি৷ সেতারের মুর্চ্ছনায় বিষাদ৷ ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তাঁর অবদান থেকে ব্যক্তিগত সম্পর্ক, ঘুরেফিরে আসা টুকরো স্মৃতি৷ ১৯৮৬ থেকে ১৯৯২ পর্যন্ত ছিলেন রাজ্যসভার সাংসদ৷ বুধবার রাজ্যসভাতেও তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করা হয়৷ 

সেতারের মূর্ছনায় ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছিলেন তিনি৷ ভারতরত্ন-সহ একাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মানে সম্মানিত হয়েছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর৷ তাঁর মৃত্যু সারা বিশ্বের সঙ্গীত জগতে এক অপূরণীয় ক্ষতি৷ তাঁর মৃত্যুতে একটি যুগের অবসান হল৷ তিনবার গ্র্যামি জয়ী এই শিল্পী, আবার ২০১৩ সালে গ্র্যামির জন্য মনোনীত হয়েছিলেন। 


বিশুদ্ধ মার্গসঙ্গীত থেকে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন৷ অনন্য সৃজনীর পরশপাথরে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মহিমা৷ জীবনের শেষ অনুষ্ঠানটি করেছিলেন গত ৪ নভেম্বর, মুখে অক্সিজেন মাস্ক নিয়েই৷ সঙ্গে ছিলেন মেয়ে অনুষ্কাও৷ শরীর ভেঙে পড়েছিল, তবু অসুস্থতা কেড়ে নিতে পারেনি তাঁর সৃষ্টিকে৷ কিন্তু, বুধবারের ভোর, এক লহমায় নিঃস্ব করে দিয়ে গেল এ-শহরকে, এ-পৃথিবীকে৷ ঘুমভাঙা শহরের চোখ তাই কি ছিল অকাল বৃষ্টিতে সিক্ত?

http://abpananda.newsbullet.in/national/60-more/31293-2012-12-12-04-04-18


পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন


পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন

:: পরিবর্তন ডেস্ক ::  
১৯৭১ সাল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী। লাখ লাখ মানুষ উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নিয়েছে সীমান্তের ওপারে, ভারতে। শরণার্থী শিবিরে খাদ্যের অভাবে ধুঁকছে লাখ লাখ মানুষ, মরণাপন্ন বাবা-মায়ের জন্য ওষুধ না পেয়ে মাথা কুটছে সন্তান, বমি করতে করতে মরছে শিশুরা।


এদিকে, দেশের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে পাকিস্তানি সেনারা। সঙ্গে আছে রাজাকার বাহিনী। এরকম এক মানবেতর অবস্থায় সহায়তার আশায় পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসনবাংলাদেশ তখন তাকিয়ে আছে সারা বিশ্বের দিকে।

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে হওয়া এই কনসার্টের মাধ্যমে পৃথিবীর বহু মানুষ প্রথম জেনেছিল বাংলাদেশের নাম। আর এই কনসার্টের মূল পরিকল্পনা ছিল উপমহাদেশের প্রখ্যাত সংগীতজ্ঞ পণ্ডিত রবিশঙ্করের।

১৯৭১ সালে নিজেকে একজন বাঙালি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাঙালি হয়ে তাই বাঙালির পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। নিজেকে তিনি ভারতীয় মনে করেননি। মনে করেছেন বাঙালি। সেতার দিয়ে আমাদের পক্ষে লড়েছেন এই পণ্ডিত রবিশঙ্কর। সেতার নিয়ে তার নানা পরীক্ষা নিরীক্ষা আর নতুন ফিউশন তাকে পরিচিত করে তুলে সর্বত্র। এ সময় বিশ্ব জুড়ে কাঁপন ধরানো রক গায়কের অনেকেই প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠলেন রবিশঙ্করের। জর্জ হ্যারিসন ছিলেন তাদেরই একজন। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের বন্ধুত্ব হয়েছিল ১৯৬৬ সালে।

বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য লড়ছে, মুক্তির সংগ্রাম করছে, রবিশঙ্করই তা জানান বন্ধু হ্যারিসনকে। সব জানার পর রবিশঙ্করের সঙ্গে একমত হন হ্যারিসন। সে সময় 'কোয়ায়েট বিটল' নামে দুনিয়া খ্যাত ছিলেন বিটলসের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসন। ষাটের দশকে দুনিয়া জুড়ে যে অস্থিরতা ও বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়েছিল তরুণদের মধ্যে, তারই প্রতিনিধি ছিলেন বিটলসরা। পুরো একটি প্রজন্মকে সংগীত দিয়ে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন তাঁরা। সেই বিটলস তখন ভেঙে গেছে। জর্জ হ্যারিসন একক ক্যারিয়ার করার কথা ভাবছেন। সে সময়ই রবিশঙ্করের মাধ্যমে বাংলাদেশের সঙ্গে নতুন এক আত্মিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে জর্জ হ্যারিসনের।

পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন

বাংলাদেশ নিয়ে কনসার্ট করার কথা প্রথম রবিশঙ্কর ভাবলেও কাজটি সম্ভব হয়েছিল জর্জ হ্যারিসনের জন্যই। তিনিই উদ্যোগী হয়ে শিল্পীদের জোগাড় করেছিলেন। আত্মাভিমান ভুলে তিনি বিটলসের সহশিল্পীদের সঙ্গেও যোগাযোগ করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গেই রাজি হয়েছিলেন ড্রামার রিঙ্গো স্টার। বিল প্রেস্টন ও লিওন রাসেলও রাজি হন। তবে জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও কনসার্টের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিলেন বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটন। বিশেষ করে এরিক ক্ল্যাপটনের গিটারের ঝংকার আর বব ডিলানের বিখ্যাত সেই গান 'ব্লোয়িং ইন দ্য উইন্ড' মানুষ আজীবন মনে রাখবে। একই দিনে দুটি কনসার্ট হয়েছিল, একই নামে।

পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন

কনসার্টটি শুরু হয়েছিল রবিশঙ্কর ও আলী আকবর খানের যুগলবন্দী দিয়ে। তবলায় ছিলেন আল্লারাখা। রবিশঙ্কর 'বাংলা ধুন' নামের নতুন একটি সুর সৃষ্টি করেছিলেন। সেটি দিয়েই শুরু হয়েছিল কনসার্ট। আর শেষ পরিবেশনা ছিল জর্জ 
হ্যারিসনের অবিস্মরণীয় সেই গান 'বাংলাদেশ'। এই গানটির মধ্য দিয়ে জর্জ হ্যারিসন বুঝিয়ে দিয়েছিলেন বাংলাদেশের সংকটের প্রকৃত চিত্র। গানটি কিন্তু শুরু হয়েছিল বন্ধু রবিশঙ্করের কথা দিয়েই। 'মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি/ উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ/ টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প/ বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ'।

পণ্ডিত রবিশংকর ও জর্জ হ্যারিসন'আই মি মাইন' বিটলসের একটি গান, লিখেছিলেন জর্জ হ্যারিসন। এই নামে তার একটি আত্মজীবনীও আছে। সেখানে দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নিয়ে অনেক কিছুই লিখেছেন। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশের উদ্বাস্তুদের জন্য কনসার্ট থেকে ২৫ হাজার ডলার তোলা যাবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ উঠেছিল। টিকিট বিক্রি থেকে আয় হয়েছিল আড়াই লাখ ডলার। এর বাইরে কনসার্টের অ্যালবাম ও কনসার্ট নিয়ে তৈরি ছবি বিক্রি করে আরও অর্থ আয় হয়। বাংলাদেশকে কখনোই ভুলে যাননি জর্জ হ্যারিসন। ১৯৮২ সালে এক মার্কিন টিভি অনুষ্ঠানে জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের শিশুদের জন্য আবারও কয়েক লাখ ডলারের একটি চেক তুলে দিয়েছিলেন।

কঠিন এক দুঃসময়ে সারা বিশ্বে 'বাংলাদেশ' নামটি তুলে ধরেছিলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর এবং জর্জ হ্যারিসন। রাষ্ট্র তাদের প্রাপ্ত সম্মান দিতে না পারলেও বাংলাদেশের মানুষের অন্তরে সব সময়ই থেকে যাবে রবিশঙ্কর ও হ্যারিসনের নাম।

বিজয়ের এই মাসে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি বাংলাদেশের এই দুই প্রিয় বন্ধুকে।

http://poriborton.com/article_details.php?article_id=7355


থেমে গেল সেতার সম্রাটের ঝংকার

মাত্র তিন ঘণ্টায় সত্যজিৎ রায়ের প্রথম সিনেমা পথের পাঁচালির সুর বেঁধেছিলেন তিনি। ২০১৩ গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মেয়ের সঙ্গে একই ক্যাটাগরিতে লড়াইয়ে নেমেছিলেন। কিন্তু মেয়ের সঙ্গে লড়াইয়ের ফয়সালা হওয়ার আগেই থেমে গেল সেতার সম্রাটের সুরের মূর্চ্ছনা। ভারতীয় সময় বুধবার সকাল ছ'টায় প্রয়াত হলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। গত বৃহস্পতিবার থেকে শ্বাসকষ্ট নিয়ে মার্কিন মুলুকের সান দিয়েগোর একটি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। এদিন হাসপাতালেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ৯২ বছরের কিংবদন্তি সেতারশিল্পীর মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতে শোকের ছায়া নেমে এসেছে।

বাঙালি হলেও পণ্ডিত রবিশঙ্করের পরিচয় ছিল বিশ্ববাসী হিসেবে। ভারতীয় সঙ্গীতকে বিশ্বের দরবারে পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। কলকাতা থেকে সানফ্রান্সিসকো সুরের মূর্চ্ছনা শ্রোতাদের মুগ্ধ করে রাখতেন এই শিল্পী। বয়স যে তাঁর কাজে বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি, তার প্রমাণ ২০১৩ গ্র্যামি পুরস্কারের জন্য মনোনীত হওয়া। এমনকী, ৪ নভেম্বর ক্যালিফোর্নিয়ায় কন্যা অনুষ্কাশঙ্করের সঙ্গে একটি মিউজিক কনসার্টও করেন তিনি।

রবিশঙ্করের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করেছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। তিনি জানিয়েছেন, পণ্ডিতজির মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতের একটা যুগের অবসান হল। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রবিশঙ্করের মৃত্যুতে শোকপ্রকাশ করে জানিয়েছেন, পণ্ডিত রবিশঙ্করের মৃত্যুতে সঙ্গীত জগতের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেল। পণ্ডিতজির পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানিয়েছেন মুখ্যমন্ত্রী। শোকস্তব্ধ তনুশ্রীশঙ্কর জানান, খবরটা বিশ্বাস করতে পারছি না। অভিভাবকহীন হয়ে পড়লাম বলে মন্তব্য করেন রাশিদ খান। কবীর সুমন বলেন, রবিশঙ্কর মানেই সঙ্গীত। এই শূন্যতা পূরণ করবে কে?

১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল উত্তরপ্রদেশের বারাণসীতে জন্ম হয়েছিল সুরের জাদুকরের। দাদা উদয়শঙ্করের ব্যালেট্রুপে যোগ দিয়ে ইউরোপ সফর করেছিলেন মাত্র ১০ বছর বয়সে। কিন্তু নৃত্য ছেড়ে সেতারের তালিম নিতে শুরু করেন ১৮ বছর বয়সে। প্রখ্যাত সেতারশিল্পী ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কাছে মাইহার ঘরানার শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন। মাত্র ২৫ বছর বয়সে ইকবালের "সারে জাঁহাসে আচ্ছা" গানটিতে নতুন করে সুর দিয়ে সাড়া ফেলে দেন রবিশঙ্কর। পথের পাঁচালি ছাড়াও সত্যজিৎ রায়ের আরও দুটি সিনেমা 'অপরাজিত' এবং 'অপুর সংসার'-এর সুরকার ছিলেন তিনি।

মৌলিক সুরসৃষ্টির জন্য দেশ বিদেশে বহু সম্মান পেয়েছেন রবিশঙ্কর। ১৯৯৯ সালে ভারতরত্ন সম্মানে ভূষিত হন তিনি। সঙ্গীত জগতের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কার গ্র্যামি জিতেছেন তিনবার। তাঁর শেষ অ্যালবাম 'দ্য লিভিং রুম সেশনস পার্ট-ওয়ান' এর জন্য ৫৫তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের একই ক্যাটাগরিতে কন্যা অনুষ্কাশঙ্করের সঙ্গে মনোনীত হয়েছেন রবিশঙ্কর। ২০১৩ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি ৫৫তম গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হবে। সুরের জাদুকর তার আগেই সুরলোকের উদ্দেশে রওনা দিলেন।

http://bengali.yahoo.com/%E0%A6%A5-%E0%A6%AE-%E0%A6%97-%E0%A6%B2-%E0%A6%B8-%E0%A6%A4-%E0%A6%B8%E0%A6%AE-%E0%A6%9F-043836715.html

