দলতন্ত্র থেকে আর এক দলতন্ত্রের পথে? |
পশ্চিমবঙ্গ এক গভীর অনিশ্চিতির কবলে। গণতন্ত্রের শক্তি জোটবদ্ধ হয়ে রাজ্যকে দলতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রে নিয়ে যেতে পারবে কি না, সেটাই প্রশ্ন। |
বিপুল জনাদেশ নিয়ে নির্বাচিত সরকার রাজ্যে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর মাসাধিককাল অতিবাহিত। কোনও সরকারের মূল্যায়নের জন্য এই সময়কাল নিশ্চয়ই যথেষ্ট নয়, কিন্তু এর মধ্যেই নতুন সরকারের কর্মসূচি, অগ্রাধিকার, কর্মপদ্ধতি ও কর্মশৈলীর বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে উঠেছে। তাতে এ কথা বলা যায় যে, এখনও পর্যন্ত মুখ্যমন্ত্রী ছাড়া অন্য মন্ত্রীদের ভূমিকা প্রান্তিক 'টিম গেম' অদৃশ্যপ্রায়, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী অতিসক্রিয়। এই কর্মশৈলীর কার্যকারিতা নিয়ে যত বিতর্কই থাক, এ কথা স্পষ্ট যে, এই সরকার নিঃসন্দেহে রাজ্য পরিচালনার এক নতুন ঘরানা চালু করেছে। এই ঘরানার যে অভিনব বৈশিষ্ট্য নজর কেড়েছে তা হল, বিভিন্ন সরকারি দফতরে মুখ্যমন্ত্রীর হঠাৎ পরিদর্শন। এই ভাবেই তিনি 'বামফ্রন্ট আমলের ঘুঘুর বাসা' চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। এতে যে সরকারি দফতরের আধিকারিক ও কর্মীরা সচকিত হয়ে উঠেছেন, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু প্রশাসনিক শৈথিল্য ও দুর্নীতি চিহ্নিতকরণে এর কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায়। উদাহরণস্বরূপ, আমি বিধানগরবাসী হিসাবে বিধাননগরের কথাই বলতে পারি। এখানে মহকুমা শাসক মাত্র তিন ঘণ্টা অফিসে থাকেন। বাকি সময় তাঁর বিধাননগর পুরসভায় কাটে। প্রসঙ্গত, রাজ্যে ৬০টি পুরসভার মধ্যে একমাত্র এই ভি আই পি পুরসভাতেই মহকুমাশাসক একযোগে কার্যনির্বাহী আধিকারিক। তাঁর অনুপস্থিতিতে দলে দলে লোক ফিরে যান। নেতা-কর্মীদের সামনেই হুট করে কেটে পড়েন, এমনকী সামান্য জন্ম শংসাপত্রের মতো নিরীহ দফতরেও টাকা ছাড়া কাজ হয় না। এই কাগজ ওই কাগজ চেয়ে ফিরিয়ে দেওয়া হয়। এই সব কি হঠাৎ পরিদর্শনে চিহ্নিত করা যায়? তাই নতুন জমানাতেও সনাতন কর্মকাণ্ডের সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলছে। কিন্তু কার্যকারিতা নিয়ে যত প্রশ্নই থাকুক, মুখ্যমন্ত্রীর এই অভিনব উদ্যোগকে মানুষজন নিঃসন্দেহে স্বাগত জানিয়েছেন। |
আসলে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী প্রথম দিন থেকেই আক্রমণাত্মক খেলছেন। আধুনিক ফুটবলে আক্রমণাত্মক খেলার জন্য আবশ্যিক হল, খেলাটা ছড়িয়ে দিয়ে মাঠটাকে বড় করে নিতে হয়। নিজের হাতে দশ দশটি দফতর রেখে দশভুজা মমতাদেবী দশ হাতে রাজ্য পরিচালনার খেলাটিকে নিঃসন্দেহে ছড়িয়ে দিয়েছেন। ফল হয়েছে এটাই যে, এখন পর্যন্ত গোল না হলেও গ্যালারির তারিফ কুড়িয়ে নিয়েছেন। প্রত্যাশিত ভাবেই মমতাদেবী আশু নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিগুলিকেই অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তাই পাহাড়ের সমস্যা, সিঙ্গুরে ও রাজারহাটে অনিচ্ছুকদের জমি ফেরত, জঙ্গলমহল ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির বিষয়গুলি সামনে এসেছে। লক্ষণীয় যে, এখানেও