সুখবর হল একূশে উদ্ যাপনের আগেই সুদুর দক্ষিণাত্যে কর্ণাটক রাজ্যে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিরা অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকার দীর্ঘ চার দশকের অন্ধকার পেরিয়ে জিতেছেন।নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির অধ্যক্ষ এই উপলক্ষে আগামী পয়লা মার্চ নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমিতি ও কর্ণাটক উদ্বাস্তু সমিতির তরফ থেকে কর্ণাটক মাতৃভাষা বিজয় দিবস পালন করার ডাক দিয়েছেন।এই ডাকে সাড়া দেবেন?
পলাশ বিশ্বাস
বাঙালির সরস্বতী পুজো এখন বাঙালির ভ্যালেন্টাইন্স ডেও বটে।
অন্ততঃ পশ্চিমবঙ্গে।
বাংলার বাইরে দেশ ভাগের পরে যাদের ফেলে দেওয়া হল, তাঁরা সর্ব ভারতীয় মুক্ত বাজারের মধ্যে নিজের অস্তিত্বের লড়াইয়ে রক্তাক্ত হতে থাকলেও বাঙাল ভাষাতেই কথা বলতে অভ্যস্ত।তাঁরা পশ্চিম বঙ্গীয় ভদ্রলোক ভাষায় কথা বলতে পারেন না।
মাতৃভাষায় শিক্ষার অধিকার তাঁদের কোনো কোনো রাজ্যে আছে, বহু রাজ্যেই নেই।
এমনকি দন্ডকারণ্য ও আন্দামানের পর সবচেয়ে বেশি উদ্বাস্তুর বাস যেখানে, সেই উত্তরাখন্ড ও উত্তরপ্রদেশে মাতৃভাষার অধিকার বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের নেই।
যেমন তামিলনাডুতে চা বাগানে বা কফি বাগানে যাদের পুনর্বাস দেওয়া হয়েছে, রাজস্থানের মরুস্থলে যাদের বসবাস, তাঁদের মাতৃভাষা শেখার সুযোগ নেই, বলাই বাহুল্য।
সর্বক্ষেত্রে অবশ্য তাঁদের নাগরিকত্ব ভারত ভাগের পর পুনর্বাসিত হওয়ার এতদিন পর এক বাঙ্গালি সন্তান প্রণব মুখার্জির কল্যাণে সন্দিগ্দ্ধ।এই পশ্চিম বাংলাতেও।
তিনি আজ একের পর এক ফাঁসিক আদেশ জারি করছেন, আমাদের গণফাঁসির ব্যবস্থা ত তিনি বহুকাল আগেই করে দিয়েছেন।
ত্রিপুরাতে অবশ্য বাংলা ভাষায় শিক্ষা অধিকার আছে। কবি অনিল সরকারের মত উদ্বাস্তুরা সরকারেও আছেন।কিন্তু তাঁদের লেখা পড়ার স্বীকৃতি বাংলাদেশে থাকলেও এই বঙ্গে নেই।আসাম, বিহার ,ঝাড়খন্ডের বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের লেখালেখির খবরআমরা কতটা কি জানি?
লোক অস্পৃশ্য বাঙ্গালিরা, যাদের ভারত ভাগের পর সুপরিকল্পিত ভাবে পাহাড়ে, জঙ্গলে, মরুস্থলে এবং সমুদ্রের মাঝখানে দ্বীপান্তরে পাঠিয়ে দেওয়া হল কায়েমি ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক কর্তৃত্ব স্থাপনার তাকিদে, তাঁরা আজও পূরাতন ঐতিহ্যের বন্ধনে আবদ্ধ।
এবং তাঁরাই আসামের কাছাড়ে মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে আত্মবলিদান দিয়েছিলেন।
সীমান্তের ওপারে যারা আজ একুশের চেতনায়, অহন্কারি উদ্বুদ্ধ , তাঁরা কিন্তু এই বাঙ্গালির ইতিহাস ভূগোল থেকে ফেলে দেওয়া উদ্বাস্তুদেরই ধর্মান্তরিত ভাই বান্ধবরা।
পশ্চিম বাংলার ভদ্রলোকদের সঙ্গে ওপার এপার কোনো পারের বাঙ্গালির রক্ত বা আত্মার কোনো সেতুব্ধন নেই।ইউরোপ আমেরিকায় ও সারা বিশ্বে প্রবাসী বাঙ্গালিদের সঙ্গে অতি অবশ্যই আছে।
এমনিতেই বাঙ্গালির ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে পশ্চিমবঙ্গীয় ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক আধিপাত্য নির্বিবাদ, তাই মাতৃভাষার অধিকার নিয়ে তাঁদের কোনো দিনই লড়তে হয় নি।
রক্ত ঝরাতে হয়নি।এক ফোঁটাও।একুশে চেতনা এখানে অবিরাম অক্লান্ত রক্তঝরা লড়াই নয়।বাংলাদেশের একুশে চেতনা বা বাংলার বাইরে উদ্বাস্তু বাঙ্গালির চরম বিপর্যয় ও প্রতিকূল পরিস্থিতিতে মাতৃভায়ার লড়াই স্থানীয় সিপিএম তৃণমুল কংগ্রেস রাজনীতির রগরগে উত্তেজনা বা ভ্যালেন্টাইন ডে র মত আলোড়িত করে না।
যেমন আশিস নন্দীর ওবিসি এসসি এসটি বিরোধী মন্তব্যের বিরুদ্ধে ত্রিশ ত্রিশ টি সংস্থার একযোগে ধিক্কার প্রতিবাদ এখানে খবর হয় না,তেমনি উদ্বাস্তুরাও খবর হয় না।
বলবেন মতুয়ারাও ত উদ্বাস্তু এবং ওঁদের খবর হয়।ওঁদের খবর না হলে পরিবর্তন হয় না, প্রত্যাবর্তন অসম্ভব।
মরিচঝাঁপির গণহত্যাও এি বাংলাকে আলোড়িত করেনি।
বাংলার বাইরেরে বাঙ্গালিদের মাতৃভাষার লড়াইয়ে তাই আমরা পশ্চিম বঙ্গকে পাশে পাইনি কোনোদিন।
তবু আমাদের লড়াই থেমে থাকে নি, থাকবে না।
সুখবর হল একূশে উদ্ যাপনের আগেই সুদুর দক্ষণাত্যে কর্ণাটক রাজ্যে পুনর্বাসিত বাঙ্গালিরা অষ্টম শ্রেণী পর্য়ন্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষার অধিকার দীর্ঘ চার দশকের অন্ধকার পেরিয়ে জিতেছেন।
নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমন্বয় সমিতির অধ্যক্ষ এই উপলক্ষে আগামী পয়লা মার্চ নিখিল ভারত উদ্বাস্তু সমিতি ও কর্ণাটক উদ্বাস্তু সমিতির তরফ থেকে কর্ণাটক মাতৃভাষ বিজয় দিবস পালন করার ডাক দিয়েছেন।
এই ডাকে সাড়া দেবেন?
মহাবোধি সোসাইটি হলে কলেজ স্কায়ার কোলকাতায় সন্ধ্যা ছ টায় ওবিসি , আদিবাসিদের ও দলিতদের বিরুদ্ধে আশিস নন্দীর বক্তব্যের বিরুদ্ধে ধিক্কার সভা হয়ে গেল!আমরা বেশ ভালো করে জানি বাংলার অচলায়তন ভাঙ্গতে মনুস্মৃতি কর্তৃত্বকে আঘাত করতে নিজেদের অধিকারের দাবিতে বাংলায় বহুজন সমাজ গঠনের কাজ শুরু হতে অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হবেওপার বাংলা আবার জাগ্রত ইসলামী বাংলাদেশী জাতিয়তার বিরুদ্ধে বাঙ্গালি জাতিসত্তার লড়াইয়ে রাস্তায় নেমেছে সারা বাংলা দেশ!অথচ এপার বাংলায় বাঙ্গালিত্ব বলতেই বোঝায় ব্রাহ্মণ্যতান্ত্রিক আধিপাত্য!এই আধিপাত্যর দরুণ আশিসনন্দীর বক্তব্য নিয়ে, ওবিসি, উপজাতি ও তফসিলীদের ক্ষমতায়ন নিয়ে এখনই কোন বিতর্ক এই বাংলায় হবে না, যেখানে আড়াআড়ি পক্ষ বিপক্ষে বিভক্ত জনমানসে তৃতীয় পক্ষের কোনও সুযোগ নেই!যেমন সুযোগ নেই সমতা, সামাজিক ন্যায়, আইনের শাসন ও গণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষতার!বাংলাদেশে চরম আক্রমনের মুখেও জাগ্রত বাঙ্গালি জাতি সত্তা, তাই বাংলাদেশী ইসলামী জাতীয়তার জিগির সত্ত্বেও সেখানে গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবেশ কখনো নষ্ট হয়নি!পৃথীবীর আর কোনো দেশে সংখ্যালঘুদের নাগরিক মানবাধিকার রক্ষার লড়াইয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবিদের আত্মবলিদানের নজির নেই!অথচ বাংলায় অন্য পক্ষ, বহুজনসমাজের কোনও কথা কোথাও বলার লেখার সুযোগ নেই!মাতৃভাষার অধিকারের দাবিতে লক্ষ লক্ষ প্রামের বিনিময়ে ভূমিষ্ঠ হয় বাংলাদেশ!আসামের কাছাড়েও বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে উদ্বাস্তু বাঙ্গালিরা!পশ্চিম বাংলার সেই ইতিহাস নেই!ভারতের রাষ্ট্রপতি বাঙ্গালি ব্রাহ্মণ সন্তান, হিন্দুত্ভের সর্বোচ্চ ধর্মাধিকারি, চন্ডী পাঠ দিয়ে যার দিন শুরু হয় আর রাষ্ট্রপতি ভবনকে যিনি চন্ডীমন্ডপে পরিণত করেছেন!ভারতের রাজনীতিতে পশ্চিম বাংলার কর্তৃত্ব প্রবল!কিন্তু তাঁদের কেউই বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্বের দাবি তোলেন নি!উদ্বাস্তুদের নাগরিকত্ব কেড়ে নিতেই তাঁরা বরং সর্বদলীয় সম্মতিতে নাগরিকত্ব সংশোধন আইন পাশ করেছেন, চালূ করেছেন আধার যোজনা!বাংলার বাইরে বাঙ্গালিরা সংরক্ষণ থেকে বন্চিত!তাঁদের নাগরিকত্ব ওবং একমাত্র তাংদেরই নাগরিকত্ব সন্দিগ্দ্ধ!এই পশ্চিম বাংলায় সন্দিগ্দ্ধ নাগরিকত্বের অজুহাতে লাখো লাখো উদ্বাস্তুর নাম ভোটার লিস্ট থেকে কাটা হল , প্রতিবাদ হয়নি!তিন দশক ব্যাতীত দন্ডকারণ্য থেকে নির্বাচনী অঙ্কের খাতিরে ডেকে এনে বাঙ্গালি উদ্বাস্তুদের মরিচঝাঁপিতে কোতল করা হল!মায়েরা ধর্ষিতা হলেন!শিসুরা অনাথ হল!রক্তে ভিজে গেল মাটি!প্রবল ভাবে স্থানীয় রাজনীতিতে ক্ষমতার লঢ়াইয়ে আমরা ওরাঁয় দ্বিধা বিভক্ত নাগরিক সুশীল সমাজ তিন দশকেও মুখ খোলেনি!বাংলার বাইরে বাঙালিদের মাতৃভায়ার অধিকারের দাবিতে সরব হয়নি!তাঁরা মাত্র বাংলার বাইরে পাঁচ লক্ষ উদ্বাস্তু আছে, এই কথা বলে কোটি কোটি বাঙ্গালির অস্তিত্ব অস্বীকার করতেই অভ্যস্ত!একশো বছর যাদের ক্ষমতায়ন হয়নি, হুর্নীতি প্রসঙ্গে তাংদের কথা বলে বড় মুশকিলে ফেলে দিয়েছেন শাসক শ্রেনীকে সমাজবিজ্ঞানী আশিসনন্দী, তাই ঘটা করে জানিয়ে দিতে হল তিনি জাতে তেলী, নবশাঁখ! অর্থাত তাঁর কথাকে, তাঁর দেওয়া তথ্যকে গুরুত্ব দেওয়া হবে না!আজও রক্তে ভেসে যাচ্ছে জমিন!আজও লজ্জিত মানুষ!আজও ধর্ষিতা মায়েরা!কিন্তু এই বাংলায় কোনো লজ্জা লেখা হবে না! রোজ টিভি দেখতে ভয় হয়, আবার কোথায় রক্তপাত হল !আবার আাদেরই কে মারা পড়ল! কোন মেয়েটি াবার ধর্ষিতা হল!
আজও রক্তে ভেসে যাচ্ছে জমিন!আজও লজ্জিত মানুষ!আজও ধর্ষিতা মায়েরা!কিন্তু এই বাংলায় কোনো লজ্জা লেখা হবে না! রোজ টিভি দেখতে ভয় হয়, আবার কোথায় রক্তপাত হল !আবার আমাদেরই কে মারা পড়ল! কোন মেয়েটি আবার ধর্ষিতা হল!
যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে শাহবাগ এখন প্রতিবাদ
মুখর। হাজার হাজার তারুণ্যের প্রতিবাদ মুখর স্লোগানে
উত্তপ্ত ঢাকার শাহবাগ চত্বর। সবার কেবল একটাই দাবী
যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসিচাই। জাতিকে কলঙ্কমুক্ত করতে
চাই। পশ্চিম বাংলা ও বারতবর্ষের যুদ্ধ অপরাধীদের
বিরুদ্ধে আমরা কবে রাস্তায় নামতে পারব?
"সারাদেশে একাত্তরের চেতনার উত্তাল ঢেউ জেগেছে। জেগে উঠেছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। তাকে স্বাগত জানাই। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ নতুন প্রজন্ম জাতিকে আশাবাদী করেছে। যে কোনো মূল্যে এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে।"
গত পাঁচই ফেব্রুয়ারি মানবতাবিরোধী অপরাধে জামাতের নেতা আব্দুল কাদের মোল্লাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের নির্দেশ দেয় আদালত। এই রায় প্রত্যাখান করে আন্দোলনে নামে বাংলাদেশের যুব সমাজ। অন্যদিকে মঙ্গলবার ঢাকার রাজপথে মিছিল করে জামাতে ইসলামি। ট্রাইবুনাল ভেঙে দেওয়া ও আব্দুল কাদের মোল্লাসহ দোষীসাব্যস্ত নেতাদের মুক্তির দাবি জানায় তারা। এর পরেই পুলিসের সঙ্গে খণ্ডযুদ্ধ বেধে যায়। অশান্ত হয়ে ওঠে মতিঝিল, করওয়ান বাজার এলাকা।
তথাকথিত সুশীল সমাজের কুশীলবদের রক্ত কি হাড়হিম হয়ে গেল নাকি! উচ্ছিষ্ট ভোগী বুদ্ধিজীবীরা কোন থালায় কি চাটছেন এখন?
কালীঘাটের ক্যানভাসে ছবি আঁকার জন্য কতটা চুন আর কালি আছে যা বিক্রি করে শ্মশানের ল্যাম্পোস্টে রবীন্দ্রসংগীত বাজানো হবে?
দিদি প্রকাশ্যে পুলিশ কর্মীদের চাবকানোর হুমকি দিচ্ছেন। ভাইয়েরা পুলিশ খুন করে আনুগত্য দেখাচ্ছে।
আর কত মায়ের কোল খালি হবে? কতটা রক্তে পিছল হবে মাটি? বাংলার মানুষ আর কতটা লজ্জিত হবে?
একমাত্র তিনিই জানেন এর উত্তর। আমরা উত্তরটা তার কাছ থেকে পেতে চাই।
যুদ্ধ অপরাধীদের ফাঁসির দাবীতে স্লোগান দিচ্ছে দুই শিশু
Monday, February 11, 2013
আশিস নন্দী মহাশয়কে একটি খোলা চিঠি
Saradindu Uddipan
আশিস নন্দী মহাশয়কে একটি খোলা চিঠি
আপনাকে ধন্যবাদ আশিস নন্দী মহাশয়। ধন্যবাদ এই কারণে যে আপনি শাসক শ্রেণীর পক্ষ নিয়েও পশ্চিমবঙ্গের আর্থ সামাজিক বিকাশের প্রকৃত সত্যটি উন্মোচন করে দিয়েছেন। জয়পুর করপোরেট সাহিত্য উত্সবে "সংরক্ষন বিরোধী মঞ্চে" আপনি বলেছেন যে, ভারতবর্ষে দুর্নীতির জন্য দায়ী হল এসসি, এস টি ও ওবিসি মানুষেরা । ... গত একশো বছরে এসসি/এসটি ও ওবিসিরা পশ্চিমবঙ্গে শাসন ক্ষমতায় নেই তাই এখানে দুর্নীতি কম। অর্থাৎ আপনি পরিষ্কার করে উল্লেখ করেছেন যে,গত একশো বছর ধরে পশ্চিম বাংলায় এসসি/এসটি ও ওবিসিদের কোন আর্থ-সামাজিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন হয়নি। ক্ষমতায়ন হয়েছে এই ৩ ক্যাটেগোরির বাইরের মানুষদের। আপনাকে আরো ধন্যবাদ জানানো যেত যদি আপনি এই তালিকার সাথে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদেরও জুড়ে দিতেন। তবেই বাংলার বহুজনকে চিহ্নিত করতে আমাদের সুবিধা হত।
আপনার আলোচনা সূত্র ধরে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন এসে যায় যে, এই ৩ ক্যাটেগোরির বহুজন সমাজের বাইরের মানুষ কারা? এবং বাংলার আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে তাদের পরিচয় কি? বা অবস্থান কোথায়?
সেন্সাস, ২০০১ অনুশারে পশ্চিমবঙ্গে এসসি/এসটি ও ওবিসিদের জনসংখ্যাগত অবস্থান নিম্নরূপঃ
এসসি - মোট জনসংখ্যার- ২৩%
এসটি- মোট জনসংখ্যার- ৫.৫%
ওবিসি- মোট জনসংখ্যার- ৬০ % এর বেশী।
ব্রাহ্মণ - মোট জনসংখ্যার- ২ %
কায়স্থ/বদ্দি -মোট জনসংখ্যার- ৩%
অন্যান্য- মোট জনসংখ্যার- ৬.৫%
এখানে অন্যান্য জনসংখ্যার মধ্যে আছে ধর্মীয় সংখ্যালঘু এবং অবাঙ্গালী মানুষেরা। যাদের অধিকাংশই আপনার উল্লেখিত শাসক শ্রেনীর মানুষ নয়। অর্থাৎ নির্দ্বিধায় একথা বলা যায় যে,পশ্চিমবঙ্গের ৯৫% মূলনিবাসী বহুজন বাঙালীর ১০০ বছরের মধ্যে কোন ক্ষমতায়ণ হয়নি। ক্ষমতায়ণ হয়েছে মাত্র ৫% মানুষের, যারা ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে অবঙ্গীয়। হয় তারা আনিত,নতুবা অনুপ্রবেশকারী অথবা বহিরাগত। তাই আপনার কথিত ১০০ বছর নয়, বরং পাল যুগ অবসানের পরবর্তী কাল থেকে বাংলার মূলনিবাসী বহুজন কতিপয় অবাঙ্গালী শোষকদের কাছে পদানত,শৃঙ্খলিত অপমানিত।
এখন প্রশ্ন হল, আপনি কোন মাপক শলাকায় জরিপ করে দাবী করলেন যে,বাংলায় অবঙ্গীয় শাসকদের সুশাসনে দুর্নীতি কম। এবং এই অবঙ্গীয়দের সুশাসনে বাংলার মূলনিবাসীরা দুধে-ভাতে প্রতিপালিত হচ্ছে। তাদের সন্তানেরা অপুষ্টি নিয়ে জন্মাচ্ছে না। মহিলারা অ্যানিমিয়াতে ভুগছে না। তাদের সন্তানেরা সুশিক্ষিত উঠছে। এবং অধিকাধিক সুযোগ পেয়ে বাংলাকে শ্মশান থেকে তুলে এনে সোনার বাংলায় রূপায়িত করে ফেলেছে।
আপনি কি বোঝাতে চাইছেন যে, অবঙ্গীয় শাসকেরা যেহেতু মূলনিবাসীদের কাঙ্খিত ক্ষমতায়ানের সব কলস ভর্তি করে দিচ্ছে তাই মূলনিবাসীদের রাজনৈতিক ক্ষমতায়ানের কোন প্রয়োজন নেই। তেলা মাথায় বেশী করে তেল ঢাললে সে তেল গড়িয়ে গড়িয়ে পায়ের তলার ধুলোকেও ভিজিয়ে দেবে। এতেই অনায়াশে ভর্তি হয়ে যাবে প্রান্তজনের পেট। কি দরকার এত কিছু বুঝে? কি দরকার এত মাথাব্যাথার। বরং তারা সুশাসনের সুবাতাস নিয়ে মিলেনিয়াম, বিলেনিয়াম, সান সিটি বা ফ্যান সিটিতে ঘুরে বেড়াক। জল-জঙ্গল -জমি বেঁচে দিক। চাষবাসের মত আদিম বৃত্তি ছেড়ে দিয়ে ন্যানো,ফিয়াট বা স্কর্পিওর চাকায় হাওয়া দিক।
রাস্তার পাশে দোকান খুলে বসুক। পিঁয়াজি, ফুলুরি মায় চাউমিন বিক্রি করুক । গ্রামের মেয়েগুলো ঘুঁটে গোবরের আল্পনা ছেড়ে বিউটিপার্লার আর ম্যাসাজ সেন্টারে গিয়ে ট্রেনিং নিক। রাতের বেলা ব্রথেল গুলোতে অতিথিদের আপ্যায়ন করতে শিখুক। উন্নয়নের এটাইতো গতিমুখ। সেটাই যখন তড়িৎ গতিতে তরান্বিত হচ্ছে, তখন মুলনিবাসীদের আলাদা সংরক্ষণ আলাদা করে ক্ষমতায়ানের কোন দরকার নেই!
ধন্য আপনি আশিস নন্দী মহাশয়। ব্রাহ্মন্যবাদীদের সাথে জলচলের সহবস্থানে আপনার এ অমোঘ পরিণতিতে আমরা বিস্মিত নই। বরং এটাই কঙ্খিত। কেননা প্রসাদান্ন ভোগ করা ভৃত্যের কাছে প্রভুর মাহাত্ব কীর্তন নতুন কিছু নয়। দাসত্বের এ এক পুরাতনী বিধান। যেটা আপনি স্বভক্তি তা পালন করেছেন। আপনার মঙ্গল ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।
আমি জানিনা আপনার সমাজতত্ত্বের বিনম্র অধ্যায়নে ইতিহাসের কতটা মূল্য আছে। শোষণ শাসনের কোন নীতি শ্রম এবং উৎপাদক শ্রেণির কাছ থেকে তাদের জীবন-জীবিকা,আত্মপরিচয়,মান-মর্যাদা কেড়ে নিয়ে তাদের অপাঙ্কতেয়,অশুচি করে দেয় তা আপনার আভিধানিক শব্দ সঞ্চয়নের মধ্যে আছে কিনা।
আপনি হয়তো জেনে থাকবেন যে ১৯০৬ সালে মহাত্মা গুরুচাঁদের নেতৃত্বে বাংলা এবং আসামের লেপ্টেন্যান্ট ল্যান্সল টের কাছে একটি তালিকা দিয়ে বাংলার দলিত জাতিসমূহের জন্য ভাগিদারী দাবী করা হয়। সেই তালিকায় বাংলার চন্ডাল সহ যে ৩১ টি জাতির নাম দেওয়া হয়েছিল সেখানে আপনার জাতি তিলি-নবশাখ তালিকা ভুক্ত ছিল। ১৯০৭ সালে আসাম বাংলার জন্য এই আইন কার্যকরী হয়। নেটিভরা শিক্ষা, চাকরী ও রাজকার্যে ভাগিদারী পায়। ১৯০৯ সালের মর্লি মিন্টো সংস্কার আইনে গুরচাঁদের দেখানো এই পথ সারা ভারতবর্ষের জন্য স্বীকার করে নেওয়া হয় এবং ১৯১৯ সালের মন্টেগু চেমস ফোরডের ভারত শাসন আইনে সমগ্র ভারতের জন্য তা কার্যকরী হয়। অর্থাৎ আপনার পূর্ব পুরুষদের শিক্ষা সম্ভব হয়েছিল সংরক্ষণ আইনের জন্যই। আর আপনার এপর্যন্ত অর্জিত সমস্ত সুখ্যাতির প্রতিটি পালকের গোড়া ছিল সংরক্ষিত। কিন্তু,আপনি এখন সংরক্ষণ বিরোধী মঞ্চের প্রধান প্রবক্তা।
বেশ বেশ!
সমগ্র মূলনিবাসীরা আপনাকে দেখে নিয়েছে! যা বোঝার বুঝে নিয়েছে। যা করবার করেছে। কিন্তু আমরা এখনো অনেক উত্তর আপনার কাছ থেকে পাইনি।
আপনি কি আমাদের বুঝিয়ে বলবেন,কোন সুশাসনের কল্যাণে মূলনিবাসীদের সমস্ত সম্পদ, স্থাবর-অস্থাবর,জল-জঙ্গল-জমি মুষ্টিমেয় অবঙ্গীয় শাসকদের হাতে পুঞ্জিভুত হয়? শ্রম এবং উৎপাদক শ্রেণীর পেটের উপর পা দিয়ে পরগাছা, পরভোগীদের স্বেচ্ছাচারের ইমারৎ ওঠে। এবং এই প্রক্রিয়াকে সুশাসন বলে মহিমান্বিত করার জন্য আপনার মত একজন জলচল শূদ্রকে ময়দানে নামানো হয়। সময় পেলে বলবেন। অন্য কোথাও। অন্যখানে। আমরা মূলনিবাসী বঙ্গবাসী এসসি/এস টি,ওবিসি সমাজ আপনাকে গৌড়ীয় সুধা পান করতে দেখে ধন্য হব।
ধন্যবাদান্তে
শরদিন্দু উদ্দীপন
সোনারপুর, কোলকাতা-৭০০১৫০
Posted by Palash Biswas at 10:26 PM
http://www.thebengalitimes.com/details.php?val=1036&pub_no=0&menu_id=7
একুশ মানে মাথা নত না করা । একুশ মানে এগিয়ে চলা। এবার কানাডাতে বেশ কয়েকটি একুশের অনুষ্ঠান হয়েছে। কেবল টরন্টো শহরেই ছিলো তিনটি শহীদ মিনার। এমনকি সাসকাচিওয়ানের রেজিনাতে, যেখানে বাঙালির সংখ্যা হাতে গোণা সেখানেও এবার পালিত হয়েছে একুশ। নির্মাণ করা হয়েছে শহীদ মিনার। প্রতিবছর ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমরা ব্যস্ত হয়ে পড়ি অনুষ্ঠান আর শহীদ মিনার নিয়ে। আর বাকিটা সময়? এসব বিষয় নিয়ে ভাববার সময়ও যেনো নেই আমাদের । একুশের অনুষ্ঠানে পাজামা পাঞ্জাবী পড়ে যিনি ভাষা নিয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করছেন তার বাড়িতেই কী বাংলা ভাষার চর্চা হচ্ছে? তার ছেলে মেয়ে কী বাংলায় কথা বলতে বা লিখতে পারে ? এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের সকলের জানা । বাংলা ভাষাটাই যদি বেচেঁ না থাকে তাহলে একুশ পালন করে লাভটা কী? এটাতো ভাষা শহীদদের সাথে আরেকদফা প্রহসন। তাই আসুন নিজে শুদ্ধ বাংলা শিখি, সন্তানকে বাংলা পড়তে ও লিখতে শেখাই। তারপরও একটি কথা না বললেই নয়। প্রবাসে শত সীমাবদ্ধতার মাঝে যারা একুশের নানা আয়োজনে যুক্ত ছিলেন তাদের প্রতিও আমাদের কৃতজ্ঞতা। এসব উদ্যোগ এক সময় একটি বিন্দুতে মিলিত হবে সেই আশায় এখন আমরাও।
প্রিয় পাঠক! ভালো থাকুন। বেঙ্গলি টাইমসের সাথেই থাকুন।
একুশ আমাদের অহংকার!
যে ভাষার জন্যে ভাইয়েরা রাজপথে রক্ত দিলো সেই ভাষাটাকে সন্তানদের মুখে তুলে দিতে এতো অনীহা কেনো?