ঘরানা ভেঙে সেতারের বিশ্বনাগরিক
সেতার বাজিয়েই যুগযুগান্তের জাতপাত ঘুচিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। কে ধ্রুপদী সঙ্গীত বোঝে, কোন ঘরানা থেকে উঠে এসেছে বা রাগরাগিণী শব্দটা আদতে শুনেছে কিনা, তা নিয়ে রবিশঙ্কর কোনও দিনই ভাবিত ছিলেন না। সকলের জন্যই দরজা খুলে দিত তাঁর বাজনা। এক বার নিউ ইয়র্কের এক ট্যাক্সিওয়ালাকে দেখলাম, অক্লেশে প্রশ্ন করল, 'হোয়েন আর ইউ কামিং ব্যাক, রবি'? আটের দশকেও ভারতীয়দের সঙ্গে ব্রিটিশ অভিবাসন দফতরের অফিসাররা বেশ দুর্ব্যবহার করতেন। কিন্তু তখনও ব্রিটিশ ইমিগ্রেশনের এক কর্তা রবিশঙ্করকে দেখেই আপ্লুত, 'একটা অটোগ্রাফ দেবেন, স্যার?'
রবিশঙ্করের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ ছিল ওখানেই। মানুষকে মুগ্ধ করার ক্ষমতা। ডোভার লেনে দেড় ঘণ্টা বা কার্নেগি হলে ১৫ মিনিটের 'পিস', তার মধ্যেই নিয়ে আসতেন যথাসম্ভব বৈচিত্র্য। তাঁর চেহারা, কথাবার্তা বা বাজানো, সর্বত্র আসল কথা একটিই। কমিউনিকেশন! সব রকমের মানুষের সঙ্গে কমিউনিকেট করত তাঁর বাজনা।
এই কমিউনিকেশনটা তৈরি হল কী ভাবে? রবিশঙ্কর প্রথম থেকেই একটা বিষয়ে সচেতন ছিলেন। রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন! 
স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন মানে? উত্তর ভারতে বেশির ভাগ ঘরানাই সৃষ্টি হয়েছে তানসেন থেকে। কিন্তু তখন যোগাযোগ এত সহজ ছিল না। একই গুরুর কাছ থেকে এসে কেউ কলকাতায় শেখালেন এক রকম, জয়পুরে অন্য রকম। ভারতীয় সঙ্গীতে স্বরলিপি সে ভাবে বিশদে নেই, সবই তখন গুরুর কাছে শোনা বিদ্যা। শ্রুত বিদ্যায় কেউ হয়তো কোনও রাগের চলনে দু'টো নি লাগিয়ে দিলেন, কেউ নি-র সঙ্গে সা। কোনওটাই ভুল নয়। কিন্তু পরবর্তী কয়েক পুরুষ ধরে শিষ্যরা লড়ে গেলেন, 'আমার গুরু এই ভাবে শিখিয়েছিলেন। এটাই শুদ্ধ।'

কিন্তু পঞ্চাশের দশকে দেশ স্বাধীন। রেলগাড়ি, পোস্ট অফিস, রেডিওর দৌলতে যোগাযোগ অনেক সহজ। তখন ওই ঝগড়াটা রেখে লাভ কী? কোনও বিদেশি হয়তো গান শিখতে এলেন। একই রাগ গ্বালিয়রে এক গুরু এক ভাবে শেখালেন, আগরায় আর এক গুরু অন্য ভাবে। সে তো ভয়ে পালাবে। কোনটা ঠিক?
রবিশঙ্কর শুরু থেকে রাগ রূপায়ণের এই 'স্ট্যান্ডার্ডাইজেশন' তৈরির চেষ্টা করেছেন। এবং কোনও ভেদাভেদ মানেননি। একটা উদাহরণ দিই। তাঁর গুরু বাবা আলাউদ্দিন খান মেঘ রাগের অন্তরায় শুদ্ধ নিখাদ প্রয়োগ করতেন। আমির খান অবশ্য আগাগোড়া কোমল নি লাগাতেন।
রবিশঙ্কর কিন্তু নিজের প্রতিভামাফিক ব্যাপারটা 'এডিট' করে নিলেন। মাইহার ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে শুধু কোমল নি-টাই রাখলেন। ভারতের সর্বত্র ওটিই বেশি ব্যবহৃত হত যে! স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের খাতিরে এই ধরনের 'এডিটিং' ধ্রুপদী সঙ্গীতে ছিল না। যে যার ঘরানা তোতাপাখির মতো আউড়ে যেত। রবিশঙ্করই যুক্তি, বুদ্ধি এবং শিক্ষা দিয়ে তোতাকাহিনীর বাইরে ধ্রুপদী সঙ্গীতকে বের করে আনলেন। 
রাগরাগিণীর স্ট্যান্ডার্ডাইজেশনের পাশে তালকেও প্রাধান্য দিলেন রবিশঙ্কর। তিনিই প্রথম বুঝলেন, তবলার তাল মোটেই সহযোগী শিল্প নয়। কিষেণ মহারাজ, কেরামতুল্লা খান, আল্লারাখার তবলায় রয়েছে ছন্দ। ফলে, সেতার বাজাতে বসে তবলাকেও ছাড়া হল কিছুটা জায়গা। সেতারের সুরে ঢুকে এল তাল আর ছন্দ। আপনি-আমি যে ভাবে নিঃশ্বাস নিই, যে ভাবে কথা বলি, সবের মধ্যেই তো থাকে ছন্দ। রবিশঙ্করের বাজনার হাত ধরেই সঙ্গীতে সেই ছন্দ খুঁজে পেল পৃথিবী। তিনিই হয়ে উঠলেন ভারতের অন্যতম 'ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসাডার।' বছর কয়েক আগে বিবিসিতে 'ইস্ট অ্যান্ড ওয়েস্ট' নামে অনুষ্ঠান। মহাত্মা গাঁধীর জন্য বরাদ্দ ৫ মিনিট, জওহরলাল নেহরুর জন্য ২ মিনিট। আর রবিশঙ্কর ৩৫ মিনিট!
ঘরানার ব্যাকরণ ভেঙে দেওয়া, তালবাদ্যকে প্রাধান্য দেওয়া...এটা রাগরাগিণী ভাল না জানলে হয় না। বাবা আলাউদ্দিন খানের কাছে তাঁর পুত্র আলি আকবর খান থেকে বাহাদুর খান, নিখিল বন্দ্যোপাধ্যায়, বীরেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী প্রায় সব শিষ্যই মার খেয়েছেন। সামান্য ভুলচুক হলেই খড়মপেটা করতেন বাবা। এক মাত্র রবিশঙ্করের গায়ে কোনও দিন হাত দেননি। সেই রকম ভুল তাঁর হতই না! আধ ঘণ্টার অনুষ্ঠানেও তাই প্রৌঢ় রবিশঙ্কর সেতারে আলাপের পর জোড় বাজাতেন। জোড়ের চারটি ভাগ। বিলম্বিত জোড়, মধ্যলয় জোড়, গমক জোড় আর লোরি জোড়। বেশির ভাগ বাজিয়ে দু' একটা জোড় বাজিয়ে ছেড়ে দেন। কিন্তু রবিশঙ্কর চারটিই বাজাতেন। ওই জোড় বাজানো শেষ হয়ে গেল! 
সেতারের কাঠামোও বদলে দিয়েছিলেন তিনি। রুদ্রবীণার আদলে তাঁর সেতারে খড়জ আর পঞ্চমে মোটা তার। যন্ত্রটা সুরবাহার আর সেতারের মাঝামাঝি। লখনউয়ের ইউসুফ আলি খানকে দিয়ে ওই যন্ত্র তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন বাবা আলাউদ্দিন।
প্রথাগত সেতারের বাইরে এই যন্ত্রে মন্দ্রসপ্তকে আরও একটি 'অক্টেভ' বেড়ে গেল, আলাপ এবং জোড়ে চমৎকার বাজে। কিন্তু তার পর? কলকাতার নদেরচাঁদ মল্লিকের সাহায্যে দুটো হুক তৈরি করলেন রবিশঙ্কর। খড়জ, পঞ্চমে পারফেক্ট সুরে, অনায়াস সাবলীলতায় যাতায়াত করে শেষ দিকে হুক লাগিয়ে তবলার সঙ্গে গৎ বাজাতেন। এক যন্ত্রে সুরবাহার এবং সেতার দুটোর সুবিধাই নিতেন তিনি। এখন সবাই রবিশঙ্করের আদলে সেতার তৈরি করান এবং প্রথম থেকেই হুক লাগিয়ে দেন। রবিশঙ্কর এটি করতেন না। অনায়াসেই চারটি তারে ঘোরাফেরা করে সুন্দর সঙ্গীতের সৃষ্টি করতেন।
রবিশঙ্কর কৃষ্ণের ভক্ত ছিলেন।
আমাদের কাছে উনি ঈশ্বরের মতোই। 
লতা মঙ্গেশকর
ভারতীয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত হারাল তার প্রধান দূতকে।
দেশ হারাল ভারতরত্নকে।
এ আর রহমান
রবিশঙ্কর ছিলেন সঙ্গীত, শিল্প ও
সংস্কৃতির আন্তর্জাতিক 'আইকন'।
প্রণব মুখোপাধ্যায়
বিশ্বে ভারতীয় সংস্কৃতির
অন্যতম দূত ছিলেন তিনি।
মনমোহন সিংহ
ভৌগোলিক সীমানা ছাপিয়ে তাঁর
সৃষ্টিশীলতা সকলেরই হৃদয় স্পর্শ করত।
এম কে নারায়ণন
বাংলার সঙ্গে রবিশঙ্করের গভীর যোগাযোগের
স্মৃতি হৃদয়ে অক্ষয় হয়ে থাকবে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
রবিশঙ্করকে চিনতাম বলে লন্ডনে
মেয়েমহলে আমার কদর বেড়ে গিয়েছিল।
শেখর কপূর
এই প্রতিভাই 'বিট্ল' জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে সেতার বাজাতে পারে, ইহুদি মেনুহিনকে দিয়ে পিলু রাগ বাজাতে পারে। ফিউসন মিউজিক তো মুম্বইয়ের ছবিতে রাইচাঁদ বড়াল, পঙ্কজ মল্লিক অনেক আগেই শুরু করেছিলেন। স্যাক্সোফোনের সঙ্গে সেতার বা গিটারের সঙ্গে তবলা। কিন্তু রবিশঙ্কর নিজে মিউজিক কম্পোজ করে ইহুদি মেনুইনকে দিয়ে বাজিয়েছেন। পিলুর শুদ্ধতা এক চুলও এ দিক-ও দিক না করে 'ইম্প্রোভাইজ্ড ফিউসন' নয়, 'কম্পোজ্ড ফিউসন।' 
তাঁর অস্তিত্বের আলাপ আর ঝালার মাঝে মিশেছিল আরও অনেক কিছু। সুপুরুষ চেহারা ও চর্চিত বৈদগ্ধ্য। মাইহারে রবিশঙ্করের ছবি দেখবেন, সরু গোঁফ তরুণ। দাদা উদয়শঙ্করের সঙ্গে প্যারিসে গিয়ে যা কিছু শিখেছিলেন, সবই ঝেড়ে ফেলেছেন। শুধুই যেন বারাণসীর তরুণ।
পরে বুঝলেন, বাজনার সঙ্গে বদলাতে হবে চেহারা, হাবভাব, কথাবার্তা। সুপুরুষ রবিশঙ্কর তখন কলারওয়ালা 'গুরু' পাঞ্জাবি পরেন। তাঁর ফ্যাশনসচেতনতা প্রথম দেখাল, ট্রাউজার্সের সঙ্গে ওই রকম পাঞ্জাবিও গায়ে দেওয়া যায়। সত্তর দশকের শেষাশেষি সামান্য ভুঁড়ি হয়েছে। বালিগঞ্জ পার্ক রোডের বাড়িতে বসে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে বললেন, 'না, এটা শিগ্গির বাতিল করতে হবে।' তেলমশলা তখনই বাদ, গ্রেট ইস্টার্ন হোটেল থেকে আসতে শুরু করল কন্টিনেন্টাল লাঞ্চ। পরের বার বিদেশ থেকে এলেন, ছিপছিপে চেহারা।
শুধু চেহারা? প্রথাগত লেখাপড়া না শিখেও হাবভাবে নিয়ে এসেছেন বৈদদ্ধ্য। নিজে মদ পছন্দ না করলেও ভাল ওয়াইন কোথায় পাওয়া যায়, ভাল ছবি কী ভাবে কিনতে হবে, লন্ডনে ভাল থিয়েটার কী চলছে সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারেন। লন্ডনের লর্ড মাউন্টব্যাটেন হলে বাজাতে নয়, ৭৫ মিনিটের বক্তৃতা দিতে এসেছেন রবিশঙ্কর। সকলে অবাক হয়ে শুনছে তাঁর কথা। মাইহারের সরু গোঁফ নিজের চেষ্টায় হয়ে উঠেছেন এক জন বিশ্বনাগরিক।
এই বিশ্বনাগরিকের মধ্যে লুকিয়ে আছে ছাত্রদরদি, প্রেমিক সত্তা। আবার, নিজের স্টারডম নিয়ে পূর্ণ সচেতন। ক্যালিফোর্নিয়ায় এক ভারতীয় রেস্তোরাঁয় উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতকাররা অনেকে খেতে যেতেন। সকলে হইহই করে দরজা পেরিয়ে যেতেন, রবিশঙ্কর গ্যাঁট হয়ে গাড়িতে বসে থাকতেন। ম্যানেজার এসে দরজা না খুলে দিলে তিনি নামবেন না।
এক দিকে বারাণসীর তরুণ, অন্য দিকে ক্যারিশমাটিক তারকা। পরস্পরবিরোধী এই দুটি সত্তাকে আজীবন বয়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। যিনি রেড মিটের সঙ্গে কোন রেড ওয়াইন ভাল যায়, তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা চালাতে পারেন, তিনিই উড়ানে উঠে বিমানসেবিকাকে সটান জিজ্ঞেস করেন, 'মাংসটা কীসের? গোরু বা শুয়োর হলে দিয়ো না।' প্রতিভাবানরা এই রকমই হন।
প্রতিভা! মাইহার ঘরানার সন্তান রবিশঙ্করের ঘরের নাম আসলে সেটাই। ভবিষ্যতে হয়তো অনেক বিখ্যাত সেতারবাদক আসবেন, কিন্তু প্রতিভা দিয়ে নতুন ব্যাকরণ তৈরি? রবিশঙ্করেই সেই ঘরানার শুরু ও শেষ!
http://www.anandabazar.com/13binodan5.html