মমতাদেবী সমানে আক্রমণাত্মক থেকেছেন। ক্রিকেটের পরিভাষায় বলা যায় যে আমাদের মুখ্যমন্ত্রী শুরু থেকেই ফ্রন্টফুটে ব্যাট করছেন। আক্রমণাত্মক এই শৈলীর স্বল্পমেয়াদি সুফল অবশ্যই আছে। ভ্রমণপিপাসু বাঙালি আবার পাহাড়ে ভিড় জমিয়েছে। সিঙ্গুর ও রাজারহাটে আনন্দের বান ডেকেছে। জঙ্গলমহলে খাদ্য নিশ্চয়তার আশা দানা বেঁধেছে। এর ফলে জনমানসে এই বিশ্বাস ছড়িয়ে দেওয়া গেছে যে, অহেতুক কালহরণ বর্জন করে স্থিরপ্রতিজ্ঞ মুখ্যমন্ত্রী আশু ফলদায়ী কাজ চান। সমস্যাগুলির দ্রুত সমাধান চান। একের পর এক এই সব উদ্যোগে বামপন্থীদের দম ফেলার ফুরসত মেলেনি এবং সন্দেহ নেই, এতে তাঁরা হতোদ্যম ও কোণঠাসা হয়েছেন। কিন্তু 'অল আউট' আক্রমণাত্মক খেলার মুশকিল হল, এতে রক্ষণে খামতি থেকে যায়। সেই খামতিটি এখন দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী পাহাড় সমস্যার অতি দ্রুত সমাধান করে ফেলেছেন। দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর হয়ে গেছে। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে যে, এর জন্য তরাই ও ডুয়ার্সে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার দীর্ঘ দিন প্রার্থিত অনুপ্রবেশের যে সুযোগ উন্মোচিত হয়েছে, তাতে এক দিকে আদিবাসী বিকাশ পরিষদ ও সমতলের সঙ্গে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সংঘর্ষ অনিবার্য হয়েছে, অন্য দিকে প্রস্তাবিত পার্বত্য পরিষদে তরাই-ডুয়ার্সের উল্লেখ না-থাকায় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা নতুন করে গাঁইগুঁই শুরু করেছে। আসলে সমাধানের নামে মুখ্যমন্ত্রী এখানে একটি 'টাইম বোমা' ফেলে দিয়েছেন। যে প্রক্রিয়ায় সুবাস ঘিসিংয়ের স্থলে বিমল গুরুঙ্গ আবির্ভূত হয়েছেন, সেই প্রক্রিয়াতেই বিমল গুরুঙ্গের বদলে গোর্খাল্যান্ডের নতুন নেতার আবির্ভাবের সম্ভাবনা কোনও ক্রমেই নাকচ করা যায় না। আসলে, এক দিকে উগ্র বাঙালিয়ানা ও অন্য দিকে গোর্খা জনজাতির খুদে জাতীয়তাবাদের মোকাবিলা না-করে পাহাড়ের সমস্যার কোনও সরল সমাধান নেই। এর থেকেও বড় হয়ে দেখা দিয়েছে 'সিঙ্গুর বিপর্যয়'। বিধানসভা অধিবেশন চলাকালীন যে অধ্যাদেশ জারি করা যায় না, এই আইন এবং প্রথা উপেক্ষা করে মুখ্যমন্ত্রী তড়িঘড়ি সিঙ্গুর অধ্যাদেশ জারি করে সিঙ্গুরে 'অনিচ্ছুক' চাষিদের জমি ফেরত দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষার তাগিদে টাটাদের থেকে জমি ফেরত নেন। কিন্তু অচিরেই তাঁকে পিছু হঠতে হয়। বিপুল জনাদেশ এবং বিচারবিভাগের সহানুভূতিতে বলীয়ান অদম্য মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় সিঙ্গুর বিল এনে রাতারাতি 'অনিচ্ছুক' চাষিদের জমি দিতে উদ্যোগী হন। সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপে জমি বিতরণ কর্মসূচি স্থগিত হয়ে যায়। এতে অবশ্য রাজনীতিগত ভাবে মমতাদেবীর কোনও ক্ষতি নেই। তিনি কৃষকদের জমি দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু টাটাদের বিরোধিতায় সে কাজ আটকে গেছে। এতে রাজনীতির দিক থেকে মমতাদেবীর লাভই হবে। কিন্তু আইনি প্রশ্নে সিঙ্গুর বিল আটকে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। তৃণমূল কংগ্রেসের আইনজীবীরা যা-ই