বাপি কর্মকার, কলকাতা, ২২ ফেব্রুয়ারি
গত ২১ ফেব্রুয়ারি 'অক্ষয় লাইব্রেরি'র উদ্যোগে দক্ষিণ কলকাতার হরিদেবপুরের বিবেকানন্দ স্পোর্টিং ক্লাব সংলগ্ন জমিতে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করা হয়েছিল। প্রদর্শনীর বিষয়বস্তু ছিল আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ জুড়ে জোর করে ঊর্দু ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে জন আন্দোলন এবং ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের কাছাড়ে বাংলা ভাষার পক্ষে মানুষের আন্দোলনের কথা উল্লেখ করা হয় প্রদর্শিত মাতৃভাষা কালপঞ্জিতে। সঙ্গে ছিল ছাত্রছাত্রীদের আঁকা মাতৃভাষার পক্ষে বিভিন্ন ছবি। এইসব আন্দোলনের ওপর রাষ্ট্রীয় নির্যাতনে শহীদদের স্মরণ করা হয়।
ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয় ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিষয় ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ে বাংলায় পরীক্ষা দেওয়া যাবে না, এই তুঘলকি ফরমানের উল্লেখ করে এবং তার বিরোধিতা করে পোস্টারও ছিল এই প্রদর্শনীতে। ছাত্রছাত্রীরা ছাড়াও অক্ষয় লাইব্রেরির সঙ্গে যুক্ত কিছু চাকুরিজীবীও এই প্রদর্শনীতে অংশ নেয়।
https://sites.google.com/site/songbadmanthan/1march2011thirteen
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা
ফেব্রু. 06 দক্ষিণ এশিয়া, বিশ্ব সংবাদ, ভারত, সংবাদ no comments
সূত্র:ভাষার জন্য শহীদ হওয়া যায়, এই আলোকিত মৃত্যুর অহংকারও ঐশ্বর্যের ভাষার জন্য প্রাণ দিতে শেখায়। বায়ান্নর বাংলাদেশ ভাষা-দমনে পীড়িত ও ক্ষুব্ধ সবাইকে উজ্জীবিত করেছে। বাংলাদেশের কাছের প্রতিবেশী ভারতের আসাম রাজ্যের বাঙালিরাও বাংলা ভাষার জন্য অকাতরে জীবন দিয়েছেন, একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২-এর মতোই তাঁদের রক্তে সিক্ত হয়েছে ১৯ মে ১৯৬১।
শুরুতেই দ্বৈত ট্র্যাজেডির শিকার শিলচর। অবিভক্ত বাংলায় শিলচর সিলেট জেলারই অংশ ছিল। একসময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা আসামের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। অস্থিতিশীলতার শুরু তখন থেকেই। তারপর আবার সাতচল্লিশের বিভাজনের সময় চারটি মহকুমাকে সুরমা ভ্যালি থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার পূর্ব বাংলায় অঙ্গীভূত করা হয়। রয়ে যাওয়া খণ্ডিত অংশের অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যায়। বাঙালিরা সেখানে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে।
সেদিন মধ্যাহ্নে রাজ্যটির কাছাড় জেলার শিলচরে ক্ষুব্ধ ভাষা আন্দোলনকারীদের ওপর পুলিশ ও সেনাবাহিনী গুলি চালায়; মৃত্যুমুখে ঢলে পড়েন ১১ জন ভাষাসৈনিক—শচীন্দ্র পাল, হীতেশ বিশ্বাস, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দেব, সত্যেন্দ্র দেব, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, বীরেন্দ্র সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, সুনীল সরকার এবং একজন তরুণী—কমলা ভট্টাচার্য।
তাঁদের মিছিলের কথা ছিল—জান দেব, জবান দেব না। 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো' গানের মতোই শহীদ ১১ ভাইবোনকে নিয়ে হূদয়ছোঁয়া কবিতা রচনা করেছেন শক্তিপদ ব্রহ্মচারী:
দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন
কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল 'এই যে ঈশান কোণ—
কোন ভাষাতে হাসে-কাঁদে কান পেতে তা শোন'
শুনলি না? তো এবার এসে কুচক্রীদের ছা—
তিরিশ লাখের কণ্ঠভেদী আওয়াজ শুনে যা—
'বাংলা আমার মাতৃভাষা, ঈশান বাংলা মা।'
(চন্দ্রিমা দত্তের 'আসামে বাংলা ভাষা সংগ্রামের ৫০ বছর' থেকে উদ্ধৃত)
শুরুতেই দ্বৈত ট্র্যাজেডির শিকার শিলচর। অবিভক্ত বাংলায় শিলচর সিলেট জেলারই অংশ ছিল। একসময় বাংলা থেকে বিচ্ছিন্ন করে তা আসামের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া হয়। অস্থিতিশীলতার শুরু তখন থেকেই। তারপর আবার সাতচল্লিশের বিভাজনের সময় চারটি মহকুমাকে সুরমা ভ্যালি থেকে বিচ্ছিন্ন করে আবার পূর্ব বাংলায় অঙ্গীভূত করা হয়। রয়ে যাওয়া খণ্ডিত অংশের অস্থিতিশীলতা আরও বেড়ে যায়। বাঙালিরা সেখানে নিজ ভূমিতে পরবাসী হয়ে পড়ে। কাছাড়, করিমগঞ্জ ও হাইলাকান্দি জেলা নিয়ে গঠিত হয় বরাক ভ্যালি। সাতচল্লিশের খেয়ালি ভাঙাগড়া অসমিয়া জাতীয়তাকে উসকে দেয়; রব ওঠে—আসাম কেবল আসামিদের। তখন বাঙালি তাড়ানোর সহিংস আন্দোলনও প্রশ্রয় পেয়ে যায়।
একসময় অসমিয়া রাজ্যের স্বীকৃত ভাষা হিসেবে রাজ্যভাষা নাম পেয়ে যায় আসামিজ, বাংলা হয়ে পড়ে উপেক্ষিত জনের ভাষা। ক্রমে আসামের রাজ্যসীমায় জন্মগ্রহণকারী ও বসবাসকারী বাংলা ভাষাভাষী সবাই নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে শুরু করে। তাদের ওপর শারীরিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো হতে থাকে। স্বাধীনতা-উত্তর আদমশুমারিতে বাঙালির সংখ্যার অবিশ্বাস্য হ্রাস ও অসমিয়ার সংখ্যার অবিশ্বাস্য বৃদ্ধি দেখিয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের আরও প্রান্তবর্তী জনগোষ্ঠীতে পরিণত করা হয়। সমঝোতা হয়নি। ১৯৪৮ সালে এই দুই জবানের মানুষের মধ্যে দাঙ্গা হয়। পূর্ব বাংলার বাঙালিরা যেমন উর্দুকে, আসামের বাঙালিরাও তেমন অসমিয়া ভাষাকে প্রত্যাখ্যান করে।
১৯৬০ সালে বাংলাকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে। তবে আন্দোলনকারীদের স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দেওয়া হয়, অসমিয়াই একমাত্র রাজ্যভাষা, বাংলার স্বীকৃত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বাধ্যতামূলক অসমিয়া শিক্ষার ফরমান জারি হওয়ার পর মরিয়া হয়ে ওঠে বাঙালিরা। শিলচরের গান্ধীবাগে ১৯৬০-এর ২-৩ জুলাই দুই দিনের 'নিখিল আসাম বাংলা সম্মেলন' আহ্বান করা হয়। এর মধ্য দিয়ে অভূতপূর্ব একটি গণজাগরণ তৈরি হয়। তখন ভারতের অন্যান্য স্থানে হিন্দি-বিরোধী অসন্তোষ ও আন্দোলন দানা বাঁধছে। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন শুরু হয় ভয়াবহ দাঙ্গা। এই প্রেক্ষাপটেই অসমিয়াকে পাকাপাকিভাবে রাজ্যভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য তোলা বিল ২৪ অক্টোবর পাস হয়।
আসামের দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া বাঙালিরা তারপর মরণকামড় দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। শুরু হয় ব্যাপক আন্দোলন এবং অন্যদিকে সহিংস প্রতিরোধ। '৬১ সালের ১৯ মে ডাকা হয় হরতাল। প্রতিরোধে নামে সেনাবাহিনী ও পুলিশ। তাদের গুলিতে শিলচর রেলস্টেশনে লুটিয়ে পড়েন ১১ জন ভাষাসংগ্রামী।
১৯৬৬ সালে বাংলা সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃত হয়—বরাক ভ্যালির কাছাড়ে অসমিয়া ও বাংলা এখন সমমর্যাদায়। ১৯৮৬ সালে আবার উচ্চশিক্ষার ভাষা হিসেবে কেবল অসমিয়াকে প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নেওয়া হলে নতুন আন্দোলন শুরু হয়।
বাঙালিরা চেয়েছে শিলচর স্টেশনের নাম হোক 'ভাষাশহীদ রেলওয়ে স্টেশন'। কিন্তু রেলওয়ে যেহেতু কেন্দ্রীয় সরকারের, রাজ্য সরকারের নয়; নতুন নামকরণে বাধা আসারই কথা।
ভাষার জন্য একসঙ্গে ১১টি মৃত্যুর নজির আর নেই।
http://www.bdtodaynews.com/%E0%A6%A4%E0%A6%BF%E0%A6%B0%E0%A6%BF%E0%A6%B6-%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%96%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%A3%E0%A7%8D%E0%A6%A0%E0%A6%AD%E0%A7%87%E0%A6%A6%E0%A7%80-%E0%A6%86%E0%A6%93%E0%A7%9F/
বরাক উপত্যকার বাঙালি ভাষাশহীদদেরও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি
লিখেছেন: রেজাউল করিম সুমন | ২১ ফেব্রুয়ারি ২০১০, রবিবার | ৯ ফাল্গুন ১৪১৬
বিষয়: আন্দোলন, ইতিহাস, উদযাপন, প্রতিরোধ, বিশেষ দিন, বৈষম্য, ভারত, ভাষা, শ্রদ্ধাঞ্জলি | ইমেইল / প্রিন্ট:
আসামের বাঙালিরা মাতৃভাষা বাংলাকে অন্যতর রাজ্যভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দানের দাবিতে দীর্ঘদিন আন্দোলন-সংগ্রাম করেছেন, শহীদ হয়েছেন — আমরা অনেকেই তাঁদের আত্মাহুতির কথা মনে রাখি না। বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও ভাষাশহীদদের পরিচিতি তুলে ধরার জন্য দুটি লেখা এখানে সংকলন করা হলো। অধ্যাপক মাহবুবুল হক ও প্রয়াত সাংবাদিক মুহম্মদ ইদ্রিসের এ প্রবন্ধ দুটি ছাপা হয়েছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা কর্তৃক প্রকাশিত সংকলন মাতৃভাষা-য়। সংকলনটির প্রকাশকাল : ১৮ বৈশাখ ১৪০৯, ১ মে ২০০২; সম্পাদক : আমীর রিদয়; সার্বিক তত্ত্বাবধানে ছিলেন ডা. শুভার্থী কর। শুভার্থী নিজে বরাক উপত্যকা থেকে ঘুরে এসেছিলেন; তাঁর উদ্যোগেই বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি ও একষট্টির উনিশে মে-র দুই স্বতন্ত্র ভাষা আন্দোলনকে একই সঙ্গে যথাযোগ্য মর্যাদায় উপস্থাপন করে প্রকাশিত হয়েছিল মাতৃভাষা নামের সংকলনটি। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বরাক উপত্যকার বাংলা ভাষা আন্দোলন নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে তথ্যসমৃদ্ধ স্বতন্ত্র গ্রন্থও প্রকাশিত হয়েছে।
. . .
ভাষার লড়াই : বরাক উপত্যকায়
মাহবুবুল হক
১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলায় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যে ভাষা আন্দোলন হয়েছিল সে আন্দোলনের কথা বাংলাদেশের জনগণের মনে চির জাগরূক হয়ে আছে। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলনের নয় বছর পরে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আর একটি আন্দোলন হয়েছিল আসামের বরাক উপত্যকায়, সে কথা আমরা অনেকেই হয়তো জানি না। কিন্তু সে আন্দোলনে রক্ত ঝরেছিল। বাঙালির আত্মপরিচয় ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সেখানেও শহীদ হয়েছিল এগারোটি তাজা প্রাণ।
পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন এবং বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের মধ্যে একাধিক ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় অভিন্নতা। প্রথমত, দুটি আন্দোলনই সংগঠিত হয়েছিল বাংলা ভাষার উপর অন্য ভাষার ভাষিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। দ্বিতীয়ত, দুটি আন্দোলনেই দলমত-ধর্ম-সম্প্রদায় নির্বিশেষে দুই ভূখণ্ডের বাঙালি জনগোষ্ঠী প্রতিবাদী সংগ্রামে অংশ নিয়ে আত্মদান করেছিল অধিকার আদায় করতে গিয়ে। অন্যদিকে এ দুই আন্দোলনের মধ্যে আলাদা বিশিষ্টতাও ছিল। পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষীর (৫৬%) উপর পাকিস্তান শাসকগোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া সংখ্যালঘিষ্ঠ (৭%) ভাষা উর্দুর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। অন্যদিকে আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন ছিল সংখ্যালঘিষ্ঠ বাঙালির ভাষা অধিকার খর্ব করে তাদের ওপর সংখ্যাগরিষ্ঠের অসমিয়াকে চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে।
বরাক উপত্যকায় বসবাসরত বাঙালির যে ভাষা আন্দোলন তা আকস্মিক কোনো ঘটনা ছিল না। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের মতোই তা দানা বাঁধতে শুরু করেছিল দেশবিভাগের সময় থেকে। অবশ্য সে প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্নতর।
১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষকে দ্বিধাবিভক্ত করে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করার সময়ে শ্রীহট্টের অঙ্গচ্ছেদ ঘটিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত সিলেট জেলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হয়। তখন প্রায় তিন লক্ষ চা-বাগান শ্রমিক — যাদের অধিকাংশই হিন্দু — আসামে আশ্রয় নেয়। অনেক অবস্থাপন্ন হিন্দু পরিবার সিলেট ছেড়ে আসামে উদ্বাস্তু হয়। এই সব বাঙালি আসামে হয়ে পড়ে সংখ্যালঘু। স্বাধীন ভারতে বহু জাতি ও বহু ভাষাগোষ্ঠী অধ্যুষিত আসাম রাজ্যে বাঙালিকে বিদেশী এবং বহিরাগত রূপে চিহ্নিত করার হীন অপপ্রয়াস শুরু হয়। আসামের প্রতি বাঙালিদের আনুগত্য নিয়ে সংশয়, সন্দেহ ও প্রশ্ন উত্থাপিত হতে থাকে মহল বিশেষের উদ্যোগে প্ররোচনায়। এমনকি, অসমিয়া ভাষা ও সংস্কৃতির বিকাশের ক্ষেত্রে বাঙালির ভাষা ও সংস্কৃতিকে অন্তরায় হিসেবে গণ্য করা হতে থাকে। 'আসাম শুধু অসমিয়াদের জন্য' এই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদকে উস্কে দিয়ে সেখানে বাঙালির অধিকার হরণের জন্য নিরন্তর প্রচেষ্টা চলতে থাকে। শুরু হয় বাঙালি অধ্যুষিত এলাকাগুলিকে সুপরিকল্পিতভাবে অসমিয়াকরণের প্রয়াস। বাংলা মাধ্যমের স্কুলগুলোতে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে অসমিয়া ভাষা প্রবর্তনের নির্দেশ দেওয়া হয় এবং অন্যথায় তাদের অনুদান বন্ধের পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ফলে ১৯৪৭ থেকে ১৯৫১-র মধ্যে সেখানে ২৫০টি বাংলা মাধ্যমের স্কুলের মধ্যে ২৪৭টিই বন্ধ হয়ে যায়। এককথায় ভারতের স্বাধীনতার পর থেকে ভাষা, শিক্ষা, নিয়োগ, এমনকি ভূমি বণ্টন ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে আসাম সরকারের নীতি-অবস্থান হয়ে দাঁড়ায় বাস্তবে অনসমিয়া তথা বাঙালি জনগোষ্ঠীর প্রতি উপেক্ষা, বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক। এই প্রেক্ষাপটেই সমগ্র ব্রহ্মপুত্র এলাকায় শুরু হয় ভাষিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসন এবং সেই সঙ্গে উৎপীড়ন ও দাঙ্গা।
আসামের বিধানসভাতেও অসমিয়াকরণের প্রচেষ্টা শুরু হয় ভারতের স্বাধীনতা লাভের পর থেকে। ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত বিধানসভায় অনসমিয়াদের বেলায় বাংলা, ইংরেজি কিংবা হিন্দি ভাষায় বক্তব্য উপস্থাপনের বিধান ছিল। ঐ বছর নতুন আইন পাশ করে তা কেড়ে নেওয়া হয়। ঐ আইনে বলা হয় : 'The business of the House shall be transacted in Assamese or in English.' তবে ঐ বিধানে তখনও অধ্যক্ষের অনুমতিক্রমে মাতৃভাষায় বক্তব্য পেশের সুযোগ ছিল। কিন্তু ১৯৫৪ সালে বিধানসভায় একমাত্র অসমিয়াকে রাজ্যের ভাষা হিসাব গ্রহণ করার জন্য প্রস্তাব উত্থাপিত হলে তাতে আসাম রাজ্যের সর্বত্র অনসমিয়া ভাষীদের মধ্যে বিতর্ক ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। অবশ্য বেসরকারিভাবে উত্থাপিত ঐ প্রস্তাব তখন বিবেচনা না করে স্থগিত রাখা হয়।
ভাষা আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে ১৯৬০-এর এপ্রিলে। ২১ ও ২২ এপ্রিল আসাম প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির এক সভায় অসমিয়াকে আসামের একমাত্র ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপিত হয়। এর পর পরই আসাম প্রদেশের শাসকবর্গ উগ্র ভাষাপ্রেমের পক্ষে অবস্থান নেন এবং অসমিয়াকে রাজ্যের একমাত্র সরকারি ভাষা করার অপচেষ্টায় সক্রিয় তৎপরতা শুরু করেন। এর ফলে অনসমিয়া বিশেষত বাংলা ভাষাভাষী বাঙালিদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া ও উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষা এবং সরকারি দ্বিতীয় ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি আদায়ের লক্ষ্যে ২১ জুন ১৯৬০ শিলচরে 'নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন'-এর উদ্যোগে এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। লোকসভা সদস্য শ্রীদ্বারিকানাথ তেওয়ারীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ঐ সভায় আলতাফ হোসেন মজুমদার, নন্দকিশোর সিংহ, নিবারণচন্দ্র লস্কর, রথীন্দ্রনাথ সেন, গোলাম ছগির খান, শরৎচন্দ্রনাথ বসু প্রমুখ বিশিষ্ট জনপ্রতিনিধি ও নেতৃবৃন্দ গভীর ক্ষোভ ও উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং প্রতিবাদ জানান। সভায় অসমিয়াকে রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে বাঙালিদের উপর হামলা ও নির্যাতনের প্রতিবাদ করা হয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার আন্দোলনকে সংহত রূপ দেওয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে ২ ও ৩ জুলাই ১৯৬০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় 'নিখিল আসাম বাঙ্গালা ভাষা সম্মেলন'। এই সম্মেলনে আসাম রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে পঁচিশ হাজার নরনারী সমবেত হয়। বিভিন্ন জাতি, উপজাতি ও গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্বমূলক অংশগ্রহণের মাধ্যমে সম্মেলন পরিণত হয় মহাসম্মেলনে। সভায় আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে একমাত্র অসমিয়ার প্রবর্তন স্থগিত রেখে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার আহ্বান জানানো হয়।
এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হওয়ার পর পরই সমগ্র ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাব্যাপী শুরু হয় দাঙ্গা হাঙ্গামা। অসমিয়াপন্থী উগ্র দাঙ্গাবাজরা পথে নামে। নির্বিচারে বহু বাঙালির বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। লুঠতরাজ, হত্যা ও ধর্ষণ চলে অসমিয়া ভাষা আন্দোলনের নামে। ক্ষমতাসীন কংগ্রেস নেতৃত্ব এতে পরোক্ষভাবে মদত জোগায়। যদিও কংগ্রেসের সবার এতে সমর্থন ছিল না। প্রশাসনের এক শ্রেণীর উগ্র জাতীয়তাবাদী কর্তাব্যক্তি ও পুলিশ কর্মকর্তা এসব ঘটনায় নেপথ্যে ইন্ধন জোগান।
১০ অক্টোবর আসাম বিধান পরিষদে আসাম সরকারি রাজ্যভাষা বিল উত্থাপন করা হয়। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত এ বিল নিয়ে আলোচনা চলে। ২৪ অক্টোবর সকল সংশোধনী প্রস্তাব, অনুরোধ-নিবেদন উপেক্ষা করে রাজ্যভাষা বিল চূড়ান্তভাবে গৃহীত হয়। এভাবে আসামের বিভিন্ন অসমিয়া উপজাতি গোষ্ঠী ও দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার দাবি উপেক্ষিত ও অস্বীকৃত হয়। এর প্রতিবাদে অনেক সংসদ সদস্য সভাকক্ষ ত্যাগ করেন। মাতৃভাষার অধিকার বঞ্চিত লক্ষ লক্ষ মানুষ ক্ষোভে, দুঃখে, উত্তেজনায় ফেটে পড়ে। ১৯৬০-এর ৬ ও ৯ নভেম্বর নিখিল আসাম বঙ্গ ভাষাভাষী সম্মেলনের উদ্যোগে কনভেনশন আহ্বান করা হয়। কনভেনশন সংবিধান স্বীকৃত ভাষা-অধিকার সুরক্ষা করা ও মাতৃভাষার স্বীকৃতি আদায় সহ বিভিন্ন দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয়।
বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন ক্রমেই সংহত রূপ নিতে থাকে। ১৯৬০-এর ১৮-২০ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় উপত্যকা তথা বরাক উপত্যকার বাঙালি নাথ যুগী সম্প্রদায়ের ৩৬তম বার্ষিক অধিবেশন। ঐ অধিবেশনে বাংলা ভাষাকে অসমিয়া ভাষার মতো সরকারি মর্যাদা দেওয়া না হলে বাঙালি ও বাংলা ভাষাভাষী অধ্যুষিত অঞ্চল আসাম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ব্যক্ত করা হয়। ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬১ করিমগঞ্জে অনুষ্ঠিত হয় কাছাড় জেলা জনসম্মেলন। সম্মেলনে বাংলা ভাষাকে আসামের অন্যতম রাজ্যভাষা করার দাবি তোলা হয়। অন্যথায় সমগ্র জেলায় অসহযোগ আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৪ এপ্রিল ১৯৬১ নববর্ষের দিনে কাছাড় জেলা গণসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে পালিত হয় 'সংকল্প দিবস'। সংকল্প করা হয় মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার। এই সংকল্প বাস্তবায়নের কার্যক্রম হিসাবে ১৯ এপ্রিল থেকে শুরু হয় পদযাত্রা। দুই সপ্তাহ ধরে পদযাত্রীরা ২২৫ মাইল পথ অতিক্রম করেন। গ্রামে গ্রামে বাংলা ভাষা আন্দোলনের পক্ষে প্রচার চালান। ২ মে তাঁরা করিমগঞ্জে এসে পৌঁছলে তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
১৯ মে ভাষা আন্দোলনের অংশ হিসাবে কাছাড় জেলার সর্বত্র হরতাল পালিত হয়। আগের রাতে করিমগঞ্জে সংগ্রাম পরিষদের কার্যালয়ে চলে পুলিশি হামলা। আন্দোলন ঠেকাতে বিভিন্ন জায়গা থেকে গ্রেফতার করা হয় অনেক নেতা-কর্মীকে। সে খবর দাবানলের মতো রাতেই ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। শহর জেগে ওঠে উত্তেজনায়। ১৪৪ ধারা উপেক্ষা করে জনতা নামে রাজপথে।
১৯ মে ভোর চারটায় শিলচর রেল স্টেশনে শুরু হয় সত্যাগ্রহীদের অবরোধ। জেলার সর্বত্র একই সময় থেকে সর্বাত্মক ধর্মঘট কর্মসূচি পালিত হতে থাকে। দোকানপাট যানবাহন চলাচল বন্ধ থাকে। কোর্ট-কাছারি, ডাকঘর, অফিস-আদালত সব কার্যালয়ের সামনে চলে পিকেটিং। গ্রেফতার বরণ করেন হাজার হাজার কর্মী।
আন্দোলনের ব্যাপকতা দেখে শাসকগোষ্ঠী মাথা ঠিক রাখতে পারেনি। ভাষা আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য তারা বেছে নেয় চরম নির্যাতনের পথ। ঐ দিন দুপুর আড়াইটায় শিলচর রেল স্টেশনে তারা ধর্মঘটরত জনতার উপর নির্বিচারে গুলি চালায়। শত শত লোক আহত হয়। গুলিতে শহীদ হন ১১ জন। এঁরা হলেন : শচীন্দ্র পাল, কানাই নিয়োগী, কমলা ভট্টাচার্য, সুনীল সরকার, সুকোমল পুরকায়স্থ, কুমুদ দাস, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, তরণী দেবনাথ, হীতেশ বিশ্বাস, বীরেন্দ্র সূত্রধর ও সত্যেন্দ্র দেব।
১৯৫২ সালে পূর্ব বাংলার পাকিস্তানে শাসকগোষ্ঠীর উগ্র ভাষানীতির মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য যেমন করে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার [প্রমুখ], তেমনিভাবে ভাষা আন্দোলনের আর এক ইতিহাস রচিত হল বরাক উপত্যকায়। তাতে খচিত হল ১১ জন শহীদের নাম।
এই ঘটনায় সারা ভারত তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়। প্রতিক্রিয়া হয় পূর্ব বাংলায়ও। ২১ মে শিলচর সহ সমগ্র কাছাড় জেলায় রেলকর্মীরা কর্মবিরতি পালন করেন। শিলংয়ে বিভিন্ন শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন শোক পালন করে। শোক পালিত হয় জলপাইগুড়িতে। কলকাতায় তীব্র প্রতিবাদ ওঠে সভা, সমিতি, মিছিলে। শহীদ স্মরণে শোক ও শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করা হয়। ২৩ মে গৌহাটি, শিলং, জাফলং, আইজল ও আগরতলায় পালিত হয় প্রতিবাদ দিবস। বিভিন্ন বাম দল সম্মিলিতভাবে ২৪ মে সমগ্র পশ্চিমবঙ্গে পালন করে প্রতিবাদ দিবস। ২৪ মে বরাকের বুকে বিশ হাজার সত্যাগ্রহী আসাম সরকারের বিদ্বেষনীতির বিরুদ্ধে আমরণ সত্যাগ্রহের শপথ নেয়। ২৬ মে ঈদ উৎসবের দিন বরাক উপত্যকার সর্বত্র ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা বুকে কালো ব্যাজ ধারণ করে হত্যাকাণ্ডের নীরব প্রতিবাদে সামিল হয়। ২৯ মে পালিত হয় ভাষা শহীদ তর্পণ দিবস। শহীদের চিতাভস্ম নিয়ে অজস্র জনতা সামিল হয় মৌনমিছিলে।
. . .