বর্ণময় জীবনে ঝোঁকই ছিল নিত্যনতুনে
কবুল ফিদা হুসেন একদা এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, নারীর প্রতি আকর্ষণ যে দিন চলে যাবে, সে দিন থেকে তিনি আর ছবি আঁকতে পারবেন না। রবিশঙ্কর অবশ্য স্পষ্ট ভাবে বলে যাননি, বহুগামিতা তাঁর সুর মূর্ছনার প্রেরণা কি না। কিন্তু তাঁর বর্ণময় জীবনসাগরে ঢেউয়ের মতো অবিরত আসা নারীদের কথা, তাঁদের সঙ্গপ্রিয়তার কথা রবিশঙ্কর কখনও গোপন করেননি। আত্মজীবনী 'রাগমালা'-য় লিখেছেন, "নিত্যনতুনের প্রতি একটু ঝোঁক ছিল আমার।" 
কতকটা রসিকতার ঢঙেই রবিশঙ্কর আত্মজীবনীতে বলেছেন, "আমার মনে হয়, আমি এক এক জায়গায় এক এক জন নারীর প্রেমে পড়েছি। এটা অনেকটা ওই প্রতিটি বন্দরে নাবিকের এক জন করে মহিলা থাকার মতো। আবার আমার ক্ষেত্রে কখনও কখনও একটি জায়গায় একের অধিক নারী।" তাঁদের কেউ নৃত্যশিল্পী, কেউ কনসার্ট প্রোডিউসার কেউ বা অভিনেত্রী। 
এবং ওই নারীদের সঙ্গে পুরোদস্তুর সম্পর্কে বিশ্বাস করতেন রবিশঙ্কর। শিল্পীসত্তা পরের কথা, এমনিতেই সুপুরুষ রবিশঙ্করের শরীরের প্রতি নারীদের অমোঘ আকর্ষণ থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কিন্তু রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁদের সম্পর্কে শরীর অবশ্যই একটা বড় জায়গা নিয়ে ছিল, সবটা ছিল না। 
১৯৮৯-এর ২৩ জানুয়ারি জীবনে দ্বিতীয় বার বিয়ের পিঁড়িতে বসে রবিশঙ্কর যখন অনুষ্কার মা, ৩৫ বছরের সুকন্যা রাজনকে স্ত্রীর মর্যাদা দিলেন, তখন তাঁর বয়স ৬৯। তার দু'বছর আগে বাইপাস সার্জারি হয়েছে। রবিশঙ্কর ও সুকন্যার কন্যা, ১৯৮১-র ৯ জুন জন্ম নেওয়া অনুষ্কা তখন সাড়ে সাত বছরের। হায়দরাবাদের কিছুটা দূরে এক মন্দিরে সেই বিয়ের দিন ঘনিষ্ঠ মহলে রবিশঙ্কর জানান, একটানা ভবঘুরে জীবন নিয়ে হাঁফিয়ে উঠে ঘর পাতার জন্য ওই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছেন তিনি।

মুম্বই ২০০৬। স্ত্রী সুকন্যার সঙ্গে। ছবি: পি টি আই
সুকন্যার সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক ১৯৭২ থেকে। সুকন্যা তখন অষ্টাদশী। সেই সুকন্যা, যিনি মাঝেমধ্যে রবিশঙ্করের কনসার্টে তানপুরা বাজাতেন। দু'জনের সম্পর্কের ন'বছর পর এল অনুষ্কা। সুকন্যা যখন রবিশঙ্করের সন্তান স্বেচ্ছায় গর্ভে ধারণ করতে চান, রবিশঙ্কর রাজি হয়েছিলেন একটাই শর্তে সন্তানের পিতৃপরিচয় গোপন রাখতে হবে। সুকন্যা তখন অন্য এক জনের স্ত্রী। রবিশঙ্করের শর্তে রাজি হয়ে তাঁর সন্তানের মা হয়েছিলেন। 
এক জন শিল্পী, এক জন সৃষ্টিশীল মানুষের জীবনসঙ্গী হতে গেলে যতটা উদার হতে হয়, তার চেয়েও বেশি উদারতা ছিল সুকন্যার। তাঁর বক্তব্য, "রবিজি তো আর সাধারণ মানুষ নন। উনি পণ্ডিত রবিশঙ্কর। অন্যদের সঙ্গে ওঁকে ভাগ করে নিতে হলে আমার কিছু মনে করা সাজে না।" সুকন্যার কথায়, "যখন ঠিক করলাম ওঁকে বিয়ে করবই, উনি বলেছিলেন, 'আমি কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারব না। তো আমার কিছু যায়-আসেনি।" 
সুকন্যার গর্ভে যখন অনুষ্কা, সেই সময়ে এক নারীর সঙ্গে ১৪ বছরের সম্পর্ক ছিন্ন হয় রবিশঙ্করের। তিনি কমলা শাস্ত্রী। তার সঙ্গেই সম্ভবত রবিশঙ্করের জীবনের প্রথম প্রেম। রবিশঙ্করের মেজ বউদি লক্ষ্মী শাস্ত্রীর বোন ওই নৃত্যশিল্পী কমলা। মনে হয়, প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ে গিয়েছিলেন রবিশঙ্কর। কারণ, তিনি বলেছেন, "কমলাকে দেখেই ঘোর লেগে গিয়েছিল আমার।" সেটা ১৯৪৪। আর ১৯৬৭-তে কমলা ও রবিশঙ্কর লিভ-টুগেদার করতে শুরু করেন। যে-সম্পর্কের শেষ হয় ১৯৮১-র গোড়ার দিকে। কিন্তু দু'জনের সম্পর্ক গভীর হলেও বিয়ে হয়নি। সম্ভবত তার কারণ, ওই সময়কালের মধ্যে রবিশঙ্কর ও তাঁর প্রথম স্ত্রী, উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁয়ের কন্যা রোশানারা তথা অন্নপূর্ণার আইনি বিবাহবিচ্ছেদ হয়নি। অন্নপূর্ণা ডিভোর্স দিতে রাজি ছিলেন না। তার পর হঠাৎ করে ১৯৮২ সালে অন্নপূর্ণা যখন নিজেই আইনি বিচ্ছেদ চান ও পাওয়ার পর ১৯৮৩-তে তাঁরই ছাত্র, ১৪ বছরের ছোট রুশি পান্ডিয়াকে বিয়ে করেন, কমলা তত দিনে রবিশঙ্করকে ছেড়ে চলে গিয়েছেন। 
তার প্রায় দু'দশক পরেও শ্রদ্ধার সঙ্গে কমলা শাস্ত্রী সম্পর্কে বলেছেন রবিশঙ্কর, "নিত্যনতুনের প্রতি একটু ঝোঁক ছিল আমার। ওই সব কামনা চরিতার্থ করার পথে কমলা কখনওই বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি।"
রবিশঙ্করের কলকাতার এক শিষ্যের কথায়, "টানা ১৫ বছর গুরুজির সঙ্গে থাকার সুবাদে আমি তাঁর জীবনে আসা তিন নারী কমলা শাস্ত্রী, সুকন্যা রাজন ও সু জোন্সকে কাছ থেকে দেখেছি। তিন জনের সঙ্গেই সুন্দর সম্পর্ক ছিল তাঁর। কোনও সম্পর্ক কেন ভেঙে যায়, সেটা সম্পর্কে আবদ্ধ থাকা দু'জনই কেবল বলতে পারেন। কিন্তু আমি দেখেছি, সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার পরেও সেই সব নারীর প্রতি সমান শ্রদ্ধাশীল ছিলেন গুরুজি।" 
তবে সেই কমলাই যখন জানতে পারেন রবিশঙ্কর ও নিউ ইয়র্কের কনসার্ট প্রোডিউসার সু জোন্স-এর ভালবাসার ফসল নোরা জোন্স-এর অস্তিত্বের কথা, তাঁর পক্ষে রবিশঙ্করের সঙ্গে থাকা আর সম্ভব হয়নি। নোরার জন্ম ১৯৭৯-তে। নোরাই রবিশঙ্করের বড় মেয়ে আর অনুষ্কা ছোট। কমলা ছেড়ে গেলেও সু-র সঙ্গে রবিশঙ্করের সম্পর্ক ও নোরার কথা জানার পর সুকন্যা কিন্তু বিচলিত হননি। যদিও সুকন্যার সঙ্গে বিয়ের খবরে সু কয়েক বছরের জন্য রবিশঙ্করের সঙ্গে সমস্ত যোগাযোগ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, এমনকী নোরার সঙ্গেও রবিশঙ্করকে দেখা করতে দিতেন না। তবে রবিশঙ্করের মতো মানুষকে যে একটি সম্পর্কের শিকলে বেঁধে রাখা সম্ভব নয়, সেটা সুকন্যা বিলক্ষণ জানতেন। 
যেটা হয়তো জেনেও অন্য রকম ভেবেছিলেন অন্নপূর্ণা। আসলে রবিশঙ্কর নিজেই স্বীকার করেছেন, ১৯৪১-এ বিয়ে করা অন্নপূর্ণার প্রেমে সে ভাবে পড়েননি তিনি, যদিও অন্নপূর্ণা গভীর ভাবে ভালবাসতেন তাঁকে। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে রবিশঙ্করের সম্পর্ক যখন একটা আকার নিচ্ছে, সেই সময়েই রেগেমেগে প্রথম বাপের বাড়ি চলে যান অন্নপূর্ণা। ফাটলের সেই শুরু, তার পর চিরতরে ভাঙন।
তাঁর অনুজ এই বঙ্গের এক শিল্পীর বিশ্বাস, "সুরসৃষ্টির মতোই রবিশঙ্কর সিরিয়াস ছিলেন ওই সব সম্পর্কে। হতে পারে বহু সম্পর্কে জড়িয়েছেন, কিন্তু সে সব তাঁর কাছে সত্যিকার সম্পর্ক ছিল, খেলা ছিল না।"
http://www.anandabazar.com/13binodan6.html

রবি-সংক্ষেপ
ইন্দিরার আর্জিতে সুর দূরদর্শনে
ইন্দিরা গাঁধী তখন প্রধানমন্ত্রী। দূরদর্শনের জন্য 'সিগনেচার টিউন' তৈরি করতে রবিশঙ্করকে অনুরোধ করলেন। দূরদর্শনের অনুষ্ঠান শুরুর আগে শোনা যাবে যে আবহসঙ্গীত। ১৯৯৭-এর ৮ মার্চ আকাশবাণীর কলকাতা কেন্দ্রে এক সাক্ষাৎকারে পণ্ডিত রবিশঙ্কর নিজেই বলেছিলেন ইন্দিরার সেই অনুরোধের কথা। অনেক আগে তাঁরই সুরে 'সারে জাহাঁ সে আচ্ছা' খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর আর্জি, দূরদর্শনের জন্য ওই রকম একটা সুর হলে ভাল হয়! রবিশঙ্কর জানিয়েছিলেন, ইন্দিরার প্রস্তাব তাঁর খুব ভাল লেগেছিল। ১৯৪৫। আইপিটিএ-র সাংস্কৃতিক স্কোয়াডে যোগ দিয়ে রবিশঙ্কর গিয়েছেন মুম্বইয়ের আন্ধেরিতে। সেখানেই গাওয়া হয়েছিল 'সারে জাহাঁ সে আচ্ছা' গানটি। কিন্তু খুব ধীর লয়ে। শুনেই গানটিতে নতুন করে সুর দেওয়ার কথা ভাবেন। পরে নিজেই বলেছেন, "সুরটি জনপ্রিয় হয়ে গেল। স্বাধীনতার পর সেনা বাহিনীতেও তা জনপ্রিয় হল। 'জনগণমন অধিনায়ক' গানের সুরের পর সারা দেশে সব চেয়ে জনপ্রিয় সুর এটিই।" প্রধানমন্ত্রী দূরদর্শনের 'সিগনেচার টিউন'-এর জন্য ওই রকম একটা সুর চাওয়ায় তাই খুশিই হয়েছিলেন রবিশঙ্কর। ওই সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, 'সারে জাহাঁ সে আচ্ছা'-র প্রথম লাইনের সুরের আদলেই তিনি টিউনটি বানালেন। মহাত্মা গাঁধীর প্রতি শ্রদ্ধায় তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে 'মোহনকোষ' রাগ সৃষ্টি করেছিলেন রবিশঙ্কর। রাগ সৃষ্টির সময় গাঁধীর নামটি তাঁর মাথায় ছিল বলে জানিয়েছিলেন ওই সুরস্রষ্টা।

