চার রাত-পাঁচ দিনের সিঙ্গাপুর ভ্রমণ। মাঝে এক দিন শিল্প সম্মেলন। এক ফাঁকে সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম বিদেশ যাত্রার সফরসূচি এমনই।
এই সফরের আগে লগ্নি নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নিজে কতটা আশাবাদী? রবিবার কলকাতা বিমানবন্দরে সিঙ্গাপুরের উড়ান ধরার আগে এ নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে মুখ্যমন্ত্রী বলেন, “কথা বললে অনেক কিছু হয়। এশিয়ার দেশগুলো আছে। দেখি চেষ্টা করব।” সিঙ্গাপুর সফরের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অর্থ তথা শিল্পমন্ত্রী অমিত মিত্র অবশ্য আগেই ঘোষণা করে রেখেছেন, “একটি সফরেই সব কিছু হয়ে যাবে না। এই সফরের মাধ্যমে সিঙ্গাপুরের সঙ্গে কলকাতার ধারাবাহিক সম্পর্ক তৈরি হবে। সেই সম্পর্কের উপর ভর করেই রাজ্যে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে বিনিয়োগ আসতে শুরু করবে।” অর্থাৎ, এ রাজ্যকে বিদেশের মাটিতে তুলে ধরাই যে মুখ্যমন্ত্রীর এ বারের সফরের প্রধান উদ্দেশ্য, তা জানিয়ে দিয়েছেন অমিতবাবু। সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর যে সব বৈঠক হওয়ার কথা, সেগুলি যাতে হয়, তা নিশ্চিত করতে রাজ্যের অফিসারদের একটি দল আগেই সিঙ্গাপুরে পৌঁছে গিয়েছে।
সাংবাদিক ও ক্যামেরাম্যানদের বাদ দিলে ৫২ জন বণিক-কর্তা ও ১২ জন সরকারি আধিকারিক মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গী হয়েছেন। রবিবার মুখ্যমন্ত্রীর উড়ান কলকাতা ছাড়ার পরে অনেকেই বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর বিদেশ সফরেও তাঁর সঙ্গে এত লোক থাকেন না।   
মুখ্যমন্ত্রীর সফরসূচি দেখে শিল্প মহলের ধারণা হয়েছে, এই সফর আসলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের চোখ-কান খোলার সফর (এক্সপোজার ট্রিপ)। শিল্পমহলের এক প্রতিনিধির বক্তব্য, সারা পৃথিবী কী ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে, তা সিঙ্গাপুরে নামার পর থেকেই বুঝতে পারবেন মুখ্যমন্ত্রী। ৭১২ বর্গ কিলোমিটারের এই দ্বীপটি যে ভাবে সব ক্ষেত্রে সোনা ফলাচ্ছে, তা মুখ্যমন্ত্রী উপলব্ধি করলে রাজ্যের মঙ্গল। বস্তুত সেই কারণেই অসংখ্য বৈঠকের বদলে মুখ্যমন্ত্রীকে পাঁচ দিন ধরে এই দেশ ঘুরিয়ে দেখানোর পরিকল্পনা করেছেন সরকারি অফিসাররা। শিল্প দফতরের এক কর্তার কথায়, “আগে তো জানতে হবে সারা বিশ্বে কোথায় কী হচ্ছে! সেই কারণেই চিড়িয়াখানা থেকে বন্দর সব কিছুই মুখ্যমন্ত্রীর সফরের মধ্যে রাখা রয়েছে।”