একুশে ফেব্রুয়ারি ও বরাক উপত্যকার ভাষা শহীদ
মুহম্মদ ইদ্রিস
একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশের চেতনা আন্তর্জাতিকীকরণের আবেগে আমরাও আপ্লুত। কিন্তু আমাদের এই ভূখণ্ডের বাইরে প্রতিবেশী ভারতে আসামের বাংলাভাষী অঞ্চল বরাক উপত্যকায় মাতৃভাষা বাংলার অধিকার দাবি করে যে পনের জন তরুণ-তরুণী আত্মোৎসর্গ করে গেছেন, তাঁদের কথা আমরা একবারও স্মরণ করি না। বাংলা ভাষার জন্য যে-দেশে যিনিই শহীদ হোন না কেন তিনি প্রত্যেক বাঙালিরই আদর্শ। বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মবলিদান বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের মধ্য দিয়ে সার্থক হয়েছে। কিন্তু বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অধিকার রক্ষার জন্য রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষ ১৯৬১ সালের ১৯ মে, ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই তিন দফায় পুলিশের গুলিতে পনের জন শহীদ হন। মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় এই শহীদরাও তো আমাদের ভাই-বোন। তাঁদের ভুলে যাওয়ার অপরাধ ক্ষমার অযোগ্য। একুশে ফেব্রুয়ারির আত্মবলিদানের ফলে জিন্নাহ্র দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গঠিত পাকিস্তানি জাতিতত্ত্বের বুনিয়াদ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। আর বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন হচ্ছে ১৮৭৪-এর বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৫-এর বঙ্গভঙ্গ এবং ১৯৪৭-এর বঙ্গভঙ্গের ঐতিহাসিক পরিণাম।
একুশে ফেব্রুয়ারির ভাষা সংগ্রাম থেকে বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের চরিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। প্রথমত, আসামে বাংলাভাষীরা সংখ্যালঘু। পক্ষান্তরে, পূর্ববঙ্গের বাঙালির ছিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বরাকের ভাষা আন্দোলন সংখ্যালঘুর আন্দোলন আর বায়ান্নের ভাষা আন্দোলন সংখ্যাগুরুর আন্দোলন। তাছাড়া, ভারতীয় সংবিধানে বিভিন্ন সংখ্যালঘু ভাষিক জনগোষ্ঠীর যে অধিকার সংরক্ষণ করা হয়, সেটাই বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শক্তি। অর্থাৎ বরাকের ভাষা আন্দোলন আসামের ভূমিপুত্র বাঙালির সংবিধান-স্বীকৃত অধিকার এবং একই সঙ্গে আসামের বহুভাষিক চরিত্র রক্ষার আন্দোলন। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সংবিধান তখনও (বায়ান্ন সালে) রচিত হয়নি। পূর্ববঙ্গের মানুষের ওপর এমন একটি ভাষা (উর্দু) চাপিয়ে দেওয়ার অপচেষ্টা করা হচ্ছিল, যে ভাষা পূর্ববঙ্গে তো বটেই, গোটা পাকিস্তানে কারও মাতৃভাষা ছিল না। সাতচল্লিশে ভারত বিভাজনের সুবাদে ভারত থেকে পাকিস্তানে আগত মুষ্টিমেয় লোকই মাত্র উর্দুতে কথা বলতেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালির ভাষাকে উপেক্ষা করে তাদের ওপর উর্দু চাপিয়ে দিয়ে বাঙালির অস্তিত্ব-বিনাশের সুদূরপ্রসারী এক চক্রান্ত প্রতিহত করতে একশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ রাঙিয়েছিলেন বাংলার দামাল ছেলেরা।
দ্বিতীয়ত, বহুভাষিক আসাম রাজ্যের অসমিয়াকরণের প্রতিক্রিয়ায় ইতোমধ্যে আসাম ভেঙে কয়েকটি স্বতন্ত্র রাজ্য গঠিত হওয়ায় বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামের সঙ্গে অনসমিয়াভাষী গোষ্ঠীসমূহের যোগসূত্রও ছিন্ন হয়ে যায়। ফলে, আসামে বাঙালির অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রাম হয়ে দাঁড়ায় বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন। তৃতীয়ত, পূর্ববঙ্গে (পূর্ব পাকিস্তানে) মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য একবারই শোণিত তর্পণ হয়েছিল। পক্ষান্তরে, মাতৃভাষার অধিকার রক্ষায় বরাক উপত্যকায় বাহাত্তরের সতেরই আগস্ট দু'জন এবং ছিয়াশির একুশে জুলাই দু'জন শহীদ হন। উনিশে মে, সতেরই আগস্ট ও একুশে জুলাই সত্ত্বেও বরাক উপত্যকার বাঙালির মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার শেষ কোথায়, কেউ জানে না। একুশে ফেব্রুয়ারির সংগ্রাম পরিণতি লাভ করেছে স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র অর্জনের মধ্য দিয়ে। বাংলাদেশে বাংলাভাষা রাজনৈতিক ক্ষমতার ভাষা। যে ভাষার রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই সেই ভাষা অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা থেকে মুক্ত নয়। আসাম তথা বরাক উপত্যকার বাংলাভাষার রাজনৈতিক ক্ষমতা নেই।
বরাকের পনের জন ভাষাশহীদ এবং উনিশে মে, সতেরই আগস্ট ও একুশে জুলাই ভাষাশহীদ দিবসগুলি সম্পর্কে এই প্রজন্মের বাংলাদেশ কিছুই জানে না। একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানেও বরাকের ভাষাশহীদদের নাম কেউ উচ্চারণ করে না। অথচ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন বরাকের বাঙালি। সেদিন বিশ্বের যেখানেই বাঙালি ছিলেন প্রত্যেকেই বাঙালির স্বাধীনতার সপক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন। এই অভূতপূর্ব ঐক্য রাজনীতির চোরাবালিতে হারিয়ে গেল কেন? বরাক উপত্যকার ভাষা সংগ্রামও নির্বাচনী রাজনীতির বেড়াজালে আটকে গেল। আসামের সরকারি ভাষা হিসেবে অসমিয়ার সঙ্গে বাংলাভাষাকেও স্বীকৃতি দানের দাবি আজও উপেক্ষিত।
বরাক উপত্যকার ভাষাশহীদ পরিচিতি :
১. কমলা ভট্টাচার্য :
বাংলাভাষা সংগ্রামের একমাত্র মহিলা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য মেট্রিক পরীক্ষা দিয়েই ভাষা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ষোল বছর বয়সে তিনি শহীদ হন। পিতৃহীন কমলা ছিলেন অবিবাহিতা, থাকতেন ভাই রামরমণ ভট্টাচার্যের সঙ্গে শিলচর শহরে। তাঁদের পরিবার ১৯৫০ সালে সিলেট ছেড়ে কাছাড়ে আশ্রয় নেন। তিন বোন ও চার ভাইয়ের মধ্যে কমলা ছিলেন তৃতীয়।
২. শচীন্দ্রমোহন পাল :
মাত্র উনিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য বুক পেতে নিয়েছিলেন আসাম সরকারের বুলেট শচীন্দ্র পাল। তাঁদের পূর্বনিবাস ছিল হবিগঞ্জ মহকুমার নবিগঞ্জের সন্দনপুর গ্রামে। ছয় ভাই ও এক বোনের মধ্যে শচীন্দ্র ছিলেন দ্বিতীয়। কাছাড় হাইস্কুল থেকে মেট্রিক পরীক্ষা দেন।
৩. কানাইলাল নিয়োগী :
আদিনিবাস ময়মনসিংহ জেলার খিলদা গ্রামে। মেট্রিক পাশ করে ১৯৪০ সালে রেলে চাকরি নেন। স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়ে রেখে মাত্র ৩৭ বছর বয়সে শহীদ হন। তখন তাঁর মা শান্তিকণা নিয়োগীর বয়স ৭০ বছর। পিতা দ্বিজেন্দ্রলাল নিয়োগী আগেই প্রয়াত।
৪. কুমুদ দাস :
পিতা কৃষ্ণমোহন দাস মৌলভিবাজারের জুরি থেকে উদ্বাস্তু হয়ে কাছাড়ে যান। মায়ের মৃত্যুর পর আট বছর বয়সে কুমুদ দাস ত্রিপুরায় মামার বাড়িতে থেকে এম.ই. পর্যন্ত পড়ে গাড়িচালকের পেশা গ্রহণ করেন। পরে শিলচরের তারাপুরে চা-দোকানে বয়ের কাজ নেন। বৃদ্ধ পিতা, চার বোন ও এক শিশু ভাইকে নিয়ে সংসার ছিল তাঁদের। পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী ছিলেন কুমুদ দাস।
৫. তরণী দেবনাথ :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে সাতচল্লিশে ভারত বিভাগের সময় শিলচরে গিয়ে বসবাস [শুরু] করেন পিতা যোগেন্দ্র দেবনাথ। মৃত্যুকালে বয়ন ব্যবসায়ী তরণীর বয়স ছিল মাত্র একুশ বছর।
৬. হীতেশ বিশ্বাস :
বাস্তুহারা হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে পিতৃহীন হীতেশ বিশ্বাস মাত্র বার বছর বয়সে ত্রিপুরার খোয়াই শহরের উদ্বাস্তু কলোনির বাসিন্দা হন। মা, ছোট ভাই ও এক বোনের সংসার ছিল তাঁদের। শিলচর শহরে ভগ্নিপতির বাসায় অবস্থানকালে মাতৃভাষার জন্য জীবনদান করেন।
৭. চণ্ডীচরণ সূত্রধর :
পিতৃহীন চণ্ডীচরণ সূত্রধর ১৯৫০ সালে হবিগঞ্জের জাকেরপুর গ্রাম থেকে মামার সঙ্গে উদ্বাস্তু হয়ে আশ্রয় নেন শিলচরে। পড়াশোনা এম.ই. পর্যন্ত। জীবিকা হিসেবে পৈতৃক বৃত্তি কাঠমিস্ত্রির কাজেই নিয়োজিত করেন নিজেকে। মাত্র বাইশ বছর বয়সে ভাষার জন্য আত্মদান করেন। তিনি তখন একা শিলচরের রাঙ্গির খাড়িতে বাস করতেন।
৮. সুনীল সরকার :
ঢাকার মুন্সিবাজারের কামারপাড়া থেকে ভারত বিভাজনের বলি হয়ে শিলচর শহরের নূতন পট্টিতে গিয়ে ঘর বাঁধেন [সুনীল সরকারের] পিতা সুরেন্দ্র সরকার। ব্যবসায়ী সুরেন্দ্রের তিন ছেলে ও চার মেয়ের মধ্যে সুনীল ছিলেন সবার ছোট। মাত্র এম.ই. পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন সুনীল।
৯. সুকোমল পুরকায়স্থ :
করিমগঞ্জের বাগবাড়ি গ্রামের বাসিন্দা পিতা সঞ্জীবচন্দ্র পুরকায়স্থ ডিব্রুগড়ে ব্যবসা করতেন। অসমিয়াকে একমাত্র রাজ্যভাষা করার আন্দোলনের নামে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় ১৯৫৯ সালে 'বঙ্গাল খেদা' অভিযানের শিকার হয়ে সপরিবারে স্বগ্রামে চলে আসেন। ভাষা সংগ্রামে আত্মাহুতি দিয়ে মাতৃভাষার ঋণ শোধ করেন সুকোমল।
১০. বীরেন্দ্র সূত্রধর : শৈশবে বাস্তুহারা হয়ে পিতামাতার সঙ্গে নবিগঞ্জের [হবিগঞ্জের?] বহরমপুর গ্রাম থেকে শিলচর যান। জীবিকার অন্বেষণে বর্তমান মিজোরামের রাজধানী আইজল শহরে গিয়ে কাঠমিস্ত্রির পেশা অবলম্বন করেন। বিয়ে করেন ত্রিপুরার ধর্মনগরে। পরে কাছাড় জেলায় অবস্থিত মণিপুর চা বাগানের কাছে ঘর ভাড়া নেন। মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে ১৮ বছরের বিধবা স্ত্রী ও এক বছর বয়সী কন্যা রেখে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার সংগ্রামে আত্মদান করেন তিনি। শিলচর রেল স্টেশনে গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর হাসপাতালে ২০ মে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
১১. সত্যেন্দ্রকুমার দেব :
মাত্র চব্বিশ বছর বয়সে মাতৃভাষার বেদীমূলে জীবন উৎসর্গ করেন। উদ্বাস্তু হয়ে ত্রিপুরায় নূতন রাজনগর কলোনিতে তিন বোন ও মাকে নিয়ে আশ্রয় নেন পিতৃহীন সত্যেন্দ্র। মা ও বোনকে সেখানে রেখে জীবিকার অন্বেষণে শিলচরে গিয়ে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি নেন। পড়াশোনা ছিল প্রাইমারি পর্যন্ত। তাঁর ক্ষতবিক্ষত লাশ উদ্ধার করা হয় ২০ মে শিলচর রেল স্টেশনের পুকুর থেকে।
http://nirmaaan.com/blog/sumon/5866
আমার বোনের রক্তে রাঙানো ….. ভাষা শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য স্মরণে
লিখেছেন: অতিথি লেখক
বিভাগ: একুশের চেতনা, ব্যক্তিত্ব, মুক্তমনা
তারিখ: ১৫ ফাল্গুন ১৪১৭ (ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১১)
লেখককে বার্তা পাঠান
(মন্তব্য করুন অথবা পৃষ্ঠার নিচে যান)
(সরাসরি মন্তব্য অংশে যান)
মন্তব্য সহ লোড করুন
অতিথি লেখক
লিখেছেনঃ মানস রায়
ভূমিকা
বেশ কয়েক বছর আগের কথা। সেটাও ফেব্রুয়ারী মাস। সন্ধেয় আড্ডা জমেছে শহর কলিকাতায়। আমার মতন পাতি আড্ডাবাজের সঙ্গে বেশ কিছু নামী-অনামী বুদ্ধিজীবি, নারীবাদী, পরিবেশবাদীরাও আছেন। ফেব্রুয়ারী মাস তাই ভাষা আন্দোলনের কথাও উঠল। কলকাতায় ভাষা আন্দোলনের প্রভাব নিয়েও তর্ক হল, কার্জন পার্কে ভাষা শহীদদের নামে কবর সম কালো বেদীটির কোন শিল্পমূল্য আছে কিনা সেই প্রশ্নও করল কেউ। বেশি কচকচানি হয়ে যাচ্ছে দেখে বন্ধুবর কল্লোল তার আবেগমথিত গলায় গান ধরেছিল, "আমার ভায়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী"।
কল্লোলের গান একটু এগিয়েছে তখনই আমার বোকাবন্ধু সত্য মিত্র মিনমিন করে বলেছিল, আচ্ছা কেউতো এমনো লিখতে পারত …. 'আমার বোনের রক্তে রাঙানো …' কথা শেষ করতে পারেনি বেচারা, হইহই করে উঠেছিল সবাই। এ কেমন কথা। যারপরনাই বিরক্ত হয়েছিলেন নারীবাদী নেত্রী। এখানে বোনের কথা আসছে কোত্থেকে ? সমতার জন্য জবরদস্তি নারীশহীদ বানাতে হবে নাকি। ওহে মুর্খ, বাংলাভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল যারা তারা সবাই পুরুষ। তুমি হিন্দুর ছেলে মুসলমান নামের লিঙ্গ জ্ঞান নেই।
সত্য তবু বলার চেস্টা করেছিল, ২১শে ফেব্রুয়ারী নয় ১৯শে মে, বাংলা ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছিল এক নারী, ষোল বছরের কিশোরী, কমলা ভট্টাচার্য্য, ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়েছিল, রেজাল্ট দেখে যেতে পারেনি……। কিন্তু ১৯শে মে পর্যন্ত বলার পর খুব গম্ভীর গলায় সত্যকে থামিয়ে ছিলেন আড্ডার সবচেয়ে মান্যগণ্য ব্যক্তি, এক বিখ্যাত বাংলা পত্রিকার সম্পাদক। বলেছিলেন, ওটা ১৯শে নয় হবে ১৩ই মে। কবি সুকান্তর মৃত্যু দিবস।সুকান্তর মৃত্যু, অকালমৃত্যু কিন্তু তাকে শহীদ বলাটা বাড়াবাড়ি হয়ে যাবে। সম্পাদক মশাই আরো জানিয়েছিলেন যে ফেব্রুয়ারীর মতন মে মাসও বাংলা ভাষার জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ মাস – রবীন্দ্রনাথ ও নজরুল, দুজনের জন্মই মে মাসে।
বলা বাহুল্য, সম্পাদক মশাই জানতেন না যে আরো একটি কারণে মে মাস বাংলা ভাষার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবর্ষে মে মাসের ১৯ তারিখে ভারতের অসম প্রদেশের কাছাড় জেলার সদর শিলচর শহরে বাংলা ভাষার সরকারী স্বীকৃতি দাবীর আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে শহীদ হন এগার জন। সেই একাদশ শহীদের একজন এবং একমাত্র নারী কমলা। কমলা ভট্টাচার্য্য সম্ভবতঃ বাংলা ভাষার জন্য প্রাণদাত্রী একমাত্র নারী।…… এই তথ্যটি পশ্চিম বাংলার বেশিরভাগ বুদ্ধিজীবির, বিশেষ করে শিল্প সাহিত্যের সংগে জড়িত মানুষদের, অজানা। কতিপয় যারা জানেন তারা না জানার ভান করেন বা এড়িয়ে যান। তাই ভিয়েতনাম, লাতিন আমেরিকা, প্যালেস্তাইনের জন্য পাতা ভরানো বাঙালী কবির কলমে (ব্যতিক্রম বনফুল, মনীষ ঘটক)শিলচরের স্থান হয় নি। পশ্চিম বাংলার কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন গবেষণাপত্র লেখা হয় নি। কলকাতায় ২১শে স্মরণে বেদী আছে কিন্তু ১৯শে ….. সেটা আবার কি? পশ্চিম বাংলায় যখন এই অবস্থা তখন বাংলাদেশের কাছে কিছু আশা না করাই স্বাভাবিক।
সেই ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে দু চার কথা
বাংলাভাষী শ্রীহট্ট জেলা ১৮৭৪ খ্রীস্টাব্দে অসম প্রদেশের অন্তর্ভুক্ত হয়। রবীন্দ্রনাথ তাই লিখেছিলেন, 'মমতাবিহীন কালস্রোতে/ বাংলার রাষ্ট্রসীমা হতে/ নির্বাসিতা তুমি/ সুন্দরী শ্রীভূমি'। অসমে এক সময় সরকারী ভাষা ছিল বাংলা। পরে অসমীয়া প্রধান সরকারী ভাষা ঘোষিত হলেও সমগ্র অসমে বাংলা চালু ছিল সরকারী স্তরে দ্বিতীয় ভাষা হিসেবে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় এক বিতর্কিত গণভোটে শ্রীহট্ট জেলাকে অসম থেকে বিছিন্ন করে পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়, শুধু কাছাড় অংশ ভারতে থেকে যায় অসমের একটি জেলা হিসেবে। একশ শতাংশ বাংলাভাষী কাছাড় জেলায় বাংলাই ছিল প্রধান সরকারী ভাষা। ১৯৬০ সালে অসম সরকার অসমীয়াকে একমাত্র সরকারী ভাষা হিসেবে ঘোষণা করে। এই ঘোষণার বিরুদ্ধে বাংলা ও অনান্য স্থানীয় ভাষার স্বীকৃতির দাবীতে কাছাড়কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক প্রবল ভাষা আন্দোলন।
প্রতিক্রিয়ায় অসমীয়া গরিষ্ঠ অঞ্চলে বাঙালীদের ওপর নেমে আসে প্রচন্ড অত্যাচার। অসমের বাংলাভাষী মুসলমানরা তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ঘোষণা না করলে তাদের পাকিস্তানে পাঠানো হবে এই জুজু দেখান হয় (যে প্রচেস্টা আজও অব্যাহত। ২০১১ সালের সেন্সাসে বাংলাভাষী মুসলমানরা যাতে তাদের মাতৃভাষা অসমীয়া ঘোষনা করেন তার জন্য সম্মেলন টম্মেলনও হচ্ছে এবং অসমের বাংলাভাষী মুসলমানরা এ ব্যাপারে বর্তমানে কিছুটা দিধা বিভক্ত।এই বিষয় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি প্রবন্ধের দাবীদার।)এবং বাংলাভাষার আন্দোলন বাঙালী হিন্দুর মুসলিম বিরোধী কার্য্যকলাপ বলে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানো হয়। দাঙ্গা দমন পীড়নকে অগ্রাহ্য করে বাংলাভাষার দাবীতে রাস্তায় নামেন কাছাড় জেলার সর্বস্তরের মানুষ।
১৯৬১র ১৪ই এপ্রিল (১লা বৈশাখ)পালিত হয় সংকল্প দিবস। ১৯শে এপ্রিল থেকে পদযাত্রা শুরু হয় সারা জেলা জুড়ে। ১৮ই এপ্রিল ছাত্র সমাবেশ, বিশাল মশাল মিছিল হল করিমগঞ্জে, শিলচরে (ফেব্রুয়ারীর আন্দোলনের মত এখানেও ছাত্ররা সামনের সারিতে)। পরদিন, ১৯শে মে, পালিত হবে অসহযোগ দিবস, স্তব্ধ হবে সারা কাছাড়, বাংলা ভাষার জন্য নিবেদিত হবে এগারটি প্রাণ, বাংলার নারীর মুখ উজ্জ্বল করবে কমলা ভট্টাচার্য্য।
কমলার কথা
দেশ ভাগের বলি কমলাদের পরিবার শ্রীহট্ট থেকে কাছাড়ে আসে ১৯৫০ সালে। পিতা মৃত। অভাবের পরিবারে দুবেলা পেটভরা অন্নের সংস্থান ছিল না। চার বোন, কমলা তৃতীয়। তিন ভাই – দুজন কমলার বড়, বকুল ছোট। দ্বিতীয় বোন (সেজদি) প্রতিভা এক স্কুলের শিক্ষিকা, তার আয়ে কোনমতে চলে। পড়ার বই, লেখার খাতা কেনার সামর্থ নেই, শতছিন্ন পোষাকে স্কুলে যাতায়াত। অনেকেই পড়াশোনা ছেড়ে দেওয়ার পড়ামর্শ দিয়েছিল কমলাকে। কমলার এক গোঁ, গ্র্যাজুয়েশন আমি নেবই। সেই গোঁ থেকে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় বসা, আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে থেকেও।
ম্যাট্রিক পরীক্ষা শেষ। পরদিনই পিকেটিংএ যাওয়ার জন্য তৈরী কমলা। আজকে তো এক বিশেষ দিন, আজকের পিকেটিং সারা কাছাড় সারা কাছাড় স্তব্ধ করে নেহেরু-চালিহাদের (চালিহা অসমের ততকালীন মুখ্যমন্ত্রী)জানিয়ে দেবে ভাষার জন্য বাঙালী সব কিছু করতে পারে। কমলাকে আটকায় মা সুপ্রভাসিনী, যাসনে বাইরে আজ। কিন্তু আজ কে কাকে আটকাবে? সেজদি স্কুলে যাওয়ার জন্য কেঁচে ধুয়ে রাখা কাপড়টা না বলেই পড়ে নেয় কমলা। দলবল এল বলে। সেজদি জানতে পেরে খুব রাগ করবে, ভাল কাপড় ওরই বা বেশি কোথায়। যাক সে কথা পরে ভাবা যাবে। ২০-২২ জন মেয়ের একটা দল এসেছে বাড়িতে, কমলাকে ডাকতে। এবার সেজদিও মানা করে, কাচা কাপড়টাও ওর নজরে এসেছে। কিছু হবে না মাসীমা, সেজদি আপনি একদম ভাববেন না। আমরা থাকব রেলস্টেশনে। সকালের ট্রেন আটকে দিলে সারা দিন সব বন্ধ। পায়ে পায়ে বেরিয়ে আসে কমলা। ইতিমধ্যে ছোটবোন মঙ্গলাও সাথ নিয়েছে। চল, তুইও চল। কিছু খেয়ে গেলে হত না? মার মুখ দেখে বুঝল ঘরে কিছু নেই। খাবার দিতে না পারলেও মা কমলাকে একটা বড় কাপড়ের টুকরো দিয়ে দিলেন। সাথে রাখিস, কাঁদানে গ্যাস ট্যাস ছোড়ে যদি।
বাড়িতে মন টেকেনা মায়ের। শুধু মেয়ে দুটো নয়, ছোট ছেলে বকুল, নাতি বাপ্পাকে নিয়ে কখন পিকেটিং এর দিকে হাঁটা দিয়েছে টের পান্নি। নাতি বাপ্পা বড় মেয়ে বেনুর ছেলে। বেনু নার্সের চাকরির ট্রেনিং এ গেছে শিমুলগুড়ি। এবার সুপ্রভাসিনী নিজে বেরুলেন। ছেলে মেয়ে নাতি সব বাইরে, হচ্ছেটা কি? নিজে একবার না দেখলে মন মানেনা। রোদ চড়েছে, রাস্তা খালি, পুলিশের একটা গাড়ি ধুলো উড়িয়ে চলে গেল। কোথায় যাবেন। মেয়েরা স্টেশনে যাবে বলেছিল, ওখানেই যাওয়া যাক। স্টেশনে পাওয়া গেল ছোট ছেলেকে আর নাতিকে। ওদের দুজনকেও পুলিশ ধরেছিল, আবার ছেড়ে দিয়েছে। কতজনকে ধরবে, রাখবে কোথায় ? মাকে দেখে স্টেশনের এক কোন থেকে উদয় হল দুই মেয়ের। একি, মা তুমি ব্লাউজ টাউজ না পরে শুধু কাপড় জড়িয়ে এখানে এসেছ কেন? কমলা বকা দেয় মাকে। ধুলো ভরা পা দেখে স্টেশনের কল থেকে কল এনে পা ধুইয়ে দেয়। এবার বাড়ি যাও তুমি, এখানে সব শান্ত।
তোরা যাবিনা? যাব, আর একটা ট্রেন আটকালেই এখানের কাজ শেষ। ওটা আটকেই বাড়ি ফিরব।
ছোট ছেলে আর নাতিকে নিয়ে বাড়ির দিকে এগোন সুপ্রভাসিনী।
খানিক্ষণের মধ্যে স্টেশনে আবহাওয়া পালটে যায়। সকাল থেকে কতগুলো ট্রেন আটকানো হল। কোন গন্ডগোল নেই। সবাই মিলে বাংলাভাষা চালু করার স্লোগান দিয়ে রেল লাইনে বসে পড়লেই হলো। এবার যেন অন্যরকম। পুলিশের সংখ্যা হঠাত বেড়ে গেছে স্টেশনে। ওরা লাঠি আর বন্দুকের বাট দিয়ে মারতে শুরু করল আন্দোলনকারীদের। কিন্তু পিকেটিং ছেড়ে নড়ছে না কেউ। মার, কত মারবি।
হটাত কমলার কানে এল চীতকার, মঙ্গলার গলা। ধনদি বাঁচাও। ধনদি মানে কমলা। পুলিশের লাঠির ঘায়ে লুটিয়ে পড়েছে মঙলা। কমলা এগিয়ে যায় বোনকে সাহায্য করতে। লাঠির সাথে গুলিও চালানো শুরু হয়েছে তা লক্ষ্য করেনি কমলা। উঠে দাঁড়িয়ে বোনকে সাহায্য করতে যাওয়া উচিত হয় নি কমলার। কিন্তু উচিত অনুচিত ভাবার সময় কই, মঙ্গলাকে ভীষণ ভাবে মারছে পুলিশ। ছুটে যায় কমলা। যাওয়া হয় না।
পুলিশের বুলেট কমলার ডান চোখের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথার খুলি চুরমার করে দেয়। আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ে কমলা। কমলা হয় শহীদ কমলা ভট্টাচার্য্য। বাংলা ভাষার নারী শহীদ।
ছোট শহর শিলচর। রেলস্টেশনে গুলি চলেছে। নিহত অনেক, আহত আরো প্রচুর। মানুষ ভীড় করে হাসপাতালে। ইতিমধ্যে সবাই জেনে গেছে কমলার গুলি লেগেছে। জীবিত না মৃত নিশ্চিত নয় কেউ। হাসপাতাল ঘিরে রেখেছে পুলিশ, মেয়ের দেখা পেলেন না সুপ্রভাসিনী। কমলার সঙ্গীরা কান্নায় ভেঙে পড়ে তার সামনে। নিয়ে গিয়ে ছিলাম আপনার মেয়েকে, ফেরত আনতে পারলাম ন।পাথরের মতন নীরব হয়ে বসে থাকেন তিনি। হঠাত মনে পরে মঙ্গলার কথা মঙ্গলা কোথায়? মঙ্গলার কথা কেউ বলছে না কেন?
মঙ্গলাও তখন হাসপাতালে। পুলিশের লাঠি ও বন্দুকের কুঁদোর আঘাতে বীভতসভাবে আহত, সজ্ঞাহীন। মঙ্গলার জ্ঞান ফিরবে একমাস পর, তারপর সারাজীবন বয়ে বেড়াবেন পুলিশী অত্যাচারের যন্ত্রণা, বেঁচে থাকবেন হার জিরজিরে রোগা শরীরে চিররুগ্ন হয়ে।
শহীদ পরিবারের কথা
কমলার মৃত্যুশোকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছিলেন মা সুপ্রভাসিনী। ঘুম হতো না। ঘুমালে স্বপ্নে ভাসে উঠত কমলার মুখ, তার জেদী ঘোষণা- গ্র্যাজুয়েশন আমি নেবই। ঘুম ভেঙে উঠে বসতেন। কাছাড়ের ডিসি এসেছিলেন আর্থিক সাহায্যের প্রস্তাব নিয়ে, নেন নি। যারা গুলি করে মেরেছে আমার মেয়েকে তাদের হাত থেকে নেব সাহায্য? কক্ষনো নয়। ছুটে যান বাড়ির ছাদে। মানসিক ভারসাম্য না থাকায় পড়ে ছাদ থেকে। সেই থেকে মনোবিকার চিরস্থায়ী। অবস্থার উন্নতি হবে ভেবে তাকে শিলচর থেকে গুয়াহাটি নিয়ে যান বড় ছেলে রামেন্দ্র ভট্টাচার্য্য। লাভ হয় নি। মানসিক ভারসাম্যহীন অবস্থায় মৃত্যু হয় শহীদ জননীর।
সেজদি ও মঙ্গল দুজনের বিয়ে হয়েছিল। তারাও চলে গিয়েছিলেন গুয়াহাটি। পুলিশী অত্যাচারের যন্ত্রণা সংগ ছাড়েনি সারা জীবিন। যার শাড়ি পড়ে শহীদ হয়েছিল কমলা, সেই সেজদিও পরবর্তি জীবনে মানসিক সমস্যার শিকার হন, বিশেষ করে কেউ কমলার কথা বললে সেই সমস্যা আরো প্রকট হত।
বড়দি বেনু চক্রবর্তী পরে আবার চেস্টা করেছিলেন কিছু সরকারী সাহায্য যোগাড় করতে এই বিধ্বস্থ পরিবারটির জন্য। পারেন নি। তবে বড়দি আসল দুঃখ স্বীকৃতির প্রশ্নে। বাংলাভাষার মূল স্রোতের কাণ্ডারীরা কমলার আত্মত্যাগকে কোনদিন যথচিত সন্মান দেন নি।
হয়তো
হয়তো একদিন সুতানটী গ্রামের বাংলা শিল্প সাহিত্যের নটনটীরা বুঝতে পারবেন যে কমলা ও তা দশ সাথীদের জীবন বলিদান ২১শের চার শহীদের মতন চিরস্মরণীয়। হয়তো একদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ ১৯৬১র ২১ শে মে নিয়ে গবেষণা করার মতন প্রাজ্ঞতা অর্জন করবে, হয়তো কফি হাউসের কোন কবি কলমে শিলচর স্টেশনের মহাকাব্য রচিত হবে, হয়তো পশ্চিম বাংলা মে মাস কে বাংলা ভাষার মাস হিসেবে চিহ্নিত করবে, হয়তো কোন নারীবাদী সাহিত্যে কমলার কথা লেখা হবে, হয়তো কলকাতা শহরের কোন রাস্তার নামফলকে শোভা পাবে কমলার নাম, হয়তো ……
তথ্যসূত্রঃ '১৯ এর শহীদেরা', দিলীপকান্তি লস্কর, লালনমঞ্চ প্রকাশনী, করিমগঞ্জ, অসম। প্রকাশনা ২০০২
http://mukto-mona.com/bangla_blog/?p=14387&plain=true
বিষয় : ১৯ মে ভাষা শহীদ দিবস
বিভাগ : অন্যান্য
শুরু করেছেন :কল্লোল
IP Address : 125.241.38.233 (*) Date:19 May 2012 -- 09:00 AM
Name: সুশান্ত
IP Address : 127.198.56.246 (*) Date:19 May 2012 -- 09:10 AM
আমাদের অন্য সমস্ত স্বপ্ন ভাষার সঙ্গে বিদেয় নিয়েছে--
তারা সবাই শহীদ হয়েছে
সুশান্ত কর
শিলচরে বড় হবার সুবাদে ছেলেবেলা থেকে দেখতাম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীর দিন কতক পরেই পাড়ায় পাড়ায় আরেকটি দিন উদযাপনের ধুম পড়ে যেত, সেতি ১৯শে মে। ১১ শহীদের ছবি একটা চেয়ার বা অস্থায়ীভাবে তৈরি বেদীর উপর রেখে ফুলে ধূপে সাজিয়ে রাখা হতো, কেউ কেউ পাশে বাংলা দেশাত্মবোধক গান মাইকে বাজিয়ে দিত, কেউ নয়। এই রীতিতে দিবস উদযাপনের রীতিটি বোধ করি শিলচরীয়, বা কাছাড়ি ব্যাপার। কেননা, ব্রহ্মপুত্র উপত্যকাতে ওমন দেখা যায় না। রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তীতে বা নেতাজী জয়ন্তীতে কেন্দ্রীয়ভাবে প্রভাত ফেরি হতো, স্কুল থেকেই যোগ দিতে বলা হতো। কিন্তু ১৯শের কোনো পথ চলাতে গেছি বলে মনে পড়ে না। কলেজে গিয়ে জেনেছি যে ১৯শের দিনে খুব সকালে শিলচর শ্মশানে জড়ো হওয়া আর বিকেলে গান্ধিবাগ শহীদ বেদীতে –একটি নিয়মিত প্রথা। পথ চলা টলা ইত্যাদি সাম্প্রতিক। সেই ১৯৮৬তে যখন ১৯শের ২৫ বছর উদযাপিত হয়েছিল , ওদিকে আবার সেবা সার্কুলারের বিরুদ্ধে উপত্যকা তথা গোটা অসম উত্তাল ছিল তখন হয়েছিল বটে এক বিশাল শোভাযাত্রা, এর পর বোধহয় কেন্দ্রীয়ভাবে ওমন শোভাযাত্রা সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং ভাষা শহীদ স্টেশন দাবি সমিতির প্রচলন।
পাড়ায় পাড়ায় স্থায়ী শহীদ বেদি নির্মাণের ব্যাপারটি জনপ্রিয় হতে শুরু করে ওই ১৯৮৬র পর, বিশেষ করে বাংলা পঞ্চদশ শতককে ( ১৪০০ সাল) যখন বরণ করা হচ্ছিল তখন থেকে। তার আগে শহরেও এতো শহীদ বেদী ছিল না, আর গাঁয়ে গঞ্জেতো মোটেও না। এখনো উধারবন্ধ, পাথারকান্দির মতো ছোট শহরগুলো বাদ দিলে উনিশ উপত্যকার কোনো প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালিত হয় কিনা আমার সন্দেহ আছে। বাংলাদেশে , পশ্চিম বাংলাতে, ত্রিপুরাতে বা অন্যত্র উনিশ পালনের ব্যাপারগুলোও অতি সাম্প্রতিক। এগুলো সম্ভবত প্রচার মাধ্যমের অবদান, অবশ্যি সংগঠিত উদ্যোগও রয়েছে। ১৯৮৬র আগে কবি লেখকেরাও ১৯ নিয়ে খুব যে লিখেছেন বলা যাবে না। শক্তিপদ ব্রহ্মচারীর সেই বিখ্যাত পংক্তি "দশটি ভাই চম্পা আর একটি পারুল বোন কলজে ছিঁড়ে লিখেছিল, 'এই যে ঈশান কোণ" আশির দশকের আগে লেখা নয়। এই নিয়ে তাঁকে এবং তাঁর সময়ের অনেক কবি লেখককে আশির দশকে প্রচুর কথা শুনতে হয়েছে। কিন্তু ১৯৮৬র ২১ জুলাইর পর এটি প্রায় অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে যে যিনিই দুলাইন গদ্য বা পদ্য লিখবেন বরাক উপত্যকাতে তিনিই ১৯ কিম্বা ২১ নিয়েও অবশ্যই লিখবেন, পারলে বই করবেন শুধু এই একটি বিষয় নিয়ে। কার বই কত বেশি, কে আগে কে পরে, কে কত ইতিহাস জানেন কিম্বা জানাতে পারেন এই নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতাও দেখা গেছে। এতে অবশ্য কোনো লাভ হয় নি তা নয়, অঞ্চলটির ভাষা, ইতিহাস, সংস্কৃতি, ভূগোল, অর্থনীত , রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে গভীর অধ্যয়নের আগ্রহও বেড়েছে প্রচুর। সুজিৎ চোধুরী, অমলেন্দু ভট্টাচার্য, সঞ্জীব দেব লস্কর, কামালুদ্দীন আহমেদ, আবুল হোসেন মজুমদার , ইমাদউদ্দীন বুলবুল প্রমুখের মতো বেশ কিছু পণ্ডিত গবেষকের আন্তরিক কাজের প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে ১৯ শে মে, ২১ জুলাই বললে ভুল বলা হবে না। অনেকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাও ১৯শেরই দান। এটা পরোক্ষ সত্য। আসলে সত্তরের শেষ এবং আশির শুরুতে ছ'বছরের অসম আন্দোলনের দিনগুলোতে গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের যে সব তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল সেটিই বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনকে জোর দিয়েছিল। তবে কিনা, ষাটের ভাষা আইন নিয়ে বিবাদ এবং অসম আন্দোলন দুটোরই প্রেরণা ছিল অসমিয়া উগ্রজাতীয়তাবাদ—সেই সুবাদে বিশ্ববিদ্যালয়কে ১৯শের সঙ্গে জুড়া যায় বইকি।
এহেন যে ১৯ , ২১ –সেই নিয়ে আমি নিজে কোনোদিনই লিখতে বিশেষ আগ্রহ বোধ করিনি। কেন, ব্যাপারটা খুলে বলি। ছেলে বেলার ১৯ উদযাপনের মানে বুঝতে বুঝতে যখন বড় হচ্ছি , ঠিক তখনইতো ১৯৮৬র ধাক্কা। নিজেও সেই লড়াইয়ের সামনের সারিতে ছিলাম। অগপ সরকার এসে অষ্টম শ্রেণি থেকে অসমিয়া পড়াটা বাধ্যতামূলক করে নির্দেশ দেবার পরে লড়াইতে যোগ দিইনি। বস্তুত, অসম আন্দোলনের বিভৎস দিনগুলোর উত্তাপের আঁচ পেতে পেতেই তো বড় হওয়া, তাই কলেজে যেতেই জড়িয়ে গেছিলাম ছাত্র আন্দোলনে। লড়াইর নামে তখন রক্ত গরম হয়ে পড়ত। অনেক দিনের খাটাখাটুনির পর, প্রথমে ১৯৮৫র অসম চুক্তি, এবং পরে ঐ সেবা সার্কুলারের পর এক বড় লড়াইয়ের পরিবেশ তৈরি হতে শুরু করল। ভেবেছিলাম এবারে একটা হেস্তনেস্ত হবে। নরসিং উচ্চতর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চূড়ান্ত পরীক্ষাতে বসেছি আর দুটো পরীক্ষার আগে জেলা উপায়ুক্তের কার্যালয়ের সামনে এসে সহকর্মীদের সঙ্গে যোগ দিয়ে স্লোগান দিচ্ছি ---–এই স্মৃতি এখনো ভুলিনি আমি। লেখা পড়া লাটে উঠেছিল। রাতে বাড়ি থাকতে মানা করছিল, সহকর্মীরা নইলে পুলিশ তুলে নেবে।
দেখলাম ২১ জুলাই, ১৯৮৬ করিমগঞ্জে পুলিশের বেপরোয়া গুলি চালনা এবং অত্যাচারের পর আন্দোলনটা দ্বিগুণ তেজে জ্বলে উঠবে কই, উলটে নেতিয়ে গেল। সভা ডাকলে সংগঠনের সভাতেই লোক কম আসতে শুরু করল। এবং ১৫ আগষ্ট যখন সার্কুলারটি স্তগিত করল সরকার তখন সত্যি লড়াইটা মরেই গেল। তার পরেও, আমরা বহুদিন বহুভাবে সড়ক, বিশ্ববিদ্যালয়, বন্যা, বিদ্যুৎ, কৃষিঋণ ইত্যাদি নিয়ে লড়াই চালিয়ে গেছি, বরাক উপত্যকাতে সেদিনকার সংগঠনগুলো নানা ভাবে এখনো সেই লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু সংগ্রাম সমন্বয় সমিতি নামে যে মহা ঐক্যজোট সেবা সার্কুলারকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল সেটি আর অক্ষত ছিল না বেশি দিন। তখন জেনেছি, ১৯৬১র ১৯ মে'র পরেও ঘটনা তাই ঘটেছিল। একমাস পরে হাইলাকান্দিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাতে সে লড়াই কলঙ্কিত হয়েছিল। ঠিক যেমন স্বাধীনতা কলঙ্কিত হয়েছিল দেশভাগে। আর পশ্চিম বাংলার বঙ্গবন্ধুরাও রাজ্যের শাসন হাতে পেয়ে আনন্দে মেতেছিল, তেমনি ঐ বরাক উপত্যকার সরকারি ভাষা বাংলা, গুয়াহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তরে বাংলা, বাংলা মাধ্যমের স্কুল এমন কিছু ছুটকো দাবি আদায় করেই বরাক উপত্যকার লড়াই চুপ মেরে গেছিল। ব্রহ্মপুত্র তখন দিন গুনছিল ১৯৮৩র ১৮ ফেব্রুয়ারীর । যেদিন নরখাদকদের হাতে এক রাতে দু হাজারের বেশি নর নারী শিশু প্রাণ বলি দিয়ে দেবে। তার আগে পরে, বিচ্ছিন্ন নরহত্যার হিসেব নিলে সংখ্যাটা তিন হাজারের উপরে যাবে। তখন আর কেবল ১১ কিম্বা ৮৬র ২জনকে আলাদা করে মনে থাকে কী করে!