বিলম্বিত আলাপ
তাঁর বাজনায় ছিল আলাদা বৈশিষ্ট্য। সেতারের সেই ঝংকার শুনলে বলে দিতে হয় না, এ তাঁরই আঙুলের ছোঁয়া। রবিশঙ্করের বাজনা সম্পর্কে ঠিক এই কথাটাই বলছিলেন সেতারবাদক দেবু চৌধুরী। বলছিলেন, "ওঁর বিলম্বিত আলাপের ধরন ছিল অননুকরণীয়, ওঁর বাজনায় ধ্রুপদের প্রভাব ছিল।" শাহিদ পারভেজ বললেন, "প্রাচ্যের সঙ্গে পাশ্চাত্যের মেলবন্ধন ঘটিয়ে, নতুন নতুন রাগ সৃষ্টির মাধ্যমে এক নতুন দিশা দেখিয়েছিলেন তিনি।" তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার বললেন, "তিনিই প্রথম সেতারে নিচের (বেস-এর) খরজ-পঞ্চম এবং খরজের 'সা' তার ব্যবহার করেছিলেন।" এই ধারা যে তিনি পেয়েছিলেন মাইহার ঘরানা থেকে, তা উল্লেখ করে তিনি বলেন, "মাইহার ঘরানার অন্য অনেকের মতোই তাঁর বাজনার একটা নিজস্ব অননুকরণীয় 'টোন' ছিল।"

যখন শিক্ষক
কেমন ছিলেন শিক্ষক রবিশঙ্কর? তাঁর শিষ্যরা বলছেন, তাঁর শিক্ষা দেওয়ার ধরন যেমন প্রথা মেনে চলতো না সব সময়, তেমনই প্রাতিষ্ঠানিক গুরু-শিষ্য সম্পর্কে নিজেকে আবদ্ধ রাখতেন না তিনি। সরোদবাদনে রবিশঙ্করের একমাত্র শিষ্য পার্থসারথি বললেন, "পণ্ডিতজির শিক্ষাদানের পদ্ধতিটা ছিল একেবারে অন্য রকম। কখনও বাজিয়ে, কখনও গেয়ে, কখনও বেড়াতে বেড়াতে উনি এত সহজ ভাবে শেখাতেন যে, এক বারেই সব কিছু মাথায় গেঁথে যেত। কোনও দিন ওঁকে রেগে যেতে দেখিনি।" সেতারবাদ শাহিদ পারভেজ বলছেন, "প্রাতিষ্ঠানিক গুরু-শিষ্য সম্পর্কের স্তরে তালিমকে আবদ্ধ না রেখে নিজে হাতে শিষ্যদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে বাজাতেন।"

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন
ভারতের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন রবিশঙ্কর। দু'মাস আগেও। রবিশঙ্কর সম্পর্কে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে জানিয়েছেন সন্তুর বাদক সতীশ ব্যাস। তিনি বলেন, "ঠিক দু'মাস আগে আমেরিকায় আমি তাঁর সঙ্গে একটি সন্ধ্যা কাটিয়েছিলাম। তখনই আমার সঙ্গে তাঁর শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের বতর্মান অবস্থা নিয়ে আলোচনা হয়েছিল। তিনি জানতে চেয়েছিলেন দেশে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুষ্ঠান হয় কি না, বা এই ধরনের অনুষ্ঠান কর্পোরেট সহযোগিতা পায় কি না?" ওই বয়সেও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের জন্য কিছু করার জন্য রবিশঙ্কর মুখিয়ে থাকতেন বলে জানিয়েছেন সতীশ ব্যাস।

শুধু একটি প্রশ্ন
রাজ্যসভায় মনোনীত সদস্য হয়েছিলেন রবিশঙ্কর। ১৯৮৬ -'৯২ সাল পর্যন্ত মেয়াদে এক বারই সভার কাজে প্রত্যক্ষ অংশ নিয়েছিলেন তিনি। অন্তত রাজ্যসভার ওয়েবসাইট তেমনই তথ্য দিচ্ছে। তিনি স্কুল শিক্ষায় সঙ্গীতচর্চা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। উত্তরে কেন্দ্রীয় মানবসম্পদ মন্ত্রকের তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী এল পি শাহি জানান, সরকার স্কুলস্তরে সঙ্গীতচর্চার জন্য উদ্যোগী হচ্ছে। বুধবার রবিশঙ্করের স্মরণে সংসদের দুই কক্ষেই নীরবতা পালন করা হয়।
http://www.anandabazar.com/13binodan7.html

শুক্রবার বিগ বি-কে প্রথম ফোন, আশীর্বাদ রবিশঙ্করের

মুম্বইঃ কিংবদন্তী সেতার শিল্পী পণ্ডিত রবিশঙ্কর হঠাতই এই বছর ডিসেম্বরের ৭ তারিখের সকালে ফোন করেছিলেন অমিতাভ বচ্চনকে। তারপর ঠিক তার পাঁচ দিন বাদে শাস্ত্রীয় সঙ্গীত জগতে বিশাল এক শূন্যতা তৈরি করে চিরতরে চলে গেলেন তিনি ১২ তারিখের ভোরে। আমেরিকার সান দিয়াগোর এক হাসপাতালে আমেরিকার সময় মঙ্গলবার বিকেল সাড়ে চারটের সময় তাঁর মৃত্যু হয়। তবে মৃত্যুর দিন কয়েক আগে বিগ বিকে হঠাত্ করেই ফোন করেন রবিশঙ্কর। অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে রবিশঙ্করের পরিবারের দীর্ঘ দিনের বন্ধুত্ব ছিল।কিন্তু খুবই অদ্ভুত ভাবে প্রথমবারের জন্য পণ্ডিত রবিশঙ্করের বাড়ির থেকে ৭ তারিখ সকালে রবিশঙ্কের স্ত্রী সুকন্যা বিগ বিকে ফোন করেন, এবং রবিশঙ্করকে ফোনটা ধরিয়ে দেন কথা বলার জন্যে। তাঁর স্ত্রীর জানিয়ে ছিলেন, সেতার শিল্পী তাঁর সঙ্গে একবার কথা বলতে চেয়েছিলেন। সেই সময়ই অমিতাভকে সুকন্যাদেবী জানান, রবিশঙ্করের শারীরিক অবস্থা ভাল নয়। একটি অস্ত্রোপচারের জন্য তিনি হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন। 

সিনিয়র বচ্চন তাঁর ব্লগে লিখেছেন, রবিশঙ্কেরর পরিবারের সঙ্গে তাঁদের পরিবারের দীর্ঘ দিনের আত্মীয়তা থাকলেও, কিংবদন্তীর কাছ থেকে এই ফোন তাঁকে অবাক করেছে, তাঁর প্রয়াণে তাই আজ তিনি বাক্যহারা। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে প্রতিটি মানুষই চেনেন। বেশ কিছু অনুষ্ঠানে তাঁর সঙ্গে দেখাও হয়েছে। বিগ বি-র বাবার সঙ্গে পণ্ডিত রবিশঙ্করের যথেষ্ট ভাল সম্পর্ক ছিল। রবিশঙ্করের বড় ভাই, নৃত্যশিল্পী উদয়শঙ্কর, উদয়শঙ্কের ছেলে আনন্দ শঙ্কর এবং তাঁর স্ত্রী তনুশ্রী শঙ্কর এবং উদয়শঙ্করের কন্যা মমতা শঙ্করের সঙ্গে যথেষ্ট পরিচিত ছিল তাঁর। কিন্তু রবিশঙ্করের সঙ্গে ফোনে কথা, তাঁরই অনুরোধে, একেবারেই অন্য অভিজ্ঞতা, জানিয়েছেন বিগ বি।  আজকে তাঁর মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ বিগ বি জানিয়েছেন, এই ফোনে কথা বলার মুহূর্তটা তাঁর চিরস্মরনীয় হয়ে থাকবে। 

http://abpananda.newsbullet.in/entertainment/54/31295

সুরসম্রাটের নারীরা



প্রায় কিশোর বয়সে গুরু আলাউদ্দিন খানের কন্যা অন্নপূর্ণা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হয় রবি শঙ্করের। দুটি সন্তানও হয় তাঁদের। সুরের প্রতি অদম্য টান দু`জনকে কাছাকাছি আনলেও বিবাহিত জীবন দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তাঁদের। চল্লিশের দশক থেকেই তাঁদের সম্পর্কে চিড় ধরলেও ষাটের দশকের প্রথম দিকে আনুষ্ঠানিক ভাবে ছাড়াছাড়ি হয় দু`জনের। এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যেই নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হয় রবিশঙ্করের। তবে সেখানেও তিনি বাঁধা পড়েননি কোনওদিন। ১৯৮১ সাল পর্যন্ত কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে স্বামী, স্ত্রীর মতো জীবনযাপন করলেও ওই সময়েই আরও দু`জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছেন তিনি। জন্ম দিয়েছেন দুই মেয়ের। আত্মজীবনী রাগ মালায় রবিশঙ্কর লিখেছিলেন, "আমি অনুভব করতাম আমি পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন নারীর প্রেমে পড়তে পারি। প্রতিটি বন্দরে একজন নারী থাকার মতো.....সেটা অনেক সময় একের জায়গায় একাধিকও ছিল।" 

কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকাকালীন ১৯৭২ সালে তাঁর কনসার্টে তানপুরা সঙ্গত করেছিলেন সুকন্যা রাজন। সুকন্যা বিবাহিত ছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁদের মধ্যে গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৯৮১ সালে সুকন্যা তাঁদের একমাত্র মেয়ে অনুষ্কার জন্ম দেন। তার আগে ১৯৭৯ সালে নিউ ইয়র্কে তাঁর কনসার্টের আয়োজন সু জোনসের প্রেমে পড়েন রবিশঙ্কর। ওই বছরই জন্ম হয় তাঁদের সন্তান নোরা জোনসের। 

অনুষ্কার জন্মের পরও বহুদিন পর্যন্ত সুকন্যার সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্কে যাননি রবিশঙ্কর। যদিও অন্য দু`জন মহিলার সঙ্গে সম্পর্ক রবিশঙ্করের সম্পর্ক থাকা সত্ত্বেও সুকন্যা বরাবরই চেয়েছিলেন তাঁকে বিয়ে করতে। মনস্থির করতে পারেননি রবিশঙ্কর। একটি ইংরেজি দৈনিককে দেওয়া সাক্ষাত্কারে সুকন্যা জানিয়েছিলেন, "রবিশঙ্কর তখন ৫৮ বছরের পৌঢ়। আমাকে বলেছিলেন উনি নিজেকে বদলাতে পারবেন না। ওঁকে এতোটাই ভালবাসতাম যে বছরে মাত্র কয়েকটা দিন উনি আমার সঙ্গে কাটালেই আমি খুশি হতাম। সেই কয়েকটা দিনের জোয়ারে আমি সারাবছর কাটিয়ে দিতে পারতাম।" 

রবিশঙ্কর যখন সুকন্যাকে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেন সু জোনস তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক ভেঙে দিয়েছিলেন। এমনকী মেয়ে নোরার সঙ্গেও রবিশঙ্করকে কোনওদিন দেখা করতে দেননি। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর দু`দশকের সম্পর্ক ভেঙে যায় তখন। ১৯৮৯ সালে অনুষ্কার ৮ বছর বয়সে সুকন্যাকে বিয়ে করেন রবিশঙ্কর। প্রেম বহু নারীর থেকে পেলেও সুকন্যাই তাঁর জীবনে স্থায়িত্ব এনে দেয়। 

রবিজি কোনওদিনই সেভাবে পারিবারিক জীবন পাননি। খুব কম বয়সে বিয়ে হয় ওনার। যখন সমস্যা শুরু হয় উনি বিদেশে অনুষ্ঠানে নিজেকে ব্যস্ত রাখতে শুরু করেন। উনি সম্পূর্ণ বোহেমিয়ান ছিলেন। অবশ্যই ওনার জীবনে কমলা আন্টি ছিল। কিন্তু উনিও রবিজিকে স্বাধীনতা দিয়েছিলেন। আমি ওনাকে সংসার দিতে চেয়েছিলাম যা উনি সত্যিই কোনওদিন পাননি। সাক্ষাত্কারে জানিয়েছিলেন সুকন্যা। 

সুকন্যা শঙ্করের কাছ থেকেই রবিশঙ্কর ভালবাসা, খুশি, স্থিতি সবকিছুই পেয়েছিলেন। সুকন্যা শুধু তাঁর দোষত্রুটিই মেনে নেননি, তাঁর আসেপাশের মানুষগুলোকেও কাছে টেনে নিয়েছিলেন। কমলা শাস্ত্রীর সঙ্গে গভীর সখ্য ছিল রবিশঙ্করের। পণ্ডিতজিতে কমলা বলেছিলেন সুকন্যাকে বিয়ে করাই তাঁর জীবনের সেরা সিদ্ধান্ত। তাঁর জীবনের সব নারীরাই বিভিন্ন সময়ে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। তবুও আজীবন ভালবেসে গেছেন সকলেই। আসলে তিনি ছিলেনই স্বতন্ত্র। তাঁর সৃষ্টির মতোই। 

http://zeenews.india.com/bengali/entertainment/ravi-shankar-and-his-women_9928.html