মুখ্যমন্ত্রীর দফতর সরকারি স্তরে যে সফরসূচি বিলি করেছে, তা থেকে জানা যাচ্ছে, সোমবার সকাল সাড়ে ছ’টায় মমতা চাঙ্গি বিমানবন্দরে নামবেন। সেখান থেকে সোজা চলে যাবেন হোটেলে। তাঁর প্রথম বৈঠক হওয়ার কথা সিঙ্গাপুর সরকারের সম্পদ ব্যবস্থাপনা তহবিল জিআইসি-র সঙ্গে। জিআইসি-র হাতে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকার একটি তহবিল রয়েছে। তারা পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লগ্নি করে। জিআইসি-র সঙ্গে বৈঠকের মাধ্যমে সফর শুরু হলে তা ইতিবাচক হবে বলেই মনে করছেন শিল্পমহলের অনেকে। যদিও জিআইসি-র প্রতিনিধিরা মমতার সঙ্গে আলাদা ভাবে বৈঠকে বসবেন কি না, তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে কিছু ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে বলে সরকারি সূত্রের খবর। তবে এ নিয়ে কেউই এখন মুখ খুলতে নারাজ। সোমবার বিকেলে মুখ্যমন্ত্রী যাবেন নেতাজি মেমোরিয়ালে, শ্রদ্ধা জানাতে। এখনও পর্যন্ত ঠিক রয়েছে, রাতে হোটেলেই তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতে পারেন জুরং টাউনশিপ কর্পোরেশনের বাঙালি প্রতিনিধিরা।
মঙ্গলবার মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি সিয়েং লুং এর সঙ্গে দেখা করতে যাবেন। নিতান্তই সৌজন্য সাক্ষাৎকার। সরকারি কর্তারা জানিয়েছেন, ভারতের কোনও অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী সিঙ্গাপুরে গেলে তাঁর সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর দেখা করাটাই এ দেশে দস্তুর। সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে রুটিন বৈঠকের পরে মঙ্গলবার বিকেলেই মুখ্যমন্ত্রীর সিঙ্গাপুর বন্দর দেখতে যাওয়ার কথা। হোটেলে ফিরে সফরসঙ্গী শিল্পপতি, সরকারি অফিসারদের সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা তাঁর। শিল্প দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, পরের দিন, বুধবারের শিল্প সম্মেলনের প্রস্তুতি বৈঠক হিসাবেই এটিকে দেখা হচ্ছে। রাজ্যে কোন কোন ক্ষেত্রে লগ্নি টানার উপরে বেশি জোর দেওয়া হবে, তা মুখ্যমন্ত্রী শিল্পপতি-অফিসারদের সামনে বলবেন বলে খবর। এ দিন রাতেই চাঙ্গি বিমাবন্দর সংস্থা এবং শিল্পোন্নয়ন নিগম যৌথ ভাবে নৈশভোজের আয়োজন করেছে।
বুধবার সকাল থেকেই সফরের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ শিল্প সম্মেলনের আসর বসবে। সিঙ্গাপুরের বিখ্যাত সাংগ্রি লা হোটেলে এই শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, ২০০৫ সালে সিঙ্গাপুর সফরে এসে এই হোটেলেই শিল্প সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এ বারে শিল্প সম্মেলনে স্থানীয় বেশ কিছু সংস্থার শীর্ষ কর্তাদের হাজির থাকার কথা। এই সম্মেলনেই সঞ্জীব গোয়েন্কা, হর্ষ নেওটিয়া, করণ পাল, ওয়াই কে মোদী, কুরুশ এন গ্রান্ট, সুমিত মজুমদার, এইচি ওনো, পুনীত ডালমিয়া, উমেশ চৌধুরি, মায়াঙ্ক জালানের মতো শিল্পপতিরা সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন সংস্থার সামনে রাজ্যের শিল্প