বলুন, স্পষ্টতই হাই কোর্টের রায়ের আগে সর্বোচ্চ আদালত এই পর্যায়ে মূল মামলায় হস্তক্ষেপ করছেন না। মূল মামলায় সুপ্রিম কোর্ট হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নিলে সিঙ্গুরে 'অনিচ্ছুক' কৃষকদের জমি ফেরত পাওয়ার আশা বিশ বাঁও জলের তলায় চলে যাবে। কিন্তু এর থেকেও গুরুত্বপূর্ণ হল ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক কৃষকের প্রশ্ন। এই প্রশ্ন সামনে এলে কৃষক বনাম কৃষক বিভাজনের দায় মমতাদেবীকে নিতে হবে। এই সেই প্রশ্ন, যার জন্য আমরা মমতাদেবীর সিঙ্গুর আন্দোলন থেকে সরে যেতে বাধ্য হই। এই আন্দোলনের আদি পর্ব থেকেই আমরা ছিলাম, ২৪ সেপ্টেম্বর সিঙ্গুরে বিডিও অফিসে আমি নিজে ছিলাম, মমতাদেবীর সঙ্গে জোর করে আমাদের আটকে তাঁর বাড়ির সামনে ছেড়ে দেওয়া হয়, মমতাদেবীর অনশন সত্ত্বেও আমরা শামিল ছিলাম। সিঙ্গুর আন্দোলন ছিল শিল্পায়নের জন্য বলপূর্বক বহুফসলি জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে। ইচ্ছুক-অনিচ্ছুক বিভাজন করে আসলে অধিগ্রহণ মেনে নিয়ে অনিচ্ছুকদের জমি আদায়ের প্রশ্ন নির্ধারক হয়ে ওঠে। সে দিনও আমরা তা মেনে নিতে পারিনি, আজও পারি না। কোনও সন্দেহ নেই যে, কৃষক বিভাজনের এই পথ সিঙ্গুর আন্দোলনের মৃত্যুবাণ হবে। আপাতদৃষ্টিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় মমতাদেবীর বিরুদ্ধে গেছে বলে মনে হলেও আসলে এই রায়ের ফলে তিনি বেঁচে গেছেন। অন্যথায় 'অনিচ্ছুক'দের জমি ফেরত দেওয়ার প্রক্রিয়ায় সিঙ্গুরে তো বটেই, সারা রাজ্যে গৃহযুদ্ধ হতে পারত। জঙ্গলমহল ও রাজনৈতিক বন্দিমুক্তির প্রশ্নে মমতাদেবী ব্যাকফুটে যেতে বাধ্য হয়েছেন। স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, উন্নয়নের প্যাকেজ দিয়ে মাওবাদীদের তুষ্ট করা যাবে না, কারণ তাঁরা চান রাজনৈতিক ক্ষমতা। তাই এখন যৌথ বাহিনী প্রত্যাহারের বদলে তাদের স্থায়ী ঘাঁটি বসানোর আয়োজন চলছে। রাজনৈতিক বন্দিদের নিঃশর্ত মুক্তির প্রশ্নে মুখ্যমন্ত্রী ১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট প্রদর্শিত পথে হাঁটতে রাজি নন। প্রতিটি কেস ধরে পর্যালোচনা করার জন্য 'রিভিউ কমিটি' গঠিত হয়েছে। এই ছাঁকনির বিরুদ্ধে মানবাধিকার সংগঠনগুলি এবং মাওবাদীরা সরব। কিন্তু এই সবের ফলে মমতাদেবীর জনসমর্থন কমে গেছে মনে করলে ভুল হবে। মানুষ ভাবছেন যে, তিনি চেষ্টা করছেন, কিন্তু পেরে উঠছেন না। বরং এ সব প্রশ্নে বামফ্রন্ট আরও কোণঠাসা হয়েছে। অন্য দিকে, তৃণমূল কংগ্রেসের অন্ধ সি পি এম-বিরোধিতা অব্যাহত রয়েছে, বরং তেজী হয়েছে। বেআইনি অস্ত্র উদ্ধারের নামে বাম নিপীড়ন চলছে। গ্রামাঞ্চলে মুচলেকা এবং জরিমানা ছাড়া বামপন্থীদের টিকে থাকাই দায়। রাজনৈতিক পালাবদলের ফলে পুলিশ প্রশাসন রং বদলে ফেলেছে, পুলিশ এ সব নিয়ে অভিযোগ নিতেই রাজি নয়। বর্গা উচ্ছেদ শুরু হয়েছে, খেতমজুরদের বসিয়ে দেওয়া হচ্ছে, বানভাসিদের ত্রাণের ব্যবস্থা নেই। আরও মারাত্মক হল সংবাদমাধ্যমের নীরবতা অধিকাংশই এ সব ব্যাপারে নীরব থাকা শ্রেয় এবং নিরাপদ ভাবছেন। এ বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, বামফ্রন্টের সমর্থনভিত্তি ধসে গেছে। গত নির্বাচনে যে ১ কোটি ৯৫ লক্ষ ভোট ছিল, তা এখন ৭০ লক্ষে নেমেছে। এর মধ্যে ছোট একটা অংশ টি এম সি'তে যোগ দিয়েছেন, অধিকাংশই বসে গিয়েছেন। অবস্থা এমনই যে, সামনের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অর্ধেক আসনে বাম প্রার্থী জোটানো দায় হবে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে রাজ্যে বামপন্থীরা নিঃসন্দেহে প্রান্তিক শক্তিতে পরিণত হবে। তৃণমূল নেতারা এখনই স্বপ্ন দেখছেন, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচন হবে কংগ্রেস ও তৃণমূল কংগ্রেসের মধ্যে, যেখানে তাঁরা ৩৯-৪০টি আসন পাবেন, কংগ্রেস পাবে দু'তিনটি, বামপন্থীরা খাতা খুলতে পারবেন না। রাজ্যের পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। মুখ্যমন্ত্রী আছেন, কিন্তু কোনও 'টিম গেম' নেই, অন্য মন্ত্রীরা কাঠপুতলিমাত্র। সচিব ও অন্য আধিকারিকরা তটস্থ। বিধানসভা অধিবেশন চলাকালীন ক্যামেরার সামনে মুখ্যমন্ত্রী অধ্যাদেশ জারি করছেন, পাশে দাঁড়িয়ে আছেন মুখ্যসচিব, তিনি বলতে পারছেন না যে, সংসদীয় গণতন্ত্রে এ জিনিস চলে না! আসলে পশ্চিমবঙ্গ দাঁড়িয়ে আছে এক খাদের কিনারায়। এখান থেকে গণতন্ত্রের শক্তি জোটবদ্ধ হয়ে রাজ্যকে দলতন্ত্রের বিপরীতে গণতন্ত্রে নিয়ে যাবে, অন্যথায় দলতন্ত্রের বদলে নতুন দলতন্ত্রের অপশক্তি রাজ্যকে স্বৈরতন্ত্রের রথে অনিবার্য ভাবে জুতে দেবে। |
প্রবন্ধ ২... |
মেডিক্যাল শিক্ষাও বেহাল সেরাদের আনা হবে কি |
শ্যামলকুমার বসু |
উচ্চশিক্ষার হৃতগৌরব ফিরিয়ে আনার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের মান উন্নত করতে উদ্যোগী হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। দেশ-বিদেশের কৃতী শিক্ষকদের নিয়ে 'মেন্টর গ্রুপ' তৈরি করার মতো বেশ কিছু ব্যতিক্রমী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এই প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। তবে শিক্ষার ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারে এ রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষাকেও এড়িয়ে যাওয়া চলে না। গত বছর মেডিক্যাল কলেজের ১৭৫ বছর পূর্ণ হল। এটি গোটা এশিয়ার প্রাচীনতম আধুনিক চিকিৎসার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ১৮৩৫ সালে ২৮ জানুয়ারি মেডিক্যাল কলেজ শুরু হয়। মেডিক্যাল শিক্ষা এবং চিকিৎসার উৎকর্ষে ভারতে পশ্চিমবঙ্গের জায়গা ছিল প্রথম সারিতে। আজ যেখানে রাজ্যের মেডিক্যাল কলেজগুলো পঠনপাঠনের ন্যূনতম শর্তগুলি মেটাতে হিমসিম খাচ্ছে, সেখানে উৎকর্ষের কথা তোলাটাই বাহুল্য বলে মনে হয়। প্রতি বছর মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরিদর্শনের সময়ে এ রাজ্যের কলেজগুলোর অবস্থা হয় ফেল-করা ছাত্রদের মতো 'এ বারের মতো পাশ করিয়ে দিন স্যর, পরের বার ঠিক করে পড়ব' গোছের আবেদন করা হয়। লাইব্রেরি, ল্যাবরেটরি, হস্টেল, লেকচার থিয়েটার প্রভৃতির সংখ্যা এবং গুণগত মানে অনেক ঘাটতি রয়েছে, মেডিক্যাল কলেজগুলোর রেডিয়োলজি, প্যাথলজি বিভাগগুলোও খুঁড়িয়ে চলছে। তবে যা সবচেয়ে মারাত্মক তা শিক্ষকের ঘাটতি। যখন যে কলেজে পরিদর্শন হচ্ছে সেখানে অন্য কলেজ থেকে শিক্ষকদের বদলি করা হচ্ছে। কী করে মেডিক্যাল কলেজগুলোয় আরও কিছু আসন বাড়িয়ে আরও ছাত্র ভর্তি করা যায়, সেটাই যেন সরকারের একমাত্র চিন্তা। পড়াশোনা কেমন হচ্ছে, কী করলে তার উন্নতি হবে, তা নিয়ে কেউ যে চিন্তা করছেন, তার কোনও পরিচয় পাওয়া যাচ্ছে না। চিকিৎসার ক্ষেত্রে এ রাজ্যের প্রয়োজন কী, ভবিষ্যতে তা কেমন হবে, আজকের মেডিক্যাল শিক্ষা কী ভাবে আগামী কালের প্রয়োজন মেটাবে, সে ভাবনারও কোনও ছাপ শিক্ষাব্যবস্থায় খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। |
মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলোর দিকে তাকালে মনে হয়, নিত্য নতুন বিপর্যয়ের মোকাবিলা করতেই তারা ব্যস্ত। আগামী দিনে মেডিক্যাল শিক্ষা কেমন হবে, কী করে তা অন্য রাজ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করবে, তা নিয়ে আলোচনার জমিই তৈরি নেই। কেউ যদি বলেন, জনসংখ্যার নিরিখে দশ বছর পর এ রাজ্যের কত ডাক্তার প্রয়োজন, তার জন্য আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে কত বাড়তি ছাত্র-আসন তৈরি করা দরকার, তাদের পড়ানোর জন্য কত শিক্ষক নিয়োগ করতে হবে, আর সেই শিক্ষকদের কোথা থেকে পাওয়া যাবে, প্রয়োজন অনুসারে নার্স, প্যারামেডিক্যাল কর্মী তৈরি হবে কী করে সে সব প্রশ্নের উত্তর কোনও সরকারি ফাইলে খুঁজে পাওয়া যাবে না। এমনই পরিকল্পনাহীন আমাদের মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থা। এই অবস্থা এক দিনে হয়নি। এ রাজ্যে মেডিক্যাল শিক্ষাকে দীর্ঘ দিন অবজ্ঞা করা হয়েছে। আমাদের সরকার রোগীর দেখভালকেই মুখ্য বলে মনে করেন, মেডিক্যাল পঠনপাঠন সেখানে গৌণ। গবেষণা তো আরও অকিঞ্চিৎকর। স্নাতকোত্তর স্তরের গবেষণা কী রকম হয়, তা ছাত্ররা ভালই জানেন। যে শিক্ষক গবেষণা করেন, বিস্তর কাঠখড় পুড়িয়ে নিজের উদ্যোগে করেন। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁর জন্য কোনও সুযোগ তৈরি করে দেয় না। মেডিক্যাল শিক্ষার সমস্যার গোড়ায় রয়েছে তার স্বাতন্ত্র্যের অভাব। পশ্চিমবঙ্গ স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়টি কার্যত জন্ম থেকে পঙ্গু, পরনির্ভর। স্বাস্থ্য দফতরের অধীনস্থ একটি বিভাগ হিসেবেই তা কাজ করে। তার নিজস্ব ভবনও জোটেনি, বিধাননগর হাসপাতালের একটি অংশ সারিয়ে তার দফতর তৈরি হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মীরা নিযুক্ত হন বা বদলি হন স্বাস্থ্য দফতরের নির্দেশে, কর্মীদের উপর বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ নেই। যে প্রতিষ্ঠানের স্বনিয়ন্ত্রণ নেই, তার স্বাধীন পরিচয় থাকবে কী করে? আর তা নেই বলেই গত ছয় মাস ধরে উপাচার্য ছাড়াই চলছে বিশ্ববিদ্যালয়। রাজ্যের সব ক'টি মেডিক্যাল, ডেন্টাল, নার্সিং প্রভৃতি কলেজ যার অধীনস্থ সেই স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ দিন উচ্চতম পদ শূন্য থাকা নিয়ে কোনও আলোচনাও শোনা যায় না। সরকার এই পদটিকে কোনও গুরুত্ব দেয় না বলে জনমানসেও তার কোনও মর্যাদা তৈরি হয়নি। 