আর কে বাজাবে বাংলা ধুন

হুমায়ূন রেজা | তারিখ: ১২-১২-২০১২


সেতারের ঝংকারে, বাংলাদেশের জন্য নিজের সৃষ্ট 'বাংলা ধুন'-এর সুরে সুরে প্রাচ্যের আকাশে জেগে ওঠা যে সুরনক্ষত্র বিশ্বের মানুষের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষের অসহায় আর্তি; যে মানুষটি প্রায় একক প্রচেষ্টায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট বিখ্যাত বিটলস শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে সঙ্গী করে মানবতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলা আর আর্থিক সহায়তার জন্য আয়োজন করেছিলেন এক অভূতপূর্ব সংগীতানুষ্ঠান—কনসার্ট ফর বাংলাদেশ; যিনি ডাক দিয়েছিলেন বিশ্বমানবতাকে—বাংলাদেশের অযুত স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী আর তাদের সেনাবাহিনীর নিপীড়ন-নির্যাতন-হত্যাযজ্ঞ ঠেকাতে, রুখে দাঁড়াতে; এই ২০১২ সালে বাংলাদেশের বিজয়ের মাস ডিসেম্বরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সানডিয়াগো শহরে মঙ্গলবার শেষ বিকেলের দিকে সেই নক্ষত্র নিভল। চলে গেলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। চিরপ্রস্থান হলো 'বাংলাদেশের বন্ধু' পণ্ডিত রবিশঙ্করের। 
তাঁর উদ্যোগে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'-এর গানে গানে, কথা ও কবিতায় বিশ্বের বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-বর্ণের মানুষের কাছে উঠে এসেছিল বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের অবর্ণনীয় নির্যাতনের কথা। বলা চলে, কনসার্ট ফর বাংলাদেশের চাঁদোয়ার নিচে তাঁর একক উদ্যোগে বাংলাদেশের মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, ওস্তাদ আলী আকবর, ওস্তাদ আল্লা রাখার মতো প্রখ্যাত সব কবি, গায়ক, সুরস্রষ্টা। 
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন চত্বরে আয়োজিত সেই সংগীতানুষ্ঠান ছিল অভূতপূর্ব। কারণ, অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয়েছিল নির্যাতনকারী শোষকদের বিরুদ্ধে; নিরস্ত্র একটি জাতির পক্ষে সমানুভূতি নিয়ে দাঁড়ানোর আহ্বানে, একটি দেশের অগণন নিরস্ত্র মানুষের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়নে পাশে দাঁড়ানোর আমন্ত্রণে। সেদিন কনসার্টের একেবারে শুরুতে বাংলাদেশের সহমর্মী রবিশঙ্কর মঞ্চে দাঁড়িয়ে ম্যাডিসন স্কয়ারে সমবেত লাখো মানুষের উদ্দেশে জানিয়ে দিয়েছিলেন তাঁর কথা; স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, 'আমরা শিল্পী; রাজনীতিবিদ নই।' তিনি বলেছিলেন, 'বাংলাদেশে অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা ঘটছে।' কনসার্ট শুরু করেছিলেন ওস্তাদ আলী আকবরের সঙ্গে যুগলবন্দীতে বাংলাদেশের লোকগীতি ও পল্লিগীতির সুর থেকে তাঁর সৃষ্ট নতুন সুর 'বাংলা ধুন' দিয়ে। রবিশঙ্করের সেই বাংলা ধুনে যে আবেগ আর ভালোবাসা ছিল, তাঁর সেই অকৃপণ ভালোবাসার মায়ায়, সুরের জাদুস্পর্শে সহমর্মী মানুষেরা পাশে দাঁড়িয়েছিলেন বাংলাদেশের। এ দেশের মানুষের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে যে বাংলা ধুন বাজিয়েছিলেন রবিশঙ্কর, 'বাংলাদেশ' নামের যে গান কণ্ঠে তুলে নিয়েছিলেন তাঁর বন্ধু জর্জ হ্যারিসন, একাত্তরের সেই দিনগুলোতে পৃথিবী বেষ্টন করেছিল সেই মানবতার সুর, আওয়াজ তুলেছিল বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে বিশ্বজনমত তৈরিতে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দীর্ঘ চল্লিশটি বছর পাশাপাশি থেকে অবশেষে চিরপ্রস্থানের পথে চলে গেলেন কনসার্ট ফর বাংলাদেশে 'বাংলা ধুন' বাজানো সেই অকৃত্রিম বন্ধুটি।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-12/news/312676


কনসার্ট ফর বাংলাদেশের চার দশক

০১ লা আগস্ট, ২০১১ সকাল ১১:০৮ |

শেয়ারঃ
00

একটি কপি পেস্ট পোস্ট..
পয়লা আগস্ট। ১৯৭১।
নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার। মঞ্চে তুমুল জনপ্রিয় ব্রিটিশ ব্যান্ড বিটলসের জর্জ হ্যারিসন, সঙ্গে বব ডিলান, লিওন রাসেল, বিলি প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, এরিক ক্ল্যাপটন। তাঁদের সঙ্গে ভারতীয় কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও ওস্তাদ আলী আকবর খান। আর তাঁদের মুখোমুখি শ্রোতা-দর্শক। সবাই সমবেত যোদ্ধার ভূমিকায়। যুদ্ধ মানবতার পক্ষে, অমানবিকতার বিরুদ্ধে। মুক্তিযোদ্ধারা যখন অস্ত্র হাতে প্রত্যন্ত বাংলার রণক্ষেত্রে লড়াইরত, তখন ম্যাডিসন স্কয়ারেও যেন গিটার-ড্রামে বাজছে রণদামামা। স্বাধীন বাংলার জন্য কত ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে লড়ছে মানুষ!
চল্লিশ বছর পেরিয়ে গেছে কনসার্ট ফর বাংলাদেশের সেই আয়োজনের। চার দশক আগে এই দিনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসনের যৌথ পৌরোহিত্যে আয়োজন করা হয়েছিল সেই বিখ্যাত কনসার্টের।
যুদ্ধে বিধ্বস্ত জনপদ, ঘরছাড়া-দেশছাড়া শরণার্থী আশ্রয় ও নিরাপত্তার খোঁজে বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা ভারতীয় রাজ্যগুলোর দিকে স্রোতের মতো ছুটতে থাকে মানুষ। সীমিত সম্পদের ভারতও প্রায় এক কোটি শরণার্থীর চাপ সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। সহায়-সম্বলহীন ঘরছাড়া এসব শরণার্থীর কথা বিবিসিসহ অন্যান্য গণমাধ্যম মারফত বিশ্ববাসী জানতে পারে। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী ভারতীয় বাঙালি সেতারবাদক রবিশঙ্কর হূদয় দিয়ে অনুভব করেন ছিন্নমূল সেই সব শরণার্থীর বিপন্নতা। এ রকম অমানবিক হূদয়বিদারক পরিস্থিতিতে বাঙালি হয়ে বাঙালির পাশে দাঁড়ানোর ইচ্ছা থেকেই রবিশঙ্করের মাথায় আসে কনসার্টের কথা।
গত শতকের ষাটের দশকে তুমুল জনপ্রিয় ব্যান্ড বিটলসের ভাঙন ধরে ১৯৭০ সালেই। জর্জ হ্যারিসন তখন একক ক্যারিয়ার গড়তে ব্যস্ত। অন্যরাও সেদিকে ঝুঁকছেন। হ্যারিসন তখন লস অ্যাঞ্জেলেসে তাঁর নতুন অ্যালবাম রাগার কাজ করছেন। তখনই রবিশঙ্কর প্রস্তাব দিলেন বাংলাদেশিদের সাহায্য করার জন্য বড় ধরনের কোনো কনসার্ট করা যায় কি না। প্রাথমিকভাবে রবিশঙ্কর হাজার পঁচিশেক ডলারের একটা তহবিল দাঁড় করানোর ইচ্ছা থেকেই এই কনসার্ট আয়োজনের কথা বলেন। কিন্তু কোনো কিছু করলে বড় পরিসরেই করা উচিত—মত হ্যারিসনের। হ্যারিসন যোগ দিলেন এই কর্মকাণ্ডে। নিজের ব্যক্তিগত ম্যানেজার অ্যালেন ক্লাইনকে যাবতীয় সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনের ভার দিলেন। যোগাযোগ শুরু করলেন ভেঙে যাওয়া দলের সদস্যদের সঙ্গে। অনেকেই জড়ো হলেন মহতী এই উদ্যোগে। বিল প্রেস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল রাজি হয়ে যান একবাক্যেই। রাজি করানো হয় বব ডিলান ও এরিক ক্ল্যাপটনকেও। জন লেননেরও যোগ দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু ব্যক্তিগত কারণে তাঁর আসা হয়নি। ঠিক হলো পুরো জুলাই মাস সাংগঠনিক তৎ পরতা চলবে। এরপর আগস্টে হবে 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
পয়লা আগস্ট দুপুরে শুরু হলো কনসার্ট। রাত অবধি চলে কনসার্ট।
প্রথম অংশে ছিল রবিশঙ্কর ও তাঁর দলের পরিবেশনা—সতেরো মিনিট স্থায়ী এই পরিবেশনার নামকরণ হয় 'বাংলা ধুন'। এই পরিবেশনায় তাঁকে সংগত করেন তবলায় ওস্তাদ আল্লা রাখা ও তাম্বুরায় কমল চক্রবর্তী।
কনসার্টের আকর্ষণের কেন্দ্রে ছিলেন স্বাভাবিকভাবেই বব ডিলান ও হ্যারিসন। জর্জ হ্যারিসন পরিবেশন করেন আটটি গান। একটি ছিল ডিলানের সঙ্গে দ্বৈত। বব ডিলান গাইলেন পাঁচটি। রিঙ্গো স্টার, বিলি প্রেস্টন ও লিওন রাসেল প্রত্যেকে গাইলেন একটি করে গান। গিটারে চমৎ কার ছন্দ তুললেন এরিক ক্ল্যাপটন।
শেষ পরিবেশনা ছিল কনসার্টের জন্য বিশেষভাবে লেখা বাংলাদেশ গানটি।
মাই ফ্রেন্ড কেইম টু মি, উইথ স্যাডনেস ইন হিজ আইজ
হি টোল্ড মি দ্যাট হি ওয়ান্টেড হেল্প
বিফোর হিজ কান্ট্রি ডাইজ...
...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ... বাংলাদেশ...
(...বন্ধু আমার এল একদিন
চোখভরা তার ধু-ধু হাহাকার
বলল কেবল সহায়তা চাই
বাঁচাতে হবে দেশটাকে তার...
...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ...
বাংলাদেশ)
(সাজ্জাদ শরিফ অনূদিত গানটির কয়েক পঙিক্ত)
বিশ্ববিখ্যাত এই শিল্পীদের সঙ্গে একাত্ম তখন চল্লিশ হাজারের বেশি শ্রোতা। বিপন্ন বাংলাদেশিদের জন্য তখন তাদের মনেও হাহাকার আর বেদনা। ...হাত নেড়ে, গলা মিলিয়ে তাঁরাও গাইছেন '...বাংলাদেশ...বাংলাদেশ...' শূন্যে নড়তে থাকা হাতের ওপরে, মাথার ওপরে সীমানাহীন যে আকাশ, সেই আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে সেই সুর...সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছে দূরে বাংলার আকাশেও বুঝি...
মার্কিন সরকার যেখানে স্বাধীন বাংলাদেশ ভূখণ্ডের জন্মের বিরোধী ছিল, সেখানেই এমন একটি আয়োজন আয়োজকদের বীরত্বের অসাধারণ নিদর্শন।
১৯৭১ সালেই কনসার্টের একটি সংকলন বের হয়। বাহাত্তরে মুক্তি পায় এর ওপর নির্মিত একটি চলচ্চিত্র। ১৯৭৩ সালে ওই অ্যালবামের জন্য গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পুরস্কার লাভ যোগ করে আরেক ভিন্ন মাত্রা। এই কনসার্ট এবং অন্যভাবে প্রাপ্ত দুই লাখ ৪৩ হাজার ৪১৮.৫০ মার্কিন ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে শরণার্থীদের জন্য পাঠানো হয়। এভাবেই দেশ-বিদেশে মুক্তিযুদ্ধের লাখো সৈনিকের সঙ্গে যোগ হয় রবিশঙ্কর, জর্জ হ্যারিসন এবং কনসার্ট ফর বাংলাদেশের আয়োজক মানুষদের নাম। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের সঙ্গে জড়িয়ে যান তাঁরাও।
এম এম খালেকুজ্জামান 
আজকের প্রথম আলো থেকে নেয়া।