পরিস্থিতি তুলে ধরবেন। রাজ্যকে নিয়ে তৈরি করা একটি ছোট্ট তথ্যচিত্রও সেখানে দেখানো হবে। তার পর মুখ্যমন্ত্রীর বক্তৃতা এবং প্রশ্নোত্তর পর্ব। শিল্প দফতরের কর্তাদের দাবি, মমতার বক্তৃতা শোনা এবং তাঁকে প্রশ্ন করতে চেয়ে সেখানকার শিল্পপতিদের মধ্যে উৎসাহ তৈরি হয়েছে। শিল্প বৈঠকের পর মুখ্যমন্ত্রী শহরটি ঘুরে দেখবেন। বুধবার বিকেলেই তিনি যাবেন মেরিনা ব্যারাজ দেখতে। সেখানকার পাবলিক ইউটিলিটি বোর্ডের প্রধান চিউ মেন লিউং মমতাকে এই ব্যারাজ তৈরির ইতিহাস জানাবেন। সিঙ্গাপুরের জল সমস্যা কী ভাবে এই ব্যারাজ থেকে মেটানো হয়, তা-ও ব্যাখ্যা করবেন সিঙ্গাপুর নৌবাহিনীর এই কর্তা। রাতে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশনের দেওয়া নৈশভোজে যাবেন মুখ্যমন্ত্রী।
শিল্প সম্মেলনের পরের দিন মুখ্যমন্ত্রীর তেমন ব্যস্ততা নেই বলেই সরকারি সূত্রের খবর। ২১ অগস্ট বৃহস্পতিবার সারা দিনই মুখ্যমন্ত্রী এখানে-ওখানে ঘুরবেন। আরবান রিনিউয়াল ফেসিলিটি, সিঙ্গাপুর ট্যুরিজম বোর্ডের সঙ্গে বৈঠক, সেখানকার বিদেশমন্ত্রীর দেওয়া মধ্যাহ্নভোজ এবং ওয়াটার ফেসিলিটি দেখে দিন কাটবে তাঁর। সফরের শেষ দিন সকাল থেকে সেন্টোসা দ্বীপ এবং মেরিটাইম মিউজিয়াম দেখতে যাওয়ার কথা মুখ্যমন্ত্রীর। চাঙ্গি বিমানবন্দরেও বেশ কিছুটা সময় কাটানোর কথা। শিল্প দফতরের কর্তারা জানাচ্ছেন, জুরং পাখিরালয়, জুরং শিল্প তালুকেও যাওয়ার কথা রয়েছে মুখ্যমন্ত্রীর। সিঙ্গাপুর সরকারের আরও কয়েক জন প্রতিনিধির সঙ্গেও বৈঠক করতে পারেন তিনি। সে সব চূড়ান্ত হলে সামান্য অদলবদল হতে পারে মুখ্যমন্ত্রীর সফরসূচিতে।

সফরকে কটাক্ষ বিজেপির
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গাপুরের বিমান ধরার কয়েক ঘণ্টা আগেও তাঁর শিল্প-সফর নিয়ে ফের কটাক্ষ করলেন বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ। বিজেপি-র সর্বভারতীয় সম্পাদক সিদ্ধার্থনাথ রবিবার বসিরহাটে দলীয় কর্মিসভায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী সারদা-কাণ্ড থেকে দৃষ্টি ঘোরাতে সিঙ্গাপুর যাচ্ছেন না তো? আপনারা প্রশ্ন করুন। সারদার এত টাকা কোথায় গেল? ওঁর দলের মহাপুরুষদের কীর্তি চাপা দিতেই এই সিঙ্গাপুর সফর নয় তো?” শনিবারই কলকাতায় সিদ্ধার্থনাথ একই সুরে আক্রমণ করেছিলেন তৃণমূলকে। তৃণমূলের তরফে বৈশ্বানর চট্টোপাধ্যায় অবশ্য এ দিন সিদ্ধার্থনাথের বক্তব্য নস্যাৎ করে দিয়েছেন। তাঁর পাল্টা মন্তব্য, “সিদ্ধার্থনাথজি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতি সম্পর্কে কিছুই জানেন না! অজ্ঞের মতো কথা বলছেন! আমাদের দলনেত্রীর সততা প্রশ্নাতীত, তিনি স্বচ্ছ রাজনীতি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে কুৎসা ও প্রতিহিংসার মনোভাব নিয়ে মিথ্যাচার করছেন সিদ্ধার্থনাথজি।”