'ওয়েস্ট বেঙ্গল ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেস' বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের অনুমোদিত নয়। তাই ন্যূনতম নিয়মগুলি মানার কোনও তাগিদ নেই স্বাস্থ্যকর্তাদের। স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়কে ডিগ্রি বিতরণের প্রতিষ্ঠান করে রেখে দেওয়া হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজগুলিতে শিক্ষক নির্বাচন, নিয়োগ বা বদলির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বা কলেজ কর্তৃপক্ষের কোনও স্বাতন্ত্র্য নেই। যে কোনও সরকারি কর্মী বদলি করার মতোই, স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা ইচ্ছে মতো শিক্ষকদের বদলি করতে পারেন। এই পরিস্থিতিতে উৎকর্ষ যে দুঃসাধ্য, সে তো স্বাভাবিক। যদি এই অবস্থার পরিবর্তন করে মেডিক্যাল শিক্ষার ঐতিহ্য উদ্ধার করতে হয়, তা হলে কী করতে হবে? প্রথম পদক্ষেপ ইতিমধ্যেই করেছে সরকার, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে। যাঁরা দীর্ঘ দিন দলনেতা বা সরকারি কর্তাদের তোষামোদ করে পেশায় উন্নতি করেছেন, তাঁদের হাতে শিক্ষাকে না রেখে আমন্ত্রণ করে আনা হয়েছে সেই মানুষদের, যাঁরা পঠনপাঠন-গবেষণায় আন্তর্জাতিক শিক্ষাক্ষেত্রে স্বীকৃতি পেয়েছেন। মেডিক্যাল শিক্ষাতেও এমন মানুষ প্রয়োজন, যাঁরা কোনও দলের আজ্ঞাবহ নন। 'সার্চ কমিটি' তৈরি করে সেরা শিক্ষকদের আনা হোক স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের হাল ধরার জন্য, মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষকতার জন্য। সেরা লোক ছাড়া সেরা কাজ হবে না। অত্যন্ত আক্ষেপের বিষয়, এ রাজ্যে রাজনৈতিক দলের আনুগত্যের পুরস্কার হিসেবে সরকারি চিকিৎসক-শিক্ষকদের পদোন্নতি বা বদলি করা হয়। পছন্দের ডাক্তারদের আনা হয় মেডিক্যাল শিক্ষা ব্যবস্থার প্রশাসনিক দায়িত্বে এবং স্বাস্থ্য বিশ্ববিদ্যালয়ে। শিক্ষকতা-গবেষণার মান যাঁরা বাড়াতে পারতেন, যাঁদের সেই ক্ষমতা এবং সদিচ্ছা রয়েছে, তাঁরা সরকারি ব্যবস্থা থেকে ক্রমশ দূরে সরে গিয়েছেন। দুঃখের বিষয়, নতুন সরকার পুরনো প্রথা বদলাবে, এখনও তার কোনও ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। শিক্ষায় এবং চিকিৎসায় যদি উৎকর্ষ আনতে হয়, তা হলে বেতনবৃদ্ধি, পদোন্নতি, সবই করতে হবে কাজের মূল্যায়নের ভিত্তিতে। বর্তমান ব্যবস্থায় চাকরিতে ঢোকার পর পদোন্নতির একমাত্র শর্ত বেঁচে থাকা। মরণোত্তর পদোন্নতি হয় না, নইলে বাধা উন্নতি। এতে আরও ভাল কাজ করার কোনও তাগিদ তৈরি হয় না, দায়বদ্ধতাও থাকে না। মেডিক্যাল শিক্ষার নীতি তৈরি করতে হলে তা অবশ্যই মানুষের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তৈরি করতে হবে। খুব প্রয়োজনীয় একটি 'ডায়নামিক ডেটাবেস', তথ্য-পরিসংখ্যান রাখার এমন ব্যবস্থা যা নিয়মিত সাম্প্রতিকতম তথ্য ধরে রাখবে। এ রাজ্যের জন্য কত এম বি বি এস ডাক্তার, কত এম ডি, কত সুপারস্পেশালিটি ডাক্তার চাই, তার একটা বাস্তবিক হিসেব দরকার। এখন যে ভাবে পরিসংখ্যান তৈরি করা হয়, তা নেহাতই একটা আন্দাজের ভিত্তিতে। এ ভাবে কোনও নীতি তৈরি হতে পারে না। অন্যান্য রাজ্যে বেশ কিছু পরিবর্তন ইতিমধ্যেই আনা হয়েছে, যা পশ্চিমবঙ্গেও দরকার। শিক্ষকের যেখানে এত অভাব, সেখানে মেডিক্যাল কাউন্সিলের পরিবর্তিত নিয়ম মেনে শিক্ষকদের অবসরের বয়স ৭০ বছর পর্যন্ত বাড়ানো যেতে পারে। স্থানীয় ডাক্তারদের আমন্ত্রিত শিক্ষক হিসেবে আনা যেতে পারে। বিশেষত জেলার