আমার এখনো মনে হয়, বরাক উপত্যকার বুদ্ধিজীবিরা যখন সেই পঞ্চাশ বছরের আগেকার ১১ শহীদের আর সেই বীরত্বপূর্ণ লড়াইএর বার্তা বরাক উপত্যকার বাইরে নিয়ে যান তখন আসলে নিজেদের তাঁরা বড় নয় , ছোটই করেন। কারণ নীরব স্রোতারা কী একবারের জন্যেও নিজের মনকে বা পাশের বন্ধুটিকেও জিজ্ঞেস করেন না, এর পরের পঞ্চাশ বছর আপনারা করলেনটা কী? আপনাদের প্রতিবেশী দেশ এবং রাজ্যের ইতিহাসেতো এর পর এর চেয়েও বহু বেশি রক্ত ঝরেছে, পালটে গেছে ভূগোল কিম্বা ইতিহাস! সম্প্রতি শিলচর রেল স্টেশনকে ভাষা শহীদ স্টেশন নামে নামাঙ্কিত করবার দাবিতে একটি লড়াই দানা বেঁধেছে। তাতে ভাষা ধর্ম নির্বিশেষে মানুষের সমর্থণ দেখা গেছে। শ্রেণি নির্বিশেষে বলা যাবে না। সন্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ এবং ভাষা শহীদ স্টেশন দাবি সমিতি রয়েছে এই আন্দোলনের পুরোভাগে। এর জন্যে আইনত দরকার রাজ সরকারের অনুমোদনও আদায় করা গেছিল। কিন্তু গেল বছর এটি আটকে দিল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। এই বলে যে, দাবিটি বুঝি 'আঞ্চলিক দেশপ্রেমে'র চিহ্নায়ক। গেল পঞ্চাশ বছরে যত দোষ দিসপুর ঘোসের ঘাড়ে চাপিয়ে অভ্যস্ত বরাক উপত্যকার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবির কাছে এটি বোধকরি অবিশ্বাস্য আঘাত। তাঁরা জ্বলে উঠবেন কৈ, মিইয়ে গেছেন। সংগঠন দুটো এখন প্রাণপণ করছে লড়াইকে জিইয়ে রাখতে। তাই, আপাতত, তাঁরা স্টেশনে খ্যাতনামা ভাস্কর স্বপন পাল নির্মিত শহীদ বেদী বসাবার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এরকম কাজে মধ্যবিত্ত বেশ স্বচ্ছন্দ বোধ করে, তাদের জাগিয়ে চাগিয়ে রাখতে বেশ সুবিধে হয়। এই বলে আমি সংগঠনদুটোকে খাটো করছি না, মোটেও । তাদের বেচারি উপায় নেই অন্য।
আমি কি খুব হতাশার গল্প শোনাচ্ছি? মোটেও না। ১৯৬১ ভাষা আন্দোলন অসমের বাঙালির একার লড়াই ছিল না। এটা বরাক উপত্যকার থেকে যেসব ইতিহাস গ্রন্থ লেখা হয় তার প্রায় সবকটিতেই রয়েছে। মিজো, খাসি, বড়ো, মণিপুরি সব্বাই ছিলেন। তার পরে এদের অনেকেই স্বতন্ত্র রাজ্য নিয়ে বেরিয়ে গেলেন, নিজেদের ভাষাকেও সরকারী ভাষার মর্যাদাতে প্রতিষ্ঠা দিলেন। প্রতিবেশি বাংলাদেশের কথা না হয় আনলামই না। আমাদের তাত্বিক তখন প্রবন্ধ লিখলেন, আমার মধ্যে ঠিক আঞ্চলিক বোর্জুয়া গড়ে উঠেনি। স্বশাসন কিম্বা স্বতন্ত্র রাজ্যের দাবিতে এখনো লড়ছেন ডিমাছা, বডো, কার্বিরা। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখানেই আছি, বড়জোড় কাছাড়ে ছিলাম , এখন বরাক উপত্যকার মানুষ হয়েছি। এমন কি ১৯৭২এ মাধ্যম আন্দোলনে আমাদেরই লোকের হাতে করিমগঞ্জে শহীদ হয়েছিলেন বাচ্চু চক্রবর্তী, তাঁকে আমরা এখনো শহীদের মর্যাদা দেব কি দেব না এই নিয়ে গধুর তর্কে মাতি। ঘটনা হলো, অসমিয়ার সঙ্গে সেদিন যে ইংরেজিটাও উচ্চশিক্ষার মাধ্যম হিসেবে থেকে যেতে পেরেছিল তার পেছনে মূল অবদানটি আসলে ছিল আহোমদের। ২১ জুলাইর করিমগঞ্জের গুলিচালনার পর সরকার আন্দোলনটিকে দমিয়েই দিয়েছিল। নতুন করে প্রস্তুতি নিচ্ছিল অসমের তাবৎ জনজাতীয় সংগঠনগুলো আটসুর নেতৃত্বে। তারা হুমকি দিয়েছিল ১৫ আগষ্ট , ১৯৮৬র আগে যদি সেবা সার্কুলার স্তগিত না হয় তবে তাঁরা ব্যাপক লড়াইয়ে নামছেন। ঠিক সেই দিনটিতেই স্তগিত হয়েছিল। জনপ্রিয় প্রচারে এগুলোর উল্লেখ মেলে না। জনপ্রিয় প্রচারটি হচ্ছে যে, লড়াইগুলো বাঙালির লড়াই, বাঙালি লড়েছে, রক্তও বাঙালি দিয়েছে।
এমন কি ভাগ্যিস, এতো দিনে ছোটখাটো এক মুসলমান মধ্যবিত্ত জগৎ গড়ে উঠেছে। অন্যথা, নব্বুইর দশকের শুরুতে ইমাদ উদ্দীন বুলবুলের ভাষা সংগ্রামের ইতিহাস নিয়ে লেখা বইটির আগে নির্লজ্জের মতো, বহু কবি লেখকদের মুখেই এই প্রশ্ন শোনা যেত, ১১ শহীদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই কেন? এই প্রশ্নটি যে কেবল সাম্প্রদায়িক নয়, আত্মঘাতি---এই প্রশ্ন যে কৌতুহলকে উত্তর সন্ধানে প্ররোচিত করবার বদলে প্রস্তুত উত্তরকে দিয়ে প্রাচীর গড়ে তোলে এটি বুঝবার বোধটুকুও নেই এই সব বুদ্ধিজীবিদের।
শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ে জনসংখ্যানুপাতে যথেষ্ট মুসলমান নেই কেন?---- এই প্রশ্ন তুলে এখন যখন, ছাত্র আন্দোলন হচ্ছে, এর মধ্যে বরং অনেকেই সাম্প্রদায়িকতার গন্ধ পাচ্ছেন সহজে। বস্তুত, এতেই আছে সেই প্রশ্নের উত্তর ----১১ শহিদের মধ্যে একজনও মুসলমান নেই কেন? এ কেবল দুটো সম্প্রদায়ের প্রশ্ন নয়, তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে এ অনেকটাই শ্রেণিরও প্রশ্ন বটে।
এবং আরো একটি ভেদ রয়েছে যেটি তাবৎ বৌদ্ধিক আলোচনাতে চাপা পড়ে থাকে। ভাষা নিয়ে আবেগটি মূলত মধ্যবিত্ত বিষয়। বরাক উপত্যকার শিলচর কেন্দ্রিক যে মধ্যবিত্ত সে মূলত দেশভাগের আগে পরে এই মাটিতে আসা লোকেদের নিয়ে গড়ে তোলা, যাদের শেকড় এখানকার মাটিতে খুব বেশি গভীরে গাঁথা হয়নি এখনো । আমি নিজেই যদি ছাত্র আন্দোলনের জড়িয়ে না থাকতাম এখানকার গ্রামাঞ্চল আর তার মানুষজনকে জানবার বুঝবার কোনো সুযোগই পেতাম না। আমাদের মুসলমান কিম্বা তপশিলি জাতি জনজাতি সহকর্মীরা যত সহজে এ গাঁয়ে ওগাঁয়ে সংগঠন গড়বার জন্যে আত্মীয় বন্ধুদের নাম করতে পারতেন, আমরা সিলেটি কায়স্থ, বামুন বন্ধুরা কিছুতেই তা করতে পারতাম না। আত্মগোপন করে আমাদের যদি গাঁয়ে যেতেও হতো, তবে যে পরিবেশ পেতাম সে আমাদের কাছে শুধু যে প্রাকৃতিক ভাবেই ভিন্ন তা নয় সাংস্কৃতিক ভাবেও অনেকটাই ভিন্ন হতো। অন্যথা, পুলশের গ্রেপ্তারি এড়িয়ে করিমগঞ্জ থেকে যারা পালিয়েছিলেন ২১ জুলাই বা তার পরে, তারা শিলচর হাইলাকান্দি ছড়িয়ে না গিয়ে গ্রামে ছড়াতে পারতেন এবং সেখান থেকে লড়াইকে নতুন উদ্যমে সংগঠিত করে পুণরুজ্জীবিত করতে পারতেন।
আমাদের এক কবির, ( দিলীপ কান্তি লস্কর) বহু পঠিত কবিতা আছে, "আমি কোত্থেকে এসছি তার জবাবে যখন বললাম, করিমগঞ্জ আসাম ... বাংলা ভাষার পঞ্চদশ শহিদের ভূমিতে আমার বাস/তিনি তখন এক্কেবারে আক্ষরিক অর্থই ভিরমি/ খাইয়ে দিয়ে আমাকে বললেন, ও! বাংলাদেশ ? তাই বলুন।"এই আক্ষেপটি সত্য। এবং সঙ্গত। কিন্তু আক্ষেপটির একটি মধ্যবিত্ত চরিত্রও আছে। প্রশ্নকর্তা কোনো বড় ভারতীয় শহরের প্রবাসী বাঙালি হবেন। উত্তরদাতাও তাই। আমার প্রশ্ন, এমন কবিতা অসমিয়া, নাগা, মণিপুরি ভাষাতেও যে লেখা যায়, লেখা যেত--- এই তথ্য আমরা জানিতো, জানলেও মানিতো? কারণ, বাঙালি ছাড়া আর যে কাউকে ভারতের যে কোনো প্রান্তে গেলে কখনো কখনো সত্যি সত্যি ভিসা পাসপোর্টও চেয়ে বসা হয়। কিন্তু সেগুলোও মধ্যবিত্ত সমস্যা। সেই মধ্যবিত্ত বাঙালি হিন্দু যে আকছার,
"ও! মুসলমান! তাই বলুন!" বলে ভিরমি খাইয়ে দেয়, এবং বরাকের বিপন্ন বাঙালি হিন্দুও তাতে এককদম পেছনে যায় না, আমরা তাই নিয়ে কবিতা খুব লিখেছি কি? লিখেছি, সাহিত্য ১১২ তে অরিজিৎ চৌধুরীর লেখা 'অদেখা তুলির আঁচড়' গল্প পড়ে দেখুন। গল্পের কথক কলকাতাতে ছ'শ স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট দরকষাকষি করাটা খুব দরকারী বোধ করছে। কেননা, আসামের যে বাংলাভাষি অঞ্চলে তার বাস সেখানে একদিকে ডি-ভোটার হবার ভয়তো অন্য দিকে মৌলবাদীদের দাপটে দেশভাগের আগের পূর্বপাকিস্তান হয়ে উঠেছে।
এখন, যারা কলকাতাতে ফ্ল্যাট কিনতে যেতে পারেন, তাদের কাছে ভাষা শহীদ স্টেশনের নামাকরণটা যত জরুরি, ব্রডগেজ লাইন ততোটা নয়। কারণ, রেলে চড়ে মজুর কিষাণ, বাবুরা সব প্লেনে যান! নামাকরণের লড়াইটা যাদের নেতৃত্বে হচ্ছে, তাদের তদবির দেখলেই বোঝা যায় ব্রডগেজের কথাটা সঙ্গে থাকলেও লোক আসছেন ঐ নামাকরণেরই মোহে, কেননা এ তাদের আত্মমর্যাদার লড়াই। কিন্তু ব্রডগেজ কেন হবে না বলে যারা রেল অবরোধ, পথ অবরোধ আর টি আই ইত্যাদি করছে তারা অন্য। কিছু ছাত্র সংগঠন , যাদের সঙ্গে মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবি নেই! যাদের সমাবেশে গান গাইতে পাঞ্জাবী পরে কেউ যাবেন না তেমন। সামাজিক ভেদ রেখা এখনও বিলীন হয় নি, তাই পঞ্চাশ বছরে ১৯শের অর্জন নেই তেমন বিশেষ। ঢাকা দিল্লী কলকাতা কিছু দৌড়ঝাঁপ ছাড়া ।
*** *** ***
বছর দুই আগে গোটা বিশ্বের কাগজগুলোতে শিরোনামে এসছিলেন বৃদ্ধা বোয়া। আন্দামানের 'বো' ভাষার শেষ ব্যক্তি মারা গেলেন। এখন শুনছি, প্রতিবেশি নেপালেও কুসুন্দা ভাষার শেষ মহিলা জ্ঞানী মাইয়া সেন জীবিত আছেন। তাঁর পরে এই ভাষা বলবার মতো আর কেউ বেঁচে রইবেন না। তো সমস্যাটি যে শুধু অসমীয়া ভাষার থেকেই নয় আমরা কি জানি না? জানি, আজকাল শোনা যাচ্ছে ইংরেজি ভাষার দাপটে আর সব ভাষা যেতে বসেছে! বো কিম্বা কুসুন্দা ভাষা ইংরেজি ভাষার দাপটে যেতে বসেছে এই কথা বর্তমান লেখক বিশ্বাস করি না। আর যতদিন কেবল নিজের ভাষাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকব আমরা ততদিন ইংরেজির দাপটকে যে হটানো যাবে তাও করি না বিশ্বাস । এই ছবিটাও স্পষ্ট হবে যদি শুধু বরাক উপত্যকার নজির দিই। ভারতের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক স্তরে ইংরেজির বাইরেও দুই একটা ভাষা মাধ্যম হিসেবে স্বীকৃত। অসমেও যেমন অসমিয়া। কিন্তু যে শিলচর বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শের অবদান বলে গৌরব করা হয়, তার প্রতিষ্ঠার প্রায় দুটো দশক অতিক্রান্ত হবার পরেও কোত্থাও স্নাতক স্তরে বাংলা মাধ্যম হিসেবে চালু হয় নি। স্নাতকোত্তরে সবচ' বড় বিভাগটি বাংলা এই নিয়ে গৌরব করা যেতে পারে, কিন্তু অন্য সমস্ত বিদ্যাচর্চাতে বাংলাকে অস্পৃশ্য করে রাখা হয়েছে। অথচ, ভারতের প্রচুর বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে যেখানে স্নাতকোত্তর স্তরেও মাধ্যম কেবল ইংরেজি নয়। কেন? এই প্রশ্ন কাউকে তেমন করতে শোনা যায় না। কানাঘোষা শোনা যায়—বাংলা চালু করলেই মণিপুরিরাও দাবি করবে! আচ্ছা, বরাক বরাক উপত্যকা, বা অসমে বা পূর্বোত্তরে ওমন বিপন্ন ভাষাতো প্রচুর আছে। আমরা সেগুলোর সব ক'টাকে অন্তত প্রাথমিক স্তরে লেখা পড়ার ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেবার দাবিতে সরব হচ্ছি না কেন? পণ্ডিতজনে বলবেন, ওদের লিপি নেই, সাহিত্য নেই। আহা! যদি বৃদ্ধা বোয়া কিম্বা মাইয়া সেনের লিপি থাকত, কবিত্ব করতে জানতেন তাঁরা আমাদের বুদ্ধির গোড়ায় তবে বেশ করে সার পড়তে পেত!
বরাক উপত্যকার বৌদ্ধিক জগতে একটি বিশ্বাস প্রায় প্রবাদে পরিণত হয়েছে, "ধর্ম যে জাতীয়তার আধার হতে পারে না , পারে ভাষা—৭১এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ তা প্রমাণ করেছে।" না হয়, আমরা ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের ভয়াল রূপ সেদেশে দেখেছি, আমরা কি ভাষা জাতীয়তাবাদের রূপ দেখিনি ১৯শে মে, ২১ জুলাই, ১৮ ফেব্রুয়ারির অসমে? দেখেছি । দেখেও আমাদের চোখ ফিরিয়ে রেখেছি বাংলাদেশের দিকে। তাও সেদেশের পাহাড়ে তাকালে আমাদের ফোকলা স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে। অসমিয়া উগ্র জাতীয়তাবাদ থেকে কিছুতেই কম ভয়ঙ্কর নয় ওদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ। তারপরেও আমরা বাংলাদেশে তাকাই, কেন? কারণ ও ভাবেই আমরা, এখনো স্বপ্ন দেখি আমাদের ভেতরকার ধর্মীয় ভেদকে ভুলিয়ে দেব, ঠিক যেমন ১৯০৫এর বঙ্গভঙ্গের বিরোধী নেতৃত্ব এক ব্যর্থ স্বপ্ন দেখেছিলেন। সেই একই নেতৃত্ব যেমন ১৯৪৭এ দেশভাগের পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন আমাদেরও তেমনি ভেতরের স্বরূপ বেরিয়ে পড়ে সামান্য সুযোগ পেলেই। 'অদেখা তুলির আঁচড়ের গল্প'টিতো বললামই। সম্প্রতি দেখলাম শিলচর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পক্ষে ক'জন লেখক, বুদ্ধিজীবি, শিক্ষাবিদ কাগজে চিঠি লিখেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে প্রবল ছাত্র-শিক্ষক আন্দোলন হচ্ছে ক'মাস ধরে। তার মধ্যে আলাদা করে কিছু দলিত , সংখ্যালঘু সংগঠনও যোগ দিয়েছে। কিছু কিছু সংবাদ মাধ্যমও হয়েছে সরব। দু'পক্ষই দাবি করছে বিশ্ববিদ্যালয় ১৯শের অর্জন । এর সম্মান ধুলিস্যাৎ করা হচ্ছে। যারা লড়াই করছে তারা উপাচার্যের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আনছেন। যারা উপাচার্যের পক্ষে তারা আন্দোলন করিয়েদের বিরুদ্ধে। এমনটাই দেখা যায় যখন ডিব্রুগড় বা গৌহাটি বিশ্ববিদ্যালয়ে লড়াই হলে। পক্ষ প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে জাতিধ্বংসের অভিযোগ এনে স্বপক্ষ সবল করবার চেষ্টা করে। কিন্তু সেই আন্দোলন বিরোধী বুদ্ধিজীবিরা যখন লেখেন, " ...দেখেছি কীভাবে সংবাদমাধ্যমের একটি আমাদের সর্বনাশের ডঙ্কা বাজাচ্ছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নানাভাবে প্রলোভিত করে সাম্প্রদায়িকতার পঙ্কিল পথে হেঁটে 'তাঁরা' আমাদের বিপর্যস্ত করতে চাইছেন...।" তখন বুঝি আমাদের সর্বনাশের ডঙ্কা বাজবার অপেক্ষা আছে কি আর? আছে শুধু কলকাতাতে দশ ফুট বাই দশ ফুট ঘরের ফ্ল্যাট কেনার স্বপ্ন...। আমাদের অন্য সমস্ত স্বপ্ন ভাষার সঙ্গে বিদেয় নিয়েছে। তারা সবাই শহীদ হয়েছে।
http://www.guruchandali.com/guruchandali.Controller?portletId=8&porletPage=2&contentType=content&uri=content1337398234685#.UR5bKB2BlA0
মাতৃভাষার আন্দোলনঃ জানার আছে অনেক কিছুই
পোস্টাইছেন: প্রমিথিউস » ২৩ জানুঃ, ২০১১, রবিবার, ১৮:১৯ শেষভাগ
ভাষা মানুষের সাংস্কৃতিক বিকাশের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ভাষার উদ্ভব ও তার বিকাশের পরিপূর্ণতা আমাদের মানব সভ্যতায় বড় ধরনের পরিবর্তনের সূচনা করেছিলো। তাই সভ্যতার ক্রমবিকাশে ভাষাকে অবহেলা করার কোনো সুযোগ নাই।
মানুষের জন্ম ও বিকাশের সাথে তার মাতৃভাষার প্রত্যক্ষ সংযোগ রয়েছে। শিশু এই পৃথিবীতে এসে প্রথম যেই ভাষার, যেই ধ্বনির সাথে পরিচিত হয় তা তার মাতৃভাষা হতেই আসে, সবচেয়ে ভালোবাসা আর উষ্ণতা লাভ করে যে মায়ের কাছ থেকে তার ভাষাই তার আপন হয়ে ওঠে অনেক বেশি। তাই মায়ের ভাষা মানুষের কাছে এক অমূল্য সম্পদ। শোকে- ক্ষোভে- আনন্দ- উচ্ছ্বলতায় মানুষের সব অনুভূতির সত্যিকার প্রকাশ ঘটে তার মাতৃভাষাতেই।
বাঙালি জাতির মাতৃভাষা বাংলা। তাই সে বাংলাতে কথা বলবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু দেখা গিয়েছে ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে বাঙালির প্রাণের ভাষাকে দমিয়ে রাখা হয়েছে অথবা তার ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলার দামাল ছেলেরা তাদের মায়ের ভাষার জন্য অকাতরে জীবন বিলিয়ে দিয়ে বুঝিয়ে দেয় কতটুকু দামী আমাদের এই মাতৃভাষা আর সেই সাথে প্রতিষ্ঠিত করে আমাদের মাতৃভাষার অধিকার।
বর্তমানের পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্র দুটি পূর্বে ব্রিটিশ শাসনাধীন অবিভক্ত ভারতবর্ষের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৯-শতকের মাঝামাঝি সময় থেকে উর্দু ভাষাটি মুসলমান রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতা যেমন স্যার খাজা সলিমুল্লাহ, স্যার সৈয়দ আহমদ খান,নওয়াব ভিকার-উল-মুলক এবং মৌলভী আবদুল হকের চেষ্টায় ভারতীয় মুসলমানদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কায় উন্নীত হয়। উর্দু একটি ইন্দো-আর্য ভাষা, যা ইন্দো-ইরানীয় ভাষাগোষ্ঠীর সদস্য,যা আবার ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা-পরিবারের অন্তর্ভুক্ত। উর্দু ভাষাটি অপভ্রংশের (মধ্যযুগের ইন্দো-আর্য ভাষা পালি-প্রাকৃতের সর্বশেষ ভাষাতাত্ত্বিক অবস্থা) ওপর ফার্সি, আরবি এবং তুর্কির ঘনিষ্ঠভাবে প্রভাবে প্রভাবিত হয়ে দিল্লি সুলতানাত ও সাম্রাজ্যের সময়ে দক্ষিণ এশিয়ায় বিকশিত হয়। এর পারসিক-আরবি লিপির কারণে উর্দুকে ভারতীয় মুসলমানদের ইসলামী সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ হিসেবে বিবেচনা করা হত; যেখানে হিন্দি এবং দেবনাগরী লিপিকে হিন্দুধর্মের উপাদান বিবেচনা করা হত।
উর্দুর ব্যবহার ক্রমেই উত্তর ভারতের মুসলমানদের মধ্যে জনপ্রিয়তা লাভ করতে থাকে, কিন্তু বাংলার (ব্রিটিশ ভারতের পূর্বাঞ্চলের একটি প্রদেশ) মুসলমানেরা বাংলা ভাষা ব্যবহারেই অভ্যস্ত ছিল। বাংলা পূর্বাঞ্চলীয় মধ্য ইন্দো ভাষাসমূহ হতে উদ্ভূত একটি পূর্বাঞ্চলীয় ইন্দো-আর্য ভাষা,যা বাংলার নবজাগরণের সময়ে বিপুল বিকাশ লাভ করে। ১৯ শতকের শেষভাগ হতেই মুসলিম নারী শিক্ষার অগ্রদূত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন বাংলা ভাষায় সাহিত্য চর্চা শুরু করেন এবং আধুনিক ভাষা হিসেবে বাংলার বিকাশ তখন থেকেই শুরু হয়। বাংলা ভাষার সমর্থকরা ভারত ভাগের পূর্বেই উর্দুর বিরোধিতা শুরু করেন, যখন ১৯৩৭ সালে মুসলিম লীগের লক্ষ্মৌ অধিবেশনে বাংলার সভ্যরা উর্দুকে ভারতের মুসলিমদের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা মনোনয়নের প্রস্তাবটি প্রত্যাখ্যান করেন।
আন্দোলনের শুরু হলো
ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশ শাসিত অঞ্চলগুলো ১৯৪৭ এবং ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভ করে চারটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত হয়: ভারত, বার্মা (বর্তমান মায়ানমার), সিংহল (বর্তমান শ্রীলংকা), এবং পাকিস্তান (যার মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানও অন্তর্ভুক্ত ছিল, যা অধুনা বাংলাদেশ নামে পরিচিত)।
১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পর পূর্ব পাকিস্তানের (পূর্ব বাংলা হিসেবেও পরিচিত) বাংলাভাষী ৪ কোটি ৪০ লক্ষ মানুষ ৬ কোটি ৯০ লাখ জনসংখ্যা বিশিষ্ট নবগঠিত পাকিস্তানের নাগরিকে পরিণত হয়। কিন্তু পাকিস্তান সরকার, প্রশাসন এবং সামরিক বাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। ১৯৪৭ সালেই করাচীতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ব্যবহারের সুপারিশ করা হয় এবং প্রচারমাধ্যম ও স্কুলে কেবলমাত্র উর্দু ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। তাৎক্ষণিকভাবে এ প্রস্তাবের বিরোধিতা ও প্রতিবাদ জানানো হয়। ঢাকার ছাত্রসমাজ আবুল কাসেম এর নেতৃত্বে মিছিল করে, যিনি ছিলেন তমদ্দুন মজলিস নামক একটি বাঙালি ইসলামীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পাদক। ওই সমাবেশে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্ব পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহারের প্রবল দাবী উত্থাপন করা হয়। কিন্তু পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন বাংলাকে তাদের অনুমোদিত বিষয়তালিকা হতে বাদ দেয় এবং সাথে সাথে মুদ্রা ও স্ট্যাম্প হতেও বাংলা অক্ষর লুপ্ত হয়। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা বানানোর জন্যে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তানে জনরোষের সৃষ্টি হয় এবং ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বাঙালি ছাত্রদের একটি বিশাল সমাবেশে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের আনুষ্ঠানিক দাবী উত্থাপন করা হয়। দাবী আদায়ের লক্ষ্যে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল, মিটিং ও র্যালির আয়োজন করে।
গণপরিষদে বাংলার দাবি
১৯৪৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণ-পরিষদে বাংলা ভাষায় কথা বলার জন্য একটি সংশোধনী আনেন। তার বক্তৃতায় বাংলাকে অধিকাংশ জাতি গোষ্ঠীর ভাষা হিসেবে উল্লেখ করে ধীরেন্দ্রনাথ বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়ার দাবি করেন। তিনি বলেন- "The state language of the state should be the language which is used be the majority of the people of the state, and for that, sir, I consider that Bengalee language is a lingua francafor our state"... এছাড়াও সরকারী কাগজে বাংলা ভাষা ব্যবহার না করার সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানান তিনি। তমিজুদ্দিন খানের নেতৃত্বে পরিষদের সকল মুসলমান সদস্য (সবাই মুসলিম লীগের) এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করেন। খাজা নাজিমুদ্দিন এই প্রস্তাবের বিরোধীতা করে বক্তৃতা দেন। প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান একে পাকিস্তানে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা বলে উল্লেখ করেন। অনেক বিতর্কের পর সংশোধনীটি ভোটে বাতিল গণ্য হয়। সংসদীয় দলের আপত্তির কারণে অনেক বাঙালি মুসলমান সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উত্থাপিত সংশোধনীটিকে সমর্থন করতে পারেননি
সে আগুন ছড়িয়ে গেলো সবখানে
গণপরিষদের ঘটনার প্রথম প্রতিক্রিয়া শুরু হয় ঢাকায়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও জগন্নাথ কলেজের উদ্যোগে শহরের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে । তমদ্দুন মজলিস এই সময়ে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলে ছাত্র-বুদ্ধিজীবিদের এক সমাবেশ ঘটে। সেখান হতে ছাত্ররা ১১ই মার্চ ধর্মঘট আহবান করে এবং ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে তাঁর পদক্ষেপের জন্য ধন্যবাদ জানায়।
১১ মার্চ ভাষার দাবিতে প্রতিবাদি কর্মসূচী পালনের সময় পুলিশ শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলি, কাজী গোলাম মাহবুব, রওশন আলম, রফিকুল আলম, শাহ্ মোঃ নাসিরুদ্দীন, নুরুল ইসলাম প্রমুখ ছাত্র নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করে। আন্দোলন ক্রমশ তীব্র রূপ ধারন করে। ১৫ই মার্চ ছাত্ররা বের হয়ে এসে আবার পিকেটিং শুরু করলে সচিবালয়ের কর্মচারী এবং রেলওয়ে ক্লার্করা তাদের সমর্থন করে। এদিকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা (কায়েদে আজম) মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ্-র সফরের দিন এগিয়ে আসার কারণে ও মুসলীম লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে বিপর্যস্ত খাজা নাজিমুদ্দিন আন্দোলনকারীদের সাথে আলোচনার আহবান জানান। তিনি কমরুদ্দিন আহমেদের কাছে দুই জন প্রতিনিধি পাঠান চুক্তির লক্ষ্যে। কমরুদ্দিন দ্রুত বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে অন্যান্য নেতাদের সাথে কথা বলেন। এরপর তিনি নাজিমুদ্দিনের কাছে গিয়ে চুক্তি সম্পাদনের পূর্বে কারাগারে আটক নেতাদের (শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ প্রমুখ) সাথে কথা বলতে চান। এরপর তাদের সম্মতিতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্র এই ব্যাপারে না জানায় তারা তাদের কর্মসূচী অব্যহত রাখে। যখন ছাত্ররা এই ব্যাপারে জানতে পারে, তখন তারা এটাকে ষড়যন্ত্র মনে করে চুক্তির ব্যাপারে খাজা নাজিমুদ্দিনের কাছে সুস্পষ্ট বক্তব্যের দাবি করেন। কিন্তু খাজা নাজিমুদ্দিন এই ব্যাপারে মুখ খোলেননি।
১৯শে মার্চ, ১৯৪৮-এ ঢাকায় এসে পৌছান পাকিস্তানের স্থপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। ২১শে মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যান) এক গণ-সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয় যেখানে তিনি একটি ভাষণ প্রদান করেন। যদিও তিনি বলেন পূর্ববঙ্গের প্রাদেশিক ভাষা নির্ধারিত হবে প্রদেশের অধিবাসীদের ভাষা অনুযায়ী, কিন্তু দ্ব্যর্থহীন চিত্তে ঘোষণা করেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, অন্য কোন ভাষা নয়। জিন্নাহ্-র এই মন্তব্যে তাৎক্ষনিকভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে উপস্থিত ছাত্রসহ জনতার একাংশ। ২৪শে মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে গিয়ে তিনি একই ধরনের বক্তব্য রাখেন। তিনি উল্লেখ করেন এই আন্দোলন সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গীর বহিঃপ্রকাশ এবং অভিযোগ করেন কিছু লোক এর মাধ্যমে তাদের স্বার্থসিদ্ধি করতে চাইছে। যখন তিনি উর্দুর ব্যাপারে তার অবস্থানের পুনরুল্লেখ করেন উপস্থিত ছাত্ররা সমস্বরে না, না বলে চিৎকার করতে থাকে। একই দিনে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটি প্রতিনিধিদল জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দবি জানিয়ে একটি স্মারক লিপি দেন। এই প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাশেম, তাজউদ্দিন আহমদে, মোহাম্মদ তোয়াহা, আজিজ আহমদ, অলি আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শামসুল আলম এবং নজরুল ইসলাম। কিন্তু জিন্নাহ্ খাজা নাজিমুদ্দিনের স্বাক্ষরিত চুক্তিকে একপেশে এবং চাপের মুখে সম্পাদিত বলে প্রত্যাখান করেন। অনেক তর্ক-বিতর্ক ও অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য জিন্নাহ্-র নিকট স্মারকলিপি পেশ করে। ২৮শে মার্চ জিন্নাহ্ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং সেদিন সন্ধ্যায় রেডিওতে তার দেয়া বক্তব্যে তার অবস্থানের কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। জিন্নাহ্-র ঢাকা ত্যাগের পর, ছাত্রলীগ এবং তমুদ্দন মজলিসের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে তমুদ্দন মজলিসের আহবায়ক শামসুল আলম তার দায়িত্ব মোহাম্মদ তোয়াহার কাছে হস্তান্তর করেন এবং পরে তারা আস্তে আস্তে আন্দোলনের পথ থেকে সরে আসে।
এরপরও আন্দোলন থেমে থাকেনি, বিভিন্নভাবে চলতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের পুনরায় জোরালো হওয়ার পেছনে ২৭শে জানুয়ারি ১৯৫২ সালের খাজা নাজিমুদ্দিনের ভাষণ প্রধান নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদে আসীন খাজা নাজিমুদ্দিন ২৫শে জানুয়ারি ঢাকায় আসেন এবং ২৭শেজানুয়ারি পল্টন ময়দানের এক জনসভায় দীর্ঘ ভাষণ দেন। তিনি মূলতঃ জিন্নাহ্-র কথারই পুনরুক্তি করে বলেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। রেডিওতে সরাসরি সম্প্রচারিত তার ভাষণে তিনি আরো উল্লেখ করেন কোন জাতি দু'টি রাষ্ট্রভাষা নিয়ে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে পারেনি।
নাজিমুদ্দিনের বক্তৃতার প্রতিবাদে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ২৯শে জানুয়ারি প্রতিবাদ সভা এবং ৩০শে জানুয়ারি ঢাকায় ছাত্র ধর্মঘট পালন।
১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বার লাইব্রেরি হলে অনুষ্ঠিত সভায় মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ৪০ সদস্যের 'সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ্' গঠিত হয়। সভায় আরবি লিপিতে বাংলা লেখার সরকারি প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করা হয় এবং ৩০ শে জানুয়ারির সভায় গৃহীত ধর্মঘটে সমর্থন দেওয়া হয়। পরিষদ্ ২১শে ফেব্রুয়ারি হরতাল, সমাবেশ ও মিছিলের বিস্তারিত কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে।
২০শে ফেব্রুয়ারি সরকার এক মাসের জন্য সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে। ঐদিন রাতে বৈঠক করে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে এবং পূর্বনির্ধারিত কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়।
রক্তাক্ত একুশ
সকাল ৯টা থেকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এসে জড়ো হয়। তারা ১৪৪ ধারা জারির বিপক্ষে স্লোগান দিতে থাকে এবং পূর্ব বঙ্গ আইন পরিষদের সদস্যদের ভাষা সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতকে বিবেচনা করার আহ্বান জানাতে থাকে।
পুলিস অস্ত্র হাতে সভাস্থলের চারদিকে প্রাচীর তৈরি করে। বিভিন্ন অনুষদের ডীন এবং উপচার্য সে সময় উপস্থিত ছিলেন। বেলা সোয়া এগারটার দিকে ছাত্ররা গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামতে চাইলে পুলিস কাঁদানে গ্যাস বর্ষণ করে ছাত্রদের সতর্ক করে দেয়।
কিছু ছাত্র এই সময়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের দিকে দৌড়ে চলে গেলেও বাকিরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে পুলিস দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে এবং পুলিসের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। উপাচার্য তখন পুলিসকে কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ বন্ধ করতে এবং ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ত্যাগ করতে বলে। কিন্তু ছাত্ররা ক্যাম্পাস ত্যাগ করার সময় পুলিস তাদের গ্রেফতার করা শুরু করলে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ে। অনেক ছাত্রদের গ্রেফতার করে তেজগাঁও নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনায় ছাত্ররা আরও ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পুনরায় শুরু করে। এই সময় প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে কিছু মহিলা তাদের এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।