http://www.somewhereinblog.net/blog/KhanandKhan/29423722


TeleTalk

একটি স্বপ্নের মৃত্যু

মতিউর রহমান | তারিখ: ১৩-১২-২০১২

আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট অনুষ্ঠিত হয়েছিল 'দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'। পণ্ডিত রবিশঙ্কর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি বিশ্বজনমত গড়ে তোলা এবং শরণার্থীদের আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য তাঁর শিষ্য-বন্ধু বিশ্বখ্যাত ব্যান্ড বিটলসের শিল্পী জর্জ হ্যারিসনকে নিয়ে এই অবিস্মরণীয় কনসার্টের আয়োজন করেছিলেন। 
সে সময়, ১৯৭১ সাল, মুক্তিযুদ্ধ চলছে। তখন আমরা ছিলাম আগরতলায়, জর্জ হ্যারিসনের দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কথা অল্পই জানতে পেরেছিলাম। দেশ স্বাধীন হলে যখন দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশের কথা আরও বিস্তারিত জানতে পারি, তখন গভীর আবেগে আপ্লুত হয়েছিলাম, অনুপ্রাণিত হয়েছিলাম। সেই সঙ্গে কনসার্টটির অ্যালবাম সংগ্রহ করা এবং গানগুলো শোনার গভীর ব্যাকুলতাও সৃষ্টি হয়েছিল মনের গভীরে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর সেই কনসার্টের তিনটি লংপ্লে রেকর্ডসহ অ্যালবামটি সংগ্রহ করে কতবার যে গানগুলো শুনেছি, হিসাব করে তা বলা যাবে না। ওই লংপ্লের সঙ্গে সুন্দর ছাপানো একটি পুস্তিকাও ছিল। সেখানে কনসার্টের আয়োজনের প্রেক্ষাপট, শিল্পীদের পরিচিতি—এমন অনেক তথ্য সন্নিবেশিত ছিল। গান শোনার সঙ্গে সঙ্গে পুস্তিকাটিও পড়েছি বহুবার। এভাবেই কনসার্ট ফর বাংলাদেশের ব্যাপারে আমার মনে একটি গভীর আবেগ ও আগ্রহের সৃষ্টি হয়েছিল। তারপর যেখান থেকে যা কিছু লেখালেখি, বই, রেকর্ড বা ডিভিডি পাই, তা সংগ্রহ করা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে ওঠে। এই কনসার্ট সম্পর্কে আমি বারবার লিখেছি। আলোচনাও করেছি নানা সময়।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ নিয়ে আমার একটি স্বপ্ন ছিল। বন্ধুদের সঙ্গে আলোচনা করেছি বহুবার—এসব মহৎ ও বিশ্বসেরা শিল্পীকে যদি বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো যেত, ঢাকায় যদি তাঁদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে একটি অনুষ্ঠান করা যেত! বা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো মানুষের সামনে যদি তাঁদের সংবর্ধনা দেওয়া যেত! এ রকম একটি দৃশ্যের কথা ভেবেছি বহুদিন—যে দেশটির জন্য, যেসব মানুষের জন্য একদিন তাঁরা সোচ্চার হয়েছিলেন সেই দেশে, এক বিশাল মঞ্চে তাঁরা উপস্থিত। আর লাখ লাখ বাঙালি তাঁদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে কৃতজ্ঞচিত্তে। পণ্ডিত রবিশঙ্কর, ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ, বব ডিলান, জর্জ হ্যারিসন, রিঙ্গো স্টারসহ অনেকে (তাঁদের অনেকেই চলে গেছেন চিরতরে), কথা আর সুরের ঐশ্বর্যমণ্ডিত ভুবন রচনা করে চলেছেন। স্বপ্নের মতো এই দৃশ্যের কল্পনা করে বহুদিন বন্ধুদের নিয়ে আমরা আবেগে বিহ্বল হয়ে পড়েছি।
কয়েক বছর ধরে আমরা এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে গেছি। ঢাকা থেকে লন্ডনের একটি বিশেষ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বব ডিলান ও এরিক ক্লিপটনের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁদের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। কিন্তু তেমন সাড়া পাইনি। চেষ্টা করেছি জর্জ হ্যারিসনের ছেলে ধ্যানি হ্যারিসন ও বব ডিলানের ছেলে জ্যাকব ডিলানকে আনার। সে চেষ্টাও সফল হয়নি। এমনকি জর্জ হ্যারিসনের স্ত্রী অলিভিয়া হ্যারিসন ঢাকায় এলে সরাসরি তাঁর সঙ্গে কথা বলেছি বিষয়টি নিয়ে, কোনোভাবে কিছু করা যায় কি না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা বুঝেছিলাম, এটা আয়োজন করা সম্ভব হবে না।
এসব প্রচেষ্টার পাশাপাশি আমরা একরকম নিশ্চিত ছিলাম যে পণ্ডিত রবিশঙ্করকে অন্তত আমরা পাব। ঢাকায় একটি অনুষ্ঠান করার জন্য ২০১০ সালে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি দ্রুত সম্মতি দিয়েছিলেন। জানতে চেয়েছিলেন আমাদের পরিকল্পনা। সে অনুসারে আমরা ওই বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠান করার বিস্তারিত পরিকল্পনাটি তাঁর কাছে পাঠিয়ে দিই। পরিকল্পনাটি যখন প্রায় চূড়ান্ত, তখন তাঁর মেয়ে আনুশকা শঙ্করের সন্তান প্রসবেরও সময় এসে যায়। এসব নিয়ে পণ্ডিত রবিশঙ্কর একটু ব্যস্ত হয়ে পড়ায় সেবার আর অনুষ্ঠানটি করা হয়ে ওঠেনি। 
আমরা তবু আশা ছাড়িনি। তাঁর সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছি। ঠিক হলো, ২০১১ সালে স্বাধীনতার ৪০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তাঁকে নিয়ে ঢাকায় দুই দিনের অনুষ্ঠান হবে, ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর, বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে। প্রথম দিনে তিনি বাদন পরিবেশন করবেন মেয়ে আনুশকাকে নিয়ে। দ্বিতীয় দিনে তাঁকে দেওয়া হবে সম্মাননা। এর পাশাপাশি আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম তাঁকে সম্মানসূচক ডিলিট উপাধি দেওয়ার জন্য। সরকারি সব ধরনের সম্মতি নেওয়া হয়েছিল। সোনারগাঁও হোটেলে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। যদি তাঁর জরুরি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়, সে জন্য চিকিৎসক ও চিকিৎসার সুবিধাও তৈরি রাখা হয়েছিল। ছাপানো হলো আমন্ত্রণপত্র। বিলি হবে ১১ ডিসেম্বর থেকে। পত্রিকায় প্রচার হবে। সব প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন, হঠাৎ করেই আমাদের কাছে খবর এল, তিনি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন গভীরভাবে মর্মাহত হওয়া ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। তবু আমরা আশা ছাড়িনি। সে সময় তিনি দিল্লিতে ছিলেন। রবিশঙ্করের ইচ্ছে ছিল, শেষবারের মতো ভারতে এক বা দুটি অনুষ্ঠান করবেন। আর ঢাকায় আসবেন, অনুষ্ঠান করবেন তাঁর পিতৃভূমিতে।
শেষ চেষ্টা করার জন্য আমার বন্ধু ফরহাদুল ইসলামকে নিয়ে তাঁর সঙ্গে দিল্লিতে দেখা করতে গিয়েছিলাম। সেদিন ছিল ১৯ ফেব্রুয়ারি। আমাদের পৌঁছতে নির্ধারিত সময়ের চেয়ে খানিকটা দেরি হয়েছিল। তবে তিনি ও তাঁর স্ত্রী সুকন্যা শঙ্কর আমাদের উষ্ণ অভ্যর্থনাই জানিয়েছিলেন। অনেক কথা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে সেদিন।
খুবই আবেগের সঙ্গে পিতৃভূমি বাংলাদেশের কথা বলেছিলেন। ঢাকায় অনুষ্ঠান করার আগ্রহ ছিল তখনো। বলেছিলেন, আয়োজন করে তিন দিন আগে জানাতে। সুস্থ থাকলে নিশ্চয়ই চলে আসবেন। আমরা একটি আশাবাদ নিয়ে ঢাকায় ফিরে আসি। অনুষ্ঠানটির বিষয়ে ভাবছিলাম, কীভাবে আয়োজন করা যায়। তবে বুঝতে পারছিলাম, হয়তো অনুষ্ঠানটি আর করা হয়ে উঠবে না। তিনি ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছিলেন। এত দূরের পথ পাড়ি দিয়ে এসে অনুষ্ঠান করার ঝক্কি সামলাতে পারবেন না তিনি। অবশেষে আমরা উভয়েই কথাবার্তা বলে অনুষ্ঠানটি করা সম্ভব হবে না বলেই সম্মত হই। তাঁর এই মহাপ্রয়াণে গভীর শোক ও বেদনার সঙ্গে ব্যক্তিগত একটি বড় কষ্টও থেকে গেল। বহু বছর ধরে ভেবেছিলাম, একটি আনুষ্ঠানিক সংবর্ধনা দেওয়ার মধ্য দিয়ে কিছুটা হলেও তাঁর প্রতি আমাদের ঋণ হয়তো শোধ করা যাবে। কিন্তু তা হলো না। পণ্ডিত রবিশঙ্করকে নিয়ে আমরা একটি স্বপ্ন দেখেছিলাম। সেই স্বপ্নের মৃত্যু হলো।
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-13/news/312925

বিশ্বজনীন বাঙালি সুরস্রষ্টাদের শেষ প্রতিনিধি

নিজস্ব প্রতিবেদক | তারিখ: ১৩-১২-২০১২


  • এক অনুষ্ঠানে মেয়ে আনুশকা শঙ্করের সঙ্গে সেতার বাজাচ্ছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর

    এক অনুষ্ঠানে মেয়ে আনুশকা শঙ্করের সঙ্গে সেতার বাজাচ্ছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর

    ছবি: সংগৃহীত

  • গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে একটি কনসার্টে সেতার পরিবেশনের আগে দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দ�

    গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের ব্যাঙ্গালুরুতে একটি কনসার্টে সেতার পরিবেশনের আগে দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে কথা বলছেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর

    ছবি: সংগৃহীত

1 2

চলে গেলেন বিশ শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সুরস্রষ্টা পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তিনি উদিত হয়েছিলেন ভারতবর্ষে। তিনি বাংলাদেশেরও। অর্ধশতকেরও বেশি সময় ধরে আলোকিত করে রেখেছিলেন সারা বিশ্বের সংগীতভুবনকে। শাস্ত্রীয় সংগীতে রবিশঙ্কর বিশ্বজনীন বাঙালি সুরস্রষ্টাদের শেষ প্রতিনিধি। এর আগেই চলে গেছেন তাঁর গুরুভাই ওস্তাদ আলী আকবর খাঁ।
রবিশঙ্করের পৈতৃক ভিটা বাংলাদেশের নড়াইলের কালিয়ায়। পেশাগত কারণে তাঁর বাবা শ্যামশঙ্কর থাকতেন উত্তর ভারতের বারানসিতে। ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল সেখানেই রবিশঙ্করের জন্ম। তাঁর আদি নাম ছিল রবীন্দ্র শঙ্কর চৌধুরী। ছিলেন সাত ভাইয়ের মধ্যে কনিষ্ঠতম। ১১ বছর বয়সে ১৯৩০ সালে ভাই উদয় শঙ্করের নাচের দলের সঙ্গে যান প্যারিসে। তাঁর শিল্পীজীবনের সূচনা নৃত্যশিল্পী হিসেবে।
রবিশঙ্কর তাঁর গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁকে প্রথম শোনেন ১৯৩৪ সালের ডিসেম্বরে, কলকাতায়। ১৯৩৫ সালে উদয় শঙ্করের ইউরোপ সফরের সময় সঙ্গে নিয়ে যান আলাউদ্দিন খাঁকে। ইউরোপ সফরেই ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ রবিশঙ্করকে সেতার শেখানোর জন্য মধ্য প্রদেশের মাইহারে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দেন। সেই শুরু।
রবিশঙ্কর ১৯৩৮ সালে মাইহারে গিয়ে আলাউদ্দিন খাঁর কাছে সেতার ও সুরবাহারের তালিম নিতে শুরু করেন। ১৯৩৯ সালের ডিসেম্বর থেকে রবিশঙ্কর বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বাজাতে শুরু করেন। বলা বাহুল্য, তাঁর বাজনার শুরু হয়েছিল আলী আকবর খাঁর সরোদের সঙ্গে যুগলবন্দী বাদনের মাধ্যমে।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ তাঁর ছেলে আলী আকবর খাঁ, মেয়ে অন্নপূর্ণা ও রবিশঙ্করকে একসঙ্গে শেখাতেন। ভারতীয় রাগসংগীতে সেতার ও সরোদের যুগলবন্দীর সেটিই সূচনা। মাইহারে পণ্ডিত রবিশঙ্করের সংগীতশিক্ষার সমাপ্তি হয় ১৯৪৪ সালে। তিনি চলে যান মুম্বাইয়ে, যোগ দেন ভারতের পিপলস থিয়েটারে। এরপর ১৯৪৯ থেকে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া রেডিওর সংগীত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময়েই তিনি সত্যজিৎ রায়ের পথের পাঁচালী চলচ্চিত্রে প্রথম সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করেন। এরপর একই দায়িত্ব পালন করেন অপরাজিত ও অপুর সংসার চলচ্চিত্রে। পরে দেশ-বিদেশের আরও বহু খ্যাতিমান চলচ্চিত্রকারের ছবিতে তিনি সংগীত পরিচালক হিসেবে যুক্ত হয়েছেন।
১৯৫২ সালে পশ্চিমের খ্যাতিমান বেহালা-শিল্পী ইয়াহুদি মেনুহিন দিল্লি এলে রবিশঙ্করের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। জাতিসংঘের ১০ বছর পূর্তি উপলক্ষে প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইউনেসকো সংগীত উৎসবে মেনুহিনের সঙ্গে তাঁর যুগলবন্দী কিংবদন্তি হয়ে আছে। আরও পরে, ১৯৬৭ সালে, রবিশঙ্কর মেনুহিনের সঙ্গে মন্টেরি পপ ফেস্টিভ্যালে যোগ দেন। এই দুই খ্যাতিমান শিল্পীর যুগলবন্দী 'ওয়েস্ট মিটস ইস্ট' (পরে অ্যালবাম আকারে প্রকাশিত) বাজিয়ে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড পান।
সংসার ও সন্তান: পণ্ডিত রবিশঙ্করের প্রথম স্ত্রী গুরু ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর কন্যা অন্নপূর্ণা। তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৪১ সালে। রবিশঙ্করের বয়স তখন ২১ বছর, অন্নপূর্ণার ১৪। তাঁদের একমাত্র সন্তান শুভেন্দ্র শঙ্করের জন্ম হয় ১৯৪২ সালে। তিনি মারা যান ১৯৯২ সালে। ১৯৬১ সালে অন্নপূর্ণার সম্পর্ক ছিন্ন হওয়ার পর তাঁর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে নৃত্যশিল্পী কমলা শাস্ত্রীর। ১৯৭০-এর দশকের শুরুতে রবিশঙ্করের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক গড়ে ওঠে সু জোনসের। ১৯৭৯ সালে জন্ম নেন তাঁদের ভালোবাসার সন্তান বর্তমানে পশ্চিমের নামী শিল্পী নোরাহ জোনস। রবিশঙ্করের সর্বশেষ স্ত্রী সুকন্যা রাজন। এই সংসারে ১৯৮১ সালে জন্ম নেন এ সময়ের নামী সেতারিয়া আনুশকা শঙ্কর। তবে সুকন্যার সঙ্গে রবিশঙ্করের বিয়ে হয় ১৯৮৯ সালে।
কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: বিটলস তারকা জর্জ হ্যারিসনের সঙ্গে রবিশঙ্করের পরিচয় ১৯৬৬ সালে, লন্ডনে। রবিশঙ্করের বাদনে মুগ্ধ হয়ে হ্যারিসন তাঁর কাছে সেতারে তালিম নেন। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মানুষ যখন স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে, পাকিস্তানি বাহিনীর নির্যাতনে এ দেশে মানবতা যখন ভূলুণ্ঠিত, তখন বন্ধুর হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। তাঁর অনুরোধে পাশে এসে দাঁড়ান বন্ধু জর্জ হ্যারিসন। লাখ লাখ নিপীড়িত মানুষকে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার জন্য দুজনের উদ্যোগে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে আয়োজিত হয় 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।
১৯৭১ সালের ১ আগস্ট, রোববার। বেলা আড়াইটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত চলে জগদ্বিখ্যাত এই কনসার্ট। রবিশঙ্কর ও জর্জ হ্যারিসন ছাড়াও তাতে অংশ নেন বব ডিলান, এরিক ক্লিপটন, রিংগো স্টার, বিলি প্রেস্টন, লেওন রাসেল প্রমুখ খ্যাতিমান পশ্চিমা শিল্পী। কনসার্টে বিশেষ আকর্ষণ ছিল রবিশঙ্কর ও ওস্তাদ আলী আকবর খাঁর যুগলবন্দী। তবলায় ছিলেন ওস্তাদ আল্লারাখা। এ কনসার্ট দেখতে জড়ো হয়েছিল ৪০ হাজার মানুষ। এই কনসার্ট মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্বজনমত গঠনে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিল। এই অনুষ্ঠানের জন্যও পণ্ডিত রবিশঙ্করকে গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড দেওয়া হয়েছিল।
সম্মান ও পুরস্কার: পণ্ডিত রবিশঙ্কর ১৯৫৭ সালে তপন সিংহ পরিচালিত কাবুলিওয়ালা ছবির সংগীত পরিচালক হিসেবে বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে বিশেষ পুরস্কার, ১৯৬২ সালে সংগীত নাটক একাডেমি পুরস্কার, ১৯৬৭ সালে পদ্মভূষণ, ১৯৮১ সালে পদ্মবিভূষণ, ১৯৯২ সালে র‌্যামন ম্যাগসাইসাই পুরস্কার, ১৯৯৯ সালে ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক খেতাব ভারতরত্নসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য এ বছর তাঁকে বাংলাদেশ সরকারের সম্মাননা ২০১২ দেওয়া হয়।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-12-13/news/312933