কলেজগুলিতে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ডাক্তাররা খুশি হয়েই পড়াবেন। অবশ্যই এই ব্যবস্থাগুলি আনা উচিত কেবল সেই সব বিভাগে যেখানে প্রয়োজনীয় শিক্ষক পাওয়া যাচ্ছে না। দিল্লির অধিকাংশ মেডিক্যাল কলেজে প্রথম বর্ষ থেকেই ছাত্রদের হাসপাতালের ওয়ার্ডে যাওয়া নিয়ম করা হয়েছে। মৌলিক বিজ্ঞান, ল্যাবরেটরি বিজ্ঞান এবং চিকিৎসায় প্রযোজ্য (ক্লিনিক্যাল) বিজ্ঞানের মধ্যে অনেক বেশি সামঞ্জস্য ও সংযোগ আনা হচ্ছে, সে জন্য পাঠক্রমে অনেক পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আমাদের ছাত্রদেরও এই সুযোগগুলি দেওয়া জরুরি। মেডিক্যাল কলেজগুলি কোথায় তৈরি হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতে গিয়েও রাজনীতির তাগিদকে প্রাধান্য দিলে চলবে না। দূরের জেলাগুলিতে মানুষের প্রয়োজন উন্নত মানের সুচিকিৎসা, মেডিক্যাল কলেজ তৈরি করলে তাঁদের সমস্যার সমাধান হবে না। অন্য দিকে, দূরের কলেজে পঠনপাঠন যথেষ্ট উন্নত মানের হয় না, যে হেতু বহু শিক্ষক (এবং ভাল ছাত্ররাও) সেখানে যেতে ইচ্ছুক হন না। এটা বাস্তব, একে মেনে নিতেই হবে। দূরের জেলাগুলিতে ভাল হাসপাতাল হোক, মেডিক্যাল কলেজগুলি থাকুক রাজধানীর কাছাকাছি। শেষ প্রশ্ন, এক দিকে ছাত্রদের মধ্যে মেডিক্যাল শিক্ষার যখন এত চাহিদা, তখন কেন বেসরকারি কলেজ খুলতে বিনিয়োগকারীরা আগ্রহী হচ্ছেন না? অন্যান্য রাজ্যে বড় বড় শিল্পপতিরা মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে বিনিয়োগে অত্যন্ত আগ্রহী। পশ্চিমবঙ্গ ব্যতিক্রম। সরকার যেখানে শিল্পপতিদের আহ্বান জানাচ্ছেন স্বাস্থ্য ও শিক্ষার ক্ষেত্রে প্রাধন্য দিয়ে বিনিয়োগ করতে, সেখানে আগ্রহের এই অভাব কেন? দক্ষিণের চারটি রাজ্য এবং গুজরাত ও মহারাষ্ট্র, এই ছ'টি রাজ্যে ৬৩ শতাংশ মেডিক্যাল কলেজ রয়েছে এবং ৬৭ শতাংশ মেডিক্যাল ছাত্র-আসন রয়েছে। বাকি আসন ছড়িয়ে আছে বাকি দেশে। এদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে গেলে রাজ্য সরকারকে এ রাজ্যে শিক্ষার উৎকর্ষ যেমন তৈরি করতে হবে, তেমনই শিক্ষার সুযোগও বাড়াতে হবে। নইলে এ রাজ্যের মেডিক্যাল শিক্ষা সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতায় ক্রমাগত পিছিয়ে পড়বে। |
লেখক মেডিক্যাল কাউন্সিল অব ইন্ডিয়া-র সদস্য এবং মেডিক্যাল কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ |
সম্পাদকীয় ১... |
যাহার যাহা কাজ নহে |
যে কোনও প্রতিষ্ঠানকে প্রথমেই ভাল করিয়া বুঝিয়া লইতে হয়, তাহার কী কাজ। আর, কাহার কী কাজ, তাহা বুঝিবার একটি পথ হইল, কোন কোন কাজ তাহার নয়, সেটুকুও বুঝিয়া লওয়া। সুপ্রিম কোর্ট যখন দেশের কেন্দ্রীয় সরকারকে দুর্নীতিদমনের মতো গুরুতর একটি কাজ ঠিক ভাবে পালন না করিবার জন্য প্রবল ভর্ৎসনা করে, এবং নিজেই দুর্নীতি-তদন্ত কমিটি তৈরি করিতে চলে, তখন প্রশ্ন ওঠে, সুপ্রিম কোর্টের নিজের কাজ বোঝায় গলদ নাই তো? কিংবা, উত্তরপ্রদেশের কোনও বিশেষ জমি লইয়া মামলা সুপ্রিম কোর্টে উপস্থিত হইলে 'গরিবের জমি কাড়িয়া শপিং মল বা আবাসন' তৈরির জন্য মুখ্যমন্ত্রী মায়াবতী কিংবা রাজ্য সরকারকে যখন সুপ্রিম কোর্ট তীব্র তিরস্কার করে, তখন প্রশ্ন তুলিতেই হয়, সুপ্রিম কোর্ট