বেলা ২টার দিকে আইন পরিষদের সদস্যরা আইনসভায় যোগ দিতে এলে ছাত্ররা তাদের বাধা দেয় এবং সভায় তাদের দাবি উত্থাপনের দাবি জানায়।
কিন্তু পরিস্থিতি নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে যখন কিছু ছাত্র সিদ্ধান্ত নেয় তারা আইন সভায় গিয়ে তাদের দাবি উত্থাপন করবেন। ছাত্ররা সেই উদ্দেশ্যে রওনা করলে বেলা ৩টার দিকে পুলিস দৌড়ে এসে ছাত্রাবাসে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিসের গুলিবর্ষণের কিছু ছাত্রকে ছাত্রাবাসের বারান্দায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমেদ ঘটনাস্থলেই নিহত হন। আবুল বরকত সে সময় আহত হন এবং রাত ৮টায় প্রয়াত হন। গুলিবর্ষণের সাথে সাথে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে কর্তব্যরত ডাক্তার এবং নার্সরা পূর্বে আহত ছাত্রদের বের করে গুলিবিদ্ধ ছাত্রদের চিকিৎসা করতে থাকেন।
ছাত্র হত্যার সংবাদ দ্রুত ছড়িয়ে পড়লে জনগন ঘটনাস্থলে আসার উদ্যোগ নেয়। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত অফিস, দোকানপাট ও পরিবহণ বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্রদের শুরু করা আন্দোলন সাথে সাথে জনমানুষের আন্দোলনে রূপ নেয়। রেডিও শিল্পীরা তাৎখনিক সিদ্ধান্তে শিল্পী ধর্মঘট আহবান করে এবং রেডিও স্টেশন পূর্বে ধারণকৃত অনুষ্ঠান সম্প্রচার করতে থাকে।
ফেব্রুয়ারির ২২ তারিখে সারা দেশ হয়ে উঠে মিছিল ও বিক্ষোভে উত্তাল। জনগণ ১৪৪ ধারা অমান্য করার পাশাপাশি শোক পালন করতে থাকে। বিভিন্ন অফিসের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কর্মস্থল ত্যাগ করে ছাত্রদের মিছিলে যোগ দেয়। সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও শহরের নাগরিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ ছাত্রাবাস পরিদর্শন করেন। পরে তাদের অংশগ্রহনে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজা শেষে বিশাল মিছিলে অংশগ্রহণ করে। বেলা ১১ টার দিকে ৩০ হাজার লোকের একটি মিছিল কার্জন হলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। প্রথমে পুলিশ তাদের সরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এবং এক পর্যায়ে তাদের উপর গুলিবর্ষণ করে। এই ঘটনায় সরকারি হিসেবে ৪ জনের মৃত্যু হয়।
নবাবপুর রোডের বিশাল মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষনে ঘটনায় শফিউর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে পরে মারা যান। একই রাস্তায় অহিদুল্লাহ নামে নয় বছরের এক বালকের লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। জনশ্রুতি আছে পুলিশ কিছু লাশ কৌশলে সরিয়ে ফেলে। আজাদের তথ্যমতে মৃতের সংখ্যা ছিল ৪ এবং সৈনিকের তথ্যমতে ছিল ৮।
স্মৃতির শহীদ মিনার
২৩ ফেব্রুয়ারি সাড়া রাত ঢাকা ম্যাডিকেল কলেজের ছাত্রবৃন্দ শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে কাজ করেন। যা ফেব্রুয়ারি ২৪ তারিখের মধ্যে সম্পূর্ণ হয়েছিল। তাতে একটি হাতে লেখা কাগজ যুক্ত করা হয়েছিল যাতে লেখা ছিল শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ। স্মৃতিস্তম্ভডটি ২২ ফেব্রুয়ারি অনানুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন আন্দোলনে নিহত শফিউর রহমানের পিতা। ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে দশটার দিকে শহীদ মিনার উদ্বোধন করেন আজাদ সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন স্মৃতিস্তম্ভটি পুলিশ ফেব্রুয়ারি ২৬ তারিখে ভেঙে দিয়েছিল। এরপর ঢাকা কলেজেও একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হয়, এটিও একসময় সরকারের নির্দেশে ভেঙ্গে ফেলা হয়। অবশেষে, বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। এর নির্মান কাজ শেষ হয় ১৯৬৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির তত্ত্বাবধানে।
প্রভাতফেরীর গান
২১ ফেব্রুয়ারি গুলিবর্ষণের ঘটনার পর, একুশ নিয়ে প্রথম গান লেখেন আবদুল গাফফার চৌধুরী। গানটি হল, আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি। প্রথমে আবদুল লতিফ সুর দেন। পরে করাচী থেকে ঢাকা ফিরে ১৯৫৪ সালে আলতাফ মাহমুদ আবার নতুন সুর দিলেন। সেই থেকে ওটা হয়ে গেল একুশের প্রভাত ফেরীর গান। ১৯৫৪ সালে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত একুশে সংকলনে প্রকাশিত গানটি। তৎকালীন সরকার সংকলনটি বাজেয়াপ্ত করে। জহির রায়হান তার জীবন থেকে নেয়া ছবিতে এই গানটি ব্যবহার করার পর এর জনপ্রিয়তা আরো বাড়ে। ২১শে ফেব্র"য়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পাবার পর এই গানটিও আন্তর্জাতিকতা পেতে শুরু করে। ইতিমধ্যে সুইডিশ ও জাপানি ভাষার অনুদিত হয়েছে।
বাংলার সাংবিধানিক স্বীকৃতি
এভাবে বিভিন্ন রকম সামাজিক- সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের ভিতর দিয়ে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার দাবি অনেক বেশি জোরালো হতে থাকে। অবশেষে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এলে বাংলা একাডেমী গঠনের উদ্যোগ নেয়া হয়। সফল যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠনের কিছুদিন পরেই সামরিক আইন জারি হয় এবং ১৯৫৫ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি সরকার এই প্রকল্প বাতিল করে দেয়। এর আগে ১৯শে ফেব্রুয়ারি সরকার সকল ধরনের নাগরিক অনুষ্ঠানের উপর ১৪৪ ধারা জারি করে। কিন্তু ছাত্র ও সাধারণ জনগন ২১ তারিখ রাতের বেলা ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে সমবেত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাসে শোকের কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। পুলিস ক্যাম্পাসে সমবেত জনতা ও ছাত্রদের উপর আক্রমণ করে বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করে। পরে তাদের কারাগারে পাঠানো হলে সেখানে পূর্বে বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতারকৃত ভাষা আন্দোলনকারীদের সাথে তাদের দেখা হয়। গ্রেফতারকৃত ছাত্ররা জামিন নিতে অস্বীকার করে এবং সরকারের পদত্যাগের দাবি জানায়। পরে তাদের মুক্তি দিয়ে আন্দোলনকারীদের ছেড়ে দিতে শুরু করে। এরই মধ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়। ১৯৫৬ সালে প্রথমবারের মতো সরকারের প্রচ্ছন্ন সহযোগিতায় ২১শে ফেব্রুয়ারি পালিত হয়। সেদিন প্রথম শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। পাকিস্তানের গণপরিষদে পাচ মিনিট বন্ধ রাখা হয় ভাষা আন্দোলনের শহীদদের স্মরণে। সারাদেশব্যপী পালিত হয় শহীদ দিবস এবং বেশীরভাগ প্রতিষ্ঠান ছিল বন্ধ। আরমানীটোলায় এক বিশাল সমাবেশের নেতৃত্ব দেন মাওলানা ভাসানী।
ভাষা আন্দোলন শুরুর প্রায় দশ বছর পর বাংলা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি পায় ১৯৫৬ সালের ২৯শে ফেব্রুয়ারি। সংবিধানের ২১৪ অধ্যায়ে রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখা হয়:
" 214.(1) The state language of Pakistan shall be Urdu and Bengali "
অর্থাৎ উর্দু এবং বাংলা হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ব্রিটিশ আমল থেকেই দাপ্তরিক ভাষা হিসাবে ইংরেজির প্রচলন ছিল। ১৯৬২ সালের ১লা মার্চ আইয়ূব খান পাকিস্তান প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে (The Consititution of the Republic of Pakistan) বাংলাকে জাতীয় ভাষা হিসাবে উল্লেখ করা হয়:
" The national languages of Pakistan are Bengali and Urdu "
স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ৪ঠা নভেম্বর প্রকাশিত বাংলাদেশের সংবিধানে বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দেয়া হয়:
" প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা (The state language of the republic is Bangla)
"
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা
২১ ফেব্রুয়ারিকে 'আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস' হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকার ইউনেস্কোর কাছে লিখিতভাবে প্রস্তাব করে, যা ১৯৯৯ সালের ১৭ নভেম্বর ইউনেস্কোর ৩০তম সাধারণ অধিবেশনে নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়ে পাশ হয়। এর পর থেকে সারা বিশ্বের কোটি কোটি লোক প্রতিবছর ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিবে পালন করে আসছে।
জানার কিছু আছে বাকী...
প্রকৃতপক্ষে পৃথিবীতে বাংলাদেশের বাঙালীরাই একমাত্র জাতি নয় যারা আপন মাতৃভাষার জন্য জীবন দিয়েছে এবং বুকের রক্ত ঝরিয়েছে।
বাংলার জন্য শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালিরাই জীবন উৎসর্গ করেনি, করেছে আসামের জনগণও। কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য এই ব্যাপারে নিচে দেওয়া হলো যা আমাদের ইতিহাসের সঠিক মূল্যায়ন করতে শেখাবে-
(১) বাহান্নর ফেব্রুয়ারিতে বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে প্রাণ দিয়েছেন সালাম, রফিক, সফিয়ুর, বরকত ও জব্বার। বাহান্নর চেতনায় উদ্দীপ্ত হয়ে ১৯৬১ সালের মে মাসে বাংলা ভাষার ব্যবহার বন্ধ করার প্রতিবাদে ভারতের রাজ্য আসামের শিলচর শহরে পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন এগারো জন ভাষাশহীদ। দুঃখের বিষয় ইতিহাস তাঁদের তেমন মনে রাখেনি।
আসাম রাজ্যর প্রধান ভাষা অহমীয়া হলে বরাক উপত্যকার করিমগঞ্জ,কাছাড় এবং শিলচর হলো বাঙালীদের ঘাঁটি। দেশবিভাগের একবছর পর ১৯৪৮ সালে রেফারেন্ডামের মাধ্যমে সুরমা ভ্যালী (বর্তমান সিলেট বিভাগ) পূর্বপাকিস্তানের অন্তর্ভূক্ত হয় । কিন্তু বৃহত্তর সিলেটের তিন চতুর্থাংশ নিয়ে বরাক ভ্যালী থেকে যায় আসামে । ১৯৬১ সালে আসাম প্রাদেশিক সরকার শুধু অহমীয়া ভাষাকে রাজ্যের একমাত্র সরকারী ভাষা ঘোষনা দিলে ক্ষোভ দানা বাঁধে বাঙালীদের ভেতর । ক্রমশঃ তা রূপ নেয় আন্দোলনে । প্রথমে সত্যাগ্রহ, পরে সহিংস ।
১৯৬১ সালের ১৯ মে । আন্দোলনের চুড়ান্ত পর্বে এদিন শিলচরে সকাল ৬টা-সন্ধ্যা ৬টা ধর্মঘট পালন করে। বেলা ৩টা ৩০ মিনিটে ভাষাবিপ্লবীরা যখন স্থানীয় রেলওয়ে ষ্টেশনে রেলপথ অবরোধ পালন করছিল তখন নিরাপত্তারক্ষায় নিয়োজিত আসাম রাইফেলসের একটি ব্যাটালিয়ান তাদের বাধা দেয়। সংঘর্ষের এক পর্যায়ে আসাম রাইফেলস গুলবর্ষন করলে ঘটনাস্থনে প্রান হারান ১১ জন ভাষাবিপ্লবী। আহত হন অর্ধশতাধিক। রাজ্য সরকার শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। এরপর আসামে বাংলাকে ২য় রাজ্যভাষা হিসাবে ঘোষনা দেয়া হয়।
সেদিন মাতৃভাষার জন্য যে ১১ জন বীর শহীদ আত্মবলি দেন তাদের মধ্যে ছিলেন পৃথিবীর প্রথম নারী ভাষাশহীদ সতের বছরের তরুনী কমলা ভট্টাচার্য। পৃথিবীর ইতিহাসে মাত্র দুজন নারী মাতৃভাষার জন্য প্রাণ উৎসর্গ করেছেন- একজন শহীদ কমলা ভট্টাচার্য, দ্বিতীয় জন শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ যিনি বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে শহীদ হন।
১৯ মের ১১ জন ভাষাশহীদদের তালিকা -
১. শহীদ কমলা ভট্টাচার্য
২. শহীদ শচীন্দ্র পাল
৩. শহীদ বীরেন্দ্র সূত্রধর
৪. শহীদ কানাইলাল নিয়োগী
৫. শহীদ চন্ডিচরন সূত্রধর
৬. শহীদ সত্যেন্দ্র দেব
৭. শহীদ হীতেশ বিশ্বাস
৮. শহীদ কুমুদরঞ্জন দাস
৯. শহীদ তারিণী দেবনাথ
১০. শহীদ সুনীল সরকার
১১. শহীদ সুকুমার পুরকায়স্থ
আসামে ১৯ মে এখনও ভাষাদিবস পালন করা হয়।
(২) ১৯৫৫ সন থেকেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা মাতৃভাষার অধিকারের আন্দোলনে ঐক্যবদ্ধ হতে শুরু করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলন(১৯৫৫-১৯৯৬) শুরু হয় 'নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভার' ১৯৫৫ সালের দাবীর ভেতর দিয়েই, যেখানে তাদের দাবী ছিল আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে বিষ্ণুপ্রিয়া শিশুদের মাতৃভাষায় শিক্ষাদান। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংবিধানিক স্বীকৃতি এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে ভাষা পরিষদের উদ্যোগে গড়ে উঠে 'সত্যাগ্রহ আন্দোলন'। সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সাতটি দাবীর ভেতর ছিল : আসাম ও ত্রিপুরা রাজ্যে প্রাথমিক স্তরে শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতি, আসামের রাজধানী গুয়াহাটি থেকে রাষ্ট্রীয় বেতার কার্যক্রমে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সাংস্কৃতিক কার্যক্রম প্রচার, নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদকে আর্থিক সহযোগিতা প্রদান, কেন্দ্র ও রাজ্য সভাতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের আসন সংরক্ষণ, সরকারী ও বেসরকারী পর্যায়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের কোটা সংরক্ষন, ভাষিক সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা প্রদান এবং ১৯৬১ সালের আদমশুমারীর সংশোধন।
সত্যাগ্রহ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৬১ সালের ২ জুলাই ভাষা পরিষদ ভাষা দাবী দিবস পালন করে। ১৯৬১ সনের ২৫ জুলাই আসাম রাজ্যের শিক্ষা বিভাগের সাথে যোগাযোগ করা হয়। ১৯৬৩ সনের ২২ মার্চ শ্রী ডি এন বাজপেয়ি নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদের সাথে দেখা করেন। ভাষা পরিষদ ১৯৬৪ সালের ৭ জুলাই আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে একটি মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৪ সালেরই ২৮ জুলাই বিষয়টি নিয়ে পদক্ষেপ নেয়ার জন্য রাজনৈতিক বিভাগের কাছে পাঠানো হয়। ১৯৬৫ সালের ২-৮ জুলাই ভাষা দাবী সপ্তাহ পালন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা পরিষদ স্টেট বোর্ড অব ইলিমেন্টারি এড্যুকেশন এর সেক্রেটারি শ্রী কে কে শর্মার সাথে সাক্ষৎ করেন এবং তাকে আসামে দ্রুত বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা প্রাথমিক শিক্ষাস্তরে চালুর প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। ১৯৬৭ সালের ২ জুলাই দাবী সপ্তাহ ১২ দিন দীর্ঘায়িত করা হয় এবং কাছাড় জেলার সর্বত্র পাবলিক সভা সমাবেশ করা হয়, এইসব সভায় আদমশুমারী জালিয়াতির বিরুদ্ধে জোড়দার বক্তব্য রাখা হয়। ১৯৬৭ সালের নভেম্বরে ভাষা পরিষদ নিজেরাই নিজস্ব উদ্যোগে জনপরিসংখ্যান উত্থাপন করেন এবং কাছাড়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের জনসংখ্যা দেখান ৬৬,৬২৩ জন। ১৯৬৮ সালের মে মাস থেকেই স্কুল, কলেজসহ রাস্তা ঘাটে পিকেটিং, ধর্মঘট, গণশ্লোগানের কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৬৮ সালের জুলাই মাসেই পাবলিক সভা গুলো আরো ব্যাপক বিস্তৃত হয় এবং ১৯৬১ সনের উপনিবেশিক আদমশুমারী প্রতিবেদন পোড়ানো হয়। ১৯৬৮ সনেরই ২৫ জুলাই আসামের শিক্সমন্ত্রী জে বি হেগজার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দাবীর প্রেক্ষিতে ভারত সরকারের ভাবনা তুলে ধরেন। একই সনের ৩০ আগস্ট কাছাড়ের জনগণ আবারো আসামের মূখ্যমন্ত্রীর কাছে দাবী দাওয়া সংবলিত মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৬৯ সালের ১৫ অক্টোবর কাছাড়ের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষার্থী ও যুবসমাজ রক্ত দিয়ে রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে। এর পর পরই ভাষা আন্দোলন আরো চূড়ান্ত গণ রূপ নেয় এবং ব্যাপক ধর্মঘট, ধরপাকড়, বন্ধ কর্মসূচি চলতে থাকে। ১৯৬৯ সালের ২২ অক্টোবর কাতিগড়া বন্ধ কর্মসূচি থেকে ৭ জন ভাষাবিদ্রোহীকে গ্রেফতার করা হয়। ১৯৬৯ সনে পূর্ব পাকিস্থানে একদিকে যেমন চলতে থাকে গণঅভুত্থান একই দিকে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলন বন্ধ-ধর্মঘট- ঘেরাও-গ্রেফতারের ভেতর দিয়ে জনরূপ নেয়। নরসিংহপুর, রাতাবাড়ি, শালচাপড়া বন্ধ(৫-২৯ অক্টোবর,১৯৬৯)। জাপিরবন্দ বন্ধ(৩০ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়, এই পয়লা কোনো নারী ভাষাবিপ্লবীও গ্রেফতার হন। মেহেরপুর বন্ধ (৩১ অক্টোবর ১৯৬৯) থেকে ৫ জন নারী আন্দোলনকারীসহ ৩ জনকে গ্রেফতার করা হয়। পয়লা নভেম্বর' ১৯৬৯ সালের পিকেটিং থেকে ২৯ জনকে গ্রেফতার করা হয়, ৩ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার হন ৩৮৫ জন, ১-৫ নভেম্বরের ভেতর তিন জেলার ডিসি অফিসে পিকেটিং করে চেয়ার দখল করে নেয়া হয়, ৪-৫ নভেম্বর ১৯৬৯ গ্রেফতার করা হয় ১১১ জনকে। রাষ্ট্রের ধরপাকড় ও নির্যাতনমূলক শাসনের বিরুদ্ধে ১১-১৩ নভেম্বর ১৯৬৯ তারিখে শিলচর শহরে বিশাল গণসমাবেশের আয়োজন হয়। শিলচর, নরসিংহপুর, হাইলাকান্দি ও পাথারকান্দিতে ১৪৪ ধারা ভেঙ্গে ফেলেন ভাষাবিপ্লবীরা, এই ঘটনায় সরকার ২৩৮ জনকে গ্রেফতার করে। ১৭ নভেম্বর ১৯৬৯ শিলচর বন্ধ থেকে ৩০০ জন সত্যাগ্রহীকে গ্রেফতার করা হয়। হাইলাকান্দির ওএসএ মাঠে বিশাল সমাবেশ ডাকা হয় একই সনের ২১ নভেম্বর, হাইলাকান্দি বন্ধ থেকে সবচে' ব্যাপক ধরপাকড়টি হয় প্রায় ১৫০০ জন ভাষাবিদ্রোহীকে সরকার অন্যায়ভাবে গ্রেফতার করে। ১৯৬৯ সালের ১৪ ডিসেম্বর 'ডিসি অব লিংগুস্টিক মাইনরিটিস ইন ইন্ডিয়া' শিলচর আসেন এবং মহাসভার সাথে বৈঠক করেন।
১৯৭০ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন অন্য মোড় নেয়। ১৯৭০ সালের ১৯-৩০ এপ্রিলের ভেতর কাছাড়, ত্রিপুরা ও শিলং-এ ২৪ ঘন্টার গণঅনশণ করেন বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষাবিদ্রোহীরা। ১৯৭২ সালের ১২ ডিসেম্বর কাছাড়ের সর্বত্র ৪৮ ঘন্টার গণঅনশণ, ১৯৭৪ সালের ৯ মার্চ কাছাড়ের সর্বত্র ৭২ ঘন্টার গণঅনশণ পালন করা হয়। ১৯৭৮ সালের ২ ডিসেম্বর করিমগঞ্জ ও কাছাড়ের সর্বত্র 'সংখ্যালঘু বাঁচাও দিবস' পালন করা হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি যেদিন বাঙালির মাতৃভাষা দিবস, সেই তারিখে ১৯৭৯ সালে সমগ্র কাছাড়ে পালিত হয় অবস্থান ধর্মঘট।
১৯৮২ সালের ২৫ জানুয়ারি আসামের শিল্প মন্ত্রণালয় ও 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের' ভেতর একটি বৈঠক হয়। 'নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা' এবং 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন' যৌথভাবে অবিলম্বে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে স্বীকৃতির দেয়ার বিষয়ে পদপে নেয়ার জন্য আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়ার কাছে মেমোরান্ডাম পেশ করেন। ১৯৮৩ সালের ২৫ অক্টোবর আসামের রাজ্য সরকারের কেবিনেট মিটিং-এ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কাছাড় ও করিমগঞ্জ জেলার স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে প্রাথমিক পর্যায়ে অন্তর্ভূক্ত করার। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত কেবলই সিদ্ধান্তই থেকে যায় এর কোনো বাস্তবায়ন হয় না। ১৪ নভেম্বর ১৯৮৩ তারিখে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু বিষয়ক একটি নোটিফিকেশন হয়, কিন্তু দুঃখজনকভাবে ৮ ডিসেম্বর ১৯৮৩ তারিখে তা স্থগিত করা হয়। ১৯৮৪ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী সাহিত্য পরিষদ ঠার ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ যাত্রা ও দাবীসমূহ নিয়ে প্রকাশিত দলিল (Let history and facts speak about Manipuris) আকারে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লীতে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে সাাৎ করে। কিন্তু তারপরও রাষ্ট্র কোনো উদ্যোগ নেয় না। আবারো 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন' আন্দোলনের ডাক দেয়। ১৯৮৫ সালের ২ জুলাই ' নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়ন' দাবীদিবস পালন করে। ১৯৮৯ সালের ১৯ জানুয়ারি পুনরায় জাপিরবন্দ-সোনাপুরে জনসভা ও রক্তস্বার কর্মসূচি পালন করে ছাএ ইউনিয়ন। আসামের রাজধানী গুয়াহাটিতে কেন্দ্রীয়ভাবে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিবাদ মিছিল করে ১৯৮৯ সালের ২৫ এপ্রিল। ১৯৮৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি নলিনী সিংহ, নির্মল সিংহ, কৃপাময় সিংহ, সুরচন্দ্র সিংহদের নেতৃত্বে ছাত্র সংগঠনের কর্মীরা ১২ ঘন্টা 'রেল রোকো কর্মসূচি' পালন করে। ১৯৮৯ সালের পয়লা ডিসেম্বর বিধান সভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত রিলে অনশন পালিত হয়। ১৯৮৯ সালের ২৭ জুলাই তারিখে সরকার আবারো বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালুর জন্য আরো একটি নোটিফিকেশন করে এবং ৬ আগস্ট ১৯৮৯ তারিখে তা স্থগিত করে। ১৯৯০ সালে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যুষিত অঞ্চলে এল.পি স্কুলের কাশ বয়কট করা হয়।
১৯৯১ সালের সালের ২৬ জানুয়ারি রাজকুমার অনিলকৃষ্ণ মণিপুরী ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি এবং সুরচন্দ্র সিংহ সাধারন সম্পাদক নির্বাচিত হন। এদের নেতৃত্বেই ১৯৯২ সালের ৬,১০,১৯ আগস্ট শিলচর, হাইলাকান্দি, করিমগঞ্জ জেলার ডিআই অফিসে অনশন ধর্মঘট পালিত হয়। লড়াকু ছাত্ররা সম্মিলিতভাবে ১৯৯২ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ১৫ দিনের ভেতর বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা চালু করার দাবী জানিয়ে চরমপত্র দেয়। ঐদিন শিলচর গান্ধিবাগ ময়দানে প্রায় দশহাজার মানুষের এক বিশাল জমায়েতের মাধ্যমে এই চরমপত্র দেয়া হয়। কিন্তু ঐ চরমপত্রকে কোনো গুরুত্ব না দেয়ায় ভাষা-আন্দোলন আরো দ্রোহী হয়ে উঠে এবং ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ ও কুলচন্দ্র সিংহের নেতৃত্বে 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ' গঠিত হয়। ১৯৯২ সালের ২১ অক্টোবর বরাক উপত্যকার বারমুনি, কাটাখাল, কালানি, পাথাবরকান্দিতে ২৪ ঘন্টার জাতীয় সড়ক অবরোধ কর্মসূচি পালন করা হয়। ১৯৯২ সালের পয়লা নভেম্বর আন্দোলনকারীরা জাতীয় কনভেনশনের আয়োজন করে। ১৯৯২ সালের ১৬ নভেম্বর ৩৬ ঘন্টার সড়ক অবরোধ কর্মসূচি আহবান করা হয়। ১৯৯২ সালের ৩ ডিসেম্বর আসামের মূখ্যমন্ত্রী হিতেশ্বর শইকিয়া দিসপুরে এক বৈঠক আহবান করেন। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে রাষ্ট্রের মূখ্যমন্ত্রী স্তরে এটিই ছিল কোনো প্রথম আনুষ্ঠানিক বৈঠক। রাষ্ট্রীয় বৈঠকে কোনো ইতিবাচক সিদ্ধান্ত না হওয়ায় আন্দোলনকারীরা পুনরায় ১৯৯৩ সালের ৮ ফেব্র"য়ারি হতে ৪৮ ঘন্টার সড়ক অবরোধ শুরু হয়। আসামে বিধানসভা চলাকালীন সময়ে দিসপুরে ১৯৯৩ সালের ২২ মার্চ ৩৬ ঘন্টার গণঅনশণ কর্মষূচি পালিত হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১০১ ঘন্টার রেল রোকো কর্মসূচি আরম্ভ হয় ১৯৯৩ সালের ২৭ এপ্রিল হতে বুরুঙ্গা, কাটাখাল, পাথারকান্দি এলাকায়। এই কর্মসূচির ফলে বরাক উপত্যকায় রেল চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। এই রেল রোকো কর্মসূচির ফলে অনেক সত্যাগ্রহী আন্দোলনকারী গ্রেফতার হন। ১৯৯৩ সালের ১০ মে কাছাড়, করিমগঞ্জ, হাইলাকান্দির তিন জেলার ডিআই এবং ডিইইও অফিসে ১২ ঘন্টা পিকেটিং করা হয় এবং এর ফলে শিক্ষা বিভাগের অফিস পুরোপুরি অচল হয়ে পড়ে। ১৯৯৩ সালের ২০ ডিসেম্বরও বরাক উপত্যকার অনেক সড়কে ৭২ ঘন্টার অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৯৫ সালের ২৬ মে ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ত্রিপুরা রাজ্যের প্রাথমিক স্কুল গুলোতে(মূলত: বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত এলাকায়) বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে অন্তর্ভূক্ত করে। কিন্তু আন্দোলনের কেন্দ্রীয় এলাকা আসাম রাজ্যে এই সিদ্ধান্ত নিতে সরকার তখনও গড়িমসি ভাবই বজায় রেখেছিল।
আসামের বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ১৬ মার্চ একটি রক্তক্ষয়ী দিন। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ভাষাবিপ্লবীরা বরাক উপত্যকায় ১৯৯৬ সালের মার্চ মাসে ৫০১ ঘন্টার রেল অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণা করেন। ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ ভাষা আসামের পাথারকান্দির কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোলনকারীদের একটি মিছিলে রাষ্ট্রের পুলিশ গুলি করে আন্দোলনকারীদের উপর। এই ঘটনায় অনেক ভাষা বিদ্রোহী আহত হন এবং ব্যাপক ধড়পাকড় হয় এবং মাতৃভাষার অধিকার চাইতে গিয়ে রাষ্ট্রের নৃশংস বন্দুকের গুলিতে জান দেন বিলবাড়ি গ্রামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিপ্লবী সুদেষ্ণা সিংহ। বরাক উপত্যকাতেই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার স্বীকৃতির আন্দোলনে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ শহীদ হোন বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ও প্রথম আদিবাসী নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ। ঐদিন পুলিশের গুলিতে আহত হোন সহস্রাধিক বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাযোদ্ধা এবং পরে হাসপাতালে প্রান হারান আরো একজন শহীদ সলিল সিংহ। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাসকে আর উপক্ষা করতে পারে না আসাম রাজ্য সরকার। আসাম রাজ্যের ইলিমেন্টারি এডুকেশন এর ডেপুটি ডিরেক্টর ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী অধ্যূষিত গ্রামের ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষার প্রথম পাঠ্য পুস্তক 'কনাক পাঠ' তৃতীয় শ্রেণীতে চালু করার সিদ্ধান্ত নেন। ২০০১ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সুপ্রিমকোর্ট 'বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী' শব্দটি লেখার রাষ্ট্রীয় অনুমোদন দেয়। দীর্ঘদিন থেকে চলে আসা মৈতৈ মণিপুরী এবং বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী বিতর্কের একধরনের স্থিতি ঘটে। ভাষা বিদ্রোহীদের দাবী বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষাকে কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী এলাকার জন্য সীমাবদ্ধ না রেখে সকল এলাকাতেই চালু করার। তাছাড়া এখনও স্কুল গুলোতে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী শিক্ষকেরা পড়ানোর দায়িত্ব পাচ্ছেন না।
শহীদ সুদেষ্ণার স্মরণে ভারত ও বাংলাদেশের মণিপুরীরা ১৬ মার্চ ভাষাদিবস পালন করে থাকে।
(৩) ১৮ শতকে বুলগেরীয়দের ভাষা আন্দোলন অন্যতম। বুলগেরীয় জনগন তৎকালীন সরকারের বিরুদ্ধে বুলগেরীয় ভাষার রাষ্ট্রীয় অধিকার আদায়ের সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিলো।
বাংলাদেশের সকল জনগনের রাষ্ট্রের সংবিধান কেবল বাংলা ভাষাকেই রাষ্ট্রের একমাত্র সাংবিধানিক ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দিয়েছে। উপরন্তু রাষ্ট্র, প্রচারমাধ্যম ও প্রকাশনাগুলো পৃথিবীর ভাষাসংগ্রামের ইতিহাস সম্বন্ধে ভুল এবং খন্ডিত তথ্য ক্রমাগতভাবে প্রচার করে জনমনে বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে এবং অপরাপর জাতিসমুহের ভাষা ও অস্তিত্ত্বের লড়াইকে অগ্রাহ্য করছে । এটি মহান ভাষা আন্দোলনের মনস্তত্ত্বের সাথে কোনক্রমেই সঙ্গতিপুর্ণ নয়। ২১ ফেব্রুয়ারি যদি আজ আন্তর্জাতিকভাবে সকলের মাতৃভাষার অধিকারের দাবী তুলতে পারে তবে যে রাষ্ট্র এই দ্রোহের জন্ম দিয়েছে সেই রাষ্ট্রই কেন আজ অপরাপর জাতির মাতৃভাষাকে মেনে নিতে বা স্বীকৃতি দিতে নারাজ? এই প্রশ্ন আজ সকল প্রগতিশীল মানুষের মনে। তাই, একুশের চেতনার সঠিক উপায়ে বাস্তবায়নের সময় এখনি।
তথ্যসূত্রঃ
• ভাষা আন্দোলনের আগে ও পরেঃ মুহাম্মদ শফী
• ভাষার জন্য একটি প্রান্তিক জাতিসত্তার সুদীর্ঘ সংগ্রামের ইতিহাস: বাংলাদেশে কি সকল জাতির সকল ভাষা সমান স্বীকৃতি ও মর্যাদা পাবেঃ পাভেল পার্থ, গবেষক, জনউদ্ভিদবিদ্যা ও প্রাণবৈচিত্র্য সংরক্ষন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
• ইন্টারনেট এর বেশ কিছু সাইট, বিশেষত Wikipedia.