গেলেন বিশ্বজনীন সুরস্রষ্টা পণ্ডিত রবিশঙ্কর!

                     

 

সালাহ উদ্দিন শুভ্রঃ তার সেতার আর সুর ছড়াবে না বিশ্বমানবের তরে। তারের সুরে আঙুল নাচিয়ে যে মন্ত্রমুগ্ধ আবেশ সৃষ্টি করতেন তিনি, তাও আর বাজবে না। শত ভক্তের মন খারাপ করে চলে গেলেন পণ্ডিত রবিশঙ্কর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অকৃত্রিম বন্ধু, ভারতীয় সঙ্গীতের বিশ্বদূত এ মহানায়ক গত মঙ্গলবার রাতে জীবনের সব আলো থেকে দূরে চলে গেছেন। অনেক দিন ধরেই তিনি ভুগছিলেন শ্বাসযন্ত্র আর হূদরোগের পীড়ায়। হার্টে একটি ভাল্ভ সংযোজনের জন্য গত বৃহস্পতিবার শেষবারের মতো শুয়েছিলেন অস্ত্রোপচারের টেবিলে যুক্তরাষ্ট্রের সান ডিয়েগোর এক হাসপাতালে। কিন্তু সব প্রত্যাশাকে হার মানিয়ে ৯২ বছর বয়সে চলে গেলেন বিশ্বজনীন সুরস্রষ্টা রবিশঙ্কর।

 

মৃদু আর আন্তরিক স্বরে তার কথা বলা, সেতারের সুরে তোলা ঝঙ্কার, পশ্চিমা সঙ্গীতের প্রতি আগ্রহ— সব মিলিয়ে নিউইয়র্কের বিখ্যাত সব গায়ক ও শিল্পীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ঘটতে থাকে পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি। সে সময়কার বিখ্যাত মার্কিন ব্যান্ড বিটলস তারকা জর্জ হ্যারিসন সেতার শিখতে আসেন রবিশঙ্করের কাছে। এ দুই বন্ধু মিলেই ইতিহাসের আলোকিত তারকা হয়ে বিরাজিত আছেন বাংলাদেশে। সে সময়কার পাকিস্তানি শাসনের মরণাঘাতে জর্জরিত বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়ান তারা। আয়োজন করেন 'কনসার্ট ফর বাংলাদেশ'।

 

১৯৭১ সালের ১ অগাস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ারের সেই অনুষ্ঠানে প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের সুরের মেলবন্ধনে বেজে ওঠে মানবতার সুর। এ স্মৃতি চিরজাগরূক থাকবে বাঙালির মনে। মার্কিন সঙ্গীত তারকা জর্জ হ্যারিসন তাকে বলতেন 'দ্য গডফাদার অব ওয়ার্ল্ড মিউজিক'। প্রাচ্য আর পাশ্চাত্যের মিশেলে এক বিশ্বজনীন সুর সৃষ্টির প্রয়াসেই কেটেছে তার বেশির ভাগ জীবন। পুরো নাম রবীন্দ্র শংকর চৌধুরী। জন্মেছিলেন ভারতের বারানসির এক বাঙালি পরিবারে, ১৯২০ সালের ৭ এপ্রিল।

 

পরিবার থেকেই সঙ্গীত ও সৃষ্টিশীল কাজের সঙ্গে তার যোগাযোগ। ১০ বছর বয়সেই নৃত্যকলা রপ্ত করেন বয়স্কদের মতোই। তার ভাই উদয় শংকর ভারতীয় একটি নাচের দল পরিচালনা করছিলেন। সেখানেই নিজেকে নিয়োজিত রাখেন রবিশঙ্কর। একই সঙ্গে দলের বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রে হাত মকশো করতে থাকেন। ভাইয়ের সূত্রে ফ্রান্স ঘুরে দেখে এসেছেন পাশ্চাত্য সঙ্গীতের গভীরতা। এক সাক্ষাত্কারে তিনি বলেছিলেন, সে সঙ্গীত তার চামড়ায়ও কোনো অনুভূতি সৃষ্টি করতে পারেনি, তুলনায় ভারতীয় সঙ্গীত অনেক গভীর, হূদয়ের তন্ত্রিকে অনুরণিত করে। এ ভাবনার অবকাশেই তিনি দেখা পেলেন আকবর আলী খানের। এ সুরসম্রাট রবিশঙ্করকে নিজের শিষ্য হিসেবে গ্রহণ করেন এক শর্তে— জাগতিক অন্য সব ব্যস্ততাকে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। রবিশঙ্কর তা-ই করলেন, নাচ ছেড়ে দিলেন। তুলে নিলেন সেতার।

 

১৯৩৭ সাল থেকে পরবর্তী সাত বছর তিনি সেতার বাদন শেখেন আকবর আলী খানের কাছে। পরে গুরুকন্যা অন্নপূর্ণাকেই বিয়ে করেন রবিশঙ্কর। ১৯৪০ সাল থেকেই তিনি বিভিন্ন পাশ্চাত্য বাজনার সঙ্গে যৌথভাবে সেতারের সুর মেলাতে শুরু করেন। ১৯৪৯ সালে অল ইন্ডিয়া রেডিওয় সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে নিয়োগ পান। ১৯৫০ সালে সত্যজিত রায়ের পথের পাঁচালি, অপরাজিতা, অপুর সংসার— এ তিন চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করেন। ওই বছরই রবিশঙ্কর ভারতের বাইরের দুনিয়াকে নিজের সুরে বাঁধার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েন। ১৯৫৪ সালে তার সামনে সে সুযোগ চলেও আসে। পরপর লন্ডন ও নিউইয়র্কে আমন্ত্রিত হন। ১৯৫৬ সাল থেকেই পশ্চিমে নিজের শেকড় ছড়াতে থাকেন।

 

যুক্তরাষ্ট্রের নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলা করতে হয়েছে; আশির দশকে হিপ্পি আন্দোলনের মুখে লাঞ্ছিতও হতে হয়েছে তাকে। কিন্তু ভারতীয় সঙ্গীতের আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী রবিশঙ্কর বিচলিত হননি কখনই। বলেছেন, 'আমি সবসময়ই চেয়েছি ভারতীয় ঐতিহ্যকে রক্ষা করতে, কারণ এতে আমার বিশ্বাস ছিল।' ইলেকট্রনিক যন্ত্রও তিনি বাজিয়েছেন। বলতেন, 'আমি সবসময় পরীক্ষার মধ্যে থাকি, হোক তা ভালো কি মন্দ।' বিশ্বসঙ্গীত সমুদ্রে এ নির্ভীক নাবিকের থেমে যাওয়া কাঁদিয়েছে বিশ্বের নানা প্রান্তের মানুষকে।

http://www.banglabarta.dk/details.php?cid=9&id=4091

শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চেহারাটাই বদলে দেন 'মিরাকল ম্যান'
আমজাদ আলি খান 

বিশ্বাসই করতে পারছি না, পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর নেই৷ দাদা বলে ডাকতাম যে ওঁকে৷ সঙ্গীতের এমন একটা অধ্যায় ওঁর সঙ্গে শেষ হয়ে গেল যাকে জাদুকরী ছাড়া অন্য কিছু বলা যায় না৷ দাদার অবদানের মৌলিকত্ব এবং অনন্যতা এতটাই যে, কোনও কিছুর সঙ্গে তার তুলনা চলে না৷ 

আমার শ্রদ্ধেয় পিতা উস্তাদ হাফিজ আলি খান এবং রবিজির গুরু উস্তাদ আলাউদ্দিন খানের সঙ্গীতশিক্ষা একই গুরুর কাছে৷ উস্তাদ ওয়াজির খানের কাছেই সেনিয়া বিকানির ঘরানায় হাতেখড়ি দু'জনের৷ এক সময় রবিজি আমাকে একটা চিঠিতে বলেওছিলেন, চলো আমরা দু'জনে সেনিয়া বিকানির ঘরানার সঙ্গীতকে প্রচারের আলোয় এনে সুরের জগতে তাকে একটা উঁচু জায়গা দেওয়ার চেষ্টা করি৷ আসলে রবিজির সুরসৃষ্টি এবং সেতারবাদনে একটা আলাদা আমেজ ছিল, নতুন একটা অনুভূতি ছিল৷ সেই কারণেই ওঁকে 'মিরাকল ম্যান' বলেও উল্লেখ করেছি আমি৷ বিশ্বজুড়ে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের চেহারাটাই তো বদলে দিয়েছিলেন দাদা৷ আমার সৌভাগ্য যে, কিষেণ মহারাজ, উস্তাদ আল্লারাখা, চতুর লাল এবং কানাই দত্তর মতো প্রথিতযশা তবলাবাদকদের সঙ্গে রবিশঙ্করের বাজনা শুনেছি৷ শুধু তো বাজানো নয়, দাদার উপস্থাপনাতেও যে একটা অভিনবত্ব ছিল, সেটা সব সময় আমায় আকর্ষণ করত৷ কলকাতা, বার্মিংহাম, দিল্লি, নিউ ইয়র্কে আমার অনুষ্ঠান দেখতে এসেছেন দাদা৷ আমার কাছে সে এক অনন্য সম্মান৷ যতদিন বাঁচব, তোমায় মিস করব দাদা৷

পন্ডিতজির সঙ্গে লন্ডনে এক বেলা



পন্ডিতজির সঙ্গে লন্ডনে এক বেলা
চার ভাই-দেবেন্দ্র, রবিশঙ্কর, উদয়শঙ্কর এবং রাজেন্দ্র।
অনির্বাণ ভট্টাচার্য 

দিনটা সম্ভবত ৯ সেপ্টেম্বর, ২০১১৷ লন্ডনে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে আর ক'দিন পরেই কলকাতায় ফিরব৷ কত্থক-গুরু সুজাতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছাত্রী জৈনা মোদাসিয়ার মঞ্চ-প্রবেশ অনুষ্ঠানে গাইবার কথা ছিল আমার৷ দিদির অনুরোধে সেই অনুষ্ঠানে আসবেন বলে কথা দিয়েছিলেন পণ্ডিতজি৷ ওঁর শরীর ভাল যাচ্ছিল না, তাই আসবেন কি না সেই নিয়ে নিশ্চিত ছিলেন না কেউ৷ 