অনধিকার চর্চা করিতেছে না কি? মঙ্গলের জন্য হউক, অমঙ্গলের জন্য হউক, অভিভাবকগিরি তো বিচারবিভাগের কাজ নয়! ভারতের বিচারবিভাগের এক বার স্মরণ করা প্রয়োজন যে, তাহা একটি সংবিধান-রচিত প্রতিষ্ঠান, এবং সংবিধান অনুযায়ী তাহার কাজ অস্তিত্বশীল আইনসমূহের অনুসরণে উপস্থিত মামলাগুলির বিচার ও নিষ্পত্তি। দেশের নৈতিক চরিত্র মেরামত করা তাহার কাজ নহে। দেশের রাজনৈতিক বাস্তবে পরিবর্তন ঘটানোও তাহার কাজ নহে। শাসন, কুশাসন, অপশাসন, এ সব বিষয়ে বিচারবিভাগ প্রবেশ না করিলেই মঙ্গল। ভারতের বিচারবিভাগের অতিসক্রিয়তার অভিযোগ পুরাতন। দশকের পর দশক অজস্র প্রসঙ্গে এই অভিযোগ উঠিয়াছে। শাসনবিভাগের কাজে হস্তক্ষেপ ও অবাঞ্ছিত অভিভাবকত্বের দৃষ্টান্ত একটির পর একটি স্থাপিত হইয়া চলিয়াছে। ইহা কিন্তু ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের কার্যকারিতা সম্পর্কেই প্রশ্ন তুলিয়া দেয়। ভারতীয় সংবিধানে তিনটি বিভাগের মধ্যে সম্পূর্ণ আলাদা দায় ও দায়িত্ব বণ্টিত। সুচিন্তিত ভাবেই বিভাগগুলি পরস্পর-বিচ্ছিন্নও বটে। সংবিধান-প্রণেতারা সঙ্গত ভাবেই চান নাই যে কোনও একটি বিভাগ অতিরিক্ত ক্ষমতাশীল হইয়া উঠিবার অবকাশ পাক। প্রজাতন্ত্রের মৌলিক চরিত্র ধরিয়া রাখিবার কাজটি সহজ নহে। সেই দুরূহ কাজটি সাধনের লক্ষ্যেই এই সতর্কতা। ব্রিটেন কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানও এই সাংবিধানিক সতর্কতা একই ভাবে মানিয়া চলে। বিভাগগুলি পরস্পরকে পর্যবেক্ষণ করিবে, মতামত প্রকাশ করিবে, কিন্তু কেহ কাহাকেও অতিক্রম করিবে না, কাহারও কাজে সরাসরি নাক গলাইবে না, ইহাই সেই গোড়ার নীতিদর্শন। ভারতীয় বিচারবিভাগ যে কেন প্রায়ই এই মূলনীতির গণ্ডি পার হইয়া যায়, পরিস্থিতির প্রতিকারার্থে নিজে হস্তক্ষেপ করিয়া বসে, তাহার কারণ অতি সহজ। শাসনবিভাগের অপারগতা বা দায়িত্বহীনতার জন্যই এই অবস্থার উদ্ভব। কিন্তু এ বিষয়ে বিচারবিভাগকে 'অন্ধ' হইতেই হইবে। শাসনবিভাগের কাজ শাসন-সভার সদস্যরাই করিবেন, এবং কেবল তাঁহারাই করিবেন। তাঁহারা নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। জনগণ তাঁহাদের এ কাজের জন্যই ভোট দিয়া পাঠাইয়াছেন। সে কাজ করিবার অবকাশ তাঁহাদের দিতে হইবে। কাজে ভুল করিলে জনগণ পরের ভোটে জবাব দিবেন। কাজ না করিলেও জনগণ ভোটের মাধ্যমে তাঁহাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত লইবেন। এমনকী সামাজিক স্তরেও জনগণ তাঁহাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ-বিক্ষোভ জানাইতে পারেন, গণতন্ত্র সে অধিকার দিয়াছে। কিন্তু তাহা বলিয়া শাসনবিভাগ পারিতেছে না বা করিতেছে না বলিয়া অন্য কেহ কাজ করিয়া দিতে পারে না। প্রশ্ন উঠিতে পারে যে, ভোটের মাধ্যমে প্রতিনিধি পরিবর্তন করিলেও যদি সেই একই দুর্নীতি কিংবা অনিয়মের ধারাপাত চলিতে থাকে, এবং বিচারবিভাগ যদি হস্তক্ষেপ না-ই করিতে পারে, তবে কিং কর্তব্যম্? বাস্তবিক, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের দুর্ভাগ্য বলিয়া তাহা মানিয়া লওয়া ছাড়া কর্তব্য কিছুই নাই। কিন্তু অন্য বিভাগকে অনধিকার হস্তক্ষেপের মাধ্যমে গণতন্ত্রকে বিপন্ন করা চলিবে না। তাহা সম্পূর্ণ অ-কতর্ব্য। |
No comments:
Post a Comment