http://www.nagorikblog.com/node/3701
কম্প্যুটার, ইন্টারনেট, মাতৃভাষা এবং পূর্বোত্তর ভারতের আন্তর্জালিক অভিধান 'শব্দ':
বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র হবার সুবাদে এক সময় আমার ইংরেজি লিখতে হাত কাঁপত। বলতে হলে বোধহয় এখনো ঠোঁট কাঁপবে। আজ আমি একটি কাগজ ( প্রজ্ঞান) নিয়মিত সম্পাদনা করি যার বেশির ভাগ লেখাই থাকে ইংরেজিতে। এ দরকারে এবং আনুষঙ্গিক আরো অজস্র দরকারে আজ আমাকে রোজ ইংরেজি লিখতে হয়। আমার হাত কাঁপে না। কারণটি, আর কিছু নয়। ইচ্ছা,নিষ্ঠা, দৃঢ়তা –এই ভারি শব্দগুলো উচ্চারণ করা যেতেই পারে। কিন্তু সহজ শব্দটি হচ্ছে 'কম্প্যুটার'। আজ অনেকদিন ধরে কলম চালাই না। পিড়িতে বসে রাতের খাবার না খেয়েও যদি কোনো বাঙালির লজ্জা না হয়, আমার তবে কলম না চালাবার জন্যে লজ্জা কিসের?
দুটোই লেখার যন্ত্র। তাতে, কম্প্যুটারেও হাত কাঁপবার কথা ছিল বটে । কিন্তু কাঁপে যে না, তার কারণ এর সঙ্গে এক বিশাল অভিধান পাওয়া যায়। যে আপনা আপনি আমার লেখার ভুল ধরে ফেলে এবং মুহূর্তে ঠিক করে নিতে পারি। অনেক সময় আমার বাক্যের ভুলও ধরে দেয় কম্প্যুটার। অন্ততঃ কলমে লিখলে যতটা ভুল থাকতে পারত তার প্রায় আশি শতাংশই এখন থাকবার সম্ভাবনা নেই। আর এই ইংরেজিতেই আমাকে আমার লেখালেখির এবং পত্রিকা সম্পাদনার কাজে দেশে বিদেশে বহু লেখকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হয়। দেশে বিদেশে যোগাযোগ করতে হলে যে আন্তর্জালিকার ( ইন্টারনেট) দরকার পড়ে সেতো অভিধানকে আরো বিশাল করে দিয়েছে। আপনি যে ইংরেজি শব্দটি এম.এস.ওয়ার্ডে খুঁজে পাবেন না, তাকে সেখান থেকেই ক্লিক করে দিন, সে আলাদীনের প্রদীপের মতো সারা পৃথিবী থেকে খুঁজে এনে সেই শব্দের অর্থ আপনার ডান হাতের কাছে ফেলে দেবে। সুতরাং আর ভয় কিসের? আপনাকে বিশেষ শ্রম করতে হবে না।
শব্দ ঃ তৈরি হচ্ছে পূর্বোত্তরের ভাষাগুলোর 'Virtual Babel Tower':
ইংরেজির মতো স্বতঃস্ফূর্ত কাজ করবার মতো অভিধান এখনো কোনো ভারতীয় ভাষার নেই বটে, সেটি হবে'আই.সি.এ.এন.এন' নামের সংস্থাটির প্রকল্প যখন পুরো মাত্রায় কাজ শুরু করবে তখন। আমি নিজে যদিও এখনো পরীক্ষা করিনি তবে অপেন অফিস এবং মাইক্রোসফট২০০৭ যে বাংলা-অসমিয়া সংস্করণ ছেড়েছে তাতে ইতিমধ্যে সেই ব্যবস্থা থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু আপনি সাইট খুলে দেখে নেবার মতো বাংলাতে সংসদের অভিধান থেকে শুরু করে প্রচুর আছে। গোগোল ব্যবহার করে বাংলা লিখলে সেটি শুরুতেই আপনাকে অনেক শব্দের বিকল্প সামনে এনে দেয়,আপনি পছন্দের শব্দটি ব্যবহার করতে পারেন। 'অভ্র'ও এম এস ওয়ার্ডের মতো অনেক বাংলা শব্দ সমর্থণ করে। বিশেষ করে দিন, মাসের নামের মতো বহু প্রচলিত শব্দগুলো লিখতে শুরু করলেই সে পুরো শব্দ দেখাতে শুরু করে । আপনি সেটিতে টিপে দিলেই এ বসে যায়। হিন্দি সহ অন্য ভারতীয় ভাষারও প্রচুর আছে। নেই অসমিয়ার এবং অন্য পূর্বোত্তরীয় ভাষার অভিধান। এবং নেই সিলেটি সহ বাংলা ভাষার পূর্বোত্তর ভারতীয় উপভাষাগুলোকে সমর্থণ করবার মতো কোনো অভিধান। সেই খালি জায়গাকে ভরে তুলতে গেল ক'বছর ধরে তৈরি হচ্ছে 'শব্দ' ( XOBDOঃ ) । এর ওয়েব ঠিকানা হচ্ছেঃ http://www.xobdo.org/ । ভাষার প্রশ্নে যে বৈচিত্র নিয়ে আমাদের গোটা দেশে গৌরব করে বেড়াবার কথা ছিল তাকেই আমরা কাজিয়ার বিষয় করে রেখেছি গেল প্রায় এক শতাব্দি বা তারো বেশি সময় ধরে। 'শব্দ' সেই গৌরবকে প্রতিষ্ঠা দেবার ঐতিহাসিক দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে। অচিরেই এটি হবে পূর্বোত্তর ভারতের সবচে' বড় আর বৈচিত্রময় অভিধান ও বিশ্বকোষ। আমরা তাই নিয়েই লিখব বলে এখন কলম তুলে নিয়ছি। থুড়ি, কম্প্যুটারের বোতাম টিপে চলেছি!
ধানবাদের ইন্ডিয়ান স্কুল অব মাইন্সের পেট্রলিয়াম প্রযুক্তিতে স্নাতক বিক্রম মজুমদার বরুয়া টেস্কাস টেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর সম্পূর্ণ করে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র হয়ে সংযুক্ত আরব আমিরাতের আবুধাবিতে গিয়ে থিতু হয়েছেন। সেখানে তিনি এক তেল সংরক্ষণাগারে অভিযন্তার দায়িত্বে কাজ করেন। ২০০৬এর শুরুতে আরবের মরুভুমিতে নিঃসঙ্গ জীবন যাপন করবার দিনগুলোতে স্বাভাবিকভাবেই দেশের নদী-পাহাড় –সবুজ অরণ্য তার কাছে ডাক পাঠাতো। ছেলেবেলা থেকেই কল্পবিজ্ঞানের গল্পে ও নানা প্রবন্ধপাতি অসমিয়াতে লিখে তিনি হাত পাকিয়েছেন। বিদেশে যখন নিজের ল্যাপটপে লিখবেন বলে ভাবছিলেন তখন স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর দরকার পড়ছিল এক অভিধানের । গোগোলে যখন তিনি অনুসন্ধান করলেন বাংলা, হিন্দি, পাঞ্জাবি, মালয়ালম ভাষাতে বেশ কিছু অভিধানের খোঁজ পেলেন। অসমিয়াতে একটিও নয়।
ব্যস, আর যায় কোথায়! ২০০৬এর মার্চের ১০ তারিখে 'আসামনেট'ইয়াহু গ্রুপে ( অসমের মানুষের সবচে' সক্রিয় আন্তর্জালিক গোষ্ঠী) তিনি 'শব্দে'র যাত্রা ঘোষণা করলেন। কম্প্যুটার প্রযুক্তিতে তিনি যে তেমন দক্ষ ছিলেন তা নয়, না ছিল তাঁর ভাষা বিজ্ঞানের উপর কোনো অধ্যয়ন! যারা মনে করেন কোনো এক বিষয়ে হাজারটা বই গিলে না খেয়ে কাজে হাত দেয়া উচিত নয় তাঁরা যে কেমন সেকেলে লোক, বিক্রম তাঁর উজ্জ্বল উদাহরণ! চাই কেবল স্বপ্ন আর সেই স্বপ্নকে সাকার করবার এক দৃঢ় আকাঙ্ক্ষা। বাকি কাজ আপনি এগোয়। শুরু শুরুতে বিশ্বের নানা কোন থেকে প্রিয়ঙ্কু শর্মা, পল্লব শইকিয়া, উজ্জ্বল শইকিয়ারা এসে যোগ দেন। ধীরে আরো অনেকে। প্রিয়ঙ্কু শব্দকে জীবনী শক্তি যোগাবার সঙ্গে সঙ্গে এর প্রচারে উঠে পড়ে লাগেন। প্রচার বিমুখ হয়ে শব্দের এক পাও এগুনো সম্ভব ছিল না, আজো নয়। কেন না এর চাই সারা বিশ্বের যেখানেই পূর্বোত্তরের মানুষ রয়েছেন তাদের থেকে অনেক অনেক সহকর্মী। পল্লব 'হৃদয়ে'র মতোই আড়ালে থেকে এর প্রাণ স্পন্দনকে সচল রাখবার কাজ করছিলেন। অর্থাৎ , তিনি যাকে বলে 'ডাটাবেস' তার কাজটা দেখছিলেন। এখনো তাই করে যাচ্ছেন। এই বিক্রম, প্রিয়াঙ্কু, পল্লব মিলে এখনো 'শব্দ' সাইটের বছরের ডোমেন ভাড়াটা বহন করেন। উজ্জ্বল শইকিয়াও শুরুর দিকে 'শব্দে'র সাইট গড়ে তুলতে বেশ খাটাখাটুনি করেছেন। একে একে এলেন দিপাঙ্কর এম বরুয়া, দ্বীপায়ন বরুয়া, অপূর্ব মিলি, রাজীব কুমার দত্ত, নীলোৎপল বরপূজারী, কিশোর কুমার বর্মন, রুবুত মাউত, হাসিনুস সুলতান, রূপম কুমার শর্মা, রেশ্মী রেখা দত্ত, সুদীপ্তা গগৈ আনিসুজ্জামান এমন আরো অনেকে।
গুয়াহাটি আই আই টিতে এক বড় কর্মীগোষ্ঠী গড়ে উঠল। বুলজিৎ বুড়াগোহাঁই, ঋতুরাজ শইকিয়া, স্বপ্নিতা কাকতি, অর্চনা রাজবংশী, সঞ্জীব শর্মা, ড০ কৃষ্ণা বরুয়া এমন আরো অনেককে নিয়ে। এদের সবার চেষ্টাতে বহু শব্দ 'শব্দে' এসে জমা হলো। ২০০৭এর ১৭ জানুয়ারীতে আই আই টি ক্যাম্পাসেই 'শব্দে'র প্রথম মুখোমুখী বসে এক সফল সভা হলো। এর আগে সবই হচ্ছিল ইণ্টারনেটে। শুরু থেকেই 'শব্দে'র সম্পাদনার সমস্যা ছিল। একা বিক্রম এদিকটা সামলাতেন। ২০০৭ থেকে প্রিয়াঙ্কুও তার সঙ্গে এ কাজে হাত বাড়ালেন। পরে রূপঙ্কর মোহান্ত এবং রূপকমল তালুকদার এসেও এ কাজে লেগে পড়লেন।
২০০৭এর শেষের দিকে 'শব্দে'র ডাটাবেসকে 'মাইক্রোসফটে'র MSSQL প্রযুক্তি থেকে 'ওপেন সোর্সে'র MySQL এ স্থানান্তরণ ঘটিয়ে সাইটিকেও সাজিয়ে তোলা হয়। পল্লব এবং বিক্রমকে এর জন্যে পৃথিবীর দু'প্রান্তে থেকেও বহু খাটাখাটুনি করতে হয়েছিল। কাজটি বড় চাট্টিখানি ছিল না মোটেও। পিয়াঙ্কু, যিনি এখন উত্তর কোরিয়ার হাংকুক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদেশ বিষয়ে অধ্যাপনা করে তখন ফ্লরিডা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছিলেন ।একই বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্প্যুটার বিজ্ঞানের ছাত্র সাকিব রহমানকে সঙ্গে নিয়ে তিনিও দিনে রাতে কাজ করে সাইটটিকে তার বর্তমান রূপ দেন। বিক্রমের ভাষাতে, " Thus, our beloved princes XOBDO got a new look… almost like a bridal make-up!"
২০০৮এর জানুয়ারীতে ফ্রেন্ডস অব আসাম এ্যাণ্ড সেভেন সিস্টার্স ( FASS) তাদের বার্ষিক সভাতে সুযোগ করে দেয় 'শব্দ'এর সাইটকে জন সমক্ষে তুলে ধরতে । প্রচার মাধ্যমগুলো সে ঘটনাকে দারুণভাবে তুলে ধরে। এর পেছনে অবশ্য বুলজিতের এক বড় ভূমিকা ছিল। এবারে ওর ভূমিকা প্রশ্নাতীত। অসমের যেকোনো ভালো ভালো সদর্থক কাজের সংবাদ সংগ্রহ করা ও সেগুলোকে যথাসম্ভব বেশি প্রচার দেয়াটা ওঁর অনেকটা 'শখে'র মতো। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এখনো গুয়াহাটি আই টি আইর গবেষণা ছাত্র। সে বছরের শুরু অব্দি ১০,২০০ অসমিয়া শব্দ সংগৃহীত হয়েছিল । সে বছরে ২০,০০০ এর লক্ষ্যমাত্রা স্থির করা হয়েছিল। এ কোনো সহজ কাজ ছিল না। কেবল শব্দ জুড়ে যাওয়াইতো আর কাজ নয়, এগুলোর শব্দতাত্বিক বিশ্লেষণ, যথার্থ ইংরেজি সহ বিভিন্ন ভাষাতে এদের অর্থ লেখা , সেই সঙ্গে এটাও নিশ্চিত করা যে শব্দগুলোর পুনরুক্তি হয় নি এমনি আরো কত কিছু! প্রায় দৈনিক হিসেব রাখার নিয়মানুবর্তীতা মেনে বছর শেষের আগেই বড়দিনের দিনে সেই লক্ষ্যে গিয়ে পৌঁছানো গেছিল পৃথিবীর নানা কোনে ছড়িয়ে থাকা 'শব্দ' কর্মীদের কাছে সে ছিল যথার্থই এক উৎসবের মুহূর্ত।
আগে যাদের নাম উল্লেখ করা গেল তারা ছাড়াও সে বছর এসে কাজে নেমেছিলেন বিরাজ কুমার কাকতি, অঞ্জলি সনোয়াল, প্রশান্ত বরা, পার্থ শর্মা, প্রবীন কাকতি, প্রসেনজিৎ খনিকর, মৌসুমী হাজরিকা, আব্দুল ওয়াহাব, পাপড়ি গগৈরা লেগে থেকে সেই লক্ষ্যমাত্রাতে পৌঁছুনো সম্ভব করে তুলেন। একই বছরে প্রবাদ-প্রবচন যোগ দেবারও এক ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়। এ পর্যন্ত পূর্বোত্তরের অন্য সব ভাষাকে 'অন্য ভাষা' ( Other Languages) বলে উল্লেখ করা হতো। সেবারেই 'শব্দ' ঠিক করে কাউকে এভাবে স্বতন্ত্র করার কাজটা ঠিক হচ্ছে না। সমস্ত ভাষাগুলোরই সমান মর্যাদা ও স্বীকৃতি থাকা উচিত। সুতরাং সাইট সম্পাদনা করে সমস্ত ভাষা নাম স্বতন্ত্র ভাবে লেখা শুরু হয়।
২০০৯তে পূর্বোত্তরের অন্য ভাষা থেকেও বেশ কিছু সহযোগী এসে যোগ দেন। তাই , মিশিং ভাষার শব্দ যোগাচ্ছেন অঞ্জলি সনোয়াল, মাড় শব্দ যোগাচ্ছেন লালরেমথাঙ মাড়, খাসি শব্দ যোগাচ্ছেন বানলাম ওয়ার্জর, মৈতৈ শব্দ প্রদান করে যাচ্ছেন মোহেন নাওরেম, ডিমাসাতে রয়েছেন বেশ ক'জন কুলেন্দ্র দাউলাগাপু, অনুজ ফঙলোসা, অর্ণব ফঙলোসা এবং উত্তম বাথাহি, প্রণব দোলে মিশিং , নব বডো এবং নওগওত ব্রহ্ম যোগাচ্ছেন বডো এবং মর্নিঙ্কি ফাঙশো ও দীপক টুমুঙ যোগাচ্ছেন কার্বি ভাষার শব্দ। এখন সারাবিশ্বে 'শব্দে'র প্রায় ১২০০ সদস্য ছড়িয়ে রয়েছেন । যদিও তাদের সবাই সমান সক্রিয় নন।
এ পর্যন্ত যতগুলো শব্দ এতে এসছে তার এক সাম্প্রতিক( ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৯) হিসেব এরকমঃ
ভাষা শব্দ সংখ্যা ভাষা শব্দ সংখ্যা
অসমিয়া ২২৬২৮ ককবরক ৩০৬
ইংরেজি ১২৪২৩ বিষ্ণুপ্রিয়া ২৩৩
ডিমাসা ২৭০৫ নাগামিজ ১৩৮
কার্বি ১৩৭০ মিজো ১২০
মৈতৈ ৯৩০ গারো ১১৭
তাই ৯১৫ চাকমা ৮৭
বডো ৮০৪ আপাতানি ৭৫
মাড় ৬৩২ আও ৭৩
খাসি ৪০৫ মনপা ১৮
মিশিং ৩৬৪ কাওব্রু (রিয়াং) ০
এই তালিকাতে বাংলা নেই। নেই হিন্দি । পূর্বোত্তরের আরো দুটো প্রধান ভাষা। নেপালিও নেই। নেই আরো বেশ কিছু প্রাচীন ভাষা। থাকা উচিত ছিল কী?
বাংলা , হিন্দি , নেপালি ভাষা এবং পূর্বোত্তর ভারতঃ
এই কথাটাই আমি বিক্রম এবং শব্দের অন্য বন্ধুদের অনেক দিন আগেই জিজ্ঞেস করেছিলাম, বাংলা নেই কেন? শব্দের সঙ্গে আমার যোগাযোগ ২০০৮এর মাঝামাঝি। আমাদের তিনসুকিয়া কলেজের নিয়মিত প্রকাশনা 'প্রজ্ঞানে'র জন্যে 'শব্দ' সম্পর্কিত তথ্যাদি পাঠান বুলজিৎ । সেখানে তা ছাপাও হয়। সেই থেকে তিনি আমাদের কাগজের এক সক্রিয় শুভানুধ্যায়ী। 'প্রজ্ঞানে'র 'প্যানোরামা'তে চোখ ফেরালেই বুলজিৎকে অনেকটা চেনা যায় । আমি নিজেও বাংলাতে লেখার সঙ্গে অসমিয়াতে লিখি । অসমিয়া থেকে অনুবাদের কাজ করি । আর যেহেতু তা ব্লগে করি, অন্য অভিধানের সঙ্গে 'শব্দ'ও সেই থেকে আমার সহযোগী। 'শব্দে'র নিজের গোগোল বন্ধু গোষ্ঠী আছে ( )। এছাড়াও আমাদের মত বিনিময় হয়ে থাকে 'ফাস', আসামনেট', 'শিলচর'( ) ইয়াহু গোষ্ঠীতে। বিক্রম বলছিলেন বাংলাতে ইতিমধ্যে অনেক অভিধান রয়েছে। আরেকটা জমবে কিনা , এ নিয়ে তাঁর সংশয় আছে। কিন্তু সেই অভিধানগুলোতে 'হে-তাই' ( He-She / 3rdt person, singular number) নেই, নেই 'লগে লগে', 'বিয়ানি বেলা', 'হাইঞ্জা বেলা' , 'কিয়ানো','কুশিয়ার' এমন আরো কত কিছু। তিনি যখন জেনেছিলেন এ হচ্ছে 'সিলেটি' তখন কথাটা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেছিলেন । প্রিয়ঙ্কু এবং অন্যেরা এমন আরো অনেকে খবর নিয়ে জেনেছিলেন , যে অবিভক্ত বাংলাদেশে একে একসময় স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে দাঁড় করাবার চেষ্টা হয়েছিল । সিলেটি নাগরি লিপিও গড়ে তোলার চেষ্টা হয়েছিল। এখনো সে চেষ্টা একেবারে বাদ পড়ে নি। বরং বিদেশেও কোথাও কোথাও একে স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে শেখানোই হচ্ছে। অসমিয়া ভাষা তাত্বিকেরাও একে নিয়ে বেশ আলোচনা করেছেন, বেনুধর রাজখোয়া থেকে শুরু করে প্রায় সবাই। উপেন রাভা হাকাচামতো একে অসমের এক প্রাচীন স্থানীয় ভাষাই বলেন। যদিও এঁরা প্রায় সবাই একে হয় অসমিয়ার উপভাষা বা বৃহত্তম অসমিয়ার অংশ হিসেবে দেখেছেন। প্রিয়ঙ্কু আমার প্রথম জিজ্ঞাসার ক'দিন পরেই জানান, ব্যাপারটা ওঁদের বিবেচনাতে আছে। সিলেটিকে আলাদা ভাষা বা উপভাষা হিসেবেও নেবার কথা বিবেচিত হচ্ছিল। কিন্তু , আমি ওঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে জানাচ্ছিলাম, কেবল সিলেটি নিলেতো হবে না, 'কাছাড়ি বাংলা'র কথা যে কেউ বলে না। আর দক্ষিণ ত্রিপুরার প্রধান উপভাষা কুমিল্লার ভাষার কী হবে? এ ছাড়া পদ্মা নদীর গোটা পূর্ব পারের বাঙালি, যারা পূর্বোত্তর ভারতে এসছেন বা আছেন, তারাই বা বাদ যাবেন কেন? এগুলো আলোচনা চলছিল।
সম্প্রতি একটা লেখাতে বিক্রম শুরুতেই প্রশ্ন করেছেন, " How many of you, whose mother tongue is Assamese, have the basic knowledge of the languages of the neighboring states, like Khasi, Ao, Mizo, Meetelon? Let alone these languages, how many of you know even the basics of few languages of Assam itself? Like Bodo, Mising, Rabha, Karbi? Probably very few of you are, that can be counted on finger-tips. The reverse is also true… there is hardly any genuine effort to learn Assamese by the non-native-speakers residing in the state, let alone those in the neighboring seven-sister states. Can we break this barrier?' এই যে 'barrier'—- এ কেবল মানবিক সম্পর্কের নয়, পরম্পরার, ইতিহাসের, সংস্কৃতির এবং ভূগোলেরো বটে। বিক্রমের কথাগুলোর Assamese শব্দের জায়গাতে Bengali বসিয়ে দিয়েও একই প্রশ্ন ছোঁড়ে দেয়া যায়। এঁরা যেমন সিলেটি বা কাছাড়ি সম্পর্কে বিশেষ জানতেন না, আমি লক্ষ্য করেছিলাম বাঙালি বন্ধুরাও জানতেন না, কাছাড়ে সিলেটির আরো এক প্রাচীন রূপান্তর 'কাছাড়ি'ও বটে! এটা শিলচর শহরের অনেকেও জানেন না, বা জানলেও আলাদা করে স্বীকার করতে চান না। সেই ক্ষোভে সম্প্রতি হাফলঙের জগন্নাথ চক্রবর্তী, যিনি আদতে হাইলাকান্দির সন্তান, এক ঢাউস সাইজের অভিধান লেখে নাম দিয়েছেন, ' বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান ও ভাষাতত্ব। ' এর মুখবন্ধ লিখেদিয়েছেন স্বনামধন্য ভাষাবিদ পবিত্র সরকার। আমি তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, 'ইটা কোন বা'ষা? সিলেটি অইলে ইতো খালি বরাকর বা'ষা নায় !" তাঁর জবাব ছিল, "চিলটি নায়। চিলটি হ'কলে আমারতাইনতর বা'ষারে মান্যতা দেইন না, এর লাগ্গিউ নাম দিলাইলাম 'বরাক বাংলা'!" অভিধানের অনেক জায়গাতে তিনি 'আঞ্চলিক বাংলা' কথাটিও ব্যবহার করেছেন। 'লেখকের নিবেদনে' এক জায়গায় লিখেছেন, " ঢাকা বাংলা একাডেমি প্রকাশিত মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সম্পাদিত 'বাংলাদেশের আঞ্চলিক ভাষা অভিধান' এ সিলেট অঞ্চল স্বাভাবিকভাবে অন্তর্ভূক্ত হলেও বরাক উপত্যকার আঞ্চলিক বাংলা সম্ভবত আলাদা রাষ্ট্রের অঞ্চল বলেই বাদ পড়েছে। আর কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের 'আঞ্চলিক বাংলা ভাষার অভিধান' সংকলন প্রকল্পটি যেহেতু পশ্চিমবঙ্গ কেন্দ্রিক তাই ওখানেও স্থান হয়নি বরাক উপত্যকার।" ছেলেবেলা তাঁর মুখের বাংলা শোনে যে সেখানকারই বাঙালি আত্মীয় তাঁর মা-বাবাকে পরামর্শ দিতেন , ' এসব গ্রাম্য নীচ লোকের ভাষা না শেখাতে…।" এই তথ্য তিনি বেশ খেদের সঙ্গেই উল্লেখ করেছেন।
'কাছাড়ি হকল, চিলটি হকল আর অইলগিয়া ( হ'লগৈ) অসমিয়া সকল'—এদের যে এক প্রাচীন ঐতিহাসিক আত্মীয়তা রয়েছে এ কথা আমরা জেনেও না জানার ভান করে থাকি । বাঙালিতো আমরা বটেই— এনিয়ে যেন কেউ আমার কথাগুলোকে ভুল না বোঝেন। কিন্তু বাঙালি বলে প্রমাণ করবার দৌড়ে আমরা এতো বেশি পশ্চিমের ( কলকাতা) দিকে তাকিয়ে থাকি যে অসমিয়া সহ অন্যরাতো বটেই, নিজেদের দিকেই ভালো করে তাকাবার আমাদের ফুরসত মেলে না। আমার মনে আছে প্রথম প্রথম তিনসুকিয়া শহরে এক অনুষ্ঠানে শক্তিপদ ব্রহ্মচারির এক কবিতা পড়তে আমার পা কাঁপছিল। এই ভয়ে যে, কোনো বাঙালি যদি আমাকে জিজ্ঞেস করে বসেন, 'কে সে হরিদাস বাবাজী?' কলকাতাতেতো এঁর নাম শোনা যায় নি!