গান-বাজনার ফাঁকে, সুজাতাদির কাছ থেকে এর আগেও শুনেছি পণ্ডিতজি সম্পর্কে ঘরোয়া নানা কথা... তাই ওঁকে দেখার আগ্রহটা আরও বেড়ে গিয়েছিল৷ 'এত কাছে থেকেও এক বার দেখা হবে না?' শুধউ এই কথাই ঘুরপাক খাচ্ছিল মাথায়৷ 

৯ তারিখ ছিল শেষ রিহার্সাল৷ সুজাতাদির বাড়িতে গিয়ে শুনলাম, রিহার্সাল দেখবেন বলে নিজেই বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন পণ্ডিতজি৷ শুনে প্রথমে বিশ্বাসই হয়নি... তার পর কোথাও যেন একটা হারিয়ে গিয়েছিলাম কয়েকটা ঘণ্টার জন্য৷ যতটুকু সময় ওঁকে সামনে থেকে দেখেছিলাম, সেটুকুই বাকি জীবনের সঞ্চয় হয়ে রইল৷ 

টেমস-এর তীরে একটা বাড়িতে সেই সময় থাকছিলেন পণ্ডিতজি৷ সুজাতাদি, তবলা অনিরুদধে মুখোপাধ্যায়, সেতারে চন্দ্রচূড় ভট্টাচার্য এবং জৈনা মোদাসিয়া-সহ আমরা সবাই পৌঁছে গিয়েছিলাম ওঁর বাড়িতে৷ মিনিট কতক পরেই নিজের ঘর থেকে বেরিয়ে এসে পণ্ডিতজি বললেন, 'তোমাদের অনেক ক্ষণ বসিয়ে রেখেছি, চলো এ বার গান-বাজনা শুরু করা যাক৷' শিখলাম, এই বয়সেও মানুষটি কতটা ঘড়ি-ধরে চলেন৷ 

পণ্ডিতজি সবাইকে যাতে শুনতে পান, তাই আমরা ওঁর কাছ ঘেঁষে বসলাম৷ শুরু হল, গান আর তার সঙ্গে জৈনার দুরন্ত নাচ৷ জৈনা বয়সে ছোট, তাই নিজের সবটুকু উজাড় করে দিল৷ কেমন যেন একটা ঘোরের মধ্যে চলল আমাদের গান-বাজনা৷ পণ্ডিতজি প্রচণ্ড উল্লসিত হয়ে হাতে তাল রেখে গেলেন বরাবর- প্রায় মিনিট ৫০ ধরে৷ পণ্ডিতজি এতটা খুশি হতে দেখে, যারপর নাই খুশি আমরাও৷ বুঝলাম, যাকে একটি বার দেখার জন্য সারা জীবন অপেক্ষা করা যায়, যাঁর পা এক বার ছুঁলে জীবন সার্থক মনে করেন শিল্পীকুল... সেই মানুষটা মনেপ্রাণে আসলে কতটা সাধারণ, কতটা অমায়িক! 

অনুষ্ঠান শেষে ওঁর পাশে বসে যখন একটু আশীর্বাদের জন্য ঘুরঘুর করছি আমরা, তখন প্রত্যেককে আলাদা করে ডেকে কথা বলায় ব্যস্ত উনি৷ জিজ্ঞেস করলেন, লন্ডনে আমার পড়াশুনা আর অভিজ্ঞতার কথা৷ এ ছাড়াকার কাছে তালিম, কত দিন শিখেছ, দেশের রাজনীতির হাল-হকিকত বা শেষ ম্যাচে ভারতের ফলাফল- সব কিছু বিষয়ে ওঁর আগ্রহ দেখে অবাক হলাম৷ বুঝলাম তবেই না তিনি রবিশঙ্করজি, তবেই না তিনি সম্পূর্ণ৷ 

হাতের কাছে ক্যামেরা তৈরি-ই ছিল৷ খালি মনে হচ্ছিল যদি এই মুহূর্তটা আর ফিরে না আসে, যদি ক্যামেরা-বন্দি করে রাখতে পারি! অনেক ভয়ে ভয়ে বললাম, 'আপনার সঙ্গে একটা ছবি তুলতে পারি?' উনি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে বললেন, 'ইয়েস, অফ কোর্স!' বললেন, 'ছবি যদি তুলতেই হয়, ভালো করে তোল... কাছে এসো' বলে নিজেই এগিয়ে এলেন৷ এই সারল্য সত্যি অপ্রত্যাশিত, আর তাই বোধ হয় তিনি সকলের পণ্ডিতজি! 

বেরনোর আগে ওঁর শেষ কতগুলো কথা আজও কানে বাজে৷ বললেন, 'তোমাদের আরও ভালো করে শুনতে চাই, আজ পুরোটা হল না৷ তবে কী জান, গান-বাজনা ভেতরের জিনিস৷ ওটা তোমাদের আছে৷ এ বার শুধু করে যাও, সঙ্গে একটা সুন্দর জীবনযাত্রা৷ ব্যস, তাহলেই হবে! পরের বার নিশ্চয়ই আমেরিকায় দেখা হবে৷' 

তার পর দেখা হয়েছিল৷ আমেরিকায় নয়, দিল্লিতেই৷ রিম্পার বার্ষিক অনুষ্ঠানে, এ বছর ফেব্রুয়ারিতে... সেটাই শেষ দেখা৷ 

রবি আঙ্কলের মতো করেই গড়ে তুলেছিলাম নিজেকে



জাকির হুসেন 

রবি আঙ্কল৷ এই নামেই ডাকতাম পণ্ডিতজিকে৷ আমাদের আলাপ কবে থেকে বলুন তো? আমার যখন চার বছর বয়স৷ আমার জন্মদিনে মাহিমে আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন আঙ্কল৷ ওখানেই সেতার সম্রাটের প্রথম অনুষ্ঠান শুনি আমি৷ 

অবাক লাগে, অত ছোট বয়েসেও রবি আঙ্কলের সুর আমার মনে গভীর ভাবে ছেয়ে গিয়েছিল৷ তখন থেকেই উনি আমার আইডল৷ সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে নিজেকে সব সময়ই গড়ে তুলতে চেয়েছি ওঁর মতো করে৷ সেটা ভাবনা হোক বা উপস্থাপনা৷ আমার যখন চোদ্দো বছর বয়স, সেই সময় প্রথম রবিশঙ্করের সঙ্গে তবলা বাজানোর সুযোগ আসে৷ মুম্বইয়ের সম্মুখানন্দে ওই দিনটার কথা কখনও ভুলতে পারব না৷ তার পর অন্তত কয়েকশো অনুষ্ঠান করেছি আঙ্কলের সঙ্গে৷ এবং অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি, ওই প্রতিটা অনুষ্ঠান থেকে নিজের সঙ্গীতজীবনে যে শিক্ষা পেয়েছি তার কোনও তুলনা হয় না৷ 

বিশ্বসঙ্গীতের শ্রেষ্ঠতম আইকন ছিলেন তিনি৷ আজ তাঁর প্রয়াণে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হল ঠিকই, কিন্ত্ত আনন্দলোক সমৃদ্ধ হল তাঁকে পেয়ে৷ তাঁর মতো শিল্পীর তো মৃত্যু হতে পারে না৷ 

ভাল থাকবেন রবি আঙ্কল৷ 

No comments:

मैं नास्तिक क्यों हूं# Necessity of Atheism#!Genetics Bharat Teertha

হে মোর চিত্ত, Prey for Humanity!

मनुस्मृति नस्ली राजकाज राजनीति में OBC Trump Card और जयभीम कामरेड

Gorkhaland again?আত্মঘাতী বাঙালি আবার বিভাজন বিপর্যয়ের মুখোমুখি!

हिंदुत्व की राजनीति का मुकाबला हिंदुत्व की राजनीति से नहीं किया जा सकता।

In conversation with Palash Biswas

Palash Biswas On Unique Identity No1.mpg

Save the Universities!

RSS might replace Gandhi with Ambedkar on currency notes!

जैसे जर्मनी में सिर्फ हिटलर को बोलने की आजादी थी,आज सिर्फ मंकी बातों की आजादी है।

#BEEFGATEঅন্ধকার বৃত্তান্তঃ হত্যার রাজনীতি

अलविदा पत्रकारिता,अब कोई प्रतिक्रिया नहीं! पलाश विश्वास

ভালোবাসার মুখ,প্রতিবাদের মুখ মন্দাক্রান্তার পাশে আছি,যে মেয়েটি আজও লিখতে পারছেঃ আমাক ধর্ষণ করবে?

Palash Biswas on BAMCEF UNIFICATION!

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS ON NEPALI SENTIMENT, GORKHALAND, KUMAON AND GARHWAL ETC.and BAMCEF UNIFICATION! Published on Mar 19, 2013 The Himalayan Voice Cambridge, Massachusetts United States of America

BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE 7

Published on 10 Mar 2013 ALL INDIA BAMCEF UNIFICATION CONFERENCE HELD AT Dr.B. R. AMBEDKAR BHAVAN,DADAR,MUMBAI ON 2ND AND 3RD MARCH 2013. Mr.PALASH BISWAS (JOURNALIST -KOLKATA) DELIVERING HER SPEECH. http://www.youtube.com/watch?v=oLL-n6MrcoM http://youtu.be/oLL-n6MrcoM

Imminent Massive earthquake in the Himalayas

Palash Biswas on Citizenship Amendment Act

Mr. PALASH BISWAS DELIVERING SPEECH AT BAMCEF PROGRAM AT NAGPUR ON 17 & 18 SEPTEMBER 2003 Sub:- CITIZENSHIP AMENDMENT ACT 2003 http://youtu.be/zGDfsLzxTXo

Tweet Please

Related Posts Plugin for WordPress, Blogger...

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS BLASTS INDIANS THAT CLAIM BUDDHA WAS BORN IN INDIA

THE HIMALAYAN TALK: INDIAN GOVERNMENT FOOD SECURITY PROGRAM RISKIER

http://youtu.be/NrcmNEjaN8c The government of India has announced food security program ahead of elections in 2014. We discussed the issue with Palash Biswas in Kolkata today. http://youtu.be/NrcmNEjaN8c Ahead of Elections, India's Cabinet Approves Food Security Program ______________________________________________________ By JIM YARDLEY http://india.blogs.nytimes.com/2013/07/04/indias-cabinet-passes-food-security-law/

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS TALKS AGAINST CASTEIST HEGEMONY IN SOUTH ASIA

THE HIMALAYAN VOICE: PALASH BISWAS DISCUSSES RAM MANDIR

Published on 10 Apr 2013 Palash Biswas spoke to us from Kolkota and shared his views on Visho Hindu Parashid's programme from tomorrow ( April 11, 2013) to build Ram Mandir in disputed Ayodhya. http://www.youtube.com/watch?v=77cZuBunAGk

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS LASHES OUT KATHMANDU INT'L 'MULVASI' CONFERENCE

अहिले भर्खर कोलकता भारतमा हामीले पलाश विश्वाससंग काठमाडौँमा आज भै रहेको अन्तर्राष्ट्रिय मूलवासी सम्मेलनको बारेमा कुराकानी गर्यौ । उहाले भन्नु भयो सो सम्मेलन 'नेपालको आदिवासी जनजातिहरुको आन्दोलनलाई कम्जोर बनाउने षडयन्त्र हो।' http://youtu.be/j8GXlmSBbbk

THE HIMALAYAN DISASTER: TRANSNATIONAL DISASTER MANAGEMENT MECHANISM A MUST

We talked with Palash Biswas, an editor for Indian Express in Kolkata today also. He urged that there must a transnational disaster management mechanism to avert such scale disaster in the Himalayas. http://youtu.be/7IzWUpRECJM

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICAL OF BAMCEF LEADERSHIP

[Palash Biswas, one of the BAMCEF leaders and editors for Indian Express spoke to us from Kolkata today and criticized BAMCEF leadership in New Delhi, which according to him, is messing up with Nepalese indigenous peoples also. He also flayed MP Jay Narayan Prasad Nishad, who recently offered a Puja in his New Delhi home for Narendra Modi's victory in 2014.]

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICIZES GOVT FOR WORLD`S BIGGEST BLACK OUT

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS CRITICIZES GOVT FOR WORLD`S BIGGEST BLACK OUT

THE HIMALAYAN TALK: PALSH BISWAS FLAYS SOUTH ASIAN GOVERNM

Palash Biswas, lashed out those 1% people in the government in New Delhi for failure of delivery and creating hosts of problems everywhere in South Asia. http://youtu.be/lD2_V7CB2Is

THE HIMALAYAN TALK: PALASH BISWAS LASHES OUT KATHMANDU INT'L 'MULVASI' CONFERENCE

अहिले भर्खर कोलकता भारतमा हामीले पलाश विश्वाससंग काठमाडौँमा आज भै रहेको अन्तर्राष्ट्रिय मूलवासी सम्मेलनको बारेमा कुराकानी गर्यौ । उहाले भन्नु भयो सो सम्मेलन 'नेपालको आदिवासी जनजातिहरुको आन्दोलनलाई कम्जोर बनाउने षडयन्त्र हो।' http://youtu.be/j8GXlmSBbbk