বাঙালির বড় ভাগটা যেহেতু পূর্বোত্তরের বাইরে থাকেন, অবাঙালি অনেকেই আমাদের 'বহিরাগত' বলে ভেবে নেন, 'খিলঞ্জিয়া'র তালিকাতে হিসেবই করেন না। আমরাও যেন এই সত্যকে প্রমাণ করবার জন্যে সদাব্যস্ত। আমাদের আচারে ব্যবহারে এবং অনুষ্ঠানে । তাই সামাজিক হাজারটা প্রশ্নে বাঙালিকে দেখা যাবে নীরব দর্শক। আমাদের মধ্য সংঘাত ভেদাভেদ আছে। নেইটা– কার মধ্যে? নাগা-কুকী বছরে সাতবার রক্তাক্ত সংঘাতে ব্যস্ত হয়। তাই বলে, এতো নৈরাসক্তি আর নিস্পৃহতা নিয়ে কেউ বাস করে না। তাই বলে, এই সত্যকে ভুলব কী করে যে 'চুঙ্গা পিঠা' আর 'মেড়ামেড়ির' ঘর না হলে আমাদেরও পৌষ সংক্রান্তি জমে উঠে না! সম্প্রতি আমিঅসমিয়া 'ফেলানি' উপন্যাসখানা ব্লগে অনুবাদ করছি। করতে গিয়ে এমন অনেক শব্দে আটকে যাচ্ছি । আমার মনে হচ্ছে এমন বহু শব্দ রয়েছে যেগুলো আমাদের ভাষাতে রয়েছে । কিন্তু যেহেতু আমাকে কলেজ ষ্ট্রিটের অভিধান অনুসরণ করতে হবে আমাকে সেগুলো কেবল অসমিয়া বলে বাদ দিতে হবে। যারাই অনুবাদ করেন তারাই নিশ্চয় আদর্শ বাংলাতে প্রথম পুরুষের একবচনে লিঙ্গ ভেদ ( সিলেটিঃ হে –তাই) না থাকার যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করেন। এতোটা সাহস অবশ্যি আমি এখনো করতে পারিনি, কিন্তু আমার প্রায়ই মনে হয়, 'আমার লগে', 'চড়াই', 'কুশিয়ার' ইত্যাদি প্রয়োগ করতে পারব না কেন? এগুলোতো আমাদের নিজেদের শব্দ। এতে ভেজালটা কোথায়? 'উরুকার মেজি'র বদলে আমি কেন 'মেড়ামেড়ির ঘর' (স্মরণ করুনঃ অসমিয়া মেরঘর, বেড়াতে ঘেরা ঘর) ব্যবহার করে আত্মীয়তাটা জাহির করব না? কেন আমাকে এর জন্যে টীকা দিয়ে লিখতে হবে 'ভোগালি বিহুর এক বিশেষ পরম্পরা!' আমারটা বুঝি দিব্বি উবে যাবে আলেয়ার আলোর মতো সমস্ত মান্য স্মৃতি থেকে ? কিন্তু আমি জানি 'মেরামেড়ির ঘরের'ও টীকা নাদিলে উজানের বাঙালি কিছুই বুঝবেন না। তার সংস্কৃতি এবং কলকাতার থেকে পাওয়া বইতে শব্দটি নেই !
এক নতুন সাম্রাজ্যের সন্ধানে 'শব্দ'- বাংলা ,হিন্দি , নেপালি এবং আদি ভাষাতেও চাই স্বেচ্ছাসেবীঃ
গেল জানুয়ারির ১২ তারিখে গুয়াহাটিতে 'শব্দে'র সভা বসেছিল। সেই সভাতে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল এবার থেকে আদি, বাংলা, হিন্দি ও নেপালিও 'শব্দে'র অংশভাগী হবে। ১১, ১২ দু'দিন গুয়াহাটির মাছখোয়া আই.টি.এ সেন্টার ফর পারফর্মিং আর্ট প্রেক্ষাগৃহে বসেছিল প্রথমবারের মতো পূর্বোত্তর ভারতীয়দের আন্তর্জাতিক সম্মেলনNEIIM 2010 । আয়োজক ছিল 'ফাস' এবং অসম সরকার। সম্মেলনের শেষে 'শব্দে'র সভা বসে। সেখানে বিক্রম, প্রিয়ঙ্কু, বুলজিত, বিরাজ, প্রশান্ত, পাপড়িরা, ছাড়াও উপস্থিত ছিলেন আকলান্তিকা শইকিয়া, ভাষ্কর জ্যোতি দাস, নীলোৎপল ডেকা এবং বর্তমান লেখক।
'শব্দে' বাংলার প্রবেশ বাংলার পক্ষে দুটো কাজ করবে। বাংলা ভাষাতে পূর্বোত্তরের স্বতন্ত্র অস্ত্বিত্ব ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে পূর্বোত্তরের অন্য ভাষার সঙ্গেও নিজের আত্মীয়তার সূত্রে এখানকার আলো হাওয়ার কাছেও নিজের অস্ত্বিত্ব ঘোষণা করবে। কেবল বাংলা নয় হিন্দির, নেপালি, পক্ষেও কথাটা সত্যি। এতো কেবল এক অভিধান নয়! বিক্রম সম্প্রতি এর এক সংজ্ঞা দেবার চেষ্টা করেছেন এরকম, ""XOBDO is a precise and detailed online multi-directional multi-lingual multi-media based dictionary-cum-phrasebook-thesaurus-cum-encyclopaedia of the languages of the North-East India!!" তিনি আরো লিখেছেন, "Search some very basic words like 'mother', 'bamboo', 'river' etc. You will get the corresponding words in almost all the major languages of the North-East – Bodo, Mising, Khasi, Karbi, Meetelon in addition to English and Assamese. Or, search the Dimasa word 'dilao' or the Karbi word 'lut' and find out what does it mean in Assamese or English or any other language of the North-East. You can actually search a word of any language and find the equivalent words in all the available languages. In other words, XOBDO is multi-directional and multi-lingual. In one article, XOBDO has been described as the 'virtual Babel Tower of the North-East'. বাইবেলীয় পৌরাণিক গাঁথার 'বেবেল মিনারে'র মতো সত্যি সত্যি 'শব্দ' স্বর্গ ছোঁয়ার সম্ভাবনা রাখে।
আমরা বিক্রমের বক্তব্যের সমর্থণে একটি উদাহরণ দিতে চাইব। ইংরেজি 'Bamboo' শব্দটির এখন অব্দি যে অর্থগুলো পাওয়া গেছে তা এরকমঃ অসমিয়াতে 'বাঁহ', বাংশ, বডো-ঔয়া (ow-vaa) , মিশিং-দিবাং (dibang), খাসি-উ স্কং (u skong) , গারো-ওয়া (wa.a), মৈতৈ-ওয়া (waa) মিজো-মাউ (mau) ,কার্বি-ছেক (chek), নাগামীজ –বাশ (bas) ডিমাসা-ওয়াহ (woah)। এবারে যখন বাংলা অর্থ প্রবেশ করবে, কী আসবে? সব্বাই জানেন-বাঁশ, বংশ । জগন্নাথ চক্রবর্তী আরো এক প্রতিশব্দের কথা জানিয়েছেন –'বা' ( পৃঃ ২৫৮)। তিনি এর সংস্কৃত উৎসের কথা জানিয়েছেন, লিখেছেন, সং-বংশ। সত্যি হতেও পারে। কিন্তু এখানেই তাঁর অভিধানের সীমাবদ্ধতা। সংস্কৃতের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্কের উল্লেখ করেছেন। যেখানে তা পারেননি নীরব থেকেছেন। যথেষ্ঠ সম্ভাবনা থাকা সত্বেও ভোট –মোঙ্গলীয় উৎসের দিকে তেমন তাকান নি। সংস্কৃত 'ঘ' প্রত্যয় নিয়ে 'বশ' ধাতু থেকে আসা 'বংশ' শব্দটির অর্থ আমরা সবাই জানি। কুল । এর থেকে তৃণ জাতীয় উদ্ভিদের কল্পনাটা বড্ড কষ্টকর। এর থেকে বডো-ঔয়া (ow-vaa) থেকে গারো-ওয়া থেকে ডিমাসা-ওয়াহ থেকে অসমিয়া বাঁহ থেকে (সিলেটি বাংলা বাহ ?) বরাক (কাছাড়ি )বাংলা বা থেকে বাংলা বাঁশ থেকে এবং 'প্রোথিতে'র মতো সংস্কৃত উৎস শব্দ 'বংশ' গড়ে দেয়া হয়েছে, ভাবা যায় না কি? আমরা অবশ্য নিশ্চিত নই। একটা সম্ভাবনার কথা বলছি। দ্রাবিড় বা অস্ট্রিক উৎস থেকেও আসতে পারে। কন্নড় 'বানবু' থেকে কোঙ্কনি 'মাম্বু' পোর্তুগীজ হয়ে গিয়ে ইংরেজিতে 'ব্যাম্বো' (থেকে অসমিয়া ও সিলেটিতে তুচ্ছার্থে'বাম্বু') হয়েছে। মালয় দ্বীপেও এর প্রতিশব্দ রয়েছে 'সামাম্বু'। এবারে, এই যে সংস্কৃত ছেড়ে আমি অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরালাম এটা 'শব্দ' আমাকে বাধ্য করল। বডো- ডিমাসা প্রতিশব্দগুলো না দেখলে আমি ভাবতামই না যে 'বাঁশ' পূর্বোত্তর ভারত সহ এই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ারই সংস্কৃতির এক ঘনিষ্ঠ অঙ্গ। শ্যামের 'বাঁশি' এদিক থেকেই বাংলাতে এবং তার পরে সারা ভারতে (হিন্দি 'বাঁশরি') গিয়ে 'রাধা'কে ডাক পাঠালেও পাঠাতে পারে। এই তথ্যের উল্লেখ করলে আমাদের সম্মান বাড়ে বই কমে না। অন্তত 'দাদা', কাকা'র মতো শব্দগুলো যে গেছেই এদিক থেকে এনিয়ে আমরা প্রায় নিশ্চিত। এগুলো সংস্কৃতে আর কৈ খুঁজে পাওয়া যাবে?
এভাবে ভাষাগুলোর তুলনামূলক অধ্যয়নে 'শব্দ' এক বিশাল উৎস ভাণ্ডারের কাজ করবে, এটি প্রায় নিশ্চিত । সে বহু অনুসন্ধানকে ইতিমধ্যে উস্কেও দিচ্ছে। তার উপর ভাষাগুলোর মধ্যে পারস্পারিক অনুবাদের কাজেও 'শব্দ' এক সহজ সহায়ক হতে পারে। 'শব্দে'র কর্মীরা যদিও সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছেন, তবু তাদের প্রায় সব্বারই বাড়ি ঘর এই ঈশান কোণে। কিন্তু বাংলা- হিন্দি-নেপালির মতো ভাষাগুলো এসে প্রবেশ করাতে আমরা আশা করতেই পারি এবারে 'শব্দে'র বিস্তার পশ্চিম তথা বায়ু কোণ অব্দি ছড়িয়ে যেতেই পারে । শব্দ যোগাতে পারে পূর্বোত্তর ভারতের অনুবাদ সাহিত্যকে এক নতুন শক্তি। অনুবাদের মধ্যি দিয়েই যেমন ভাষাগুলোর সমস্ত লিখিত পরম্পরা পরস্পরের মধ্যে আরো ছড়াতে পারে তেমনি বাংলা, হিন্দি ইত্যাদি ভাষাতে অনুদিত হয়েই এখানকার সমস্ত লিখিত পরম্পরা বাকি ভারতে তার বিজয় নিশান ছড়াতে পারে।
খরগোশ এবং কচ্ছপের সেই প্রাচীন গল্পের অর্বাচীন রূপান্তর এবং 'শব্দ':
এ পর্যন্ত এসে আমার সেই খরগোশ আর কচ্ছপের গল্পটির কথা মনে পড়ে গেল। সেই যে খরগোশ ঘুমিয়ে গেছিল আর কচ্ছপ দৌড়ে ওকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। সেটি প্রাচীন গল্প । গল্পটির এক অর্বাচীন কম্প্যুটার সংস্করণ তৈরি হয়ে গেছে। দুর্দান্ত ! সংক্ষেপে সেটি এই। খরগোশ বেচারা মন খারাপ করে ভাবতে বসলে, সে ওমনটি হারল কেন? অতি আত্মবিশ্বাসই তার বিপদ ডেকে এনেছে— সে বুঝতে পারল। সুতরাং ,সে আবারো গিয়ে দৌড়ের প্রস্তাব দিল কচ্ছপকে । কচ্ছপ বেচারা রাজি হয়ে গেল। এবারে কিন্তু খরগোশই জিতল। ধর্য্য, স্থর্য্য নিয়ে যে এগোয় সেও জেতে বটে। কিন্তু বিজয়ী হবার জন্যে স্থৈর্য আর দৃঢ়তার সঙ্গে দ্রুতি অনেক বেশি জরুরি ব্যাপার। সেটি কচ্ছপের জানা ছিল না। এবারে কচ্ছপ এক দুষ্ট চাল চালল। হেরে এসে সে আরেকবার দৌড়ের প্রস্তাব দিলে খরগোশ আবারো একই ভুল করল। এবারে পথ বেছে নেবার দায়িত্ব নিয়েছিল কচ্ছপ। যে পথে এগুলো তার মাঝে রয়েছে এক নদী। সেটি পেরিয়েও এর পরেও যেতে হবে আরো বহু দূর। খরগোশ বেচারা যখন আগে আগে এসে ভাবছে কী করবে, কচ্ছপ এসে দিব্বি সাঁতার কেটে পেরিয়ে গেল। হেরে গিয়ে খরগোশ ভাবল, নিজের ক্ষমতার সীমাবদ্ধতাটা তার জানা উচিত ছিল । এতোবার দৌড়ঝাঁপ করতে করতে ওদের মধ্যে একটা বন্ধুত্বও হয়ে গিয়েছিল। তাই খরগোশ এসে বলল, নিজেদের মধ্যেতো অনেক প্রতিযোগিতা হলো। এবারে চলো, আমাদের প্রতিযোগিতা হবে ঐ পথের সঙ্গেই। নিজেদের মধ্যে কেবল সহযোগিতা। এবারেও তারা ঐ নদী পথটাই বেছে নিল । কিন্তু এবারে নদী অব্দি পথে খরগোশ কচ্ছপকে পিঠে তুলে নিল। নদীতে আসতেই কচ্ছপ নেমে গিয়ে খরগোশকে পিঠে নিয়ে নদী সাঁতরে পেরিয়ে গেল। বাকিটা পথ আবারো খরগোশের পিঠে চেপে আগের দিনের জায়গাতে গিয়ে যখন ওরা পৌঁছলো বেলা ডুবতে তখনো অনেক অনেক অনেক বাকি।
পুরো গল্পটির এক ফ্লাস প্রস্তুতি আমার নিজের ব্লগে রয়েছে। আমি নিজেও প্রায় সমস্ত কাজে এই গল্পের আধুনিক শিক্ষা কাজে লাগাই। 'শব্দ'ও তাই করে । করতে বলছে, সব্বাইকে। নইলে যে তার পথ চলা হবেই না। যেখানে ছিল দাঁড়িয়ে থাকবে। দাঁড়িয়ে থাকবে গোটা পূর্বোত্তর! তাই কি ! তা হলে চলুন, সেই খরগোশ আর কচ্ছপের মতো আমরা সবাই সেই দৌড়ের অর্বাচীন সংস্করণে নাম লেখাই। আজই গিয়ে 'শব্দে'র সাইটটি খুলুন আর মাউসে ক্লিক করে লিখতে বসে পড়ুন পূর্বোত্তরের সমস্ত ভাষা সাহিত্যের এক নতুন ইতিবৃত্ত।
০০০০০০০০০০০০~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~~০০০০০০০০০০০০০০০
ঋণ স্বীকারঃ এ প্রবন্ধ লিখতে সম্প্রতি প্রকাশিত বিক্রম বরুয়ার দুটি লেখা থেকেও সাহায্য নিয়েছিঃ Making of XOBDO , p 105, FRIENDS, একটি 'ফাস' প্রকাশনা এবং The Virtual 'Bebel Tower of North East' , p69 , স্মরণিকা –NEIIM 2010
http://coffeehouseradda.in/sushanta/1715/
বাঙালী ও বাংলাভাষার ভোটবর্মী আত্মীয়তা সন্ধানে
সুশান্ত কর
বাংলা তো শুধু এপার আর ওপার নয়। ভারতবর্ষের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে আছে বাংলা ভাষা, শহর কলকাতা থেকে যাকে অনেক সময়ই সুদূর উপগ্রহ মনে হয়। সেই বিস্তীর্ণ ভূখন্ডের ইতিহাস-ভূগোল-কথা-উপকথা-বৃত্তান্ত নিয়েই শুরু হল আমাদের নতুন বিভাগ অপর বাংলা।
( গারোদের জাতীয় উৎসব "ওয়ান গালা ২০১০' উপলক্ষে বাংলাদেশের একটি স্মরণিকার জন্যে লেখা)
এক সময় ভাষার ভিত্তিতে মনে করা হতো বাঙালি মাত্রেই আর্য নৃগোষ্ঠীরই একটি প্রধান শাখা। এর পেছনে নিজেদের বিলেতিদের সঙ্গে একপাত্রে ঠাঁই নেবার মোহটাই ছিল প্রবল। বাঙালিরা যে আর্য এমন ধারণা উনিশ শতকের হিন্দু ভারতীয়/ বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তকদের মধ্যে প্রবল ছিল। তাঁদের চিন্তার সমর্থনের বেশির ভাগটাই তাঁরা গুটিয়েছিলেন জার্মান পন্ডিত ম্যাক্সমুলারের রচনাবলীর থেকে। ঋষি অরবিন্দতো তামিল আর সংস্কৃতের মতো দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ভাষাগোষ্ঠীকেও একই উৎস জাত বলে "আবিষ্কার' করবার ধারে কাছে গিয়ে পৌঁছেছিলেন। ম্যাক্সমুলার কখনো ভারতে আসেন নি, কিন্তু তিনিই সেকালের এক প্রধান ভারততত্ববিদ বলে স্বীকৃতি পেয়ে বসে আছেন। এদেশে ও দেশে তাঁর বহু ভক্ত তখনো ছিলেন, এখনো রয়েছেন। তিনি লন্ডনের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সংগ্রহশালাতে পাওয়া ভারতীয় নথিপত্রের উপরেই নির্ভর করেছিলেন। অনেকে এও বলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অর্থ সাহায্যেই তিনি তাঁর কাজগুলো করেছিলেন। উদ্দেশ্য কী ছিল তা নিয়ে নানা মুনির নানা মত আছে, অনেক পশ্চিমী লোক তাঁর বিরুদ্ধে খ্রিস্টধর্মের স্বার্থবিরোধী কাজ করবার দায়েও অভিযোগ এনেছিলেন। তাতে আপাত দৃষ্টিতে মনে হয় না যে বিলেতি শাসকদের প্রত্যক্ষ কোনো সুবিধে হবার ছিল। কিন্তু, বিলেতিরাও আর্য, ভারতীয়রাও আর্য এমন এক তত্ত্বে যদি খুব হাওয়া পানি দেয়া যায় তবে বিলেতি শাসনকে ঝাড়েমূলে উপড়ে ফেলবার দরকারটা উবে যায় না কী? তাই দেখব পরবর্তী কালে যারা হিন্দুত্বের ধ্বজা তুলে ভারতীয় রাজনীতিতে নেমেছিল তাদের কাছে প্রধান শত্রুপক্ষ হয়ে পড়েছিল বিলেতিরা নয়, এ দেশেরই মুসলমানেরা। ধরে নেয়া হয়েছিল এদেশে ইসলাম একটি নব্যআগন্তুক ধর্ম এবং এই ধর্মের প্রায় সবাই অনার্য সিমেটিক সভ্যতার উত্তরসূরী। এমনটি ধরে নিতে গিয়ে এও ভুলে যাওয়া হয়েছিল যে আধুনিক বিশ্বে যে দেশের নামের সঙ্গে "আর্য' শব্দটি জুড়ে আছে সেই "ইরান' মূলত একটি মুসলমান প্রধান দেশ। অবশ্যি এটি সত্য যে ১৯৩৫-এর আগে সরকারি ভাবে "ইরান' নামটি চালু ছিল না, কিন্তু পণ্ডিতি বিস্মৃতির পক্ষে এটি কোনো যুক্তি হতে পারে না। বিশেষ করে যখন সেদেশের আর্য ভাষা "পার্শি' বৃটিশ ভারতেও দীর্ঘদিন রাজভাষা হিসেবে বহাল ছিল ।
যে উনিশ শতক শুরু হয়েছিল হিন্দুধর্মেরই ভেতরে নানা সংস্কার আন্দোলনের মধ্যি দিয়ে সেই শতকের শেষে এসে দেখলাম সেই সংস্কার আন্দোলনগুলোর লক্ষ্য মুখ ঘুরে গেল অন্য ধর্মাবলম্বীদের বিরুদ্ধে আর একই সঙ্গে ভারতীয়তা আর হিন্দুত্বকে সমার্থক করে শুরু হলো তার গৌরবোদ্ধত আস্ফালন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর বেশ কিছু লেখাতেই সে প্রসঙ্গ ছুঁয়ে গেছেন। তেমনি এক কবিতাতে মজা করে লিখেছেন: মোক্ষমুলর বলেছে "আর্য',/ সেই শুনে সব ছেড়েছি কার্য,/ মোরা বড়ো বলে করেছি ধার্য,...'(বঙ্গবীর) বিপরীতে মূলত: উত্তরভারতের অবক্ষয়ী সামন্তীয় সমাজ থেকে গড়ে উঠা মুসলমান মধ্যবিত্তদের মধ্যে দেখা গেল প্রাচীন আরবি আর ইসলামি ঐতিহ্যের সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করে গৌরবোদ্ধারের প্রয়াস। বাংলাদেশেও যে সামান্য মুসলমান মধ্যবিত্ত সমাজ গড়ে উঠছিলেন তাদেরও একাংশ সেই আবেগে গা ভাসিয়ে "আর্য দম্ভে'র জবাব দিতে শুরু করলেন। আসরাফ আতরাফের দ্বন্দ্বে বাংলার মুসলমান সমাজকে ক্ষত বিক্ষত করতে শুরু করলেন। আরবি জাতীয়তাবাদের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করতে গিয়ে আসরাফেরা "আরবি' ভাষাটিকেতো নিজেদের বলে দাবি করতে পারলেন না। কিন্তু বাংলাকে যথা সম্ভব "আরবি' করে তুলবার চেষ্টা চালালেন। আর ইতিমধ্যে যে উত্তর ভারতীয় ভাষাটি এক স্বাভাবিক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়াতে "আরবি-ফার্সি' প্রভাববহুল ভাষাতে পরিণত হয়েছিল কিম্বা সেভাবে গড়ে উঠেছিল সেই উর্দুকে নিজেদের মাতৃভাষা বলে চালাবার চেষ্টা করে গেলেন।
সেই উর্দুটাও যে ভারতীয় আর্য শাখারই এক অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষা সে যেন দুটো পক্ষই ভুলে থাকতে ভালোবাসলেন। একমাত্র ৫২র ভাষা আন্দোলন আর ৭১এর স্বাধীন বাংলাদেশ গঠনের মধ্যে দিয়েও এই বিভ্রান্তির ইতিহাসের থেকে বাঙালি মুসলমান বেরিয়ে এলেন। কিন্তু "মোক্ষমুলরের' পাঠশালা থেকে বহু হিন্দু বাঙালি এখনো যে বেরিয়ে এসছেন তা মনেতো হয়ই না, বরং বহু মুসলমানও আজকাল সেই পাঠশালার আশেপাশে ঘুরাঘুরি করেন এমনটি চোখে পড়ে। ম্যাক্সমুলারের পাঠশালা বলে আমরা সেই জার্মান জাতীয়তাবাদের ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরাতে চাইছি যা পরে জার্মানিতে নাৎসিবাদের রূপে চরম আকার ধারণ করেছিল। সেরকম ম্যাক্সমুলার শিষ্যরাই ভারতে যেমন কামতাপুরি ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টাতে ক্ষান্তি দেন না, তাদেরই সগোত্রীয়রা বাংলাদেশে চাকমা, হাজংদের বাংলা বলে চালিয়ে দিতে পারলেই হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন যেন। এর জন্যে তারা যে সহজ বুদ্ধিটি কাজে লাগান, তা এই যে--- কোথায় কোন ধ্বনিতে, শব্দরূপে, বাক্যতত্ত্বে বাংলার সঙ্গে এদের মিল রয়েছে তাই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিতে তাঁরা সতত উদ্গ্রীব। এই সহজ বুদ্ধিতে এককালে অসমিয়ার মতো পূর্বভারতের উন্নত ভাষাকে বাংলা বলে চালিয়ে দেবার ফাঁদে রবীন্দ্রনাথও পড়েছিলেন। এবং এখন প্রায় সমস্ত অসমিয়া পণ্ডিত সিলেটির মতো বাংলার এক সমৃদ্ধ উপভাষাকেও অসমিয়া বলে চালিয়ে দেবার ভাষারাজনীতি করে থাকেন।
মজা হলো, রবীন্দ্রনাথ যখন অসমিয়াকে বাংলা বলে ভুল করছিলেন তখন অসম বৃহৎ বাংলারই এক প্রান্তীয় অঞ্চল ছিল। আজ যখন অসমিয়া পণ্ডিতেরা ওই একই পথ ধরে সিলেটিকে অসমিয়া বলে প্রচার করে থাকেন তখন সিলেটিদের বাস্তবতা হলো তাদের এক বড় ভাগ অসমের প্রান্তীয় তিনজেলা কাছাড়-করিমগঞ্জ-হাইলাকান্দির সংখ্যালঘু বাসিন্দা। কামতাপুরিরা অসম, পশ্চিমবাংলা দুই প্রদেশেরই সংখ্যালঘু বাসিন্দা। তাই তাদের ধরে দু'পক্ষই দড়ি টানা টানির খেলা খেলে থাকেন। বাংলাদেশেও রয়েছেন তারা, কিন্তু সংখ্যাতে এতো অল্প যে ওদের কথা কেউ ভুলেও মুখে আনেন না। সেখানে চাকমা হাজংদের কবে বাঙালি বলে মানানো যাবে তার জন্যে কিছু বাংলাভাষাপ্রেমীদের রাতের ঘুম হয় না ভালো করে। সম্ভবত ২১ ফেব্রুয়ারীর সকালে শহীদ বেদির তলায় গিয়েও তারা তাদের প্রার্থনা জানাতে ভুল করেন না। যে দেশের উদ্যোগে ২১এর দিনটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি পায় সে দেশে এখনো বাংলার বাইরে কোনো ভাষার রাষ্ট্রীয় কোনো স্বীকৃতি নেই এর চে' লজ্জার কথা আর কী-ই বা হতে পারে! অথচ এক দুটি নয় সে দেশে প্রায় পয়তাল্লিশটি ছোট বড় অবাঙালি নৃগোষ্ঠীর মধ্যে প্রচলিত পঁচিশটিরও বেশি ভাষা রয়েছে।
বাংলা আর্য ভাষা বটে--- কিন্তু বাঙালি আর্য নয়, বহু নৃগোষ্ঠীর মিশ্রণ সম্ভূত জাতি-- এই সত্য নীহার রায়, সুনীতি চট্টোপাধ্যায়দের কল্যাণে আমরা অনেক আগেই জেনেছি। এই দুজনের মধ্যেই "হিন্দুত্ব' নিয়ে এক গৌরব বোধ ছিল বটে, কিন্তু তারাই এই সত্যগুলোকে প্রথম প্রকাশ্যে নিয়ে আসেন। "সংস্কৃত বাংলার জননী ভাষা' এমন মিথকেও প্রথম জোর ধাক্কা দিয়ে ভাঙেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায়। অতুল সুর বলে এক সুপরিচিত নৃতাত্ত্বিক গবেষক রয়েছেন---যার হিন্দুত্ব ভাবটাও বেশ সরেস---তিনি অতটা অনার্য হওয়াটাকে মেনে না নিতে পেরে এক "আলপাইন আর্য তত্ত্বে'র বেশ প্রচার করেছিলেন, সুনীতি চট্টোপাধ্যায় সেই তত্ত্বকেও তাঁর আগেই নাকচ করা সত্বেও। সেই আলপাইনরা বুঝি বৈদিক আর্যদের অনেক আগে এসেই বাংলার সভ্যতাকে নির্মাণ করেছিলেন। দেখা যাবে, এই সব গবেষক-বুদ্ধির লোকেরা বৈজ্ঞানিক নৈরাসক্তিকে দূরে ঠেলে, পায়ে দলে যে মতটিকে দাঁড় করালে নিজেদের আভিজাত্যের, বলা ভালো ভাষিক ও ধর্মীয় আধিপত্যকে প্রতিষ্ঠা দেয়া যাবে সেই মতের পক্ষে অবরোহী পদ্ধতিতে নানা তথ্যের সমাবেশ ঘটাতেই বেশ সহজ বোধ করেন। তাই না দেখে, বর্তমান লেখকও নিজের গায়ের কালো রঙ, শরীরের নাতিদীর্ঘ উচ্চতা দেখিয়ে বাংলা ভাষার ছাত্রদের এই বলতে বেশ ভালোবাসেন যে তার পূর্বপুরুষ ছিল মহিষাসুরের রাজ্যের কোনো সাঁওতাল আদিবাসি গাঁয়ের "গাওঁবুড়া'।
চাটগাঁয়ের বন্দরের পথ ধরে আরব-ইরানি ব্যবসায়ী আর সুফি সন্তেরা মোটামুটি খৃষ্টীয় আটের নয়ের শতক থেকে বাংলাতে প্রবেশ করতে শুরু করেছেন --এই সত্য আমরা জানি। আর্যরা বড় জোর তার এক সহস্রাব্দ আগে থেকে মৌর্য যুগের শেষের দিকে বাংলাদেশে ঢুকতে শুরু করেছিলেন। পুব বাংলাতে তারা রাজা শশাংক, কুমার ভাস্কর বর্মাদের আগে জাঁকিয়ে বসতেই পারেন নি। এই সব ঐতিহাসিক তথ্য আজকাল একটুআধটু অনুসন্ধান যারা করেন তাদের প্রায় সবার জানা। আমরা শুধু কথাটা মনে করিয়ে দিলাম, এই সত্যের দিকে চোখ ফেরাতে যে বাংলার প্রাচীন জমানা নিয়ে যদি গৌরব করবার কারো কিছু থাকে, প্রাচীনতার দাবিতে যদি বাংলার মাটির উপর কোনো অধিকার দাবি করবার কারো কিছু থাকে তবে সে বাংলার অনার্য মানুষের। অন্তত যারা সেই অনার্যত্বকে অক্ষত রাখতে পেরেছেন সেইসব--- চাকমা, ত্রিপুরী, মগ, গারো, হাজং, খাসিয়া, রাজবংশি, সাঁওতাল, মুণ্ডা, বডো, রাভা মানুষদের বাদ দিয়ে বাংলার মাটির কোনো কথা শুরুই হতে পারে না। সেই অর্থে তারাই বাংলার "আদিবাসী' বটে। কিন্তু বাঙালিরা নয় কি?
বাঙালিরা কি আদিবাসী নয়? আর্যত্বের দাবি দাঁড় করালেই কি বাঙালির আদিবাসিত্ব প্রতিষ্ঠা পায়? অথবা বাঙালি যেহেতু "আর্য' তাই কি তারা শশাংক-ভাস্কর বর্মাদের কালে নিয়ে আসা উত্তর ভারতীয় বামুন কিম্বা চাঁটগাঁয়ের বন্দর দিয়ে প্রবেশ করে পার্শি বণিকদের সঙ্গে করে আসা আগন্তুক প্রবাসী? রাষ্ট্রসঙ্ঘের ব্যবহৃত শব্দ 'indigenous' এর আক্ষরিক অর্থে ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহার করাটা বড় গোলমেলে। আফ্রিকা, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ার মত দেশে গেল দুই তিন শতকে ইউরোপ থেকে গিয়ে সাদা চামড়ার সাহেবেরা ওখানকার মুল অধিবাসিদের মেরে কেটে হয় সাফ করে দিয়েছে, নতুবা তাদের প্রান্তিক অবস্থানে ঠেলে দিয়ে নিজেরাই রাজা হয়ে বসেছে। কিন্তু ভারতীয় উপমহাদেশেতো তারা সেটি করতে পারে নি। প্রাচীন আর্য , পার্শি কিম্বা আরবি কেউ সেটি পারেনি। "শক হূন দল পাঠান মোঘল' এখানে এক দেহে সবাই "লীন' হয়ে গেছে। এই সত্যটি কেন যে আমরা সবাই ভুলে থাকি। কী মুশকিল! যে সাদা চামড়ার লোকেরা নৃগোষ্ঠীগত সাফাই অভিযানের জন্যে জগৎ বিখ্যাত আমরা তাদের থেকেই নিরাপদে "শব্দ', "বাক্য', "পরিভাষা' এবং "তত্ত্ব' সবই ধার করতে ভালোবাসি।
বাংলাভাষাতে "উপজাতি' বলে একটি অপমান জনক শব্দ চালু আছে। তার মানে, যারা এখনো পুরো জাতি হয়ে ঊঠেনি, অন্য জাতির শাখা হয়ে রয়েছে। উপভাষার মতো আরকি। "উপজাতি'দের ভাষাকে অনেকেই তাই "উপভাষা' বলে চালিয়ে দেবার ফাজলামোও করে থাকেন। এমনকি বাঙলা দেশে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি ভাষাকেও কেউ কেউ বাংলা বলে চালিয়ে দেন একথা জানতে পেলে শহিদ সুদেষ্ণা সিনহার জন্মভিটে অসমের করিমগঞ্জে জেলার বহু বাঙালিও আঁতকে উঠবেন। পশ্চিমবাংলা-ত্রিপুরাতেও "উপজাতি' শব্দটি চালু রয়েছে। রয়েছে "জাতি-উপজাতি'র সংঘাত এবং "ভাই ভাই ঠাই ঠাই' করবার বিপরীত রাজনীতিও। অসমেও শব্দটি ছিল। কিন্তু এখানেই সম্ভবত শক্তিশালী জনজাতীয় রাজনীতির দৌলতে এক সম্মানজনক সমাধান বের করে এনে ব্যবহৃত হচ্ছে "জনজাতি'। 'Indigenous' শব্দটি অসমেরর রাজনীতিতেও এক জনপ্রিয় শব্দ। কিন্তু তার অসমিয়া প্রতিশব্দ একটি আরবি মূলীয় শব্দ "খিলঞ্জিয়া' । "খিলঞ্জিয়া' বললে কেবল Tribal-দেরকে বোঝায় না। অসমিয়া "ভট্টাচার্য-চক্রবর্তী' বামুনরাও নিজেদের খিলঞ্জিয়া বলে দাবি করতে সদা ব্যস্ত। আটশ বছর আগে অসমে আসা "আহোমে'রাও খিলঞ্জিয়া, কিন্তু হাজার কয় বছরের প্রাচীন করিমগঞ্জের সিলেটিরা নয়। ধরেই নেয়া হয় যে, অসমের বাঙালিরা এই সেদিন বৃটিশ আমলের নব্য আগন্তুক বিদেশি। বহু বাঙালি সেটি বিশ্বাসও করে। যখন "খিলঞ্জিয়া'দের জন্যে সাংবিধানিক অধিকারাদি দাবি করা হয়, তখন সে দাবির থেকে অন্য "আগন্তুক' ভারতীয়রা বাদ পড়েন। ময়মনসিংহ মুলের মুসলমান বাঙালিদের অসম সাহিত্য সভার মতো প্রভাবশালী সংগঠন "ন'অসমিয়া' বলে স্বীকৃতি দিলেও তারা "খিলঞ্জিয়া'তো ননই, আমজনতা তাদের "বাংলাদেশি' বলেই ভেবে থাকে এবং সেরকম ব্যবহারও করে থাকে তাদের প্রতি।
ভয় হয়, বাংলাদেশে যদি বাঙালিরা "আদিবাসী' না হন তবে তাদেরকেও একদিন "নব্যআগন্তুক' বলে ভেবে নেয়া হবে নাতো? প্রশ্নটি "আদিবাসী'দের পরিচিতি আন্দোলনের কৌশলগত অবস্থান থেকেও ওঠা উচিত। বহু বাঙালি মনে এই প্রশ্নটি কাজ করবে। শাসক শ্রেণির জাত্যাভিমানী অবস্থানের বাইরেও বহু সাধারণ বাঙালি নিজেদের বিপন্নতাবোধ থেকেও এর বিরোধিতা করছেন আর করবেন। তাই দেখা যাবে যেসব দল সংগঠনগুলো সেদেশে "নীতিগত'ভাবে "আদিবাসী' পরিচিতির দাবিকে মেনে নেন, তারাও কৌশলগত অবস্থানে অন্যত্র গিয়ে "উপজাতি' শব্দটিই দেদার ব্যবহার করে থাকেন।
অবিভক্ত বাংলাদেশে বাংলা ভাষাটি মূলত আগন্তুক ভারতীয় আর্য ভাষার সন্তান, এর গড়ে ওঠার বয়স হাজার বছরের বেশি নয়। ব্রাহ্মণ্য হিন্দু ধর্মও এখানে নব্য আগন্তুক ধর্ম, ইসলামতো বটেই। কিন্তু, তাই বলে বাঙালি আগন্তুক নয়। এখানে যে প্রাগআর্য "কিরাত-নিষাদ' নৃগোষ্ঠীগুলো ছিল তারাইতো কালক্রমে ব্রাহ্মণ্য প্রভাবে সামন্তীয় স্থায়ী কৃষি অর্থনীতিতে প্রবেশ করল আর আর্য ভাষা, ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বরণ করে নিল। সেই ষোড়শ শতকে বডোমূলীয় রাজা কুমার ভাস্কর বর্মার কামরূপের আমল থেকেই সেই প্রক্রিয়া চলছে। পুব বাংলার এক বড় ভাগ সেই কামরূপের অঙ্গ ছিল সে কথা যেন আমরা ভুলে না যাই। আর শুধু ব্রাহ্মণ্য প্রভাবেই বলি কেন? শাহজালাল থেকে শুরু করে যে সুফী সন্তরা এদেশে এসছিলেন তাদের ধর্ম প্রচারের ভাষা কী ছিল স্মরণ করুন। আরাকানে, কাছাড়ে, ত্রিপুরাতে, কামতাপুরের রাজসভাতে কেন বাংলা সাহিত্য চর্চা হচ্ছে ভাবতে বসুন। গেল হাজার বছরে এদেশে ধর্মান্তরণের কথাগুলো ইতিহাসের বইতে খুব বড় বড় করে লেখা হয়েছে তাতে ধর্মীয় জাতিয়তাবাদী রাজনীতির বেশ সুবিধেও হয়েছে। ভাষান্তরের কথাটাওতো লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলো বাংলা ভাষার ইতিহাসের ভূমিকা হিসেবে থেকে গেল। এ নিয়ে কেউ কেউ হৈ চৈ করবার তেমন দরকার বোধ করলেন না। যেটুকু হয়েছে, তা ঐ বাঙালির একাংশকে উর্দুতে ভাষান্তরিত করবার প্রয়াস নিয়ে। তার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল হিন্দু-মুসলমান ধর্মীয় পরিচিতির বিরোধও। এই ভাষা বিরোধ নিয়ে বাঙালি এতো ব্যস্ত রইল যে তার নিজেরই আদিম ভাষাগুলো, পরে যেগুলো তার প্রতিবেশি ভাষা হয়ে গেল সেদিকে তাকাবার দরকারও সে বোধ করল না আর করলেও ফুরসত যেন সে কোনোদিনই পেল না। এটি আমরা প্রায় নিশ্চিত হয়েই বলতে পারি। কেননা রামেশ্বর শ' গেল শতকের আশির দশকের মাঝামাঝি ( বাংলা ১৩৯০) তাঁর "সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা' বইতে ভারত বাংলাদেশে বাঙালির ভাষাতত্ব চর্চার এক খতিয়ান তুলে ধরেছিলেন। সেখানে দেখা যাবে দু'একজন সাঁওতালি বা নেপালি ভাষা নিয়ে এক আধটু অধ্যয়ন করলেও বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিকদের প্রায় কেউই প্রতিবেশি অন্য ভাষা নিয়ে বিশেষ চর্চা করেন নি। সেই সুনীতি চট্টোপাধ্যায় যা তাঁর ODBL লিখবার দরকারে এবং পরেও "কিরাত জনকৃতি'র মতো গ্রন্থে কিছু কিছু কাজ করেছিলেন। নীহার রঞ্জন রায়, মুহাম্মদ সহীদুল্লাহদের ধারণা ছিল দ্রাবিড় বিশেষ করে অস্ট্রিক সাঁওতাল মুণ্ডারিদের প্রভাব যদিও বাংলাতে ব্যাপক, ভোট বর্মীদের প্রভাব প্রায় নগণ্য বললেই চলে।
অতি অল্প বাঙালিই তারপরে প্রশ্ন করেছেন,"তা কী করে হবে?' সুনীতি চট্টোপাধ্যায় "কামরূপী'কে বাংলার একটি উপভাষা বলে চিহ্নিত করে যাবার পর ভারতে অন্তত প্রায় সমস্ত বাঙালি ভাষাতাত্ত্বিক তাঁর এই উপভাষা বিভাজনকে নিয়ে প্রশ্ন তুলেন নি। এই "কামরূপী'রাই এখন "কামতাপুরি'নামে বাংলার থেকে ( এবং অসমিয়ার থেকেও) আলাদা হয়ে যেতে চাইছেন। তারা যে নৃগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব করেন সেই কোচ-রাজবংশীরা যে স্পষ্টতই বড়োদের থেকে বেরিয়ে যাওয়া ভোট-বর্মী নৃগোষ্ঠীর লোক সেই সত্য কিন্তু কেউ অস্বীকার করেন না। তারা কি আর্যায়নের প্রক্রিয়াতে চলে এলেন তাদের নিজেদের কোনো নৃতাত্বিক প্রভাব ছাড়াই? এই সত্য কে কবে প্রমাণ করলেন? যে মণিপুরিরা বিষ্ণুপ্রিয়া নাম নিয়ে আর্যভাষা বরণ করে নিলেন তাদের ভাষাতে কি মণিপুরি প্রভাব বলতে কিছুই নেই? তর্কের খাতিরে না হয় মেনে নেয়াই গেল তারাতো আর বাঙালি নন, কিন্তু একটি ভোটবর্মী জনগোষ্ঠি কেমন আর্য ভাষার অধিকারী হয়ে পড়তে পারেন বিষ্ণুপ্রিয়ারা কিন্তু এই সময়ে তার প্রত্যক্ষ নিদর্শন। তাদের নিয়ে বাঙালিরা ভারতে টানাটানি না করলেও অসমিয়ারা করে থাকেন। হাজং, চাকমারাও শুধু প্রমাণ করেন যে কী রকম এক একটি জনগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব গতিতে আর্যায়নের প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হবার আগেই বাঙালিকরণের চাপের মুখে অবরুদ্ধ পথে দাঁড়িয়ে গেছে। চাকমা-হাজংদের বাঙালি বলব আর তাদের ভাষার মধ্যে ভোটবর্মী প্রভাব নিয়ে মাথা ঘামাবো না, বরং তারা কতটা বিশুদ্ধ আর্য-বাংলার অধিকারী তাই প্রমাণ করতে মাথার ঘাম পায়ে ফেলব এমন দ্বিচারিতা কি না করলেই নয়?
এই চাকমা-হাজং-কামতাপুরি-বিষ্ণুপ্রিয়া ভাষার লোকেরা হচ্ছেন পুথির বাইরে আমাদের চোখের সামনে থাকা সেই সব জনগোষ্ঠী যারা প্রমাণ করেন যে নৃগোষ্ঠীগুলোর ধর্মান্তরণ শুধু নয়, ভাষান্তরণও একটি অবশ্য সম্ভব ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া। তারা যদি, তাদের প্রাচীন অনার্য ভাষাগুলো ছেড়ে আর্য ভাষাকে বরণ করেছেন তবে সেটি হয়েছে এক স্বাভাবিক ঐতিহাসিক সামাজিক প্রক্রিয়াতে। ইতিহাসের নানা সময়ে এ রকম বিচিত্র প্রক্রিয়াতে, বিশেষ করে স্থায়ী কৃষি ব্যবস্থাতে এবং সেই সঙ্গে আর্যায়নের প্রক্রিয়াতে প্রবেশ করে যে অনার্য নৃগোষ্ঠিগুলো সে প্রক্রিয়াকে সম্পূর্ণ করেছেন বাংলাদেশে তারাই গেল এক হাজার বছরের নবাবী আমলে নিজেদের "বাঙালি' বলে পরিচয় গড়ে তুলেছেন। সেই অনার্যদের মধ্যে অস্ট্রিকরা অবশ্যই আছেন। কিন্তু, পূব বাংলাতে আর্যদের আসার আগেই যে ভোটবর্মীরা ছেয়ে গেছিলেন সে কথা সুনীতি চট্টোপাধ্যায় লিখে গেছেন। তারা সব গেলেন কোথায়? তারাই বাঙালি হলেন, গড়ে তুললেন বাংলাদেশ।
বাংলা চর্চা করবার জন্যে তাদের কেউ বাধ্য করেনি। মণিপুরে শতিনেক বছর আগে প্রাচীন মণিপুরি লিপিতে লেখা সমস্ত বইপত্র পুড়িয়ে ফেলে বাংলা লিপি চালু করা হয়েছিল। কিন্তু সেটি বাঙালিরা গিয়ে করেন নি। মণিপুর রাজ পামহেইবা বৈষ্ণব গুরু শান্তিদাসকে ডেকে নিয়ে গেছেন। নিজে বৈষ্ণব ধর্ম বরণ করেছেন এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রচারের স্বার্থে তিনিই প্রাচীন মণিপুরি লিপি বর্জন করিয়েছিলেন।
এখন সে রাজতন্ত্র গেছে বটে, কিন্তু জনতন্ত্র কায়েম হয়নি। "গণতন্ত্রে'র নামে কায়েম হয়েছে সংখাগুরুতন্ত্রের ভন্ডামি। ধর্ম-আর ভাষার নামে চলে সেই সংখ্যাগুরুতন্ত্র। ভোটের জন্যে "সংখ্যালঘু তোষণে'র অভিযোগ যতই উঠে থাকুক না কেন, সংখ্যাগুরুকে তরল আবেগে খুশ করে রাখাটাই এই সংখ্যাগুরুতান্ত্রিক রাজনীতির প্রধান ধারা। বাংলাভাষা নিজেই সেই সংখ্যাগুরুতন্ত্রের স্বীকার ছিল বাংলাদেশে, এখনো আছে ভারতের অসমে। দু'দেশেই ভাষার জন্যে বাঙালি প্রাণ দিয়েছে। এখন সেই বাঙালি নিজেই যেখানে স্বাধীনতা আর স্বাতন্ত্র্য অর্জন করতে পেরেছে সেখানে চালাচ্ছে সেই বাংলাভাষার "গণতন্ত্র'। সেটি হোক বাংলাদেশে, কিম্বা ত্রিপুরাতে কিম্বা পশ্চিম বাংলাতে। ধর্ম আর ভাষার নামে জাতীয়তার আবেগকে প্রবল না করলে পুঁজিবাদ নিজের লুন্ঠনকে আড়াল করবার পথ খুঁজে পায় না। এই জাতীয়তার বাইরের লোকেরাতো শাসক শ্রেণির ঘোষিত শত্রু বটে, জাতীয়তার ভেতরে থেকে যারা বর্তমান লেখকের মতো সেই গণতন্ত্রের মুখোস উন্মোচন করেন তারা চিহ্নিত হয়ে পড়েন "জাতির শত্রু -জাতি বহির্ভূত শত্রুপক্ষের দালাল' বলে। এভাবে জাতীয়তাবাদ তার বাইরে ভেতরে সাঁড়াশির আক্রমণ হানে নিজের দেশেরই দুর্বল জাত-বর্ণ-শ্রেণী-লিঙ্গগুলোর এবং যারা আরো ব্যাপকতর গণতন্ত্রের আওয়াজ তুলেন তাদের বিরুদ্ধে। নিরাপদে থাকে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদ।
আমরা এটা দেখাবার চেষ্টা করলাম বটে যে বাঙালিরাও বাংলাদেশে, পশ্চিম বাংলাতে, ত্রিপুরাতে, কাছাড়ে, করিমগঞ্জে "আদিবাসি', "খিলঞ্জিয়া', 'Indigenous'; ]কিন্তু 'Tribal' অথবা অসমের অর্থে "জনজাতি' নয়। কানাডা, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, লাতিন আমেরিকার মতো বাঙালিরা আগন্তুক বিদেশি দখলদারও নয়। কিন্তু, বাঙালি জাতীয়তাবাদটি এক বিলেতি আমদানি। সেই জাতীয়তাবাদের ভূমিকা বিলেতি 'Nationalism' থেকে তথা 'Nation State' গড়বার প্রয়াস থেকে ভিন্ন নয়। যে ন্যাশনেলিজম তার আভ্যন্তরীণ জাতি-বর্ণ-ধর্মগত বৈচিত্রকে ভয় করে , এবং প্রায়শ:ই নানা ছুতোয় তাকে ধ্বংস করবার চেষ্টা করে। একেই তারা নাম দেয় "জাতীয় সংহতি' । সেই "সংহতি' নিজেকে প্রকাশ করে সাম্প্রদায়িকতার চেহারাতে। রাবীন্দ্রিক ভাষাতে "অজগর সাপের ঐক্যনীতি'। পাকিস্তানের শাসকেরা যার জন্যে খোদ বাঙালিদের মধ্যেই কুখ্যাত। যে সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার বাংলাদেশের চাকমা, গারো, ত্রিপুরা, মগ, হাজং, মণিপুরি ইত্যাদি ভাষিক সংখ্যালঘু মানুষেরা। ঘটনাচক্রে তাদের ধর্মও সংখ্যাগুরুর ধর্ম থেকে ভিন্ন। ধর্মটি এক হলেও যে তারা সেরকম সাম্প্রদায়িকতার স্বীকার হতেন তার প্রমাণ সেদেশের বিহারি মুসলমান সম্প্রদায়। ভারতবর্ষের বাংলা কাগজগুলো মূলত সেদেশে হিন্দু বাঙালির বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা নিয়ে সরব। কেননা, তারাও এক ভাষিক জাতীয়তাবাদের ধ্বজা তুলে রেখেছে যার রঙটি শুধু হিন্দু। বাংলাদেশের ভাষিক সংখ্যালঘুদের প্রতি তাদের দরদ কেমন তা বুঝতে হলে এদেশে শরণার্থী হয়ে আসা বাংলাদেশের "চাকমা'দের দিকে তাকালেই স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে যাবে। সারাক্ষণ ভিটেচ্যুত হবার ভয় তাদের তাড়া করে বেড়ায় মিজোরামে, অরুণাচলে।
জাতীয়তাবাদ চেষ্টা করে সবাইকে বাঙালি করতে, চেষ্টা করে এটি প্রমাণ করতে যে সংখ্যালঘুদের কারা কী পরিমাণে বাঙালি হয়েই আছেন। কিন্তু যদি গণতন্ত্রকে সত্যি শক্তিশালী করতেই হয়, তবে কে বাঙালি আর কে নয় সেটি প্রমাণ কিম্বা অপ্রমাণ করবার অধিকার দিতে হবে সেই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে। যারা বাঙালি বলে নিজেদের স্বীকার করবেন না, তাদের ভাষা সংস্কৃতি যত ক্ষুদ্রই হোক তাকে সম্মান জানানো স্বীকৃতি জানানো এক সুস্থ আর স্বাস্থ্যবান ভবিষ্যতের জন্যেই এক অবশ্য প্রয়োজনীয় বিষয়। তা নইলে আজ হোক কাল হোক আন্তর্জাতিকভাবে ২১শে ফেব্রুয়ারির ইতিহাস লজ্জিত হবে এটি প্রায় নিশ্চিত। চাকমা হাজংদের ভাষা কতটা বাঙালি , সেই সত্য প্রমাণ করবার পন্ডশ্রম না করে, বাংলা কতটা ভোটবর্মী , কিম্বা অস্ট্রিক সেই গবেষণাতে বাঙালি শ্রম নিয়োগ করুক। তাতে লাভ দুটো। প্রথমত: এই সব ছোট ছোট জনগোষ্ঠির স্বমর্যাদা আর স্বাধিকার বোধ প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়াতে বাঙালি দ্রুতি এনে তাদের আপন করে নিতে পারবে। তারা বিশ্বাস করতে পারবেন যে জোর যার মুলুক শুধু তারই নয়। "প্রথম আলো' কাগজে পড়লাম ২০০৯ সালের চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত আদিবাসি মেলাতে বাংলাদেশের শিল্পমন্ত্রী দিলীপ বড়ুয়া বললেন, ঞ্ছবাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে মিশে আছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ৩৫টি আদিবাসী গোষ্ঠী। তারা বাংলাদেশের সৃজনশীল চেতনাকে সমৃদ্ধ করছে। তারা আমাদের গর্বিত নাগরিক। তাদের ঐহিত্য ও সংস্কৃতিকে লালন এবং বিকশিত করে অসাম্প্রদায়িক চেতনার বাংলাদেশ গড়তে হবে।ঞ্ছ এমন উক্তি মোটেও অসাম্প্রদায়িক নয়। এ হলো বাংলাভাষার ভেতরে সবাইকে বিলীন করে ফেলবার সাম্প্রদায়িকতা। এমন উক্তির সামনে সংখ্যালঘু ভাষা সম্প্রদায়ের মানুষ শুধু ভয়ে নীরবে থাকতে পারেন। মনে মনে তারাও তাদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতির জন্যে নতুন করে সেই "১৯৫২'র আগুন ধিকি ধিকি করে হলেও জ্বালবেন আর জ্বালচ্ছেন। এই করে সমৃদ্ধ আর ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশ গড়া যাবে না। এই করে তাদের মধ্যে শিক্ষাদীক্ষাও ছড়ানো যাবে না। কেন না এই সত্যতো বাঙালিই বড় গলাতে বলে থাকে যে "মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সমান।' চাকমা-হাজং -গারো-বিষ্ণুপ্রিয়াদের মাতৃভাষার হবেটা কী? দ্বিতীয়ত: বাংলা কতটা ভোটবর্মী, কিম্বা অস্ট্রিক সেরকম গবেষণাতে বাংলা ভাষা আর বাঙালির ইতিহাসেরও অনেক নতুন দিক উন্মোদিত হবে এটি নিশ্চিত।
আমরা সেরকম দুএকটি ভাষাতাত্ত্বিক ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের এই লেখা শেষ করব।
""আশীর্বাদম ন গৃহ্নিয়াত পূর্ব দেশ নিবাসিনাম ।
শতায়ুর' ইতি বক্তব্যে, "হতায়ুর' ইতি ভাষিনাম ।।
--এই শাস্ত্র বাক্যটির উল্লেখ করেছেন সুনীতি চট্টোপাধ্যায় তাঁর বিখ্যাত বই ODBL-এ । আমরা পূর্বদেশবাসীদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে। কেন না আমরা "শতায়ু' হবার আশীর্বাদ দিতে গিয়ে "হতায়ু' হবার শাপ দিয়ে বসি। আমরা মানে প্রায় সমস্ত পূব বাংলার বাঙালিরা আর অসমিয়ারা । এই শাস্ত্রবাক্য প্রমাণ করে আমরা বহু আগে থেকেই এই "হ' উচ্চারণ করি । যাদের থেকে আশীর্বাদ নিতে মানা করা হচ্ছে তারা হয় আর্য নন, নতুবা ইতিমধ্যে ভেজালে পরিণত হয়েছেন। তারা "হতায়ু' বলেন কেন? ---এই প্রশ্নের উত্তরই খুব কম লোক সন্ধান করেছেন । সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ও তাঁর গ্রন্থে খুব নিশ্চিত হয়ে কিছু উত্তর দেন নি। কিন্তু লিখেছেন , "... The presence of a large Tibeto-Burman element in the population of Assam and East and North Bengal may have something to do with this...." এই "হ' উৎস সন্ধানে অনেকে আলপাইন আর্যদের ভাষা অবধিও গিয়ে পৌঁছোন। অনেক আর্যভাষাতে এই "হ'কারীভবন দুর্লভও নয়। কিন্তু তার আগে "আলপাইন' তত্ত্বেতো নিশ্চিত হতে হবে। তার চে' বরং সুনীতি চট্টোপাধ্যায়ের অনুমানের পক্ষে তথ্যাদি আমাদের হাতের কাছেই রয়েছে।
এই /স-শ-ষ/এর "হ' হবার তথা মহাপ্রাণতার প্রবণতা পুব বাংলার উপভাষাগুলোতে ব্যাপক। তা এমনই যে শুধু "হে',হকালি বেলা', "হাইঞ্জা বেলা', "হক্কলডি'র মতো শব্দগুলোতেই নয় ,শব্দের শুরুতে অ/আ স্বরান্ত ব্যঞ্জন পেলেই , এমনকি শুধু "অ'কে পেলেও হয় মহাপ্রাণ হয়ে যাবে অথবা শেষের দিকে হবার প্রবণতা দেখাবে। তাই পূর্ববাংলার লোকেরা "কাপ', পাপড়, চল, চাল, জল , জাল, ?পরান,কপাল উচ্চারণ করতে পারেন না। করেন কা'প,পা'পড়, চ'ল,জ'ল, জা'ল, প'রান, ক'পাল অনেকটাই /খা,ফা,ছ,ঝ,ফ,খ/-এর কাছাকাছি কিন্তু পুরোটা নয়। অকারণ হয়ে উঠে অহকারণ, অনাচার হয়ে যায় অহনাচার। এরকম "হ' -এর টানে অ অনেক সময় "আ' হয়ে যায় যেমন আঞ্চল, আষ্ট। আবার উল্টোটাও হয় । সাধারণত সঘোষ মহাপ্রাণ অল্পপ্রাণে পরিণত হয়। "হ' থাকলেতো কথাই নেই "হলদি' হয় "অ'লদি'; ভাত হয়ে যায় বা'ত ; ভাই হয়ে যায় "বা'ই' ; "ঘাই' হয়ে যায় "গা'ই'। বডো ভাষার স্বরধ্বনিতে "অ' নেই, "আ' রয়েছে। ক,ত,চ,ট,প,ঘ,ধ,ঝ, স,ষ,শ এরকম কোনো ব্যঞ্জন ধ্বনিই নেই। কিন্তু "হ' রয়েছে। বস্তুত এই "হ' ধ্বনিটিই খুব মোটা দাগে পূর্ব আর পশ্চিম বাংলার বাংলাকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয়। সাধারণত বাংলাভাষাতে /স, ষ/এর কোনো স্বনিমীয় তাৎপর্য নেই। বাঙালি সবেতেই উচ্চারণ করে "শ'। তবু পশ্চিম বাংলার কিছু বাঙালি যে "স' উচ্চারণ করে তাঁর উৎসের খোঁজে সাঁওতালি ভাষা অব্দি গিয়ে পৌঁছুনো যেতে পারে। তারাও যে খুব বিশুদ্ধ আর্য নয় তার প্রমাণ তাদের ভাষাতে প্রথম পুরুষে "সে (হে) -তাই' এমনটি সংস্কৃতের ( কিম্বা পুববাঙালিদের) মতো লিঙ্গভেদ নেই। এমন লিঙ্গভেদ নেই বডোতেও, সাঁওতালিতেও। এখন, এই দুই ভাষাগোষ্ঠীর কারা তাদের প্রভাবিত করছে সেটিও অনুসন্ধানের বিষয় হতে পারে।
এই "হ' ধ্বনিই অসমিয়াকে বাংলার সঙ্গে আলাদা করে। অসমিয়াতেতো স্বতন্ত্র অবস্থাতে থাকা /শ,স, ষ/ তিনটিই "হ' উচ্চারিত হয় তাও স্পষ্ট উষ্ম নয়, একটু ঘৃষ্ট। তাই তারা ইংরেজিতে ধ্বনিটি প্রকাশ করেন "h' লিখে নয়, লেখেন "x'-- Mexico ("মেহিকো')-তে যেরকম । তাঁরা অসম লেখেন Asom নয় Oxom। অসমিয়াদের মধ্যে এই "হ' ধ্বনিটি নিয়ে বেশ একটা গৌরব বোধ রয়েছে। পুব বাংলার বাঙালিদের সেনিয়ে গৌরব না করবার কোনো কারণ আছে কি? আমরা আরো টেনে গেলে দেখাতাম এই একটি ধ্বনি পুব বাংলার উপভাষাগুলোর উপর কত বিচিত্র রঙ চড়িয়েছে।
কিন্তু, সে হবে খন অন্য সময়, অন্য কোনোখানে। আমরা যদি আপাতত তাই নিয়ে "বাঙালদের' গৌরব বোধ একটু বাড়াতে অনুপ্রাণিত করতে পারি, (সিলেটি হিসেবে বর্তমান লেখকের সেই গৌরব বোধ প্রবল), যদি আমাদের আত্মার আত্মীয় বলে প্রতিবেশি সংখ্যালঘু ভাষার মানুষকেওতাদের "আদিবাসি' কিম্বা "জনজাতি' যে নামেই চিহ্নিত করুন--- সেই ঐতিহ্যের প্রতি গৌরববোধের শরিক করতে পারি, সেই ঐতিহ্যের ঘনিষ্ঠ আর প্রত্যক্ষ বাহক বলে তাদের ভাষা সংস্কৃতির সমান স্বীকৃতি, মর্যাদা আর বিকাশের লড়াইতে তাদের পাশে দাঁড়াবার জন্যে আরো কিছু বন্ধু বাড়াতে পারি তাতেই আমার এ লেখার শ্রম সার্থক। তাতে বাংলা ভাষা বিপন্ন হবে না, সমৃদ্ধ হবে। তার নিজেরই আরো আরো নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে যাবেএটি নিশ্চিত।
তথ্যসূত্র:
1) The Origin and Development of Bengali Language, Suniti Kumar Chatterji;
2) বাঙালির ইতিহাস, নীহার রঞ্জন রায়;
৩) বাঙালা ও বাঙালীর বিবর্তন , অতুল সুর;
৪) ভাষার ইতিবৃত্ত, সুকুমার সেন;
৫)সাধারণ ভাষা বিজ্ঞান ও বাংলা ভাষা;
৬)ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ, পবিত্র সরকার;
৭) উত্তর বঙ্গের ভাষা, সম্পাদনা রতন বিশ্বাস;
৮) অসমিয়া আরু অসম্র ভাষা উপভাষা, উপেন রাভা হাকাচাম;
৯) অসমিয়া আরু অসমর তিব্বতি-বর্মীয় ভাষা, ঐ; এবং এরকম কিছু ওয়েবসাইট:
অ)http://w4study.com/?p=22,
আ)http://www.prothom-alo.com/detail/news/42105,
ই)http://swabhimanngo.blogspot.com/2010/08/protibadi-aandolon-o-bamponthider.html,
ঈ)http://www.facebook.com/note.php?note_id=138982706139600
প্রকাশঃ 21 February 2011 22:59:00 IST #
http://www.guruchandali.com/default/2011/02/21/1298309340000.html#.UR5aJR2BlA0
স্থানীয় খবরের উত্তেজনা দেখুন!ক্ষমতা দখলের লড়াই দেখুন।ইহার নামি পশ্চিমবঙ্গ।বড় রঙ্গ এই বঙ্গে।
Current Real News
7 years ago
No comments:
Post a Comment